দাওয়াত-তাবলীগ ও জিহাদ (এই তিনে খেলাফত)
লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ২৩ জুলাই, ২০১৭, ০২:৫০:২৩ রাত
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়্যাতি বা দাওয়াতি জীবনের দুটি পর্যায় (ভাগ) ছিল। একটি অবস্থা হলো হিজরতের আগে, অপরটি হলো হিজরতের পরের অবস্থা। প্রথমটি ছিল ব্যক্তিগত পর্যায়ের দাওয়াতি কাজ আর দ্বিতীয়টি ছিল রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দাওয়াতি কাজ। এই জন্য দাওয়াত ও তাবলিগের ক্ষেত্রে দুই ধরণের বিধান দেখতে পাই, একটি হলো ব্যক্তিগত অপরটি হলো রাষ্ট্রীয় বিধান! জিহাদ (সশ্রস্ত্র) ও কিতালের বিধান হলো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের, ব্যক্তিগত-দলগত বা গোষ্ঠীগত নয়।
সুতরাং যারা ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ের দাওয়াতি কাজ আর রাষ্ট্রীয় বিধানকে এক করে গুলিয়ে ফেলে তারা গন্ডমূর্খ ও জালিম।
ইসলামী দাওয়াতের মূল ভিত্তি হলো (তাওহীদ); অর্থাৎ, একমাত্র এক আল্লাহরই ইবাদত করতে হবে আর তাঁর ইবাদতের সাথে অন্য কাউকে শরীক বা অংশীদার করা যাবে না।... সূরা ৪২ শু’রার ১৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন-
"তিনি তোমাদের জন্য নির্ধারিত করেছেন দ্বীন; যার নির্দেশ দিয়েছিলেন নূহকে এবং যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি তোমাকে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই বলে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করো এবং ওতে মতভেদ করো না.....।"দ্বীন হল তাওহীদ (একত্ব) ও রসূলের আনুগত্যের নাম। কেবল এক আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর আনুগত্য (অথবা তাঁর রসূলের আনুগত্য যা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই আনুগত্য) করাই হল ঐক্যের ও ভ্রাতৃত্বের মূল। আর তাঁর ইবাদত ও আনুগত্য থেকে বিমুখতা অথবা এতে অন্যকে শরীক করা হল বিচ্ছিন্নতা ও অনৈক্যের শিকড়। ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাওহীদ যেমন ফরয তেমনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও তাওহীদ ফরয। যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত হবে তাদের উপর কর্তব্য হলো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করা। আর সাধারণ মুসলমানদের দায়িত্ব হলো ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাওহীদকে প্রতিষ্ঠিত করা। (আরো দেখুন: সূরা ২১ আম্বিয়া: ২৫এর তাফসীর)
ইসলামী আইন ও বিধান:
আল্লাহর বিধানের আনুগত্য করা, সেই মোতাবেক বিচার-ফায়সালা করা এবং নিজেদের জীবনের সকল কর্মকান্ডে ঐ বিধান থেকে পথনির্দেশ গ্রহণ করা প্রতিটি মুসলমানের উপর ফরয। আর যদি তারা তা না করে, তাহলে আল্লাহর দরবারে তারা যালেম (অত্যাচারী ও সীমালঙ্ঘনকারী), ফাসেক (পাপী) ও কাফের বিবেচিত হবে। আর এই ধরনের লোকেদের জন্য আল্লাহ তিন রকম শব্দ ব্যবহার করে নিজের ক্রোধ ও অসন্তুষ্টির কথা পূর্ণরূপে ব্যক্ত করে দিয়েছেন। (দ্রষ্টব্য: সূরা ৫ মায়িদা:৪৪-৪৭)
প্রত্যেক মুমিনের উপর ফরয হলো আল্লাহর বিধানের উপর অনুগত থাকা এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত হলে সেই বিধান অনুসারে মানুষের মাঝে ফায়সালা করা। আল্লাহ বলেন-
"....সুতরাং আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুসারে তুমি তাদের বিচার-নিষ্পত্তি করো এবং যে সত্য তোমার নিকট এসেছে, তা ত্যাগ করে তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করো না। তোমাদের প্রত্যেকের জন্য এক একটি শরীয়ত (আইন) ও স্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি..... (সূরা ৫ মায়িদা: ৪৮)
সুতরাং মানুষের তৈরি বিধানের আনুগত্য করা যাবে না, বর্তমানে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে যারা মানুষের তৈরি বিধান দ্বারা ফায়সালা করে তারা ফাসিক ও জালিম! (তাদের কালেমার কারণে কাফির শব্দ ব্যবহার করা যাবে না)। এদের প্রতি রাষ্ট্রীয়ত্বের আনুগত্য থাকবে বটে (ইসলামী অনুগামিতায়, বিপরীতে নয়) কিন্তু তাদের সমর্থন, সহযোগিতা করা যাবে না। তাদের থেকে দুরে থাকতে হবে।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ وَجَاهِدُوا فِي سَبِيلِهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
হে বিশ্বাসীগণ! আল্লাহকে ভয় কর, তাঁর নৈকট্য লাভের উপায় অম্বেষণ করো ও তাঁর পথে সংগ্রাম কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। (সূরা ৫ মায়িদা:৩৫)
ইমাম শাওকানী (রঃ) বলেন; অসীলা শব্দটি নৈকট্য লাভের অর্থ বুঝায়, তা ছাড়া সংযম (তাকওয়া) ও অন্যান্য ভালো কর্মের সাথে সম্পৃক্ত যার দ্বারা বান্দা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারে। অনুরূপভাবে নিষিদ্ধ ও হারাম কর্ম করা থেকে বিরত থাকার দ্বারাও আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়। কেননা নিষিদ্ধ ও হারাম কর্ম বর্জন করাও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম। (দেখুন তাফসীরে ইবনে কাসীর)
গণতন্ত্র ও ইসলাম: "গণতন্ত্র" নামেই রয়েছে কুফুরী! আর তার মূল পরিচয়ে রয়েছে ইসলামের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক অবস্থা। গণতন্ত্র সর্বাবস্থায়ই হারাম। একজন মুসলমান কখনো গণতন্ত্রের উপর আনুগত্যশীল হতে পারে না। সুতরাং যারা সালাত পড়ে, যাকাত দেয়, রোযা রাখে কিংবা হজ্জও করে অথচ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, সমর্থক বা সহযোগী কিংবা মানুষের আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য (নানা দলের নানা মত, পথ, আদর্শ) জীবন ব্যয় করছে তাদের অবস্থাটা একটু ভাবুন! একদিকে সালাত পড়ছে অপরদিকে মানুষের তৈরি বিধান দিয়ে ফায়সালা (শাসনকার্য বা বিচারকার্য) করছে তারা কোন পর্যায়ের মুসলিম?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের জালিমদের সাহায্য-সহযোগিতা করতে নিষেধ করেছেন। সুতরাং যারা দল করেন, প্রার্থী হন বা ভোট দেন একটু কি নিজের জবাবদিহিতা নিয়ে ভেবেছেন? কাঁটা দিয়ে কাঁটা হয়তো তোলা যায় তবে ব্যাপারটা ঝুঁকিপূর্ণ! কিন্তু হারাম দিয়ে হারামকে দূর করা যায় না এবং ইসলামে বৈধও নয়।
সুতরাং যারা ভাবছেন গণতন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামী আইন জারি করবেন, তারাও ঝুঁকির মধ্যে আছেন!
দাওয়াত-তাবলীগ ও জিহাদ::
উমাইয়্যাযুগের পথভ্রষ্ট নেতাদের শাসনামলেও অনেক সাহাবী জীবিত ছিলেন, ছিলেন তাবেয়ীগণ,তাবে-তাবেয়ীগণ! তাদের কর্ম-পদ্ধতি কি আমাদের কর্ম পদ্ধতি হওয়া উচিত নয়? ফিকহের সেরা ইমাম কিংবা হাদীসের শ্রেষ্ঠ ইমামরা কি আমাদের চেয়ে জ্ঞানী নয়? সুতরাং তাদের কর্মপদ্ধতিই আমাদের তাওহীদের দাওয়াতী কর্মের পদ্ধতি! অপূর্নাঙ্গ বা মনগড়া পদ্ধতিতে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ আল্লাহর কাছে গ্রহনীয় নয়!
শুধু বিশুদ্ধ কুরআন তেলাওয়াত, সালাতের মাসলা-মাসায়েল জানা কিংবা তাসবীহ হাতে সুন্নতী লিবাসের মাধ্যমে নিজকে পরিবর্তন করা আর মন-মানুসিকতা ও ধ্যান-ধারণায় মানুষের আদর্শ প্রতিষ্ঠার (আসলে শুধুই ক্ষমতা!) কাজে নিয়োজিত রাখার নাম দাওয়াত-তাবলীগ নয়!
মসজিদ-খানকাহ-দরবার-মজলিস-মাহফিল-ইজতেমাতে ইসলামী বিধান আর ঘর থেকে বাইরে সর্বত্র তাগুতের বিধান মেনে মুসলমানিত্ব টিকে না। সুতরাং যারাই তাগুতের দল বা পার্টি (ইসলামী পার্টি বা দল বলেও কিছু নেই, মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে আল্লাহ বলেছেন) করছেন, আগে ওসব বর্জন করুন তারপর দাওয়াত-তাবলীগ-জিহাদের কথা বলুন।
ব্যক্তিগতভাবে তাওহীদের দাওয়াত কিংবা পারিবারিকভাবে তাওহীদকে প্রতিষ্ঠাই হলো দ্বীন কায়েমের প্রাথমিক ভিত্তি। আল্লাহর বিধানের উপর অনুগত থাকা এবং তাগুতের আদর্শকে বর্জন করা হলো ব্যক্তিগত জিহাদ!
যতদিন খিলাফত (ইমামত) প্রতিষ্ঠিত না হবে ততদিন ব্যক্তিগত পর্যায়ে দাওয়াতি কাজ চালিয়ে যেতে হবে। সুতরাং আপনার নিকটাত্মীয়দের দিয়ে শুরু করুন। যারা সমাজের মাথা-রাষ্ট্রের মাথা তাদের দাওয়াত দিতে হবে। কেননা তারা সংশোধন হলে পুরো জাতি সহজেই সংশোধন হয়ে যাবে।
(দ্রষ্টব্য: বিস্তারিত জানতে ও বুঝতে পড়ুন:- সূরা ৫ মায়িদা: ৪০- ৪৮, সূরা ৪২ শূরা : ১৩-১৫ আয়াতের তাফসীর, বুখারীর ফিতনা ও আহকাম অধ্যায়(كتاب الفتن,كتاب الاحكام), মুসলিমের অধ্যায়ঃ ৩৪/ রাষ্ট্রক্ষমতা ও প্রশাসন (كتاب الإمارة) তিরমিযী ও আবু দাউদের ফিতনা অধ্যায়।)
আল্লাহ আমাদের দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন।
বিষয়: বিবিধ
৭৫৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন