তাক্বদীর বা ভাগ্যলিপি কি চাপিয়ে দেয়া বস্তু_?
লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ২০ এপ্রিল, ২০১৭, ০৩:২১:৫৫ রাত
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
তাকদীর চাপিয়ে দেয়া বস্তু নয়। আল্লাহ বলেন-
لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا ۚ لَهَا مَا كَسَبَتْ وَعَلَيْهَا مَا اكْتَسَبَتْ
আল্লাহ কাউকেও তার সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব অর্পণ করেন না। যে ভাল উপার্জন করবে সে তার (প্রতিদান পাবে) এবং যে মন্দ উপার্জন করবে সে তার (প্রতিফল পাবে)। (সূরা ২ বাকারা:২৮৬)
তাক্বদীর হলো সৃষ্টিজগতের আদি-অন্ত। সুতরাং আমরা যা করছি বা করবো তার লিপিবদ্ধতাই হলো তাক্বদীর।
‘উবাদাহ্ ইবনুস্ সামিত (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ সর্বপ্রথম যে বস্ত্তটি সৃষ্টি করেছিলেন তা হচ্ছে কলম। অতঃপর তিনি কলমকে বললেন, লিখো। কলম বলল, কী লিখবো? আল্লাহ বললেন, ক্বদর (কদর) (তাক্বদীর) সম্পর্কে লিখ। সুতরাং কলম- যা ছিল ও ভবিষ্যতে যা হবে, সবকিছুই লিখে ফেলল।(তিরমিযী ২০৮১, সহীহহুল জামি‘ ২০১৭, আহমাদ ৫/৩১৭)
আলী (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা বাকী গারকাদে একটি জানাযা সলাতে উপস্থিত ছিলাম। তারপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিকট এসে বসলেন এবং আমরাও তার পাশাপাশি বসলাম। তার সাথে ছিল একটি ছড়ি। তিনি মাথা নিচু করেছিলেন। সে সময় তিনি তার ছড়ি দ্বারা জমিনে টোকা দিচ্ছিলেন। তারপর তিনি বললেন, তোমাদের মাঝে এমন কোন লোক নেই, যার পরিণাম আল্লাহ তা’আলা জান্নাতে বা জাহান্নামে নির্ধারণ করেননি এবং সে দুর্ভাগ্যবান হবে বা সৌভাগ্যবান হবে, তা লিপিবদ্ধ করেননি। বর্ণনাকারী বলেন, তখন জনৈক লোক আবেদন করল, হে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমরা কি আমাদের ভাগ্যলিপির উপর অটুট থেকে ‘আমাল ত্যাগ করব না? তখন তিনি বললেন, যে লোক সৌভাগ্যবান সে সৌভাগ্যবানদের ‘আমালের দিকে ধাবিত হবে। যে হতভাগাদের অন্তর্ভুক্ত সে হতভাগার আমালের প্রতি ধাবিত হবে। তারপর তিনি বললেন, তোমরা আমাল করো। প্রত্যেকের পথ সহজ করে দেয়া হয়েছে। অবশ্যই সৌভাগ্যবান লোকদেরকে সৌভাগ্যের আমাল করা সহজ করে দেয়া হচ্ছে। হতভাগ্যদেরকে হতভাগ্যের ‘আমাল সহজ করে দেয়া হচ্ছে। তারপর তিনি তিলাওয়াত করলেন, "সুতরাং যে দান করল, তাকওয়া অর্জন করল এবং যা উত্তম তা সত্যায়ন করল, আমি তাদের জন্যে সফল তার পথ সুগম করে দিব এবং যারা বখিলী করল এবং নিজকে স্বয়ংসম্পূর্ণ অমুখাপেক্ষী মনে করল আর যা উত্তম তা মিথ্যা সাব্যস্ত করল, আমি তার জন্যে কঠোর ও বিফলতার
পথ সহজ করে দিব"- (সূরা আল লায়ল ৯২ঃ ৫-১০)।(বুখারী ৪৯৪৯.মুসলিম:২৬৪৭)
আল্লাহ বলেন-
শপথ আত্মার এবং তার সুঠাম গঠনের। এরপর তার উপর তিনি পাপ-পুণ্যের জ্ঞান ঢেলে দিয়েছেন"- (সূরা আশ শামস ৯১ঃ ৭-৮)
তাক্বদীর আল্লাহ তাআলার ইলম:
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কাফির-মুশরিকদের শিশু-সন্তানদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল (মৃত্যুর পর তাদের স্থান কোথায় জান্নাতে, না জাহান্নামে)? জবাবে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন, তারা (জীবিত থাকলে) কি ‘আমাল করত। (বুখারী ১৩৮৪, মুসলিম ২৬৫৯)
আমরা তাকদীরের পুতুল নই, বরং আমরা যা করতাম তাই কলম দ্বারা আল্লাহ পাক লিপিবদ্ধ করিয়েছেন।
তবে কদরের কারণ হলো, যেহেতু সৃষ্টিজগতের যাবতীয় বিষয় ও বিষয়ের পরিমাপ বা পরিমাণ আল্লাহর পক্ষ থেকে।
যেমন, আমাদের ইচ্ছাশক্তি, যোগত্যা, ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা, কর্মের ক্ষমতা সবই আল্লাহ প্রদত্ত।
একটি উদাহরণ-
وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَى اللَّهِ رِزْقُهَا وَيَعْلَمُ مُسْتَقَرَّهَا وَمُسْتَوْدَعَهَا ۚ كُلٌّ فِي كِتَابٍ مُبِينٍ
আর ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী কোন এমন প্রাণী নেই যে, তার রুযী আল্লাহর দায়িত্বে নেই। আর তিনি প্রত্যেকের স্থায়ী ও অস্থায়ী অবস্থানক্ষেত্র সম্বন্ধে জ্ঞান রাখেন; সবই সুস্পষ্ট গ্রন্থে (লাওহে মাহ্ফুযে লিপিবদ্ধ) রয়েছে।(১১:৬)
রিযকের দায়িত্ব আল্লাহর" -এর মানে হলো রিযকে আল্লাহর সাথে কারো অংশীদার নেই। সুতরাং যাবতীয় রিযক তার কাছেই চাইতে হবে আর সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এর মানে এই নয় যে, বান্দাহ বসে থাকবে আর মুখের উপর টুপ করে খাবার এসে যাবে।
তেমনিভাবে হেদায়াত বা পথপ্রদর্শনের ক্ষেত্রেও।এখানে তার সাথে কোনো শরীক নেই। তিনি ছাড়া অন্য কেউ হেদায়েতের মালিক নয়। যেমন-
مَنْ يُضْلِلِ اللَّهُ فَلَا هَادِيَ لَهُ ۚ وَيَذَرُهُمْ فِي طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُونَ
আল্লাহ যাকে বিপথগামী করেন তার কোন পথপ্রদর্শক নেই। আর তিনি তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় উদভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়াতে ছেড়ে দেন। (৭:১৮৬)
সুতরাং যা কিছু হয় সবই আল্লাহর হুকুমে। তিনি তার হুকুম কাউকে অংশীদার বানাননি। এটাই তাওহীদ।
ভালো বা মন্দ সবকিছুই আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহ মানুষদের ভালো-মন্দ বুঝার ক্ষমতা দান করে পরীক্ষা করে দেখতে চান কে ভালো কাজ করে আর কে মন্দ কর্ম করে।
সুতরাং বান্দাহর কোনো মন্দকর্ম বা মন্দকর্মের ইচ্ছাও আল্লাহ প্রদত্ত যোগ্যতা ও ক্ষমতার ফলেই হয় তেমনি বান্দাহর কোনো ভালোকর্ম বা ভালোকর্মের ইচ্ছাও আল্লাহ প্রদত্ত যোগ্যতা ও ক্ষমতায় হয়।
"জীব মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে; আমি তোমাদেরকে মন্দ ও ভাল দ্বারা বিশেষভাবে পরীক্ষা করে থাকি। আর আমারই নিকট তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।" (২১:৩৫)
"শপথ আত্মার এবং তার সুঠাম গঠনের।অতঃপর তাকে তার অসৎকর্মও সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন।সে সফলকাম হবে, যে তাকে পরিশুদ্ধ করবে।এবং সে ব্যর্থ হবে, যে তাকে কলুষিত করবে।" (সূরা ৯১ শামস:৭-১০)
"বিধান আল্লাহরই। আমি তাঁরই উপর নির্ভর করলাম এবং যারা নির্ভর করতে চায় তারা আল্লাহরই উপর নির্ভর করুক।’ (সূরা ১২ ইউসুফ:৬৭)
আমাদের প্রয়োজন শুধু চেষ্টা-সাধনা করা:
আমাদের দায়িত্ব হলো হলো (যে কোনো বিষয়ে, পার্থিব বা পারলৌকিক) শুধু সাধ্যমত চেষ্টা করে যাওয়া।
"তোমরা আল্লাহকে যথাসাধ্য ভয় কর এবং শোনো, আনুগত্য করো ও ব্যয় করো, তোমাদের নিজেদেরই কল্যাণ হবে। আর যারা অন্তরের কার্পণ্য হতে মুক্ত, তারাই সফলকাম।" (৬৪:১৬)
"আল্লাহর অনুমতি ব্যতিরেকে কোন বিপদই আপতিত হয় না। আর যে আল্লাহকে বিশ্বাস করে, তিনি তার অন্তরকে সুপথে পরিচালিত করেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক অবগত।" (৬৪:১১)
وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا ۚ وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ
যারা আমার উদ্দেশ্যে সংগ্রাম করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথসমূহে পরিচালিত করব। আর আল্লাহ অবশ্যই সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গেই থাকেন। (২৯:৬৯)
وَمَنْ جَاهَدَ فَإِنَّمَا يُجَاهِدُ لِنَفْسِهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ لَغَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ
যে কেউ সংগ্রাম করে, সে তো নিজের জন্যই সংগ্রাম করে; আল্লাহ অবশ্যই বিশ্বজগতের ওপর নির্ভরশীল নন। (২৯:৬)
কাকেও প্রিয় মনে করলে তুমি তাকে সৎপথে আনতে পারবে না, তবে আল্লাহই যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনেন এবং তিনিই ভাল জানেন কারা সৎপথের অনুসারী। (২৮:৫৬)
তাকদীর কেন_?
মানুষ ইচ্ছায়, চেষ্টা-সাধনায়, কর্মে স্বাধীন হলেও কর্মফল বা চুড়ান্ত পরিণতিতে স্বাধীন নয়। কেননা প্রতিটি প্রাণের সাথে, ব্যাক্তির সাথে অন্য প্রাণ ও জিনিসের সম্পৃক্ততা রয়েছে। যেমন- একজন মানুষ নিজ মেধা, যোগ্যতা ও কর্মের স্বাধীনতায় ক্ষেত চাষ করে বীজ বপন করল, সাধ্যমত পরিচর্যা করল কিন্তু নিজের ইচ্ছা মাফিক ফলন সে ফলাতে পারবে না, কেননা এখানে বীজ, ক্ষেতের সক্ষমতা/গুণের তারতম্যতা ও আবহাওয়ার সাথে পরিবেশের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। সুতরাং নিজের সাধ্যমত ভালো বীজ, ক্ষেতের ভালো উপযোগিতা-পরিচর্যা, পরিবেশ-আবহাওয়া তৈরি করেও সে নিজের মনমত ফলন নাও পেতে পারে, কোনো কীট বা পশু-পাখি বা মানুষ তার ফসল নষ্ট করে দিতে পারে।এখানেই কদরের মুখাপেক্ষিতা।
আল্লাহ তাঁর দাসদের মধ্যে যার জন্য ইচ্ছা তার রুযী বর্ধিত করেন এবং যার জন্য ইচ্ছা তা হ্রাস করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক অবহিত। (২৯:৬২)
এটা পরীক্ষা করার জন্য। নইলে আল্লাহ চাইলে সবাই একই রকম হতো, চেহারায়, বুদ্ধিতে, যোগ্যতায়, জীবিকায় ও যাবতীয় কর্মে ।
তেমনি ভাবে মানুষ বেঁচে থাকার জন্য, সঠিকভাবে পরীক্ষা দেওয়ার (হেদায়াতের পথে চলতে) জন্য মানুষ ছাড়াও আল্লাহর যাবতীয় সৃষ্টির সাহায্য নিতে হয় এবং তার জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট। সৃষ্টি মানে মুখাপেক্ষী আর স্রষ্টাই শুধু অমুখাপেক্ষী।
সুতরাং ক্বদরের প্রয়োজনীয়তা যাবতীয় সৃষ্টির ঘটনায়, দূর্ঘটনায়, বিপদাপদ বা মৃত্যু, কষ্ট-ক্লেশ বা মুসিবতে ধীরতা ধৈর্য ধারণে। যেন আমরা যাবতীয় বিষয়ে তারই মুখাপেক্ষী হই, ভরসা করি। তাওয়াক্কুলে যেন কাউকে শরীক না করি।
اَلَّذِى خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَوةَ لِيَبْلُوَكُمْ اَيُّكُمْ اَحْسَنُ عَمَلأ.
অনুবাদ: তিনি (মহান আল্লাহ) মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন যেন পরীক্ষা করে নিতে পারেন কে কাজে-কর্মে উত্তম (শ্রেষ্ঠ)। (মুলক : ২)
আবূ মূসা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহর হাতে (মানুষের) ‘ক্বলব’ (কলব) বা মন, যেমন কোন তৃণশূন্য মাঠে একটি পালক, যাকে বাতাসের গতি বুকে-পিঠে (এদিক-সেদিক) ঘুরিয়ে থাকে।(আহমাদ ১৮৮৩০, ইবনু মাজাহ্ ৮৫)
আবূ মূসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঁচটি বিষয়সহ আমাদের মাঝে দাঁড়িয়ে বললেনঃ (১) আল্লাহ তা‘আলা কক্ষনো ঘুমান না। (২) ঘুমানো তাঁর পক্ষে সাজেও না। (৩) তিনি দাঁড়িপাল্লা উঁচু-নিচু করেন [সৃষ্টির রিযক্ব (রিজিক/রিযিক) ও আ‘মাল প্রভৃতি নির্ধারিত করে থাকেন]। (৪) রাতের ‘আমাল দিনের ‘আমালের পূর্বে, আর দিনের ‘আমাল রাতের ‘আমালের পূর্বেই তার নিকটে পৌঁছানো হয় এবং (৫) তাঁর [এবং সৃষ্টিজগতের মধ্যে] পর্দা হচ্ছে নূর [জ্যোতি]। যদি তিনি এ পর্দা সরিয়ে দিতেন, তবে তাঁর চেহারার নূর সৃষ্টিজগতের দৃষ্টির শেষ সীমা পর্যন্ত সব কিছুকেই জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিত। (মুসলিম ১৭৯)
আসুন বেশি বেশি পাঠ করি-
اَللّهُمَّ مُصَرِّفَ الْقُلُوْبِ صَرِّفْ قُلُوبَنَا عَلى طَاعَتِكَ
"আল্লাহুম্মা মুসাররিফার ক্কুলূব, সাররিফ ক্বুলূবুনা আ'লা ত্ব'আতিক"
‘‘হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী আল্লাহ! আমাদের অন্তরকে তোমার ‘ইবাদাত ও আনুগত্যের দিকে ঘুরিয়ে দাও।’’ (মুসলিম:৪৭৯৮)
বিষয়: সাহিত্য
১১১৭ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন