মুসলমানদের গালি দেওয়া ও জিহ্বার অসংযতা

লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০৩:৫৩ রাত

চিত্র: ১

আমার গ্রামের এক চাঁচা, কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। একদিন সকালে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলেন (বিলের অপর পারে) কে যেন তার ক্ষেত থেকে সষ্য তুলছে (হালকা কুয়াশা ও দূরের কারণে ঠিক বুঝা যাচ্ছে না)। সে গলা ছেড়ে বলে ওঠল-

কোন শালার পোতে রে! আমার ক্ষেত থেকে কে আনাচ তুলছে কোন ...বাচ্চা?????

ওপার থেকে জবাব এলো: আব্বা আমি! ( মানে চাঁচার ছোট ছেলে)

পাশ থেকে তার পরিচিতরা বলতে লাগল, কেমন হলো এবার?

এ রকমই আমাদের বেশিরভাগ লোকেরা (মুসলিম হয়েও) অহেতুক গালি-গালাজ করে থাকেন। অথচ ইসলামে গালি-গালাজ হারাম। এর কোনো বৈধ বা অবৈধ পন্থা নেই। একজন লোক ( এই রমাযানে যোহরের) নামায পড়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে প্রতিবেশীকে ( প্রতিবেশীর সামান্য অন্যায় ছিল; সে তার পানির টাংকির ওভার ফ্লোর জন্য কোনো ব্যবস্থা রাখে নি, ফলে রাস্তায় এসে পড়ত।) সমানে অশ্লীল ভাষায়, বাপ-তুলে জন্ম নিয়ে গালি দিতে লাগল। এ রকম গালি কোনো ভদ্র সমাজে দেওয়া হয় না, অথচ সেখানে ছিল শিশু ও নারী।

এখন দেখুন কী অবস্থা তার নামাযের আর রোযার?

এখন তো বক্তারাও তাদের মাহফিলে গালি-গালাজ করে থাকেন। অথচ তারা দ্বীনের পথে দা'য়ী! কী বলব? তারা পরস্পরের প্রতি অশ্লীল গালি এমনকি কাফের-মুশরিক পর্যন্ত বলে থাকে।

ইসলাম কী বলে?

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّـهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ ﴿١٠﴾ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِّن قَوْمٍ عَسَى أَن يَكُونُوا خَيْرًا مِّنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِّن نِّسَاءٍ عَسَى أَن يَكُنَّ خَيْرًا مِّنْهُنَّ وَلَا تَلْمِزُوا أَنفُسَكُمْ وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيمَانِ وَمَن لَّمْ يَتُبْ فَأُولَـئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ

অর্থ: মুমিনরা তো পরস্পর ভাই-ভাই। অতএব, তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করবে এবং আল্লাহকে ভয় করবে-যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।

মুমিনগণ, কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাদের মন্দ নামে ডাকা গোনাহ। যারা এহেন কাজ থেকে তওবা না করে তারাই যালেম। (সূরা ৪৯ হুজুরাত: ১০-১১)

مَّا يَلۡفِظُ مِن قَوۡلٍ إِلَّا لَدَيۡهِ رَقِيبٌ عَتِيدٞ

অর্থাৎ মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে (তা লিপিবদ্ধ করার জন্য) তৎপর প্রহরী তার নিকটেই রয়েছে। (সূরা ক্বাফ ১৮ আয়াত)

وَٱلَّذِينَ يُؤۡذُونَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتِ بِغَيۡرِ مَا ٱكۡتَسَبُواْ فَقَدِ ٱحۡتَمَلُواْ بُهۡتَٰنٗا وَإِثۡمٗا مُّبِينٗا

অর্থাৎ যারা বিনা অপরাধে ঈমানদার পুরুষ ও নারীদেরকে কষ্ট দেয়, তারা অবশ্যই মিথ্যা অপবাদ এবং স্পষ্ট অপরাধের বোঝা বহন করে। (সূরা আহযাব ৫৮ আয়াত)

ইবনে মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসেকী [আল্লাহর অবাধ্যাচরণ] এবং তার সাথে লড়াই ঝগড়া করা কুফরি।’’ (বুখারী ৪৮, ৬০৪৫, ৭০৭৬, মুসলিম ৬৪, তিরমিযী ১৯৮৩, ২৬৩৪, ২৬৩৫, নাসায়ী ৪১০৫, ৪১০৬, ৪১০৮-৪১১৩, ইবনু মাজাহ ৬৯, ৩৮৯৩, ৩৯৪৭)

আবূ যার্র রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তিনি এ কথা বলতে শুনেছেন যে, ‘‘যখন কোন মানুষ অন্য মানুষের প্রতি ‘ফাসেক’ অথবা ‘কাফের’ বলে অপবাদ দেয়, তখনই তা তার উপরেই বর্তায়; যদি তার প্রতিপক্ষ তা না হয়।’ (বুখারী ৬০৪৫, মুসলিম ৬১)

আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভাল কথা বলে; নচেত চুপ থাকে।” (বুখারী ৬০১৮, ৩৩৩১, ৫১৮৬, ৬১৩৬, ৬১৩৮, ৬৪৭৫, মুসলিম ৪৭, ১৪৬৮)

আবূ মুসা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! সর্বোত্তম মুসলিম কে?’ তিনি বললেন, “যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমরা নিরাপদ থাকে।” (বুখারী ১১, মুসলিম ৪২, তিরমিযী ২৫০৪, ২৬২৮, নাসায়ী ৪৯৯৯)

সাহাল ইবনে সায়াদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী (অঙ্গ জিভ) এবং দুই পায়ের মধ্যবর্তী (অঙ্গ গুপ্তা-ঙ্গ) সম্বন্ধে নিশ্চয়তা দেবে, আমি তার জন্য জান্নাতের নিশ্চয়তা দেব।” (বুখারী ৬৪৭৪, ৬৮০৭, তিরমিযী ২৪০৮, আহমাদ ২২৩১৬)

আবূ বাকরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায়ী হজ্জে মিনায় ভাষণ দানকালে বলেছেন, “নিশ্চয় তোমাদের রক্ত, তোমাদের মাল এবং তোমাদের স‎ম্ভ্রম তোমাদের (আপসের মধ্যে) এ রকমই হারাম, যেমন তোমাদের এ দিনের সম্মান তোমাদের এ মাসে এবং তোমাদের এ শহরে রয়েছে। শোন! আমি কি পৌঁছে দিলাম?” (বুখারী ৬৭, ১০৫, ১৪৪১, ৩১৯৭, ৪৪০৬, ৪৬৬২, ৫৫৫০, ৭০৭৮, ৭৪৪৭, মুসলিম ১৬৭৯)

মুসলমান তো তার দ্বীনী ভাইয়ের কল্যাণকামী ও সংশোধনকারী:

আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘তোমরা কু-ধারণা পোষণ করা থেকে বিরত থাক। কারণ কু-ধারণা সব চাইতে বড় মিথ্যা কথা। অপরের গোপনীয় দোষ খুঁজে বেড়ায়ো না, অপরের গোয়েন্দাগিরি করো না, একে অপরের সাথে [অসৎ কাজে] প্রতিদ্বন্দ্বিতা করো না, পরস্পরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করো না, একে অপরের বিরুদ্ধে শত্রুভাবাপন্ন হইয়ো না। তোমরা আল্লাহর বান্দা, ভাই ভাই হয়ে যাও; যেমন তিনি তোমাদেরকে আদেশ দিয়েছেন। এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার প্রতি জুলুম করবে না, তাকে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেবে না এবং তাকে তুচ্ছ ভাববে না। আল্লাহ-ভীতি এখানে রয়েছে। আল্লাহ-ভীতি এখানে রয়েছে। [এই সাথে তিনি নিজ বুকের দিকে ইঙ্গিত করলেন।] কোন মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ ভাবা একটি মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য যথেষ্ট। প্রত্যেক মুসলিমের রক্ত, সম্ভ্রম ও সম্পদ অপর মুসলিমের উপর হারাম। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের দেহ ও আকার-আকৃতি দেখেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমল দেখেন।’’

অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘‘তোমরা পরস্পর হিংসা করো না, পরস্পরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করো না, অপরের গোয়েন্দাগিরি করো না, অপরের গোপনীয় দোষ খুঁজে বেড়ায়ো না, পরস্পরের পণ্যদ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়ো না। তোমরা আল্লাহর বান্দা, ভাই ভাই হয়ে যাও।’’

আর এক বর্ণনায় আছে, ‘‘তোমরা পরস্পর সম্পর্ক-ছেদ করো না, একে অপরের বিরুদ্ধে শত্রুভাবাপন্ন হইয়ো না, পরস্পরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করো না, পরস্পর হিংসা করো না। তোমরা আল্লাহর বান্দা, ভাই ভাই হয়ে যাও।’’

অন্য আরও এক বর্ণনায় আছে, ‘‘তোমরা একে অন্যের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করো না এবং অপরের ক্রয়-বিক্রয়ের উপর ক্রয়-বিক্রয় করো না।’’ (এ সবগুলি মুসলিম বর্ণনা করেছেন এবং এর অধিকাংশ বর্ণনা করেছেন বুখারী) দ্রষ্টব্য রিয়াদুস সালেহীন; পরিচ্ছেদ: ৭৮, হাদীস নম্বর: ১৫৭৮)

কারো কাছ থেকে মন্দ প্রকাশ পেলে বা কারো কথায় গোমরাহী থাকলে বা কেউ ভ্রান্তপথ অবলম্বন করলে আমাদের উচিত যথাযথ পদ্ধতিতে তাকে দ্বীনের সঠিক দাওয়াত পৌঁছে দেয়া। অনর্থক গালমন্দ করে বা দোষারোপ না করে আল কুরআন ও হাদীস দিয়ে মানুষকে সঠিক জিনিস ব্যাখ্যা করাই কর্তব্য।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে জিহ্বার, হাতের, পায়ের অপরাধ থেকে হেফাজত করুন।

"যেদিন প্রকাশ করে দেবে তাদের জিহবা, তাদের হাত ও তাদের পা, যা কিছু তারা করত" ( সূরা ২৪ নূর: ২৪

বিষয়: বিবিধ

২৩৩২ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

358134
০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ রাত ১২:১৩
আফরা লিখেছেন : আল্লাহ আমাদের সবাইকে জিহ্বার, হাতের, পায়ের অপরাধ থেকে হেফাজত করুন । আমীন

জাজাকাল্লাহ খায়ের ।
০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ রাত ০১:০৯
297125
অপি বাইদান লিখেছেন : আবু জাহেলের আসল নাম কি?
358143
০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ রাত ০১:০৮
অপি বাইদান লিখেছেন : আবু জাহেলের আসল নাম কি?
358147
০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ রাত ০২:০৫
দুষ্টু পোলা লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ ভালো লাগলো
358167
০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ দুপুর ১২:১০
মু. মিজানুর রহমান মিজান (এম. আর. এম.) লিখেছেন : কাকে বলছেন? আপনি নিজে ঠিক আছেনতো?

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File