বাংলা তাফসীর: সূরা ১৬তম নাহল আয়াত: ১০৬-১০৯ (মুরতাদ বা ধর্মত্যাগীদের ব্যাপারে ইসলামী হুকুম)

লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ২১ মার্চ, ২০১৬, ০২:৩৫:৪৯ রাত

সূরা ১৬তম নাহল আয়াত: ১০৬-১০৯ এর তাফসীর: মুরতাদ বা ধর্মত্যাগীদের ব্যাপারে ইসলামী হুকুম

مَنْ كَفَرَ بِاللَّهِ مِنْ بَعْدِ إِيمَانِهِ إِلَّا مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيمَانِ وَلَٰكِنْ مَنْ شَرَحَ بِالْكُفْرِ صَدْرًا فَعَلَيْهِمْ غَضَبٌ مِنَ اللَّهِ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ

বাংলা অনুবাদ: কেউ বিশ্বাস করার পরে আল্লাহকে অস্বীকার করলে এবং অবিশ্বাসের জন্য হৃদয় উন্মুক্ত রাখলে তার উপর আপতিত হবে আল্লাহর ক্রোধ এবং তার জন্য রয়েছে মহাশাস্তি; তবে তার জন্য নয়, যাকে অবিশ্বাসে বাধ্য করা হয়েছে, অথচ তার চিত্ত বিশ্বাসে অবিচল।১৬ঃ১০৬

ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمُ اسْتَحَبُّوا الْحَيَاةَ الدُّنْيَا عَلَى الْآخِرَةِ وَأَنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ

অনুবাদ: এটা এ জন্য যে, তারা দুনিয়ার জীবনকে আখেরাতের উপর প্রাধান্য দেয় এবং এই জন্য যে, আল্লাহ অবিশ্বাসী সম্প্রদায়কে পথপ্রদর্শন করেন না। ১৬ঃ১০৭

أُولَٰئِكَ الَّذِينَ طَبَعَ اللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ وَسَمْعِهِمْ وَأَبْصَارِهِمْ ۖ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ

অনুবাদ: ওরাই তারা; আল্লাহ যাদের অন্তর, কর্ণ ও চক্ষু মোহর করে দিয়েছেন এবং তারাই উদাসীন। ১৬ঃ১০৮

لَا جَرَمَ أَنَّهُمْ فِي الْآخِرَةِ هُمُ الْخَاسِرُونَ

অনুবাদ: নিঃসন্দেহে তারা পরকালে হবে ক্ষতিগ্রস্ত। ১৬ঃ১০৯

সংক্ষিপ্ত তাফসীরঃ আলোচ্য আয়াতটি (ইবনে আব্বাস রা.এর বর্ণনায় এবং অধিকাংশ মুফাসসিরীনদের মতে) আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.)এর ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে। ঘটনা হলো- মুশরিকরা তাকে কঠিন শাস্তি দিতে থাকে, যে পর্যন্ত না সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অস্বীকার করে। তখন তিনি নিরুপায় হয়ে ও বাধ্যগত কারণে তাদের সমর্থন করে এবং তিনি রাসূলুল্লাহ সা.-এর নিকট এসে এ ব্যাপারে ওজর পেশ করেন (মানে তিনি বাধ্য হয়ে জীবন বাঁচাতে ধর্ম ত্যাগ করেছিলেন) তখন এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (দ্রষ্টব্য: তাফসীরে ইবনে কাসীর)

আলেমদের ফতোয়া হলো- বাধ্যগত কারণে জীবন বাঁচানোর জন্য ঈমান ত্যাগ বা মুরতাদ হওয়ার ঘোষণা দেয়া যাবে (তবে অন্তরে তো একনিষ্ট ঈমান থাকবেই) আবার ঈমানের জন্য জীবনও দেয়া যাবে তবুও মুরতাদ বা বেঈমান হওয়া যাবে না। যেমনটি করেছেন বিলাল রা. তিনি শত কষ্টের পরও ঈমান ত্যাগ করেন নি। এ ব্যাপারে খুবাইব ইবনে যায়েদ আনসারীর (রা) ঘটনাও তাফসীরে এসেছে যিনি মুসালাইমা কাযযাবের নির্যাতনের স্বীকার হয়েছিলেন।

মুরতাদ বা ধর্মত্যাগের কারণঃ আল্লাহ তাআলা ১০৭ নাম্বার আয়াতে মুরতাদ হওয়ার কারণ হিসেবে দুটি বিষয় বর্ণনা করেছেন। একটি হলো- পরকালের তুলনায় দুনিয়াকে প্রাধান্য দেয়া অর্থ্যাৎ পার্থিব স্বার্থেই তারা ঈমানকে অস্বীকার করে। পৃথিবীর সম্পদ ও চাক-চিক্যময় জীবনের লোভে নিজের ঈমানের মত মহা সম্পদকে তারা তুচ্ছ মনে করে।

দ্বিতীয় কারণ হলো- আল্লাহ তাদের জন্য হেদায়েত নসীব করেন নি।

কেন মুরতাদ হয়? ইসলামের সুমহান আদর্শ থাকা স্বত্তেও কেন মুরতাদরা নিজেদের দ্বীন ত্যাগ করে?

এর উত্তরও আল্লাহ দিয়েছেন ১০৮ নম্বর আয়াতে। কারণ আল্লাহ মুরতাদদের অন্তর, কান ও চোখে মোহর মেরে দিয়েছেন এবং তারা দ্বীনের ব্যাপারে বেখবর। মানে হলো তারা দুনিয়ার লোভে পড়ে দ্বীনকে ভুলে গেছে!

এই জন্যই আমরা বর্তমান সময়ে দেখতে পাই- অনেক মুসলমান ( শিক্ষিত ও দুনিয়ামুখি) নিজেদের দ্বীনকে অস্বীকার করছে বা নবী ও রাসূলদের অবমাননা করছে বা ইসলামী বিধি-বিধানকে তুচ্ছ তাচ্ছ্বিল্য করছে।

কেননা-

তারা দ্বীনের জ্ঞানের ব্যাপারে অজ্ঞ এবং তারা তাদের মহান সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তার ব্যাপারে গবেষণা করে না।

মুরতাদের পরকালীন শাস্তির কথা কুরআনে বর্ণিত আছে ( সূরা ৩ আলে ইমরান: ৯০; সূরা ২ বাকারা: ২১৭)পরিষ্কারভাবে এবং দুনিয়ার শাস্তিও হাদীসে বর্ণিত আছে সহীহ বর্ণনার ভিত্তিতে। সুতরাং যে হাদীসকে অস্বীকার করবে সেও গোমরাহী হবে এবং তাওবা না করলে তার জন্যও কঠিন শাস্তি রয়েছে।

আল্লাহ বলেন:- "তোমাদের মধ্যে যে কেউ নিজ ধর্ম ত্যাগ করে এবং সে সত্যপ্রত্যাখ্যানকারী (কাফের)রূপে মৃত্যুবরণ করে, তাদের ইহকাল ও পরকালের কর্ম নিষ্ফল হয়ে যায়। তারাই দোযখবাসী, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।" (সূরা ২ বাকারা: ২১৭)

তাফসীরে ইবনে কাসীরে ইমাম আহমাদের বর্ণনায় বিভিন্ন হাদীস এসেছে। যে গুলো সহীহ বুখারী ও মুসলিমেও এসেছে। আমরা এখন পার্থিব শাস্তির বর্ণনা দেখব।

° আবূ কিলাবা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, ………………. আমি বললাম, আল্লাহর কসম! রাসুলাল্লাহ তিন কারনের কোন একটি ব্যতীত কাউকে হত্যা করেননি। (যথা) (অন্যায়ভাবে) কাউকে হত্যা করলে তাকে হত্যা করা হবে। অথবা যে ব্যাক্তি বিয়ের পর যিনা করে, অথবা যে ব্যাক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুল -এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ও ইসলাম থেকে ফিরে মুরতাদ হয়ে যায়। (বুখারী (ইফাঃ)/ অধ্যায়ঃ ৭৬/ রক্তপন/ হাদিস নম্বরঃ ৬৪৩২)

° ইকরামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আলী (রাঃ) এক সম্প্রদায়কে আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন। এ সংবাদ আবদুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ)-এর নিকট পৌছলে তিনি বলেন, ‘যদি আমি হতাম, তবে আমি তাদেরকে জ্বালিয়ে ফেলতাম না। কেননা, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা আল্লাহ নির্ধারিত শাস্তি দ্বারা কাউকে শাস্তি দিবে না। বরং আমি তাদেরকে হত্যা করতাম। যেমন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যাক্তি তার দ্বীন পরিবর্তন করে, তাকে হত্যা করে ফেল।’ (সহীহ বুখারী (ইফাঃ)/ অধ্যায়ঃ ৪৮/ জিহাদ/ হাদিস নম্বরঃ ২৮০৮ )

° আবূ নু’মান মুহাম্মদ ইবনু ফাযল (রহঃ) ইকরামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আলী (রাঃ)- এর নিকট একদল যিন্দীককে (নাস্তিক ও ধর্মদ্রোহী) আনা হল। তিনি তাদেরকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিলেন। এ ঘটনা ইবনু আব্বাস (রাঃ)- এর কাছে পৌঁছলে তিনি বললেন, আমি হলে কিন্তু তাদেরকে পুড়িয়ে ফেলতাম না। কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম – এর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর শাস্তি দ্বারা শাস্তি দিও না। বরং আমি তাদেরকে হত্যা করতাম। কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম – এর নির্দেশ রয়েছে, যে কেউ তার দ্বীন বদলে ফেলে তাকে তোমরা হত্যা কর।

[সূত্র- বুখারী (ইফাঃ)/ অধ্যায়ঃ ৭৭/ আল্লাহদ্রোহী ও ধর্মত্যাগীদের তউবা/ হাদিস নম্বরঃ ৬৪৫৪ )

° আবূ মূসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,.........ঘটনাক্রমে তার কাছে একজন লোক শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিল। তিনি (মু'আয ইবনে জাবাল রা.) জিজ্ঞাসা করলেন, ঐ লোকটি কে? আবূ মূসা (রাঃ) বললেন, সে প্রথমে ইহুদী ছিল এবং মুসলমান হয়েছিল। কিন্তু পুনরায় সে ইহুদী হয়ে গিয়েছে। আবূ মূসা (রাঃ) বললেন, বসুন। মু’আয (রাঃ) বললেন: না, বসব না, যতক্ষণ না তাকে হত্যা করা হবে। এটাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলুল্লাহ সা. -এর ফায়সালা। কথাটি তিনি তিনবার বললেন। এরপর তার সম্পর্কে নির্দেশ দেয়া হল এবং তাকে হত্যা করা হল। তারপর তাঁরা উভয়ই কিয়ামুল লায়ল (রাত জাগরণ) সম্পর্কে আলোচনা করলেন। ( সহীহ বুখারী (ইফাঃ)/ অধ্যায়ঃ ৭৭/ আল্লাহদ্রোহী ও ধর্মত্যাগীদের তউবা/ হাদিস নম্বরঃ ৬৪৫৫ )

হাফিজ ইবনে আসাকীর রহ. আব্দুল্লাহ ইবনে হুযাফা (রা)এর জীবনীতে তার সম্পর্কে লিখেন যে, রোমকরা তাকে বন্দী করে সম্রাটের নিকট নিয়ে গেলে সম্রাট তাকে রাজপাটের, মেয়ের বিয়ের ইত্যাদি প্রলোভন দেখান ঈমান ত্যাগের জন্য, তিনি মৃত্যুর তোওয়াক্কা করেন নি এবং খৃষ্টানও হননি। (বিস্তারিত দেখুন তাফসীরে ইবনে কাসীর)

একটি কথা পরিষ্কার বুঝতে হবে যে, মুরতাদদের দুনিয়ার শাস্তি অন‌্যান্য শাস্তির মতোই শাসক বা বিচারকের মাধ্যমে কার্যকর হবে। এখানে ব্যাক্তিগত ভাবে কেউ সাজা দিতে পারবে না। মুরতাদের হত্যা করে দিতে হবে এটা সর্ব সম্মত বিধান। সুতরাং এই শাস্তির ব্যবস্থা রাষ্ট্র না করলে রাষ্ট্রের উপরই আরোপিত হবে এবং শাসক ও বিচারকেরা পরকালে আল্লাহর মুখোমুখী হবেন।

আল্লাহ আমাদের সঠিক দ্বীন বুঝার তৌফিক দিন। আর কুরআনের অনুসারীর নামে সহীহ হাদীস ও উম্মাতের ইজমাকে অস্বীকার করা থেকে রক্ষা করুন। আমাদের সুন্নাতের উপর চলার তাওফিক দিন. আমীন!! সুম্মা আমীন।

( সামসূল আলম দোয়েল)

বিষয়: বিবিধ

১৫২৭ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

363107
২১ মার্চ ২০১৬ সকাল ০৭:৫৫
চেতনাবিলাস লিখেছেন : ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে লেখা পোস্ট পড়ে অনেক কিছুই জানা হল। আর এজন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ |
363152
২১ মার্চ ২০১৬ সন্ধ্যা ০৬:৩০
কুয়েত থেকে লিখেছেন : লেখাটি ভালো লাগলো নিয়মিত লেখা চালিয়ে যান ধন্যবাদ আপনাকে

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File