তাফসীর: সূরা ২৯ আনকাবূত: (১-৭) ১ম পর্ব
লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৬, ০২:৩১:০৭ রাত
بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
পরম করুনাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)
الم ﴿
১. আলিফ লাম মীম। এটা হরূফে মুকাত্ত্বয়াতের (বিচ্ছিন্ন বর্ণ) অন্তর্ভূক্ত। এর অর্থ একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন।
أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ
২. মানুষ কি মনে করে যে, তারা একথা বলেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে যে, "আমরা বিশ্বাস করি" এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না?
তাফসীর: মৌখিকভাবে ঈমান আনার পর কোন পরীক্ষা না নিয়েই এমনি ছেড়ে দেওয়া হবে --এই ধারণা পোষণ করা ঠিক নয়। বরং মুমিনদের জান-মালে বিপদ-আপদ দিয়ে এবং অন্যান্য সমস্যা দিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হবে, যাতে আসল-নকল, সত্য-মিথ্যা এবং মু’মিন ও কাফেরের মধ্যে পার্থক্য সূচিত হয়।
যেমন আল্লাহ বলেন- “তোমরা কি মনে করেছ যে তোমরা কোন পরীক্ষা দেওয়া ছাড়াই জান্নাতে প্রবেশ করবে যেমনটি তোমাদের পূর্বের লোকদের পরীক্ষা করা হয়েছিলো ? তার কঠোর দারিদ্রতা ও মুশকিল দ্বারা ব্যথিত হয়েছিলো এবং এমনভাবে প্রকম্পিত হয়েছিলো যে এমনকি রসুল ও তার সাথে থাকা ইমানদারগণ বলে উঠেছিল, ‘আল্লাহ্র সাহায্য কখন আসবে?’ হ্যাঁ ! নিঃসন্দেহে আল্লাহ্র সাহায্য নিকটেই।” (সূরা ২ বাকারা :২১৪)
মুমিনদের উপর আল্লাহর পরীক্ষা: নবী-রাসূলরা সবচেয়ে বেশি পরীক্ষার মুখোমুখি হন তারপর ঈমানের দৃঢ়তার উপর ভিত্তি করে পরীক্ষা করা হয় অন্যান্য বান্দাহদের উপর। যার ঈমান যত মজবুত তার পরীক্ষাও হয় ততো কঠিন।
আল্লাহ তাআ'লা বলেন-
"এবং অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের।" (সূরা বাকারা: ১৫৫) তিনি আরো বলেন-
অবশ্য ধন-সম্পদে এবং জনসম্পদে তোমাদের পরীক্ষা হবে এবং অবশ্য তোমরা শুনবে পূর্ববর্তী আহলে কিতাবদের কাছে এবং মুশরেকদের কাছে বহু অশোভন উক্তি। আর যদি তোমরা ধৈর্য্য ধারণ কর এবং পরহেযগারী অবলম্বন কর, তবে তা হবে একান্ত সৎসাহসের ব্যাপার। (সূরা ৩ আলে ইমরান: ১৮৬)
আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেন-
যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে তোমাদের সবাইকে এক উম্মত করে দিতেন, কিন্তু এরূপ করেননি-যাতে তোমাদেরকে যে ধর্ম দিয়েছেন, তাতে তোমাদের পরীক্ষা নেন। অতএব, দৌড়ে কল্যাণকর বিষয়াদি অর্জন কর। (সূরা মায়িদা: ৪৮)
তিনি আরো বলেন:তিনিই তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছেন এবং একে অন্যের উপর মর্যাদা সমুন্নত করেছেন, যাতে তোমাদের কে এ বিষয়ে পরীক্ষা করেন, যা তোমাদেরকে দিয়েছেন। আপনার প্রতিপালক দ্রুত শাস্তি দাতা এবং তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, দয়ালু। (সূরা আনআম: ১৬৫)
প্রত্যেককে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। আমি তোমাদেরকে মন্দ ও ভাল দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি এবং আমারই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে। (সূরা ২১ আম্বিয়া: ৩৫)
কুরআনের অনেক আয়াতে পরীক্ষা নেওয়ার কথা এসেছে, সুতরাং এমনটা মনে করা উচিত নয় যে, কাউকেই পরীক্ষা ছাড়া ছেড়ে দেয়া হবে। তিনি মানুষের উপর বিপদাপদ, কষ্ট দিয়ে পরীক্ষা করবেন যে, কে সব সময় আল্লাহর বিধান সবকিছুর উপর প্রাধান্য দেয়!
আল্লাহ পরবর্তীতে পূর্ববতী জাতির উপর করা পরীক্ষার কথা উল্লেক করে নব মুসলিমদের কষ্ট সহ্য করে ঈমানের পথে সৎ আমল করার বলেন!
وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّـهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ
৩. আমি তাদেরকেও পরীক্ষা করেছি, যারা তাদের পূর্বে ছিল। আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন যারা সত্যবাদী এবং নিশ্চয়ই জেনে নেবেন মিথ্যুকদেরকে।
তাফসীর: এই সকল আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণ সম্পর্কে যে বর্ণনা রয়েছে তাতে বলা হয়েছে যে, সাহাবা (রাঃ) রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট মক্কার কাফেরদের অত্যাচার ও উৎপীড়নের কথা অভিযোগ করে দু’আর আবেদন জানালেন, যাতে আল্লাহ তাঁদের সাহায্য করেন। তিনি বললেন, দুঃখ-কষ্ট ভোগ করা ঈমানদারদের ইতিহাসের একটি অংশ। তোমাদের পূর্বের কোন কোন মু’মিনকে গর্ত খুঁড়ে তার মধ্যে দাঁড় করিয়ে করাত দিয়ে তাকে দু’ফাঁক করে দেওয়া হয়েছে। অনুরূপ লোহার চিরুনি দিয়ে তাদের শরীর হতে গোশত আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই সমস্ত অত্যাচার তাদেরকে হক পথ হতে ফেরাতে পারেনি। (বুখারীঃ আম্বিয়ার হাদীস অধ্যায়) আম্মার, তাঁর মাতা সুমাইয়্যাহ ও পিতা ইয়াসির, সুহায়েব, বিলাল ও মিকদাদ (রাঃ) ইত্যাদি সাহাবাদের উপর ইসলামের প্রারম্ভিক যুগে যে অত্যাচারের পাহাড় ভাঙ্গা হয়েছিল তা ইতিহাসের পাতায় আজও সংরক্ষিত আছে। এই পরিস্থিতি ও ঘটনাবলীই এসব আয়াতের অবতীর্ণ হওয়ার কারণ। পরন্তু আয়াতের সাধারণ অর্থের দিক দিয়ে কিয়ামতের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সকল ঈমানদারও এতে শামিল। অর্থ্যাৎ সকল ঈমানদারদের পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে।
أَمْ حَسِبَ الَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ أَن يَسْبِقُونَا سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ
৪. যারা মন্দ কাজ করে, তারা কি মনে করে যে, তারা আমার হাত থেকে বেঁচে যাবে? তাদের ফয়সালা খুবই মন্দ।
তাফসীর: যারা মন্দ বা খারাপ কাজ করে (শরীয়াতের দৃষ্টিতে) তাদের কর্ম দেখে এটাই মনে হয় তারা আল্লাহর করায়ত্বের বাইরে বা আল্লাহ তাদের পাকড়াও করবেন না। আল্লাহ তাদের সেই ভুল ধারণা প্রকাশ করে বলেন-তাদের সিদ্ধান্ত কত মন্দ!
অর্থাৎ, আল্লাহর ব্যাপারে তাদের ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। যখন তিনি সর্বশক্তিমান ও প্রত্যেক বিষয় সম্পর্কে অবগত, তখন তাঁর অবাধ্য হয়ে তাঁর পাকড়াও এবং আযাব হতে বাঁচা কিভাবে সম্ভব?
مَن كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ اللَّـهِ فَإِنَّ أَجَلَ اللَّـهِ لَآتٍ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
৫. যে আল্লাহর সাক্ষাত কামনা করে, আল্লাহর সেই নির্ধারিত কাল অবশ্যই আসবে। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।
অর্থাৎ, যারা পরকালে বিশ্বাস করে এবং নেকী ও পুণ্যের আশায় সৎকর্ম সম্পাদন করে, আল্লাহ তাদের আশা পূর্ণ করবেন। তাদেরকে তাদের কর্মের পূর্ণ প্রতিদান দান করবেন। কেননা কিয়ামত অবশ্যই অনুষ্ঠিত হবে এবং তাঁর ন্যায় বিচার নিঃসন্দেহে প্রতিষ্ঠিত হবে।
وَمَنْ جَاهَدَ فَإِنَّمَا يُجَاهِدُ لِنَفْسِهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ لَغَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ
৬. যে কেউ সংগ্রাম করে, সে তো নিজের জন্যই সংগ্রাম করে; আল্লাহ অবশ্যই বিশ্বজগতের ওপর নির্ভরশীল নন।
তাফসীর: মানুষের সত্যের পথে চেষ্টা-প্রচেষ্টা, সাধনা, কষ্ট স্বীকার সবই তার নিজের জন্য। আল্লাহ এই বিশ্বজগত ও বিশ্ববাসী থেকে বে-পরওয়া। যেমন সূরা জাসিয়াতে বলেন- যে সৎকাজ করছে, সে নিজের কল্যাণার্থেই তা করছে, আর যে অসৎকাজ করছে, তা তার উপরই বর্তাবে। অতঃপর তোমরা তোমাদের পালনকর্তার দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে।(৪৫:১৫)
অর্থাৎ, যে ভাল কাজ করবে তার ফল সে নিজেই ভোগ করবে। তাছাড়া আল্লাহ বান্দাদের কোন কাজের মুখাপেক্ষী নন। যদি পৃথিবীর সবাই আল্লাহর পরহেযগার বান্দা হয়ে যায়, তাহলে তার ফলে তাঁর রাজ্যের শক্তি বৃদ্ধি হবে না। আর যদি সকল মানুষই আল্লাহর নাফরমান ও অবাধ্য হয়ে যায়, তাহলেও তাঁর রাজ্যে কোন প্রকার কমি আসবে না। শাব্দিক অর্থের দিক দিয়ে এতে কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদও শামিল। কারণ, এটিও অন্যতম সৎকর্ম।
وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَنُكَفِّرَنَّ عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَحْسَنَ الَّذِي كَانُوا يَعْمَلُونَ
৭.আর যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আমি অবশ্যই তাদের মন্দ কাজ গুলো মিটিয়ে দেব এবং তাদেরকে কর্মের উৎকৃষ্টতর প্রতিদান দেব।
তাফসীর: মহান আল্লাহ সমস্ত সৃষ্টি হতে অমুখাপেক্ষী। কিন্তু তিনি কেবল কৃপা ও অনুগ্রহ করে ঈমানদারদের উত্তম প্রতিদান দেবেন এবং এক একটি পুণ্যের কয়েক গুণ বেশি সওয়াব দান করবেন। যেমন অন্য আয়াতে বলেন -
পূর্ণ কাজ অবশ্যই পাপ দূর করে দেয় (সূরা ১১ হুদ: ১১৪)
যে একটি সৎকর্ম করবে, সে তার দশগুণ পাবে এবং যে, একটি মন্দ কাজ করবে, সে তার সমান শাস্তিই পাবে। বস্তুতঃ তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না। (৬:১৬০)
বিষয়: বিবিধ
১২১৮ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন