বন্ধুত্ব কার সাথে এবং ফেতনারযুগে মানুষের সংশ্রব থেকে দুরে থাকা
লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ০৫:২০:০২ সকাল
বন্ধুর দোকানে আমার একটা জরুরী ফাইল জমা রেখে ছিলাম। হঠাৎ করেই প্রয়োজন পড়ে যায়, তাই ফোন করে বন্ধুকে বললাম, তার পাশের কোনো দোকানদারের কাছে (যে আমার এলাকার) যেন ফাইলটা দিয়ে দেয়। বন্ধু একজনকে পেল যার বাড়ি আমার মহল্লার পাশের মহল্লায়। তার সাথে আমার ঘনিষ্টতা বা ওঠা-বসা নেই, শুধু এলাকার লোক হিসেবে পরিচিত।
পরদিন যখন বাজারে কাছে যাই, বন্ধু আমাকে হঠাৎ কথা প্রসঙ্গে বলল,
দোস্ত! তোমার বিদেশ থাকাই ভালো।আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম ও বললাম, হেলাল (গতরাতে যে আমার ফাইল নিয়ে এসেছিল) কিছু বলেছে?
আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, কেন? ওর কথার ধরণ ধরতে পারছিলাম না।
- তোমাকে তো দেখছি এলাকার লোকেরাই চেনে না, কেউ তোমার সম্পর্কে ভালো কিছু বলছে না।
গতরাতে আমার এলাকার অনেক লোকই নাকি বলেছে আমাকে তারা চেনে না!
বন্ধুটি না বললেও আমি ঠিকই বুঝতে পারছি হেলালই তাকে আমার সম্পর্কে বলেছে।
আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন বাড়িতে আসলে কমই মহল্লার মোড়ে (ছোটবাজার) যেতাম।(রক্ষণশীল পরিবারের ছেলে বলে বাইরে বা দোকানে আড্ডা-মারাসহ অনেক কিছুর বিধি নিষেধ ছিল) ঔষধের দোকান বা সেলুন ছাড়া অন্য কোথাও বসতামও না। একদিন সেলুনের সামনে দাড়িয়ে আছি, ওই মহল্লার হানিফ ভাই বলল, কী খবর! তোমাকে তো ইদানিং দেখি না। বললাম, ঢাকা থাকি, বাড়িতে কমই আসি।
আরো কিছু বলার আগেই হেলাল বলে ওঠে, ওরা কি বাড়ি থেকে বের হয় নাকি? মাষ্টারবাড়ির মফিজ দারোগা ছাড়া আর কোনো মানুষ আছে নাকি, উনিই একটু আমাদের সাথে মিশে সামাজিক হয়েছে, নইলে ওই পাড়ার সবই তো অসামাজিক।
বন্ধুকে বললাম, শোনো! হেলালকে বলে দিও, এমন সামাজিক হতে চাই না যে আমাকে অমানুষ করে তোলে, এমন মানুষ হতে চাই না যে আমাকে খুনী আর সন্ত্রাসী বানায়।
ওর সেই সামাজিক মানুষ মফিজ দারোগার নির্দেশেই তার ছোট ভাইকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে মেরেছিল ওদেরই তিন সামাজিক ছেলেরা যারা তার ভাইয়ের সাথে আড্ডা দিতো।
দোকানপাট বা বাজার হলো সবচেয়ে ঘৃণিতস্থান: ইদানিং সকাল আর সন্ধ্যায় মফস্বল শহর কি গ্রামে চা-পানের ব্যস্ততা বেড়েছে, যেমনটা আগে ছিল না। দোকানপাট, বাজার আর রাস্তার পরে বখাটে ছাড়া কেউ আড্ডা মারতো না। আমাদের তো আড্ডা মারাটা পারিবারিকভাবেই নিষিদ্ধ ছিল। কেননা অভিভাবকরা বলতেন, দোকানপাটের স্থান হলো আল্লাহর কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্টস্থান।
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহর নিকট সকল জায়গা হতে মাসজিদই হলো সবচেয়ে প্রিয়, আর বাজার সবচেয়ে ঘৃণ্য স্থান।
(মুসলিম ৬৭১, সহীহ ইবনু হিব্বান ১৬০০, সুনানুল কুবরা:৪৮৬৮,সহীহ ইবনে খুযাইমা:১২৯৩)
এর ব্যাখ্যায় ইমাম নববী বলেন-
কারণ এটা প্রতারণা, প্রবঞ্চনা ও মিথ্যা শপথ এবং সুদ ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার জায়গা।
বাস্তবিকই বাজারে, বন্দরে, দোকানে মানুষের আড্ডায় যা হয় তার বেশিরভাগই হলো- গীবত/পরচর্যা-পরনিন্দা, তোহমত/মিথ্যা অপবাদ, চোখলখুরী, অশ্লীলতা, কুৎসিত আচার আর ঝগড়া বিবাদ। আল্লাহ আমাদের বাজার কিংবা দোকানপাটে অনর্থক কাজ থেকে বিরত রাখুন।
বন্ধু বা সঙ্গী নির্বাচন: একজন প্রকৃত মুসলমানের বন্ধু বা চলার সঙ্গী কে হবে এই সম্পর্কে আল্লাহ বলেন-
"নিশ্চয় তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ, তাঁর রসূল ও বিশ্বাসীগণ; যারা বিনত হয়ে নামায পড়ে ও যাকাত আদায় করে। (সূরা ৫ মায়িদা:৫৫) মানে হলো, শুধু মুসলমান নাম হলেই হবে না উপরোক্ত গুণাবলী সম্পন্ন মুলমান হতে হবে।আল্লাহ আরো বলেন-
"তুমি নিজেকে তাদেরই সংসর্গে রাখ, যারা সকাল ও সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালককে তাঁর মুখমন্ডল (দর্শন বা সন্তুষ্টি) লাভের উদ্দেশ্যে আহবান করে এবং তুমি পার্থিব জীবনের শোভা কামনা করে তাদের দিক হতে তোমার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ো না। আর তুমি তার আনুগত্য করো না, যার হৃদয়কে আমি আমার স্মরণে অমনোযোগী করে দিয়েছি, যে তার খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে ও যার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে। (সূরা ১৮ কাহফ: ২৮)
'হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হও। ' (সুরা ৯ তাওবা : ১১৯)
বন্ধুত্ব কার সাথে এবং প্রকৃত বন্ধুর গুণাবলী: আল্লাহ বলেন-
" আর বিশ্বাসী পুরুষরা ও বিশ্বাসী নারীরা হচ্ছে পরস্পর একে অন্যের বন্ধু,তারা সৎ কাজের আদেশ দেয় এবং অসৎ কাজে নিষেধ করে। আর যথাযথভাবে নামায আদায় করে ও যাকাত প্রদান করে, আর আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করে। এসব লোকের প্রতিই আল্লাহ অতি সত্বর করুণা বর্ষণ করবেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ অতিশয় ক্ষমতাবান হিকমতওয়ালা। (সূরা ৯ তাওবা:৭১)
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মানুষ তার বন্ধু রীতি-নীতির অনুসারী হয়ে থাকে সুতরাং রক্ষ্য করবে সে কার সাথে বন্ধুত্ব করছে। -সহিহাহ ৯২৭,তিরমিযী:২৩৮১, মিশকাত ৫০১৯
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ যে ব্যক্তি যাকে ভালবাসে সে তার সঙ্গেই থাকবেই। আর তুমিও তার সঙ্গেই থাকবে যাকে তুমি ভালবাস। (আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহ বলেন) এই কথা শুনে মুসলিমদের যে আনন্দ হয়েছিল ইসলামের পর আর কোন বিষয়ে মুসলিমদেরকে এত আনন্দিদ হতে আমি দেখিনি। -তিরমিযী:২৩৮৮,রাওযুন নাযীর ১০৪, বুখারি, মুসলিম।
উত্তম মুমিনের পরিচয়:
আবূ সা‘ঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! কোন ব্যক্তি সর্বোত্তম?’ তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘ঐ মু’মিন যে আল্লাহর পথে তার জান ও মাল দিয়ে যুদ্ধ করে।’’ সে বলল, ‘তারপর কে?’ তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘তারপর ঐ ব্যক্তি যে কোন গিরিপথে নির্জনে নিজ প্রতিপালকের ইবাদত করে।’’
অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘‘যে আল্লাহকে ভয় করে এবং লোকদেরকে নিজের মন্দ আচরণ থেকে নিরাপদে রাখে।’’ (বুখারী ২৭৮৬, ৬৪৯৪, মুসলিম ১৮৮৮, তিরমিযী ১৬৬০, নাসায়ী ৩১০৫, আবূ দাউদ ২৪৮৫)
ফিতনার যুগে মানুষের সাথে কম মেলামেশা: যে সময় মানুষের মাঝে অশ্লীলতা, হারাজ (খুন-খারাবী), অরাজকতা, পাপাচার বেড়ে যাবে সে সময় নিজেকে পাপাচারের হাত থেকে রক্ষা পেতে নির্জনবাস বা মানুষের সাথে কম মেশাই শ্রেয় ও নিরাপদ (নিজের ঈমান ও আমলের জন্য)
সা‘দ ইবনে আবী অক্কাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা ঐ বান্দাকে ভালোবাসেন, যে পরহেযগার (সংযমশীল), অমুখাপেক্ষী ও আত্মগোপনকারী।’’ (মুসলিম ২৯৬৫, আহমাদ ১৪৪৪, ১৫৩২)
আবূ সা‘ঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘সত্বর এমন এক সময় আসবে যে, ছাগল-ভেড়াই মুসলিমের সর্বোত্তম মাল হবে; যা নিয়ে সে ফিতনা থেকে তার দ্বীনকে বাঁচানোর জন্য পাহাড়-চূড়ায় এবং বৃষ্টিবহুল (অর্থাৎ তৃণবহুল) স্থানে পলায়ন করবে।’’(বুখারী ১৯, নাসায়ী ৫০৩৬, আবূ দাউদ ৪২৬৭)
আবূ মূসা রাদিয়াল্লাহু আনহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিতনা প্রসঙ্গে বলেছেনঃ এই সময় তোমরা তোমাদের ধনুকগুলি ভেঙ্গে ফেলবে, এগুলোর ছিলা কেটে ফেলবে। ঘরে অভ্যন্তরে অবস্থান করাকে দৃঢ় ভাবে ধারণ করবে, আর আদমপুত্র (হাবিলের) মত হয়ে থাকবে। -ইবনু মাজাহ- ৩৩৬১, তিরমিযী:২২০৭
কম কথা বলা:
যারা নিজের আত্মশুদ্ধি করতে চায় তখন তাকে চারটি কাজ করতে হয়। ১.কম খাওয়া। ২. কম ঘুমানো। ৩. কম কথা বলা। ৪.লোকদের সাথে কম মেলামেশা করা।কেননা-
বেশি কথা মানে বেশি মিথ্যা, গীবত, অশ্লীলভাষার ব্যবহার। এ ধেকে বাঁচতে চাইলে কম কথাই শ্রেয়। আল্লাহ বলেন-
মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে (তা লিপিবদ্ধ করার জন্য) তৎপর প্রহরী তার নিকটেই রয়েছে। (সূরা ৫০ কফ: ১৯)আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে লোক নীরব থাকলো, সে নাজাত (মুক্তি) পেলো।(তিরমিযী:২৫০১, আহমাদ:৬৪৮১, তাবারানী: ১১৩)
রাসূলুল্লাহ সা. আরো বলেন-
যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাত দিবসে বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভাল কথা বলে অথবা চুপ থাকে। (বুখারী: ৬০১৯, ৬১৩৫, ৬৪৭৬; মুসলিম ১/১৯, হাঃ ৪৮)
বিষয়: বিবিধ
১৩৮৮ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কাফেররা মনে করতো যে নবী রাসূল পাঠালে আল্লাহ ফেরেশতাদেরকেই পাঠাবেন , কোন মানুষকে নয় । তারা এমনও বলতো - এ কেমন নবী যে খাওয়া দাওয়া করে , বাজারে যায় ?
আল্লাহ এর জবাবে বলেছেন যে , আল্লাহ
আর আগে মানুষদেরকেই তার পয়গম্বর করে পাঠিয়েছেন । তারাও আহার করতো , বাজারে যেত।
প্রয়োজনীয় কাজে বাজারে যেতে হয় বৈকি । আপনার কাছে নিত্য প্রয়োজনীয় সব কিছু থাকে না , কারও কাছেই থাকে না । তাই দুনিয়াতে একজন আরেকজনের উপর তাদের বিভিন্ন কাজে ঠেকা থাকে।
বাজারে গেলেই যে আড্ডাবাজি - মাস্তানী করবে সেটা কি ধ্রুব সত্য ? ঘরে বসে বসে কি মানুষ ডিরেইলড হয় না ?
আর বৈরাগ্য কি ইসলাম অনুমোদন করে ?
কথায় আছে - সৎ সঙ্গ স্বর্গ বাস , অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ । সঙ্গ কি আপনি ঘরে বসে পাবেন?
একটা ছুরি তরকারি বা ফল কাটার কাছে ব্যবহার হয় আবার খুন করতেও ব্যবহার হয় । পারমানবিক শক্তি কেউ জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করে আবার কেউ বোমা বানাতেও ব্যব হার করে । এসব নির্ভর করে ব্যক্তির মানসিকতার উপর । সে ঘরে বসে থাকলো না বাইরে বেড়াল সেটা এখানে একবারেই গৌণ।
ধন্যবাদ!!
আপনার বাজারে যাওয়া নিয়ে পাড়ার লোকেরা যে টিজ করতো সেটার ফলে বাজারে যাওয়াকেই একেবারে খারাপ বলে ফেললেন।
আপনাদের বাজার সদাই কি কেউ করে নিয়ে আসতো ? তাহলে সেই লোকও তো বাজারে যেত ! নাকি আপনাদের বাসায় বা বাড়িতে নিত্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই পাওয়া যেত যার জন্য বাজারে যাবার দরকারই হত না ! এমন কি বই খাতা কলমও বাড়িতে প্রস্তুত হত!
ব্যাটারটা বুমেরাং হয়ে গেল না ?
আর দেদারসে কেনাকাটা করা - তাই না ! এটা মিস করলেন কি জেনে বুঝেই ?
০ তাহলে উনারা বাজার সদাই করতেন কি করে ?
কোন স্থানই নিকৃষ্ট হয় না , নিকৃষ্ট হয় মানুষের অপকর্মের কারণে । সেটা বাজারও হতে পারে আবার সংসদও হতে পারে। সবাই তো বাজারে আড্ডা মারতে যায় না বা আড্ডা যারা মারে সবাই কি গুন্ডা বা সন্ত্রাসী প্রকৃতির হয় ? আড্ডাতে তো অনেক ভাল কাজের পরামর্শ ও উপদেশ পাওয়া যায় ।
আপনার লেখার বিপরীত মতামতও যে থাকতে পারে সেটাই দেখালাম এবং আপনার এই ক্ষোভ যে একেবারেই বাচ্চামী সেটাও বুঝতে পারলাম ।
ব্লগে লিখলে বা কমেন্ট করলে সেগুলোর যে সমালোচনা হতে পারে সেটা মাথায় লিখেই লিখেন ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন