হে মানুষ পালাবে কোথায়? (আমাদের পক্ষে বা বিপক্ষে কিয়ামতে যারা সাক্ষ্য দেবে)
লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ১০ জানুয়ারি, ২০১৬, ০৭:৩২:০৩ সন্ধ্যা
আমরা পৃথিবীতে যে কথা বলি না কেন এবং যে কাজই করি না কেন (যদি লুকিয়েও করি) তার পক্ষে বা বিপক্ষে ৪টি সাক্ষ্য দাঁড়িয়ে (মানুষ বা জিন ছাড়া) যাবে কিয়ামতের দিন মহান প্রভুর দরবারে; যদিও তিনি সবই জানেন।
যদি মানুষের সামনে কোনো পাপকাজ সংঘটিত হয়, তাহলে মানুষও সাক্ষ্য হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে এটা (খুবই মারাত্মক) তখন বান্দাহর হকের সাথে জড়িত হয়ে যায়। যেমন কেউ রোযা রাখে নি, কেউ জানে না সে রোযা রেখেছি কীনা; হয়তো আল্লাহ তাকে মাফ করেও দিতে পারেন। কিন্তু যদি সে প্রকাশ্যে রোযার দিন খাবার খেয়ে মানুষদের জানিয়ে সে রোযাদার নয়, তাহলে আল্লাহ আর তাকে ক্ষমা করবেন না, যদি কিয়ামতের দিন কোনো বান্দাহ তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়।
এই জন্যই আমরা হাদীসে দেখতে পাই- রাসূলুল্লাহ সা. আমাদের গোপনে কোনো পাপ হয়ে গেলে প্রকাশ করতে নিষেধ করেছেন।
আসুন আমরা দেখি কারা আমার পক্ষে বা বিপক্ষে সাক্ষ্য দিবে।
আমাদের বিরুদ্ধে জমীনের সাক্ষ্যদান: আমরা পৃথিবীর বুকে যেখানেই থাকি না কেন (মহাশূন্য, মহাসাগর কিংবা অন্ধকার গুহায়) যে কোনো অপরাধ বা ভালো কর্ম করি না কেন সবই জমীনের উপর। এই জমীন কিয়ামতের দিন আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে।
আল্লাহ বলেন:-
يَوْمَئِذٍ تُحَدِّثُ أَخْبَارَهَا
বঙ্গানুবাদ: "সেদিন সে(জমীন) তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে। (৯৯তম সূরা যিলযাল:৪)
হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী (সাঃ) এই আয়াত পাঠ করলেন এবং বললেন, ‘‘তোমরা জান, পৃথিবীর বৃত্তান্ত কি?’’ সাহাবীগণ (রাঃ) বললেন, আল্লাহ এবং তাঁর রসূলই ভাল জানেন। নবী (সাঃ) বললেন, ‘‘তার বৃত্তান্ত এই যে, নর অথবা নারী এ মাটির উপর যা কিছু করছে এই মাটি তার সাক্ষী দেবে। আর বলবে, অমুক অমুক ব্যক্তি অমুক অমুক দিনে অমুক অমুক কর্ম করেছে। (তিরমিযী কিয়ামতের বিবরণ ও সূরা যিলযালের তাফসীর পরিচ্ছেদ, মুসনাদে আহমদ ২/৩৭৪ নং)
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘মুওয়াযযিনের আযানের ধ্বনি জিন, ইনসান, গাছ, পাথর, মাটি সহ যেই-ই শুনবে, সকল বস্ত্তই ক্বিয়ামতের দিন তার জন্য সাক্ষ্য প্রদান করবে’। আর এটা হবে আল্লাহর ন্যায়বিচারের প্রমাণ হিসাবে এবং পাপীদের অস্বীকারের জওয়াব হিসাবে। (ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/৩৮৯; বুখারী হা/৬০৯)
অঙ্গ-প্রতঙ্গের সাক্ষ্যদান: কিয়ামতের দিন আমাদের অঙ্গ-প্রতঙ্গ আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে, সেদিন কেউ মিথ্যা বলে পার পাবে না। আল্লাহ সূরা নূরে বলেন-
يَوْمَ تَشْهَدُ عَلَيْهِمْ أَلْسِنَتُهُمْ وَأَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
"যেদিন তাদের বিরুদ্ধে তাদের রসনা, তাদের হাত ও পা তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে সাক্ষী দেবে। " (২৪তম সূরা নূর: ২৪)
আল্লাহ তাআ'লা আরো বলেন, الْيَوْمَ نَخْتِمُ عَلَى أَفْوَاهِهِمْ وَتُكَلِّمُنَا أَيْدِيهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ ‘আজ আমরা তাদের মুখে মোহর মেরে দেব এবং আমাদের সাথে কথা বলবে তাদের হাত ও তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দেবে তাদের পা’ (৩৬তম সূরা ইয়াসীন : ৬৫)।
এই মোহর লাগানোর প্রয়োজন এই জন্য হবে যে, কিয়ামতের দিন প্রথম দিকে মুশরিকরা মিথ্যা বলবে এবং বলবে, (واللهِ رَبِّنَا مَا كُنَّا مُشْرِكِيْنَ) অর্থাৎ, ঐ আল্লাহর শপথ যিনি আমাদের প্রভু, আমরা মুশরিক ছিলাম না। (সূরা আনআম ২৩ আয়াত) সুতরাং আল্লাহ তাআলা তাদের মুখে মোহর লাগিয়ে দেবেন, ফলে তারা কথা বলার শক্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে। তবে আল্লাহ তাআলা মানুষের শরীরের অন্য অঙ্গকে কথা বলার শক্তি প্রদান করবেন। সুতরাং হাত বলবে, ‘আমার দ্বারা সে এই এই কর্ম করেছিল’ এবং পা তার সাক্ষী দেবে। ঠিক এইভাবে স্বীকার ও সাক্ষী, উভয় পর্যায় পার হয়ে যাবে। এ ছাড়া কথা বলতে সক্ষম বস্তুর মোকাবেলায় কথা বলতে অক্ষম বস্তুর কথা বলে সাক্ষ্য দেওয়া, দলীল ও প্রমাণ হিসাবে অধিক প্রভাবশালী হয়; যেহেতু তাতে অলৌকিক বিষয় পাওয়া যায়। (ফাতহুল ক্বাদীর) মুখ ছাড়া অন্য অঙ্গের কথা বলার বিষয়টি হাদীসসমূহেও বর্ণিত হয়েছে। (দেখুন সহীহ মুসলিমঃ কিতাবুয্ যুহদ)
আল্লাহ ৪১তম সূরা ফুসসিলাতে বলেন:-
তারা যখন জাহান্নামের কাছে পৌঁছাবে, তখন তাদের কান, চক্ষু ও ত্বক তাদের কর্ম সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে।
তারা তাদের ত্বককে বলবে, তোমরা আমাদের বিপক্ষে সাক্ষ্য দিলে কেন? তারা বলবে, যে আল্লাহ সব কিছুকে বাকশক্তি দিয়েছেন, তিনি আমাদেরকেও বাকশক্তি দিয়েছেন। তিনিই তোমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে।
তোমাদের কান, তোমাদের চক্ষু এবং তোমাদের ত্বক তোমাদের বিপক্ষে সাক্ষ্য দেবে না ধারণার বশবর্তী হয়ে তোমরা তাদের কাছে কিছু গোপন করতে না। তবে তোমাদের ধারণা ছিল যে, তোমরা যা কর তার অনেক কিছুই আল্লাহ জানেন না।
তোমাদের পালনকর্তা সম্বন্ধে তোমাদের এ ধারণাই তোমাদেরকে ধ্বংস করেছে। ফলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছ।
( দেখুন ৪১তম সূরা ফুসসিলাতের তাফসীর: ২০-২৩)
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, কা’বা শরীফের পাশে দু’জন কুরাইশী এবং একজন সাক্বাফী অথবা দু’জন সাক্বাফী এবং একজন কুরাইশী একত্রিত হয়। তাদের মধ্যে মোটা শরীর এবং অল্প বুদ্ধির অধিকারী ব্যক্তিটি বলল, ‘তোমরা কি মনে কর যে, আমাদের কথা আল্লাহ শুনেন?’ দ্বিতীয়জন বলল, ‘আমাদের জোরে বলা কথাগুলো শুনেন এবং আস্তে বলা কথাগুলো শুনেন না।’ অপর আর একজন বলল, ‘তিনি যদি আমাদের উঁচু আওয়াজে বলা কথাগুলো শুনেন, তবে চুপি চুপি বলা কথাগুলো অবশ্যই শুনেন।’ এরই উপর আল্লাহ {وَمَا كُنْتُمْ تَسْتَتِرُوْنَ} আয়াত অবতীর্ণ হল। (বুখারীঃ তাফসীর সূরা ফুসসিলাত বা হা-মীম সাজদাহ)
ফেরেশতাদের সাক্ষ্যদান: ফেরেশতারা আমাদের পক্ষে বা বিপক্ষে সাক্ষ্য দিবেন। যেমন আল্লাহ বলেন:
إِذْ يَتَلَقَّى الْمُتَلَقِّيَانِ عَنِ الْيَمِينِ وَعَنِ الشِّمَالِ قَعِيدٌ ﴿×﴾ مَّا يَلْفِظُ مِن قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ
"যখন দুই সংগ্রাহক (ফিরিশতা তার কর্ম) সংগ্রহ (লিপিবদ্ধ) করে, (যারা তার) ডাইনে ও বামে বসে আছে। মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে (তা লিপিবদ্ধ করার জন্য) তৎপর প্রহরী তার নিকটেই রয়েছে। (৫০তম সূরা কাফ: ১৭-১৮) আল্লাহ আরো বলেন-
সেদিন প্রত্যেক ব্যক্তি উপস্থিত হবে, তার সাথে থাকবে এক চালক ও সাক্ষী। তুমি এই দিবস সম্বন্ধে উদাসীন ছিলে, এখন তোমার সম্মুখ হতে পর্দা উন্মোচন করেছি; সুতরাং আজ তোমার দৃষ্টি প্রখর। তার সঙ্গী (ফিরিশতা) বলবে, ‘এই তো আমার নিকট (আমলনামা) প্রস্তুত। (৫০তম সূরা কাফ: ২১-২৩)
অর্থাৎ, ফিরিশতা মানুষের সমস্ত রেকর্ড সামনে রেখে দেবেন এবং বলবেন, এটা হল তোমার কর্ম-তালিকা (আমলনামা) যা আমার কাছে ছিল।
তিনি আরো বলেন:- অবশ্যই তোমাদের উপর (নিযুক্ত আছে) সংরক্ষকগণ। (৮২তম সূরা আল ইনফিতার: ১০)
মানুষের আমলনামা: মানুষকে তাদের আমলনামা উপস্থাপন করা হবে। যা বিভিন্ন আয়াতে এসেছে। উপরোক্ত আলোচনাতেও পড়েছেন যে ফেরেশতারা শুধু সাক্ষ্যই দিবেন না তারা আমাদের কর্মকান্ড যথাযথ লিপিবদ্ধ করে চলেছেন। আল্লাহ বলেন-
وَكُلَّ إِنسانٍ أَلزَمناهُ طائِرَهُ في عُنُقِهِ وَنُخرِجُ لَهُ يَومَ القِيامَةِ كِتابًا يَلقاهُ مَنشورًا ﴿×﴾ اقرَأ كِتابَكَ كَفى بِنَفسِكَ اليَومَ عَلَيكَ حَسيبًا
'প্রত্যেক মানুষের কৃতকর্ম আমি তার গ্রীবালগ্ন করেছি এবং কিয়ামতের দিন আমি তার জন্য বের করব এক কিতাব, যা সে উন্মুক্ত পাবে। (তাকে বলা হবে,) ‘তুমি তোমার কিতাব (আমলনামা) পাঠ কর; আজ তুমি নিজেই তোমার হিসাব-নিকাশের জন্য যথেষ্ট।’ (১৭তম সূরা আল ইসরা:১৩-১৪)
ইমাম ইবনে কাসীর (রঃ) এখানে طَائِرٌ এর অর্থ নিয়েছেন, মানুষের আমল। আর فِي عُنُقِهِ বলতে তার সেই ভাল ও মন্দ আমল, যার ভাল অথবা মন্দ প্রতিদান তাকে দেওয়া হবে। গলার হারের মত তার সাথে থাকবে। অর্থাৎ, তার সমস্ত আমল লিখা হচ্ছে। আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণ এই লিখিত জিনিস সুরক্ষিত থাকবে। কিয়ামতের দিন এই অনুযায়ী তার বিচার-ফায়সালা হবে। আর ইমাম শাওকানী طَائِرٌ এর অর্থ করেছেন, মানুষের ভাগ্য। যা মহান আল্লাহ তাঁর জ্ঞানের আলোকে প্রথমেই লিপিবদ্ধ করে দিয়েছেন। যার সৌভাগ্যবান ও আল্লাহর অনুগত হওয়ার ছিল, তা আল্লাহর জানা ছিল এবং যার অবাধ্য হওয়ার ছিল, তাও তাঁর জানা ছিল। এই ভাগ্যই (সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য) প্রত্যেক মানুষের সাথে গলার হারের মত লেগে আছে। সেই অনুযায়ী হবে তার আমল এবং কিয়ামতের দিন সেই অনুযায়ীই হবে তার ফায়সালা। (বিস্তারিত জানতে পড়ুন-তাফসীর ইবনে কাসীর)
তিনি আরো বলেন_
"আল্লাহ যা ইচ্ছা তা মুছে দেন এবং যা ইচ্ছা তা বহাল রাখেন। আর তাঁর নিকট রয়েছে মূল গ্রন্থ।" (১৩তম সূরা রা'দ: ৩৯ ) এই সূরার তাফসীরে আল্লামা ইবনে কাসীর লিখেন- রাসূল স. বলেন:
‘‘মানুষকে পাপের কারণে রুযী থেকে বঞ্চিত করা হয়, দু‘আর মাধ্যমে ভাগ্য পরিবর্তন হয় এবং আত্মীয়তা বন্ধন বজায় রাখার কারণে আয়ু বৃদ্ধি পায়।’’ (মুসনাদ আহমাদ ৫/২৭৭) কতিপয় সাহাবা থেকে নিম্নলিখিত দু‘আটি বর্ণিত হয়েছে,(اللَّهُمَّ إنْ كُنْتَ كَتَبْتَنَا أشْقِيَاءَ فَامْحُنَا وَاكْتُبْنَا سُعَدَاءَ، وَإنْ كُنْتَ كَتَبْتَنَا سُعَدَاءَ فَأثْبِتْنَا، فَإنَّكَ تَمْحُوْ مَا تَشَاءُ وَتُثْبِتُ وَعِنْدَكَ أُمُّ الْكِتَابِ) । অর্থাৎ, হে আল্লাহ! যদি তুমি আমাদেরকে দুর্ভাগ্যবান বলে লিখে দিয়েছ, তাহলে তা মিটিয়ে দিয়ে আমাদেরকে সৌভাগ্যবান বলে লিখে দাও। আর যদি সৌভাগ্যবান বলে লিখেছ, তাহলে সেটাই বহাল রাখো, কেননা তুমি যা চাও মিটিয়ে দাও আর যা চাও বহাল রাখ এবং তোমার কাছেই রয়েছে লওহে মাহফূয বা সংরক্ষিত ফলক।
এই আয়াতের বিস্তারিত তাফসীর পড়তে হবে।
আল্লাহ আমাদের (বিশেষ করে মুসলমানদের) বুঝার তাওফিক দান করুন। আমরা কী করছি কেন করছি তা যেন করার পূর্বেই ভাবি। আর কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়ে গেলে যেন তাওবা করি ও আল্লাহর কাছে ফিরে আসি।
বিষয়: বিবিধ
১৯৯৮ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন