পীর-মুরিদি ও অলী-আউলিয়া কি এক জিনিস?একটি তুলনামূলক আলোচনা

লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ১৪ মার্চ, ২০১৭, ০২:৫৩:১৯ রাত

পীরপন্থী বা সুফিবাদে বিশ্বাসীরা ইসলামে পীরের গুরুত্ব ও মর্যাদার কথা আলোচনা করতে গিয়ে ওলীদের সম্পর্কে কুরআনে বর্ণিত আয়াত উল্লেখ করে থাকে। সত্যবাদী, সৎকর্মপরায়ণ, মুত্তাকীদের শানে বর্ণিত আয়াতকে টেনে এনে পীরদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকে আর কিছু হাদীসের অপব্যখ্যা করে থাকে। সুতরাং আমাদের জানা দরকার- পীর ও ওলীর পরিচয়।

পীর:

পীর শব্দটি ফার্সি (پیر) শাব্দিকভাবে এর অর্থ হলো, মুরব্বী, গুরু, বৃদ্ধ বা প্রবীণ। (যেমন আরবীতে শায়খ) তবে এই শব্দটি পথপ্রদর্শক বা গুরু হিসেবেই (আরবীতে মুরশিদ) সুফিবাদ তথা তরীকতপন্থীরা ব্যবহার করে থাকে।

সাধারণভাবে কোনো শিক্ষক বা শায়খকে পীর বলা হয় না। কেননা পীর হতে হলে আগে আরেকজন পীরের হাতে নির্দিষ্ট তরীকার (যেমন, মুজাদ্দেদিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া, কাদেরিয়া, সোহরাওয়ার্দিয়া) উপর বাই'য়াত (অঙ্গীকারনামা) গ্রহণ করতে হয় এবং তার বাতানো পন্থায় চলতে হয়। তখন তাকে বলে মুরিদ (আরবী শব্দ, এর অর্থ হলো, একজনের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ)।

যদিও তারা বলে থাকে বা লিখে থাকে মুরিদ মানে হলো ইচ্ছাপোষণকারী। যে ব্যক্তি আল্লাহর আদেশ নিষেধ আল্লাহ তাআলা যেভাবে চান সেভাবে পালন করার ইচ্ছা পোষণ করে কোন বুযুর্গ ব্যক্তির হাত ধরে শপথ করে সে ব্যক্তির নাম হল “মুরিদ”। প্রকৃত পক্ষে পীর যেভাবে চায় সেভাবে নিজের ইচ্ছাকে বিলীন করার নামই মুরিদ। ভন্ড কিংবা হক্কানী পীরদের বই পড়লেই তাই মনে হবে।



পীর তার মুরিদের অবস্থার উন্নতিতে বা তার প্রতিনিধি বাছাইয়ে বা উত্তরাধিকার মনোয়ন খিলাফত দেন যাদেরকে পীরপন্থিদের ভাষায় "খলিফা" বলা হয়।

পীরগীরিতে আরো বেশকিছু নিজস্ব পরিভাষা আছে, যেমন- খানকাহ, দরবার, গাউস, কুতুব, আবদাল।

মূলত সুফিবাদ বা তরিকত সাধনায় পীর বা মুর্শিদ বা পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন হয়। সেই পথে একজন মুরীদ প্রথমে ফানা ফিশ্‌শাইখ ও পরে ফানা ফিররাসুল ও ফানাফিল্লাহ হয়। ফানাফিল্লাহ হওয়ার পর বাকাবিল্লাহ লাভ হয়। বাকাবিল্লাহ অর্জিত হলে সুফি দর্শন অনুযায়ী সুফি আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ শক্তিতে শক্তিমান হন। (এসবের সাথে ইসলামের কী সম্পর্ক আছে তা পাঠকই চিন্তা-ভাবনা করবেন)

ওলী:

অলী বা ওলী শব্দটি আরবী (ولي বহুবচনে أولياء ) যার শব্দিক অর্থ: নৈকট্যপ্রাপ্ত,পছন্দনীয়, নেককার/সৎকর্মপরায়ণ ,অঙ্গীকারাবদ্ধ, বন্ধু, অভিভাবক।

অলী শব্দটি আল্লাহর প্রতি সম্বন্ধ হলে (তথা বান্দাহর ক্ষেত্রে) এর অর্থ হবে- আজ্ঞাবহ, অনুগত, নেকট্যপ্রাপ্ত আর আল্লাহর ক্ষেত্রে এর অর্থ হবে-সাহায্যকারী বা মিত্র। যেমন -

إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ

অর্থ:নিশ্চয় তোমাদের ওলী/বন্ধু তো আল্লাহ তাঁর রসূল ও বিশ্বাসীগণ; যারা বিনত হয়ে নামায পড়ে ও যাকাত আদায় করে।(সূরা ৫ মায়িদা:৫৫)



أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ

অর্থ: মনে রেখো যে, আল্লাহর অলী/বন্ধুদের না কোন আশংকা আছে আর না তারা বিষণ্ণ হবে। (সূরা ১০ ইউনুস: ৬২)



ওলীদের পরিচয়:

উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ নিশ্চয়ই আল্লাহর বান্দাদের মাঝে এমন কিছু লোক আছে যারা নবী নন এবং শহীদও নয়। কিয়ামাতের দিন মহান আল্লাহর দরবারে তাদের মর্যাদার কারণে নবীগণ ও শহীদগণ তাদের প্রতি ঈর্ষান্বিত হবেন। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর আমাদের অবহিত করুন, তারা কারা? তিনি বলেন, তারা ঐ সব লোক যারা আল্লাহর মহানুভবতায় পরস্পরকে ভালোবাসে, অথচ তারা পরস্পর আত্মীয়ও নয় এবং পরস্পরকে সম্পদও দেয়নি। আল্লাহর শপথ! তাদের মুখমন্ডল যেমন নূর এবং তারা নূরের আসনে উপবেশন করবে। তারা ভীত হবে না, যখন মানুষ ভীত থাকবে। তারা দুশ্চিন্তায় পড়বে না, যখন মানুষ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকবে। তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করলেনঃ ‘‘জেনে রাখো! আল্লাহর বন্ধুদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবে না।’’(সূরা ইউনুসঃ ৬২)[আবু দাউদ:৩৫২৭, হাকেম: ৭৩৯৮]

আবু জা'ফর বলেন: আল্লাহর ওলী হলো, ঐ সমস্ত গুণের অধিকারী যে গুণ বর্ণনা করেছেন তিনি -( الذين آمنوا وكانوا يتقون তারা হচ্ছে সেই লোক, যারা বিশ্বাস করেছে এবং সাবধানতা অবলম্বন করে থাকে।)

কেউ কেউ বলেছেন,তারা হলেন যাদের দেখলে মহান আল্লাহর স্মরণ হয়। (দ্রষ্টব্য: তাফসীরে ইবনে কাসীর, তাবারী, কুরতবী)

ওলী কারা:

আল্লাহ নিজেই ওলীদের পরিচয় দিয়েছেন, তারা হলেন, ঈমান আনার পর যারা মুত্তাকী হয়।(আল্লাহর ভয়ে যারা শিরক ও পাপাচার থেকে বিরত থাকে- কুরতবী)

মুত্তাকিদের গুণাবলী সম্পর্কে কুরআনে অনেক আয়াত এসেছে। মূল কথা হলো, আল্লাহর ভয়ে তার সমস্ত অবাধ্যতা থেকে বেচে থাকার নামই তাকওয়া।

মুত্তাকীদের বিশেষ গুণাবলী সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:

الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا إِنَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

যারা বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! নিশ্চয় আমরা বিশ্বাস করেছি; অতএব আমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা কর এবং দোযখের শাস্তি থেকে আমাদেরকে রক্ষা কর।’ (৩:১৬) এবং

الصَّابِرِينَ وَالصَّادِقِينَ وَالْقَانِتِينَ وَالْمُنْفِقِينَ وَالْمُسْتَغْفِرِينَ بِالْأَسْحَارِ

যারা ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, অনুগত, দানশীল এবং রাত্রির শেষাংশে ক্ষমাপ্রার্থী। (সূরা ৩ আলে ইমরান:১৭)

আরো দেখুন: সূরা ২ বাকারা: ২-৪ এবং ১৭৭) সূরা ৩ আলে ইমরান: ১১৪-১১৫, সূরা ৭ আরাফ: ২০১

উপরের আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার যে, আল্লাহর ওলী হতে গেলে দুটি গুণ দরকার, তা হলো- ঈমান ও তাকওয়া। আর পীর হতে হলে দরকার আরেক পীরের সোহবত ও খেলাফত। সুতরাং দুটো কখনো এক জিনিস নয়। ইসলামে ওলীর পরিচয় ও মর্যাদা আছে কিন্তু পীরের পরিচয় ও মর্যাদা কোথায় আছে?

বিশেষ দ্রষ্টব্য:

আমরা মানুষের বাহ্যিক আচরণ ও আমল দেখে তার সম্পর্কে শুধু ধারণা করতে পারবো মাত্র সে একজন মুত্তাকী, সালেহী, সত্যবাদী বা সৎলোক আর আমরা তাদের সংষ্পর্শে থাকবো ও দ্বীন গ্রহণ করবো। প্রকৃত ওলীত্ব তো শুধু আল্লাহই জানেন।

আমার আলোচনা ভুল হলে তত্ত্ব ও তথ্যসহ সমালোচনা করুন, ভুল ধরিয়ে দিন।

আল্লাহ আমাদের দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুক। আমীন!

বিষয়: বিবিধ

২০৬৯ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

382245
১৪ মার্চ ২০১৭ রাত ১১:২১
সন্ধাতারা লিখেছেন : Salam. Amin.

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File