সালাতে বিনয়ী ও একাগ্রতার গুরুত্ব ও অমনোযোগী মুসুল্লীদের পরিণতি
লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ৩১ মার্চ, ২০১৬, ১২:৪৫:০৫ রাত
বর্তমান সময়ে মুসলমানদের জন্য বড় পরীক্ষা হলো দলাদলি ও বিভক্তি! আশ্চর্যজনক কথা হলো- এই ফেতনার সময়ে এসে সবাই নিজেদের হক দাবি করছে আর বিপক্ষদের বাতিল বলে সাব্যস্ত করে নিজেদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করছে। দলাদলির একটি মাধ্যম হলো সালাত"। সহীহ হাদীসের কথিত দাবিদার রা সালাতের মুস্তাহাব বিষয় নিয়ে খুবই বাড়াবাড়ি করছে আর গুরুত্বপূর্ণ রূকনগুলো নিয়ে উদাসীন (এ বিষয়ে মাযহাবীরাও কম নয়) আমাদের পূর্বতন ইমামরা যে বিষয়ে মতভেদ বা মতান্তর করেও ঐক্যবদ্ধ ছিলেন এবং মুহাদ্দিসরা সঠিক বিষয় নির্ধারণের এক পর্যায়ে বলতেন "আল্লাহই ভালো জানেন" আর আমরা এখন আমাদের বিপক্ষদের সরাসরি বাতিল বলে দিচ্ছি। আল্লাহ আমাদের বুঝার তাওফিক দিন।
সালঅতে যে সব বিষয়ে মুসুল্লীদের মনোযোগ দেওয়ার কথা ছিল যা বর্তমানে অনুপস্থিত তার মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো সালাতে শৈথিল্য ও অমনোযোগিতা!
সালাতে বিনয়ী ও একাগ্রতার (খুশু-খূযু) গুরুত্ব ও করণীয়:
মহান আল্লাহ তাআলা সফলকাম মুমিনদের গুণাবলী বর্ণনা করার ক্ষেত্রে প্রথমেই বলেন-
মুমিনগণ সফলকাম হয়ে গেছে, যারা নিজেদের নামাযে বিনয়-নম্র (সূরা ২৩ মুমিনুন:১-২)
ò خُشُوع অর্থ আন্তরিক ও বাহ্যিক (অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে) একাগ্রতা ও নিবিষ্টতা। অন্তরের একাগ্রতা হল, নামাযের অবস্থায় ইচ্ছাকৃত খেয়াল, কল্পনাবিহার ও যাবতীয় চিন্তা (সুচিন্তা, কুচিন্তা ও দুশ্চিন্তা) হতে হৃদয়কে মুক্ত রাখা এবং আল্লাহর মহত্ত্ব ও মহিমা তাতে চিত্রিত করার চেষ্ট করা। আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের একাগ্রতা হল এদিক ওদিক না তাকানো, মুদ্রাদোষজনিত কোন ফালতু নড়া-চড়া না করা, চুল-কাপড় ঠিক-ঠাক না করা। বরং এমন ভয়-ভীতি, কাকুতি-মিনতি ও বিনয়ের এমন ভাব প্রকাশ পাওয়া উচিত, যেমন কোন রাজা-বাদশা বা মহান কোন ব্যক্তিত্বের নিকট গিয়ে প্রকাশ হয়ে থাকে। (দ্রষ্টব্য: তাফসীরে আহসানুল বয়ান)
সালাতে বিনয়াবনত ও একাগ্রতার গুরুত্ব দিয়ে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘তোমরা আল্লাহর সম্মুখে দণ্ডায়মান হও বিনীতভাবে’ [সূরা ২ বাকারাহ : ২৩৮]
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন: ‘তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয়ই তা বিনয়ী-একনিষ্ঠ ব্যতীত অন্যদের উপর অতীব কষ্টকর’ [সূরা ২ বাক্বারা : ৪৫]
সালাতে অমনোযোগিতার কুফল:
সালাতে অমনোযোগিতা তথা বিনয়ী, একাগ্রতা না থাকার পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহ বলেন-
সুতরাং পরিতাপ সেই সালাত আদায়কারীদের জন্য; যারা তাদের সালাতে অমনোযোগী। ( সূরা ১০৭ মাউন: ৪-৫) পরের আয়াতে তিনি বলেন, এই শ্রেণির মুসুল্লী হলো লোক দেখানো; তারা কেবলমাত্র লোক প্রদর্শন করার জন্যই নামায পড়ে।
এই জাতীয় সালাত তো কেবল মুনাফিকদের হয়। এ জন্যই মুনাফিকদের একটি গুণ এও বর্ণনা করা হয়েছে যে, ‘‘যখন তারা (মুনাফিকরা) সালাতে দাঁড়ায় তখন শৈথিল্যের সাথে, কেবল লোক-দেখানোর জন্য দাঁড়ায় এবং আল্লাহকে তারা অল্পই স্মরণ করে থাকে।’’(সূরা ৪ নিসা: ১৪২)
সালাতে খুশুর ফজিলত ও খুশু ছেড়ে দেয়া সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«خمس صلوات افترضهن الله تعالى، من أحسن وضوءهن وصلاهن لوقتهن ، وأتم ركوعهن وخشوعهن كان له على الله عهد أن يغفر له ، ومن لم يفعل ، فليس له على الله عهد، إن شاء غفر له وإن شاء عذّبه»
“আল্লাহ তা‘আলা পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন, যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে ওজু করে, ওয়াক্ত মত সালাতগুলো আদায় করে এবং ভালোভাবে রুকু-সেজদা করে ও খুশুকে পরিপূর্ণ রূপ দেয়, তাকে ক্ষমা করে দেয়ার বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা প্রতিশ্রুতি-বদ্ধ। আর যে ব্যক্তি এগুলো করে না, তাকে ক্ষমা করার ব্যাপারে আল্লাহর কোন প্রতিশ্রুতি নেই। তিনি চান ক্ষমা করবেন অথবা তাকে আযাব-শাস্তি- দেবেন। [আহমাদ, আবুদাউদ হা/৪২৫; মিশকাত হা/৫৭০]
রাসুল সা. আরো বলেন, ‘যে সুন্দরভাবে অজু করে, অতঃপর মন ও শরীর একত্র করে (একাগ্রতার সাথে) দু’রাকআত নামাজ আদায় করে, (অন্য বর্ণনায় এসেছে- যে নামাজে ওয়াসওয়াসা স্থান পায় না) তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়। (অন্য বর্ণনায় রয়েছে, তার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়)। [নাসাঈ হা/১৫১; বুখারি হা/১৯৩৪; মিশকাত হা/২৮৭]
তিনি বলেন: ‘আল্লাহর ইবাদত কর এমনভাবে, যেন তাঁকে তুমি দেখতে পাচ্ছ। আর যদি দেখতে না পাও, তবে তিনি যেন তোমাকে দেখছেন’। [বুখারি হা/৫০; মুসলিম হা/৮; মিশকাত হা/২]
আবু কাতাদা রা. হ’তে বর্ণিত, রাসুল সা. বলেছেন, ‘নিশৃষ্টতম চোর হ’ল সেই ব্যক্তি, যে নামাজে চুরি করে। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! নামাজে কিভাবে চুরি করে? তিনি বললেন, ‘যে রুকু-সিজদা পূর্ণভাবে আদায় করে না’। [আহমাদ ;:মিশকাত হা/৮৮৫, সনদ সহি]
রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি পূর্ণভাবে রুকূ করে না এবং সিজদাতে শুধু ঠোকর দেয়, সে ঐ ক্ষুধার্ত ব্যক্তির ন্যায়, যে দু’তিনটি খেজুর খেল, কিন্তু পরিতৃপ্ত হল না’। [তাবারানি; সহিহুল জামে হা/৫৪৯২, সনদ হাসান]
এছাড়া রাসুল সা. সংক্ষেপে সালাত আদায় করতে নিষেধ করেছেন। সাথে সাথে তিনি দীর্ঘ সালাতকে সর্বোত্তম সালাত বলে আখ্যায়িত করেছেন। [মুসলিম হা/৭৫৬; মিশকাত হা/৮০০]
ধীর-স্থিরতা ব্যতীত একাগ্রতাপূর্ণ সফল সালাত আদায় করা অসম্ভব। কাকের ন্যায় ঠোকর দিয়ে আদায়শৃত সালাতে একদিকে যেমন একাগ্রতা থাকে না, অন্যদিকে তেমনি নেকী অর্জনও সুদূর পরাহত হয়ে পড়ে।
সালাতে মনোযোগি হওয়া এবং একাগ্রতার উপায়:
রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘তুমি নামাজে মৃত্যুকে স্মরণ কর। কারণ যে ব্যক্তি নামাজে মৃত্যুকে স্মরণ করবে, তার নামাজ যথার্থ সুন্দর হবে। আর তুমি সেই ব্যক্তির ন্যায় নামাজ আদায় কর, যে জীবনে শেষবারের মত নামাজ আদায় করে নিচ্ছে’। [দায়লামী; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৪২১]
রাসুল সা.-এর নিকটে জনৈক ব্যক্তি সংক্ষিপ্ত উপদেশ কামনা করলে তিনি তাকে বললেন, ‘যখন তুমি নামাজে দন্ডায়মান হবে, তখন এমনভাবে নামাজ আদায় কর, যেন এটিই তোমার জীবনের শেষ নামাজ’। [ইবনু মাজাহ; মিশকাত হা/৫২২৬, সনদ হাসান]
সালাতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত (তাকবীর থেকে সালাম) সকল কাজ রাসূলের সুন্নাত অনুযায়ী করা এবং প্রতিটি রূকনের প্রতি লক্ষ্য রাখাটাই একাগ্রতা।
জানা আবশ্যক যে, একাগ্রতা ও খুকূর পরিমাণ অনুপাতে নামাজে ছওয়াব অর্জিত হয়। রাসুল সা. বলেন,
‘মুসল্লী নামাজ আদায় করে, কেউ পায় দশভাগ নেকী, কেউ নয়ভাগ, আটভাগ, সাতভাগ, ছয়ভাগ, পাঁচভাগ, চারভাগ, তিনভাগ আবার কেউ অর্ধেক নেকী অর্জন করে’। [আহমাদ হা/১৮৯১৪; ছহীহুল জামে‘ হা/১৬২৬]
আল্লাহ আমাদের সালাতে বিনয়ী ও একাগ্র হওয়ার তাওফিক দিন এবং পরিপুর্ণ ও কামিয়াবী মুসুল্লীরূপে গণ্য করুন। আমীন!!
বিষয়: সাহিত্য
১৬৫৫ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমিন৷
মন্তব্য করতে লগইন করুন