শবে বরাত ও একটি পর্যালোচনা
লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ১৬ মে, ২০১৬, ০১:১৪:২২ রাত
শবে বরাত নামে আমাদের উপমহাদেশে বেশি পরিচিত হলেও হাদিসের যেসব বিবরণ পাওয়া যায়, সর্বত্র এর উল্লেখ এসেছে লাইলাতুল নিস্ফি মিন শা'বান বা শাবানের মধ্য রজনী হিসেবে।কুরআনের কোথাও শাবানের এই রাতের কথা নেই বা কোনো ফযীলাত বর্ণিত হয়নি। যারা বলে তারা সূরা দুখানের একটি আয়াতের অপব্যাখ্যা করে। দ্রষ্টব্য: সূরা দুখান: ২-৫ আয়াতের তাফসীর, যে কোনো নির্ভরযোগ্য তাফসীর গ্রন্থ।
এ ক্ষেত্রে হাদীসের কিতাবে দুই ধরণের বর্ণনা পাওয়া যায়। কিছু ফযীলাত সম্পর্কিত আর কিছু ইবাদতের বিশেষ পদ্ধতির বর্ননা স্বরূপ। দ্বিতীয় পর্যায়ের হাদীস বাতিল বলে সকল ইমাম ও মুজতাহিদগণ মত দিয়েছেন এবং তা নির্ভরযোগ্য কোনো হাদীসের কিতাবের বর্ননা পাওয়া যায় না।
প্রথম পর্যায়ের হাদীস আবার দুই ধরণের। কিছু বর্ণনা কিছু মুহাদ্দিসগণের মতে সহীহ এবং এই রাতের ফযিলাত প্রতিষ্ঠিত হয়। আর দ্বিতীয় পর্যায়ের বর্ণনা পরিত্যজ্য। শায়েখ নাসিরুদ্দীন আলবানী সহ পূর্বতন অনেক ইমাম এই রাত (মধ্য শাবানের রাত) সম্পর্কে বলেছেন, অনেক হাদীসের একত্রতায় এই রাতের বিশেষ কোনো গুরুত্ব বুঝালেও (মানে, বিশেষ মর্যাদা রয়েছে) তবে বিশেষ কোনো ইবাদত নেই এবং কোনো অনুষ্ঠানও নেই।
আসুন হাদীসের বর্ণনাগুলো দেখি এবং পরবর্তীতে এই রাতের করণীয় সম্পর্কে জানি।
মধ্য-শাবানের রাতের ফযীলাতের হাদীস:
عن مالك من يخامر , عن معاذ بن جبل, عن النبى (, قال : يطلع الله الى خلقه فى ليلة النصف من شعبان, فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن
১. মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম স. বলেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন।
(দ্রষ্টব্য: সহীহ ইবনে হিব্বান:১৩/৪৮১, হা-৫৬৬৫; ইমাম বাইহাকির শুআবুল ঈমান: ৩/৩৮২, হা-৩৮৩৩; ইমাম তাবরানীর আল-মুজামুল কাবীর :২০/১০৮-১০৯)
ইমাম ইবনে হিব্বান একে সহীহ বলেছেন। (দেখুনঃ ইবনে রজব রচিত লাতায়েফুল মাআরিফ, ১/২২৪)
পর্যালোচনা:
ইমাম ইবনে হাজার হাইসামী (রঃ) বলেছেনঃ হাদিসটিকে ইমাম তাবরানী মুজাম আল কাবির এবং আল আওসাত এ বর্ণনা করেছেন এবং উভয় হাদিসের রাবীগণ সিকাহ (বিশ্বস্থ)। (দেখুনঃ মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৮/৬৫)
ইমাম মুনযিরী, ইবনে রজব, কাস্*তাল্লানী, যুরকানী এবং অন্যান্য হাদীস বিশারদ এই হাদীসটিকে আমলযোগ্য বলেছেন। (দেখুনঃ আততারগীব ওয়াততারহীব ২/১৮৮; ৩/৪৫৯; শারহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যা ১০/৫৬১)
শাইখ শুয়াইব আল আরনাউত (রঃ) হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন। (দেখুনঃ আল ইহসান ফি তারিক সাহিহ ইবনে হিব্বান, ১২/৪৮১, হাদিস নম্বরঃ ৫৬৬৫)
শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী (রহঃ) সিলসিলাতুল আহাদসিস্ সাহীহা ৩/১৩৫-১৩৯
২. আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসুল (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং বিদ্বেষ পোষণকারী ও হত্যাকারী ব্যতীত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (দ্রষ্টব্য: মুসনাদে আহমাদ ২/১৭৬, হাদিস নম্বরঃ ৬৬৪২)
পর্যালোচনা: শাইখ আহমেদ শাকির তার মুসনাদে আহমেদের তাহকীকে হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন।
শাইখ আলবানী হাদিসটিকে ‘হাসান’ সাব্যস্থ করেছেন। (দেখুনঃ সিলসিলা আহাদিস আস সাহীহা ৩/১৩৬)
একই রকম হাদিস বর্ণিত হয়েছে হজরত আবু বকর (রাঃ) থেকে যেখানে তিনি বলেছেনঃ রাসুল (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং বিদ্বেষ পোষণকারী ও হত্যাকারী ব্যতীত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (দ্রষ্টব্য: আত তারগীব ৩/৪৫৯)
একই রকম হাদিস বর্ণিত হয়েছে আবু মুসা আশয়ারী (রাঃ) থেকে যেখানে তিনি বলেছেনঃ রাসুল (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন।(সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৩৯০)
উপরে বর্ণিত দুটি বর্ণনাই হাসান পর্যায়ের।
শবে বরাতের ব্যাপারে সলফে সালেহীনদের মতামতঃ
সলফে সালেহীনদের মধ্যে অনেকে এই রাতের বিশেষত্ব বর্ণনা করেছেন। যেমনঃ উমার বিন আব্দুল আজিজ (রঃ), ইমাম শাফেয়ী (রঃ), ইমাম আওযায়ী (রঃ), আত্তা ইবনে ইয়াসীর (রঃ), ইবনে তাইমিয়া (রঃ), ইবনে রজব আল হাম্বলী (রঃ), হাফিজ জয়নুদ্দিন আল ইরাকী (রঃ)। (দেখুনঃ হাফিজ ইবনে রজব রচিত লাতায়েফুল মায়ারিফ ২৬৩-২৬৪ পৃষ্টা ও ফায়জুল ক্বাদীর ২/৩১৭)
ক) ইমাম শাফেয়ী (রঃ) বলেছেনঃ
(قال الشافعي) وبلغنا أنه كان يقال: إن الدعاء يستجاب في خمس ليال في ليلة الجمعة وليلة الاضحى وليلة الفطر وأول ليلة من رجب وليلة النصف من شعبان {الأم – الامام -ج 1 الصفحات: 264}
আমাদের কাছে যেসব কথা পৌঁছেছে, (তার মধ্যে এটাও আছে যে) নিশ্চয়ই দুয়া ৫ টি রাতে কবুল হয়। জুমুয়ার রাত, ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর এর রাত, রজবের ১ম রাতে ও শাবান মাসের ১৫ তারিখ রাতে। (দেখুনঃ আল উম্ম ১/২৩১)
খ) ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রঃ) বলেছেনঃ
لكن الذي عليه كثير من أهل العلم، أو أكثرهم، من أصحابنا وغيرهم -على تفضيلها، وعليه يدلنص أحمد، لتعدد الأحاديث الواردة فيها، وما يصدق ذلك من الآثار السلفية، وقدروي بعض فضائلها في المسانيد والسنن . وإن كان قد وضع فيها أشياء أخر.فأما صوم يوم النصف مفردًا فلا أصل له، بل إفراده مكروه
(কেউ কেউ বলেছেন, এই রাতের সাথে বছরের অন্যান্য রাতের কোন পার্থক্য নেই) কিন্তু অনেক আলিম ও আমাদের মাজহাবের (হাম্বালী মাজহাবের) আলিমগণ এবং আরো অনেকের এই রাতের মর্যাদার ব্যাপারে একমত। এ ব্যাপারে অনেক হাদিস উপস্থিত থাকায় ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বালের মতও এটাই। সলফে সালেহীনদের কথা থেকেও যা প্রমাণিত হয়েছে। এই রাতের বিশেষত্ব কিছু কিছু সুনান ও মুসনাদ হাদিস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। এই (রাতের মর্যাদার) ব্যাপারটি সত্য যদিও এ ব্যাপারে অন্যান্য যা বর্ণিত হয়েছে সেগুলি মিথ্যা। আর শুধু ১৫ তারিখ দিনে আলাদা রোযা রাখা এ ব্যাপারে কোন দলীল নেই, বরং এই দিনকে রোযার জন্য আলাদা করা মাকরুহ। (দেখুনঃ ইক্*তিযাউস সিরাতিল মুস্তাকিম ২/৬৩১-৬৪১)
গ) ইমাম সুয়ুতী (রঃ) বলেছেনঃ শাবান মাসের ১৫ তারিখ রাতের ব্যাপারে কথা হলো এর অনেক ফজীলাত রয়েছে, এবং এই রাতের কিছু অংশ নফল ইবাদাতে কাটানো উত্তম। … যদি এই ইবাদাত অবশ্যই একাকী করতে হবে, জামায়াতে করা যাবে না। (দেখুনঃ হাকীকাতুস সুন্নাহ ওয়াল বিদয়াহ, ৫৮ পৃষ্টা)
ঘ) ইমাম আলাউদ্দিন আল সাকাফী (রঃ) বলেনঃ নফল নামাজ পড়া যায় … দুই ঈদের রাতে, শাবান মাসের ১৫ তারিখ রাতে, রমজান মাসের শেষ ১০ রাতে ও জিলহজ্জ্ব মাসের প্রথম ১০ রাতে। (দেখুনঃ দুররুল মুহতার ফি শারহ তানভীন আল আবছার, উল্লেখ্য এই কিতাবের বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ ইবনে আবেদীন (রঃ) রচিত রাদ্দাল মুহতার যা শরহে ইবনে আবেদীন / ফতোয়ায়ে শামী নামেও পরিচিত হানাফী মাজহাবের প্রসিদ্ধ ফিকহ গ্রন্থ)
ঙ) ইমাম নববী (রঃ) তার ফতোয়ার কিতাব আল-মাজমুতেও ইমাম শাফেয়ী (রঃ) উক্তি উলেখ করেছেন।
উপরে উল্লেখিত হাদীস ছাড়াও আরো হাদীস পাওয়া যায় এই জাতীয় ফযীলাত বা বিশেষ ফযীলাত ও ইবাদতের। সবগুলোই বানোয়াট বা পরিত্যাজ্য বর্ণনাসূত্রে বর্ণিত। যা হাদীসের ইমামরা আলোচনা-সমালোচনা করেছেন।
পর্যালোচনা-
[b]প্রথম কথা:
[/b]এখন আমরা উপরে বর্নিত সহীহ বা হাসান সনদের হাদীসের ভিত্তিতে বলতে পারি যে, মধ্য-শাবানের রাতের ফযিলাত রয়েছে, এবং মুশরিক ও বিদ্বেষীলোক ছাড়া সকল মুমিনের জন্যই তা প্রযোজ্য।
এ সকল হাদীসের কোথাও এ কথা নেই যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরাম এ রাতে গোসল করেছেন, মাসজিদে উপস্থিত হয়ে নফল সালাত আদায় করেছেন, যিক্র-আযকার করেছেন, কুরআন তিলাওয়াত করেছেন, সারারাত জাগ্রত থেকেছেন, ওয়াজ নাসীহাত করেছেন কিংবা অন্যদের এ রাতে ইবাদাত বন্দেগীতে উৎসাহিত করেছেন অথবা শেষ রাতে জামাতের সাথে দু'আ-মুনাজাত করেছেন।
দ্বিতীয় কথা: কুরআন ও সহীহ হাদীসের কোথাও বর্ণিত হয় নি যে, ইসলামে বিশেষ কোনো রাতের বিশেষ কোনো ইবাদত রয়েছে। সেটা কদরের রাত হৌক আর শাবানের রাত হৌক!
তৃতীয় কথা: ইবাদতের সংখ্যার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো বান্দাহর ইখলাস বা অন্তরের বিশুদ্ধতা, পদ্ধতিগত শুদ্ধতা এবং পরিপূর্ণ আত্মশুদ্ধিতা। এর মানে হলো- ইবাদত হবে রাসূলের পদ্ধতিতে এবং একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য।যেমন সালাতে দীর্ঘ কিয়াম, কিরাত; দীর্ঘ রূকু বা সাজদা করা ইত্যাদি।
চতুর্থ কথা: ইসলাম কোনো প্রথা বা অনুষ্ঠান সর্বস্ব ধর্মের নাম নয় যে, বিধর্মীদের দেখাদেখি আমাদেরও অনুষ্ঠান সর্বস্ব দ্বীন পালন করব। ইসলাম পরিপূর্ণ আনুগত্যের ভিত্তিতে আল্লাহর তাওহীদ বা একত্ববাদের নাম, ইবাদতসর্বস্ব এক অনুপম আদর্শের নাম যার দৃষ্টান্ত হলেন-রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
পঞ্চম কথা: শবে বরাতের নামে কেন ইবাদত করবেন? নফল সালাত আপনি প্রতিরাতের শেষ তৃতীয়াংশে করতে পারেন, কুরআন তেলাওয়াত করতে পারেন, আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা সহ সকল দুআ করতে পারেন। কেননা আবূ হুরাইরা (রাঃ) বর্ণিত বুখারী ও মুসলিমের হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ তা‘আলা প্রতি রাতের শেষ অংশে দুনিয়ার আকাশে আসেন বলতে থাকেনঃ কে আছ আমার কাছে দু‘আ করবে আমি কবুল করব। কে আছ আমার কাছে চাইবে আমি দান করব। কে আছ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করব। । আর রোযা রাখতে চাইলে, আইয়ামে বীজের তিনটি রোযা –প্রতিমাসের ১৩, ১৪, ১৫ – রাখতে পারেন। এর পক্ষে সহীহ হাদিসের দলিল রয়েছে। শুধু একটি না রেখে এ তিনটি বা তার চেয়েও বেশী রোযা রাখতে পারলে আরও ভাল। আর শা’বান মাসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সবচেয়ে বেশী পরিমাণ নফল রোযা রেখেছেন।
৬ষ্ঠ কথা: এই রাত উপলক্ষ্যে কোনো ওয়ায বা নসীহত করাও বিদআত! যা রাসূল করেন নি, খুলাফায়ে রাশেদীন করেন নি তা আমাদের জন্য অনুসরণীয় হতে পারে না।
৭ম কথা: শবে বরাত নামটাও খারাপ! ফার্সি শব্দে এই রাতের মানে দাড়ায় সুভাগ্য বা ভাগ্য-রজনী! আমরা জানি ভাগ্যরজনী হলো কদরের রাত। এই নামের কারণেই আমাদের সমাজে হালুয়া রুটি, মিলাদ মাহফিল, ইসালে সাওয়াব বা কবর যিয়ারতের ধূম লেগে যায়।
পরিশেষে-
আসুন ইসলামকে ভালো করে বুঝি, ইবাদত কী, ইবাদতের পদ্ধতি কী আর কোন পদ্ধতিতে করলে কবুল হবে, তা জানি। বিদআত থেকে দূরে থাকি আর সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরি।
বিষয়: বিবিধ
১৫১৪ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনাকে অসংখ্য কৃতজ্ঞতা। ভালো থাকুন
মন্তব্য করতে লগইন করুন