পরকালে কেউ কি কারো উপকারে আসবে? ( ওয়াসীলা ও শাফায়েতের মানে কী?)
লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ৩১ জানুয়ারি, ২০১৬, ০২:০২:৫৭ রাত
চট্টগ্রামীয় এক পীরের বক্তব্যে শুনেছিলাম, তিনি তার ভক্ত-মুরীদদের বলছেন: আপনারা সবাই (জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ) আমার সাথে (হাতে ইশারা করে )বেহেশতে যাবেন!
পীরদের কেতাবে পাওয়া যায়, তারা (মানে পীর-কুতুবরা) তাদের ভক্তদের মধ্য থেকে ৭০ হাজার/ ৭ লাখ (সুপারিশের মাধ্যমে) জান্নাতে নিয়ে যাবেন।
বাংলাদেশের হক্কানী (?) দাবীদার পীরেরাও দাবি করে, কেয়ামতের মাঠে বড় বড় (আল্লাহর) কুতুবরা(?) জাহাজ নিয়ে উঠবেন! তারা তাদের মুরীদ রেখে যাবেন না (জান্নাতে নিয়ে যাওয়ার কথা সরাসরি না বললেও বুঝতে বাকি থাকে না, তারা জাহাজ নিয়ে কোথায় রওয়ানা দিবেন, আর মুরীদদের কোথায় নিয়ে যাবেন)। ভক্তরা এই আশাতেই পীরের হাতে বায়আত(?) হয়। পীরের কাছে যায়, পীরের জন্য নজর, নেওয়াজ, হাদিয়া নিয়ে যায় (নিজের বউ-ছেলে-মেয়েরা ঠিকমত খাবার পায় না, চিকিত্সা পায় না, এটা আমার নিজের অভিজ্ঞতায় বলছি-আমার বন্ধুর পিতা এমনই একজন হক্কানী পীরের মুরিদ; নিজের বেতনের টাকা পান খাওয়া আর পীরের সেবায় চলে যায়!)
*আমার প্রতিবেশী এক চাচীর কাচে জানতে চাইলাম কেন চট্টগ্রামে ওরশে যায়? তিনি বললেন: বাবা শুধু জাহের (৬ হাজার কালাম) নিয়ে থাকলে হবে, বাতেনীও জানতে হবে!আমি বললাম:
জাহেরী যা আছে সব জেনে ফেলেছেন?
: জাহেরীর চেয়ে বাতেনী অনেক শক্তিশালী।
আমার এই চাচীর মতো অনেকেরই মাথা-ই পরিশোধন করা হয়েছে শয়তানী আক্বীদা ও চিন্তাধারায়।
পীর ধরার দলীল:
পীর ধরার দলীল হিসেবে (ভন্ড ও হক্কানী পীর ও তার ভক্তরা দুইটি ) আয়াত পেশ করে বলে: আল্লাহ ওয়াসীলা ধরার কথা বলেছেন!
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّـهَ وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ وَجَاهِدُوا فِي سَبِيلِهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
অর্থ: হে বিশ্বাসীগণ! আল্লাহকে ভয় কর, তাঁর নৈকট্য লাভের উপায় অম্বেষণ কর ও তাঁর পথে সংগ্রাম কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। ( সূরা ৫ মায়িদা: ৩৫)
তাফসীরে ইবনে কাসীরে সূরা মায়িদার আলোচ্য অংশের তাফসীরে বলা হয়েছে, ওয়াসীলা মানে ( ইবনে আব্বাস রা. সহ সকলের ঐক্যমতে) নৈকট্য লাভের উপায়।
ইমাম শাওকানী (রঃ) বলেন; ওয়াসীলা শব্দটি নৈকট্য লাভের অর্থ বুঝায়, তা ছাড়া সংযম (তাকওয়া) ও অন্যান্য ভালো কর্মের সাথে সম্পৃক্ত যার দ্বারা বান্দা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারে। অনুরূপভাবে নিষিদ্ধ ও হারাম কর্ম করা থেকে বিরত থাকার দ্বারাও আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়। কেননা নিষিদ্ধ ও হারাম কর্ম বর্জন করাও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম। কিন্তু অজ্ঞরা প্রকৃত অসীলাকে বাদ দিয়ে কবরে সমাধিস্থ মানুষদেরকে নিজেদের অসীলা বানিয়ে নিয়েছে; যার শরীয়তে কোন ভিত্তি নেই। অনুরূপ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, জান্নাতের সুউচ্চ স্থানকেও ‘ওয়াসীলা’ বলা হয়; যা নবী (সাঃ)-কে প্রদান করা হবে । আর এই জন্যেই নবী (সাঃ) বলেছেন ; যে ব্যক্তি আযানের পর এই দু’আ পাঠ করবে, তার জন্য আমার সুপারিশ হালাল হয়ে যাবে। (বুখারীঃ আযান অধ্যায় ও মুসলিমঃ নামায অধ্যায়) আরো দেখুন সূরা ১৭ ইসরা:৫৭।
পীর ধরার দ্বিতীয় দলীল:
পীরেরা আল্লাহকে চেনার, জানার, বুঝার, পাবার মাধ্যম। হক্কানী পীরেরা দাবি করে তারা শুধু ( জান্নাতে যাবার প্রতিশ্রুতি সরাসরি না দিয়ে) আল্লাহকে পাবার রাস্তা/তরীকা বাতলিয়ে দেন। কোনো মুরীদের দাবি-পীরেরা তাদের মুরীদের জন্য সুপারিশ করবে।
আসলেই কি আল্লাহকে পাবার জন্য মাধ্যম দরকার? আল্লাহর কাছে কিছু চাইতে কি কারো সুপারিশ দরকার?
কী বলে কুরআন!
"আল্লাহ কি তাঁর বান্দার পক্ষে যথেষ্ট নন? অথচ তারা আপনাকে আল্লাহর পরিবর্তে অন্যান্য উপাস্যদের ভয় দেখায়। আল্লাহ যাকে গোমরাহ করেন, তার কোন পথপ্রদর্শক নেই।
আর আল্লাহ যাকে পথপ্রদর্শন করেন, তাকে পথভ্রষ্টকারী কেউ নেই। আল্লাহ কি পরাক্রমশালী, প্রতিশোধ গ্রহণকারী নন?"
(সূরা ৩৯ যুমার: ৩৬-৩৭)
পরকালে কেউ কি কারো উপকারে আসবে? (এই যে ভন্ডরা দাবি করে তারা ভক্তদের জান্নাতে নিয়ে যাবেন/সুপারিশ করবেন)
কী বলে কুরআন!
"হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর এবং সেদিনকে ভয় কর, যেদিন পিতা সন্তানের কোন উপকারে আসবে না, সন্তানও তার পিতার কোন উপকারে আসবে না।আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। সুতরাং পার্থিব জীবন যেন তোমাদেরকে কিছুতেই প্রতারিত না করে এবং শয়তান যেন কিছুতেই আল্লাহ সম্পর্কে তোমাদেরকে ধোঁকায় না ফেলে। (সূরা ৩১ লুকমান: ৩৩)
যদি পিতা ছেলেকে বাঁচানোর জন্য তার পরিবর্তে নিজেকে অথবা ছেলে পিতার পরিবর্তে নিজেকে মুক্তিপণরূপে পেশ করতে চায়, তবুও সেখানে তা অসম্ভব হবে। প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার আপন কর্মের ফল ভোগ করতে হবে। যখন পিতা-পুত্র এক অপরের কোন কাজে আসবে না, তখন অন্যান্য আত্মীয়দের আর কি ক্ষমতা? তারা কিভাবে একে অপরকে উপকৃত করতে পারবে? ( দেখুন তাফসীরে ইবনে কাসীর, দ্রষ্টব্য:তাফসীরে আহসানুল বায়ান)
"সেদিন পলায়ন করবে মানুষ তার ভ্রাতার কাছ থেকে, তার মাতা, তার পিতা, তার পত্নী ও তার সন্তানদের কাছ থেকে। সেদিন প্রত্যেকেরই নিজের এক চিন্তা থাকবে, যা তাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখবে।" (সূরা ৮০ আবাসা:৩৪-৩৭)
কেয়ামতে কেউ কারো কোনো উপকারে আসবে না এই সম্পর্কে আরো আয়াত:
৭০ তম সূরা মাআরিজ: ১০-১১; ২৩তম সূরা মুমিনুন: ১০১; সূরা ২ বাকারা: ৪৮
শাফায়েতের মালিক কে?
আল্লাহ বলেন: "বলুন, সমস্ত সুপারিশ আল্লাহরই ক্ষমতাধীন, আসমান ও যমীনে তাঁরই সাম্রাজ্য। অতঃপর তাঁরই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।" (সূরা ৩৯ যুমার:৪৪)
কে করতে পারবে সুপারিশ: সবাই সুপারিশ করতে পারবে না। আর রাসূল সা: ছাড়া কে সুপারিশ করতে পারবে তা এই পৃথিবীতে থেকে কেউ বলতে পারবে না (শয়তানের ধোঁকা ছাড়া)। সুপারিশের যোগ্য হবেন তারাই -যার প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট ও যাকে সুপারিশের অনুমতি দেবেন।
"দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দেবেন এবং যার কথায় সন্তুষ্ট হবেন সে ছাড়া কারও সুপারিশ সেদিন কোন উপকারে আসবে না।" (সূরা ২০ ত্বহা: ১০৯)
সুপারিশের শর্ত: আল্লাহর অনুমতি পাওয়া।
কেউ সুপারিশ করতে পাবে না তবে তাঁর অনুমতি ছাড়া ইনিই আল্লাহ তোমাদের পালনকর্তা। অতএব, তোমরা তাঁরই এবাদত কর। তোমরা কি কিছুই চিন্তা কর না ? (সূরা ১০ ইউনুস: ৩)
কারা সুপারিশের যোগ্য? যাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট ও যাদের জন্য আল্লাহ অনুমতি দেবেন। এরা হবে শুধুমাত্র তাওহীদপন্থী (শিরকমুক্ত আল্লাহর ইবাদতকারী) ; যাদের ব্যাপারে আল্লাহ সুপারিশ করার অনুমতি দেবেন। এ বিষয়টি কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় আলোচিত হয়েছে। যেমন সূরা নাজমঃ ২৬, সূরা সাবাঃ ২৩, সূরা নাবাঃ ৩৮ এবং আয়াতুল কুরসীতে( সূরা বাকারা: ২৫৫)।
"তাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে যা আছে, তা তিনি জানেন। তারা শুধু তাদের জন্যে সুপারিশ করে, যাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট এবং তারা তাঁর ভয়ে ভীত।" (সূরা ২১ আম্বিয়া: ২৮)
সুপারিশ সবার জন্য নয়: যারা শিরক করে আল্লাহর সত্তায়, গুণাবলীতে ও তার ইবাদতে তাদের জন্য কোনো সুপারিশ নাই। অথচ এইসব ভন্ড বিদ'আতী, মুশরিক ও জালিমরাই সবচেয়ে বেশি সুপারিশের হকদার দাবী করে!
"ওদেরকে আসন্ন দিন সম্পর্কে সতর্ক করে দাও, যখন দুঃখে-কষ্টে ওদের হৃদয় কণ্ঠাগত হবে। সীমালংঘনকারীদের জন্য অন্তরঙ্গ কোন বন্ধু নেই এবং এমন কোন সুপারিশকারীও নেই যার সুপারিশ গ্রাহ্য করা হবে। (সূরা ৪০ গাফির: ১৮) আরো দেখুন-
[৭৪ মুদ্দাসির:৪৮]
মুক্তির পথ: সীরাতে মুস্তকীম হলো শুধু একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করা। আর দ্বীন প্রতিষ্ঠা হল, তাওহীদ বা একত্ববাদকে সবকিছুর উপর প্রাধান্য দেয়া, এর জন্য চেষ্টা-সাধনা, সংগ্রাম করা।
"নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার প্রতিপালক এবং তোমাদের প্রতিপালক। সুতরাং তোমরা তাঁর উপাসনা কর। এটাই হল সরল পথ।" (সূরা ৩ আলে ইমরান: ৫১)
অর্থাৎ, আল্লাহর ইবাদত সম্পাদনে এবং তাঁর সামনে অসহায়তা ও অপরাগতার প্রকাশ করার ব্যাপারে আমি (রাসূলুল্লাহ সা.) ও তোমরা সমান। সুতরাং এক আল্লাহর ইবাদত করা এবং তাঁর উপাস্যত্বে অন্য কাউকে শরীক না করাই হল সঠিক ও সরল পথ।
বিষয়: বিবিধ
২৫৯৯ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন