সূরা ২ বাকারা(আয়াত: ৬৫)এর শিক্ষা ও বতর্মানে ঘুষের নানা কৌশল!
লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ১৮ মে, ২০১৬, ০২:৩৮:৫৮ রাত
বনু ইসরাঈলদের জন্য শনিবার ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন এবং ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট ও পবিত্র দিন। এ দিন তাদের জন্য মৎস্য শিকার নিষিদ্ধ ছিল। তারা সমুদ্রোপকুলের বাসিন্দা ছিল এবং মৎস্য শিকার ছিল তাদের পেশা। কিন্তু পরীক্ষার জন্য শনিবার দিন বেশি বেশি মাছ পানির উপর ভেসে উঠত। আর এদিন পার হলে এমনটি আর হত না। শেষ পর্যন্ত ইয়াহুদীরা এক চালাকি অবলম্বন করে আল্লাহর আদেশ লংঘন করল। তারা সমুদ্র সংলগ্নে খাল খনন করে ফাঁদ পেতে ছিল, ফলে শনিবার তাতে মাছ প্রবেশ করে ফেঁসে যেত। অতঃপর শনিবার গত হলেই তা শিকার করত। ফলে আল্লাহ তাদের কঠোরভাবে পাকড়াও করলেন এবং বানরের রূপান্তর করে দিলেন।
(দ্রষ্টব্য: সূরা ২ বাকারাহ: ৬৫; সূরা ৭ আরাফ: ১৬৩-১৬৬ এর তাফসীর)
আয়াতের শিক্ষা ও বর্তমানে বাহানাকারীদের অবস্থা:
যারা নানান কৌশলে সুদ- ঘুষ গ্রহণ ও প্রদান করেন; যারা নানান কৌশলে অপরের জমি দখল করেন, যারা সেবার নামে খাসজমি ব্যবহার করেন, যারা পেশাগত দায়িত্বে নানা কৌশলে উপড়ি কামান বা কাজে ফাঁকি দেন তারা কি ব্যাপারটা ভেবে দেখবেন?
বর্তমান সমাজে উপহার, উপঢৌকন, টিপস, বখশিস, উপড়ি আয়/ কামাই, নজরানা, হাদীয়া, তোহফা ইত্যাদির কৌশলে ঘুষ প্রচলিত।
১. ঘুষ দেওয়া এবং নেওয়া দুটোই হারাম এবং তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর লা'নত; এটা আমরা সবাই জানি। তবুও আমরা ফাঁদে পড়ে(বাধ্য হয়ে) বা ইচ্ছাকৃতভাবে (চাকুরীর জন্য, টাকা উত্তোলনের জন্য, সরকারী সেবা নিতে) ঘুষ দিচ্ছি আর একপ্রকার লোক " নজরানা বা উপহারের নামে তা গ্রহণ করছে।
ইহুদী জাতির মতো আমরাও কৌশল গ্রহণ করছি, অথচ আমাদের কৌশল আল্লাহর কাছে প্রকাশিত! যারা বাধ্যগত কারণে দেন তারা হয়তো মাফ পেতে পারেন কিন্তু যারা তাড়াতাড়ি ফাইল ছাড়াতে, চাকুরী পেতে, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির সংযোগ নিতে ইচ্ছাকৃতভাবে ঘুষ দেন (নানা নামে) তাদের কী অবস্থা হবে?
আমরা সবাই একে অপরের কাঁধে দোষ চাঁপিয়ে খালাস পেতে চাই, কেউ প্রতিরোধ, প্রতিবাদ করি না।
যারা চিকিৎসা সেবায় আছেন (মানুষ বা পশুর) তারা নানান বাহানায় জনগণের কাছ থেকে উৎকোচ/ পারিশ্রমিক/ উপহার/ Gift নিচ্ছেন, ঔষূধ কোম্পানীর কাছ থেকে উপহার/উপঢৌকন নিচ্ছেন(?) অথচ আপনি যদি চিকিৎসক বা সেবাদাতা না হতেন তাহলে বিভিন্ন কোম্পনী আপনাকে কিছুই দিতো না।
আপনি যখন চাকুরী করবেন তখন ভিন্ন উপায়ে নানা কৌশলে মানুষের সেবা দিয়ে বাড়তি আয় করাও ঘুষ আর সুদের অন্তর্ভুক্ত।
এই হাদীসটি ভালো করে বুঝুন আর ভাবুন তো বর্তমানে কারা কারা এর আয়ত্বাধীন-
আবু হোমায়েদ আসসায়েদী থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবনুল লুতবিয়্য নামে আসাদ গোত্রের জনৈক ব্যক্তিকে যাকাত আদায়ের জন্য নিয়োগ করেন। অতঃপর আদায় শেষে সে ফিরে এসে বললো, এটুকু তোমাদের জন্য আর এটুকু আমাকে হাদীয়া দেয়া হয়েছে। একথা শুনে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বরে দাঁড়িযে গেলেন এবং আল্লাহর প্রশংসামূলক বাক্য উচ্চারণের পর বললেন, ব্যাপার কি? আমি কোন একজনকে যাকাত আদায়ের জন্য কর্মচারী হিসেবে পাঠাই, আর সে এসে বলে এটা তোমার, আর ওটা আমার। সে তার বাবা-মায়ের ঘরে বসে থাকুক দেখুক, তাকে কোন হাদীয়া দেয়া হয় কিনা? যে সত্ত্বার হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ। সে যা কিছুই এ থেকে গ্রহণ করবে, কিয়ামতের দিন তা ঘাড়ের উপর বহন করে উপস্থিত হবে। যদি তা হয় উট, তাহলে উটের ন্যায় চিৎকার করতে থাকবে, আর গাভী হলে হাম্বা রব করতে থাকবে কিংবা ছাগল হলে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করতে থাকবে। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’হাত উপরে তুললেন। ফলে আমি তার বগলের নিচের সাদা অংশ দেখতে পেলাম। তিনবার তিনি বললেন, আমি কি পৌছিয়েছি। ( ‘সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম।)
যারা সরকারী চাকুরীরত অবস্থায় বা কোনো প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বরত অবস্থায় আলাদাভাবে মানুষকে চিকিৎসা বা নানান সেবা দিয়ে অর্থ আয় করে থাকেন তারাও ঘুষ ও সুদের সাথে জড়িত।
বিভিন্ন সেবাকারী প্রতিষ্ঠানের লোকজন (চিকিৎসা,বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, ডাক) লোকজন এই অপরাধে বেশি জড়িত। আজকাল কোনো সরকারী সেবাই পাওয়া যায় না ঘুষ ছাড়া। আর তাই অনেক নিরীহ ও সৎলোকদের বাধ্য হয়ে এসব কাজে জড়াতে হয়!
অনেকে চাকুরীর জন্য ঘুষ দেন। একটু নিজের বিবেককে কাজে লাগান। চাকুরী ছাড়াও আপনার জন্য জীবিকার পথ আল্লাহ প্রশস্ত রেখেছেন।
আবদুর রহমান ইবনে আওফ রা. বর্ণনা করেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘নিকৃষ্ট ও মন্দ উপার্জনে যে দেহ উঠবে, জাহান্নামই হবে তার উৎকৃষ্ট স্থান।’ প্রশ্ন করা হলো- নিকৃষ্ট ও মন্দ উপার্জন করি? উত্তরে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-‘প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ঘুষ।’ ‘হাদীসটি বাযযার তার মুসনাদ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।’ আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ঘুষ গ্রহণ করবে, তারও বেহেশতের মাঝে সেই ঘুষ বাধা হয়ে থাকবে।’
২.দায়িত্বপ্রাপ্ত/ নেতা/ কর্মকর্তাদের জন্য উপহার (কোনো উপকারের বিনিময়ে বা ফায়দা হাসিলের জন্য) সুদের অন্তর্ভুক্ত।
উমর ইবনে আবদুল আজীজকে হাদীয়া দেয়া হলে তিনি তা ফেরত দেন এবং ‘নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীয়া গ্রহণ করতেন’ এ প্রশ্ন তাকে করা হলে তিনি বলেন, ‘নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রদত্ত উপঢৌকন তাঁর জন্য হাদীয়াই ছিল, কিন্তু আমাদের জন্য তা হবে ঘুষ। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হাদীয়া দেয়ার মাধ্যমে প্রদানকারী তাঁর ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করতেন তাঁর নবুওয়াতের কারণে, প্রশাসনিক কোন উদ্দেশ্যে নয়। কিন্তু আমাদেরকে হাদীয়া প্রদান করা হয় প্রশাসনিক কোন বিশেষ উদ্দেশ্য চরিতার্থের জন্য’। ‘মুইনুল হুক্কাম পৃ: ১৭।’
৩.যে সব নেতারা/ দায়িত্বপ্রাপ্তরা অন্যকে লেনদেনের/ সুবিধা প্রদানের বিনিময়ে সুপারিশ করেন তারাও এর অর্ন্তভূক্ত।
৪. কোনো পরিষেবা গ্রহণ করে (যেমন- হোটেলের বয়দের কাজ থেকে বেশি সেবা/ ভালো খাবার/ বেশি মনোযোগ/ অতিরিক্ত ফায়দা/ মালিককে ঠকানোর পথ বের করার জন্য....ইত্যাদি) সেবাদাতাদের (খুশির নামে/ মনের ইচ্ছায় !!) টিপস বা বখশিস দেয়াও সুদের অন্তর্ভুক্ত।
৫. কোনো পরিষেবা পেতে (বাধ্যগত কারণে না হলে, তাড়াতাড়ি ও সিরিয়ালের আগে) যা দেয়া হবে সবই ঘুষের অর্ন্তভুক্ত।
এমনই ভাবে অন্যান্য সকল খাতের অবস্থা! সংক্ষেপের জন্য আর তালিকা দিলাম না। আপনারাই বিবেচনা করুন।
আমাদের কাজ যেমন এমন গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকা তেমনি অপরকে এমন কাজ থেকে বিরত রাখা/ রাখার চেষ্টা করা। তা না হলে আমরাও আল্লাহর গযবে পতিত হবো। সূরা আরাফের পরবর্তীতে তাই বলছেন-
আর স্মরণ কর, যখন তাদের একদল বলেছিল, ‘আল্লাহ যাদেরকে ধ্বংস করবেন কিংবা কঠোর শাস্তি দেবেন তোমরা তাদেরকে সদুপদেশ দাও কেন?’ তারা বলেছিল, ‘তোমাদের প্রতিপালকের নিকট দোষ মুক্তির জন্য এবং যাতে তারা সাবধান হয় এ জন্য।’ (সূরা ৭ আ'রাফ:১৬৪)
পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ বলেন-
যে উপদেশ তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল তারা যখন তা বিস্মৃত হল,তখন যারা মন্দ কাজে বাধা দান করত, তাদেরকে আমি উদ্ধার করলাম এবং যারা অত্যাচারী ছিল, তারা সত্যত্যাগ করত বলে আমি তাদেরকে কঠোর শাস্তির সাথে পাকড়াও করলাম। (সূরা ৭ আ'রাফ: ১৬৫)
এতে স্পষ্ট বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধকারীদের পক্ষাবলম্বন না করে নিরপেক্ষতা অবলম্বনকারী ব্যক্তিগণ যালেম ও ফাসেকদের সাথেই আল্লাহর গযবে ধ্বংস হবে। যদিও কিছু বিজ্ঞলোক বলেছেন- এতে শুধু পাপাচারীরা ধ্বংস হয়েছিল।
বানরে রূপান্তরদের পরিণতি: ছহীহ মুসলিমে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, একদা কয়েকজন ছাহাবী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে রাসূল! এ যুগের বানর-শূকরগুলো কি সেই আকৃতি পরিবর্তিত ইহুদী সম্প্রদায়? তিনি বললেন, আল্লাহ তা‘আলা যখন কোন সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেন, কিংবা তাদের উপরে আকৃতি পরিবর্তনের আযাব নাযিল করেন, তখন তাদের বংশধারা থাকে না। আর বানর-শূকর পৃথিবীতে পূর্বেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে।[মুসলিম, ‘তাক্বদীর’ অধ্যায় হা/৬৭৭০] ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, তারা খায় না, পান করে না এবং তিন দিনের বেশী বাঁচে না। (কুরতুবী, তাফসীর সূরা বাক্বারাহ ৬৫, পৃ: ১/৪৭৯)
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সত্য বুঝার তাওফিক দিন।
(সহায়ক গ্রন্থ: তাফসীরে ইবনে কাসীর, তাফসীরে মারেফুল কুরআন, সহীহ মুসলিম, জামে আত তিরমিযী)
বিষয়: বিবিধ
১৬৫৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন