তাফসীর: সূরা ২৯ আনকাবুত (১৬-১৮): নবীদের কাজ দাওয়াত দেয়া, হিদায়াত দান করা একমাত্র আল্লাহর এখতিয়ারভুক্ত।

লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ০১ জানুয়ারি, ২০১৭, ০৩:১১:৪৭ রাত

পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)



وَإِبْرَاهِيمَ إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاتَّقُوهُ ۖ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ

১৬.স্মরণ কর ইব্রাহীমের কথা, যখন সে তার সম্প্রদায়কে বলেছিল, ‘তোমরা আল্লাহর উপাসনা কর এবং তাঁকে ভয় কর; তোমাদের জন্য এটাই উত্তম যদি তোমরা জানতে।



إِنَّمَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَوْثَانًا وَتَخْلُقُونَ إِفْكًا ۚ إِنَّ الَّذِينَ تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ لَا يَمْلِكُونَ لَكُمْ رِزْقًا فَابْتَغُوا عِنْدَ اللَّهِ الرِّزْقَ وَاعْبُدُوهُ وَاشْكُرُوا لَهُ ۖ إِلَيْهِ تُرْجَعُون

১৭. তোমরা তো আল্লাহ ব্যতীত কেবল প্রতিমার উপাসনা করছ এবং মিথ্যা উদ্ভাবন করছ; তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদের উপাসনা কর, তারা তোমাদের রুযী দানে অক্ষম। সুতরাং তোমরা আল্লাহর নিকটেই রুযী কামনা কর এবং তাঁর উপাসনা ও কৃতজ্ঞতা কর। তোমরা তাঁরই নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে।



তাফসীর: أَوثَان শব্দটি وَثَن এর বহুবচন। যেমন, أَصنَام শব্দটি صَنَم এর বহুবচন। দুয়েরই অর্থ হল প্রতিমা। কেউ কেউ বলেন, স্বর্ণ-রৌপ্য, পিতল ও পাথরের তৈরী মূর্তিকে صَنَم বলা হয়। আর وَثَن মূর্তি এবং চুন-পাথর নির্মিত আস্তানাকেও বলা হয়। تَخلُقُون إِفكًا এর অর্থ تَكذِبُونَ كَذِبًا (মিথ্যা উদ্ভাবন করা)। এর অন্য একটি অর্থ হল, تَعمَلُونها وتَنحِتُونَها لِلإفْك (মিথ্যা উদ্দেশ্য লাভের আশায় তা গড় ও নির্মাণ কর।) ভাবার্থের দিক দিয়ে উভয়ই অর্থ সঠিক। অর্থাৎ, আল্লাহকে বাদ দিয়ে তোমরা যাদের ইবাদত করছ, তারা তো পাথর-নির্মিত মূর্তি মাত্র; না তারা শুনতে পায়, আর না দেখতে, তারা না উপকার করতে পারে, না অপকার।

যখন এই সকল মূর্তি তোমাদের জীবিকার বা উপার্জনের কোন প্রকার ক্ষমতা রাখে না; তারা না বৃষ্টি বর্ষণ করতে পারে, আর না পৃথিবীতে কোন প্রকার গাছ-পালা উৎপন্ন করতে পারে, না সূর্যের আলো পৌঁছানোর ক্ষমতা রাখে, আর না তোমাদের এমন শক্তি প্রদানে সক্ষম যার দ্বারা প্রকৃতির ঐ সমস্ত জিনিস হতে উপকৃত হতে পার। সুতরাং তোমরা তোমাদের জীবিকা আল্লাহর নিকটেই কামনা কর এবং তাঁরই ইবাদত কর ও তাঁরই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।

ইব্রাহীম আ.এর দাওয়াত:

আল কুরআনে বর্ণিত নবীদের মধ্যে ইব্রাহীম (আঃ) ষষ্ঠতম। তাঁর পিতা অগ্নি পূজক আজর ছিল নমরুদের মন্ত্রী। ইরাকের নাসিরিয়া থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার এবং বাগদাদ থেকে ৩৯৬ কিলোমিটার দূরে ‘উর’ নামক স্থান যা প্রাচীন বাবেল শহর নামে পরিচিত।

হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর পিতার নাম ছিল আযর। হযরত লুত (আঃ) ইব্রাহীম (আঃ) এর ভাতিজা ও অনুগামী। হযরত ইসমাইল (আঃ) এর জন্মকালে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর বয়স ছিল ৮৭ বছর এবং হযরত ইসহাক (আঃ) এর জন্মকালে তাঁহার বয়স ছিল ১০০ বছর। হযরত ইব্রাহীম (আঃ)এর বয়স ছিল ১৭৫ বছর। কেরআনে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) সম্পর্কে বলা হয়েছে- “নিঃসন্দেহে আমি ইব্রাহীমকে প্রথম হইতেই হেদায়েত ও সৎপথের জ্ঞান দান করিয়াছিলাম এবং তাঁহার সম্বন্ধে খুব পরিজ্ঞাত ছিলাম। যখন তিনি তাঁহার পিতা ও স্বীয় কাওমকে বলিলেন এই মূর্তি গুলো কী? যাহা লইয়া তোমরা বসিয়া রহিয়াছ। তাহারা বলিল, আমরা আমাদের পূর্ব-পুরুষগনকে ইহাদেরই পূজা করিতে দেখিয়াছি। ইব্রাহিম (আঃ) বলিলেন নিঃসন্দেহে তোমরা এবং তোমাদের পূর্ব-পুরুষগন প্রকাশ্য ভ্রান্তির মধ্যে রহিয়াছে। তাহারা উত্তর করিল, তুমি কি আমাদের জন্য কোন সত্য লইয়া আসিয়াছে? না কি এমনি বিদ্রুপকারীদের মত বলিতেছ? ইব্রাহীম (আঃ) বলিলেন (এ সমস্ত মূর্তি তোমাদের প্রতিপালক নহে) বরং তোমাদের প্রতিপালক জমিন ও আসমানসমুহের পরওয়ার দিগার যিনি এই সমুদয়কে সৃষ্টি করিয়াছেন। আর আমি এই বিশ্বাসই পোষণ করিতেছি। (সুরা আম্বিয়া: ৫১-৫৬) । হযরত ইব্রাহিম (আঃ) দেখলেন শিরকের সর্বাপেক্ষা প্রধান কেন্দ্র তাঁহার নিজের ঘরে বর্তমান। আর আযরের মুর্তি নির্মাণ ও মূর্তিপূজা গোটা কাওমের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র ও মেরুদন্ড হয়ে রয়েছে। সুতরাং এটাই সুকৌশল হবে যে সত্যের প্রতি আহবান এবং সত্যের পয়গাম প্রচার নিজের ঘর হতেই আরম্ভ করা। তিনি তার পিতাকে সত্যের পথে আহবান করলেন। কিন্তু পিতা তাঁর কথায় কর্ণপাত করল না। পিতা বলিলেন- তুমি যদি মূর্তি সমুহের নিন্দাবাদ হইতে বিরত না হও, তবে আমি তোমাকে প্রস্তর নিক্ষেপ করে হত্যা করিয়া ফেলিব। পিতার কথা শুনে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) বললেন পিতা ! যদি আমার কথার উত্তর ইহাই হয় তবে আজ হইতে আপনাকে সালাম করিয়া পৃথক হইয়া যাইতেছি। আমি আল্ল্লাহ তায়ালার সত্য ধর্ম ত্যাগ করিতে পারিতেছি না এবং কোন অবস্থাতেই মূর্তিপূজা করিতে পারিব না। পিতা ও পুত্রের মধ্যে যখন ঐক্য হওয়ার কোনই উপায় হইল না। তখন তিনি তাঁর পিতার নিকট হইতে পৃথক হইয়া গেলেন এবং কাওমের কাছে সত্যের দাওয়াত দিলেন।

বি.দ্র.:

ইব্রাহীম আ. এর নাম (শব্দ) এসেছে কুরআনের ৬৩টি আয়াতে। আর ইব্রাহীম আ. সম্পর্কে কুরআনের ২৫টি সূরায় ২০৪টি আয়াতে আলোচনা রয়েছে।



وَإِنْ تُكَذِّبُوا فَقَدْ كَذَّبَ أُمَمٌ مِنْ قَبْلِكُمْ ۖ وَمَا عَلَى الرَّسُولِ إِلَّا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ

১৮. তোমরা যদি আমাকে মিথ্যাবাদী বল, তাহলে (জেনে রাখ,) তোমাদের পূর্ববর্তিগণও নবীদেরকে মিথ্যাবাদী বলেছিল। আর (সত্যকে) স্পষ্টভাবে প্রচার করে দেওয়াই রসূলের দায়িত্ব।



তাফসীর: এটি ইবরাহীম (আঃ)-এর উক্তিও হতে পারে যা তিনি নিজ জাতির উদ্দেশ্যে করেছিলেন। অথবা আল্লাহরও কথা হতে পারে যাতে মক্কাবাসীদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। আর এতে নবী (সাঃ)-কে সান্ত্বনা দেওয়া হচ্ছে যে, যদি মক্কার কাফেররা তোমাকে মিথ্যাবাদী মনে করে, তাহলে এতে ঘাবড়ে যাওয়ার কিছুই নেই। নবীদের সাথে এই আচরণই করা হয়ে থাকে। পূর্বের জাতিরাও তাদের নবীদেরকে মিথ্যাবাদী মনে করেছে। আর তার কুফলস্বরূপ তাদেরকে পৃথিবী হতে নিশ্চিহ্ন হতে হয়েছে।

অতএব প্রচারকদের দায়িত্ব প্রচারের কাজ চালিয়ে যাওয়া; কেউ হিদায়াতপ্রাপ্ত হোক বা না-ই হোক। এ দায়িত্ব মানুষের নয় এবং এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিতও হবে না। কারণ, হিদায়াত দান করা একমাত্র আল্লাহর এখতিয়ারভুক্ত। যিনি নিজ হিকমত ও নিয়মানুসারে যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দানে ধন্য করেন। আর অন্যদেরকে ভ্রষ্ট ও অন্ধকার পথের পথিক বানিয়ে উদভ্রান্ত ছেড়ে দেন।

বিষয়: বিবিধ

১৩৪৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File