তাফসীর: সূরা ২৯ আনকাবুত: ৮-১১ (দ্বিতীয় পর্ব) পিতা-মাতার আনুগত্য, ঈমানের পরীক্ষা
লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৬, ০২:৪৫:৩৯ রাত
بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
পরম করুনাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)
وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْنًا ۖ وَإِنْ جَاهَدَاكَ لِتُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا ۚ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
৮. আমি মানুষকে পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার জোর নির্দেশ দিয়েছি। যদি তারা তোমাকে আমার সাথে এমন কিছু শরীক করার জোর প্রচেষ্টা চালায়, যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তবে তাদের আনুগত্য করো না। আমারই দিকে তোমাদের প্রত্যাবর্তন। অতঃপর আমি তোমাদেরকে বলে দেব যা কিছু তোমরা করতে।
তাফসীর: কুরআন কারীমের বিভিন্ন স্থানে মহান আল্লাহ তাঁর একত্ববাদের ও ইবাদতের আদেশ দানের সাথে সাথে পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করারও আদেশ দিয়েছেন। যাতে একথা সুস্পষ্ট হয় যে, আল্লাহর প্রতিপালকত্ব ও উপাস্যত্বের চাহিদা তারাই সঠিকভাবে বুঝতে ও পূরণ করতে পারে, যারা পিতা-মাতার আনুগত্য ও খিদমতের চাহিদাকে বুঝে ও পূরণ করে থাকে। (আরো দ্রষ্টব্য: সূরা বনী ইসরাঈল: ২৩-২৪; সূরা নিসা: ৩৬, সূরা লুকমান: ১৪) হাদীসে এসেছে- মাতা-পিতার সন্তুুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং মাতা-পিতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি। (তিরমিযী) রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন: তিন জনের দুআ অবশ্যই কবুল হয়, তাতে কোন সন্দেহ নেই। (১) মজলুমের (২) মুসাফিরের (৩) মাতা-পিতার। (তিরমিযী)
আল্লাহর অসন্তুষ্টিতে তথা নাফরমানীতে পিতা.মাতার আনুগত্য নেই: মাতা-পিতা যদি শিরক করতে (অনুরূপ অন্যান্য পাপ করতে) আদেশ করে এবং এর জন্য তারা যদি চাপ সৃষ্টি করে, তবুও তাদের আনুগত্য করা চলবে না। সূরা লুকমানের ১৫ নম্বর আয়াতেও একই কথা বলা হয়েছে।
কেননা, لا طاعة لمخلوق في معصية الخالق অর্থাৎ, আল্লাহর অবাধ্যতায় কোন ব্যক্তির আনুগত্য চলবে না। (আহমাদ ৫/৬৬, হাকেম, সহীহুল জামে’ ৭৫২০নং) এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণ হিসাবে সা’দ বিন আবী অক্কাস (রাঃ)-এর ঘটনা বর্ণিত হয়। কারণ যখন তিনি মুসলমান হয়ে গেলেন, তখন তাঁর মাতা শপথ করেছিলেন যে, আমি আমরণ পানাহার করব না; যদি না তুমি মুহাম্মাদের নবুঅতকে অস্বীকার করেছ! শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর মাতার মুখে জোরপূর্বক খাবার পুরে দিয়েছিলেন। যার জন্য উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়। (মুসলিম)
وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَنُدْخِلَنَّهُمْ فِي الصَّالِحِينَ
৯. যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকাজ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে সৎকর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করব।
তাফসীর: যদি কারো পিতা-মাতা মুশরিক হয়, তাহলে তার মুসলিম পুত্র সৎ লোকদের সঙ্গী হবে, পিতা-মাতার সঙ্গী নয়; যদিও সে তার সংসার জীবনে মাতা-পিতার বেশি নিকটবর্তী ছিল। পিতা-মাতার প্রতি ছিল তার দুনিয়াবী (ইহসান স্বরূপ) সদ্ব্যবহার আর মুসলিমদের সাথে ছিল ঈমানী সম্পর্ক।
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَقُولُ آمَنَّا بِاللَّهِ فَإِذَا أُوذِيَ فِي اللَّهِ جَعَلَ فِتْنَةَ النَّاسِ كَعَذَابِ اللَّهِ وَلَئِنْ جَاءَ نَصْرٌ مِنْ رَبِّكَ لَيَقُولُنَّ إِنَّا كُنَّا مَعَكُمْ ۚ أَوَلَيْسَ اللَّهُ بِأَعْلَمَ بِمَا فِي صُدُورِ الْعَالَمِينَ
১০. কতক লোক বলে, আমরা আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছি; কিন্তু আল্লাহর পথে যখন তারা নির্যাতিত হয়, তখন তারা মানুষের নির্যাতনকে আল্লাহর আযাবের মত মনে করে। যখন আপনার পালনকর্তার কাছ থেকে কোন সাহায্য আসে তখন তারা বলতে থাকে, আমরা তো তোমাদের সাথেই ছিলাম। বিশ্ববাসীর অন্তরে যা আছে, আল্লাহ কি তা সম্যক অবগত নন?
তাফসীর: এখানে মুনাফিক ও দুর্বল ঈমানের লোকদের অবস্থা বর্ণনা করা হচ্ছে যে, যখন ঈমান আনার কারণে কোন আপদ-বিপদ আসে, তখন তা আল্লাহর আযাবের মতই তাদের অসহনীয় হয়ে ওঠে। যার ফলে সে ঈমান হতে ফিরে যায় এবং সাধারণের ধর্মকে বেছে নেয়।
যদি মুসলিমরা বিজয় ও আধিপত্য লাভ করে তখন তারা মুসলমানদের বলতে থাকে তোমরা তো আমাদের দ্বীনী ভাই। এ কথাটি অন্যত্র এভাবে বর্ণিত হয়েছে, ‘‘যারা তোমাদের (শুভাশুভ পরিণতির) প্রতীক্ষায় থাকে; সুতরাং আল্লাহর অনুগ্রহে তোমাদের বিজয় লাভ হলে তারা (তোমাদেরকে) বলে, ‘আমরা কি তোমাদের সঙ্গে ছিলাম না?’ আর যদি অবিশ্বাসীদের আংশিক বিজয় লাভ হয়, তাহলে তারা (তাদেরকে) বলে, ‘আমরা কি তোমাদের বিরুদ্ধে জয়ী ছিলাম না এবং আমরা কি তোমাদেরকে বিশ্বাসীদের হাত থেকে রক্ষা করিনি?’ (সূরা নিসা ১৪১আয়াত)
ওরা মুখে যাই বলুক না কেন, আল্লাহ তো বিশ্ববাসীর মনের খবর জানেন।
وَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْمُنَافِقِينَ
১১. আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন কারা বিশ্বাসী এবং কারা মুনাফিক (মুখে এক অন্তরে ভিন্ন)।
তাফসীর: এই সুরার শুরুতেই আল্লাহ পরীক্ষার কথা বলেছিলেন। এখানেও মহান আল্লাহ বলছেন (সুখ ও দুঃখ দিয়ে) আমাদেরকে পরীক্ষা করবেন, যাতে মু’মিন ও মুনাফিকের পরিচয় প্রকাশ হয়ে যায়। যে উভয় অবস্থায় আল্লাহর আনুগত্য করবে সে মু’মিন, আর যে কেবলমাত্র সুখে-সম্পদে আল্লাহর আনুগত্য করবে, সে আসলে নিজ প্রবৃত্তির অনুগত; আল্লাহর নয়। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছে,{وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّى نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِينَ مِنكُمْ وَالصَّابِرِينَ وَنَبْلُوَ أَخْبَارَكُمْ} অর্থাৎ, আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব; যতক্ষণ না আমি তোমাদের মধ্যে মুজাহিদ ও ধৈর্যশীলদেরকে জেনে নিই এবং আমি তোমাদের অবস্থা পরীক্ষা করি। (সূরা মুহাম্মাদ ৩১ আয়াত) যেমন উহুদ যুদ্ধে মুসলিমদেরকে ভীষণ পরীক্ষার সম্মুখীন করা হয়েছিল, তার পরবর্তীকালে মহান আল্লাহ বলেন,
{مَّا كَانَ اللّهُ لِيَذَرَ الْمُؤْمِنِينَ عَلَى مَآ أَنتُمْ عَلَيْهِ حَتَّىَ يَمِيزَ الْخَبِيثَ مِنَ الطَّيِّبِ} অর্থাৎ, অপবিত্র (মুনাফিক)-কে পবিত্র (মু’মিন) হতে পৃথক না করা পর্যন্ত তোমরা যে অবস্থায় রয়েছ আল্লাহ সে অবস্থায় বিশ্ববাসিগণকে ছেড়ে দিতে পারেন না। (সূরা আলে ইমরান ১৭৯ আয়াত)
দ্রষ্টব্য: তাফসীরে ইবনে কাসীর, আহসানুল কুরআন, সহীহ মুসলিম, জামে তিরমিযী।
বিষয়: সাহিত্য
৮৮৭ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন