মুসলমানদের প্রথম ব্যথর্তা (কুরআন থেকে দূরে)
লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ০৮ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:৪৩:২৯ রাত
মুসলমান হিসেবে আমাদের প্রথম ব্যথর্তা ও অপরাধ হলো, আমরা কুরআন পড়তে জানি না, কেউ জানলেও বেশিরভাগ অন্ধত্বের মতো পড়ে। কী পড়ছি বুঝতে পারছি না। অথচ এই কুরআন আমাদের পথ নির্দেশিকা।
মহান আল্লাহ তাআলা বলেন: كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِّيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ
এটি একটি বরকতময় কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি বরকত হিসেবে অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসূহ লক্ষ্য করে এবং বুদ্ধিমানগণ যেন তা অনুধাবন করে। (সূরা সাদ: ২৯)
তিনি আরো বলেন: এ সেই কিতাব যাতে কোনই সন্দেহ নেই। পথ প্রদর্শনকারী পরহেযগারদের জন্য (সূরা বাকারা: ২)
তিনি আরো বলেন: রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। (সূরা বাকারা: ১৮৫)
আল্লাহ বলেন:-
وَما أَنزَلنا عَلَيكَ الكِتابَ إِلّا لِتُبَيِّنَ لَهُمُ الَّذِي اختَلَفوا فيهِ وَهُدًى وَرَحمَةً لِقَومٍ يُؤمِنونَ
আমি আপনার প্রতি এ জন্যেই গ্রন্থ নাযিল করেছি, যাতে আপনি সরল পথ প্রদর্শনের জন্যে তাদের কে পরিষ্কার বর্ণনা করে দেন, যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করছে এবং ঈমানদারকে ক্ষমা করার জন্যে। (সূরা নাহল: ৬৪)
উপরোক্ত আয়াত সমূহের মাধ্যমে এটা পরিষ্কার হয়েছে, এই কুরআন বুঝার জন্য, পথ দেখানোর জন্য, সত্য-মিথ্যার পার্থক্যের জন্য এবং মানুষের মাঝে ফায়সালা করার জন্য অবতীর্ণ হয়েছে।
আমরা মুসলমান হিসেবে কতইনা দূর্ভাগ্য! আমরা আমাদের প্রভুর কিতাব, আমাদের পথ-নির্দেশনা আল কুরআন পড়তে পারি না। পড়তে পারলেও এর অর্থ বা মানে বুঝি না। আবার অনেকে মানে বুঝার চেষ্টাও করে না। কী আফসোস আমাদের জন্য! অথচ এটা নাযিলের উদ্দেশ্যই হচ্ছে হেদায়েত লাভ। যদি এর মানেই না জানি, তাহলে কীভাবে আমরা এর থেকে হেদায়েত লাভ করতে পারি? অথচ আল্লাহ বলেন:-
হে মানবকুল, তোমাদের কাছে উপদেশবানী এসেছে তোমাদের পরওয়ারদেগারের পক্ষ থেকে এবং অন্তরের রোগের নিরাময়, হেদায়েত ও রহমত মুসলমানদের জন্য। (সূরা ইউনুস: ৫৭)
আমরা কীভাবে উপরোক্ত ফায়দা হাসিল করতে পারি যদি কুরআন অর্থসহ পড়তে না পারি, বুঝতে পারি?
কুরআন নাযিলই হয়েছে অনুধাবনের জন্য-
যারা মুমিন, তাদের জন্যে কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবর্তীর্ণ হয়েছে, তার কারণে হৃদয় বিগলিত হওয়ার সময় আসেনি? তারা তাদের মত যেন না হয়, যাদেরকে পূর্বে কিতাব দেয়া হয়েছিল। তাদের উপর সুদীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হয়েছে, অতঃপর তাদের অন্তঃকরণ কঠিন হয়ে গেছে। তাদের অধিকাংশই পাপাচারী।
তোমরা জেনে রাখ, আল্লাহই ভূ-ভাগকে তার মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবিত করেন। আমি পরিস্কারভাবে তোমাদের জন্যে আয়াতগুলো ব্যক্ত করেছি, যাতে তোমরা বোঝ। (সূরা হাদীদ: ১৬-১৭)
হায়! আফসোস! আমাদের কী হবে যদি আমরা বুঝতে পারি- আল্লাহ আমাদের জন্য কী পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করেছেন।
তিনি আমাদের আরো সতর্ক করে বলেছেন: আমি যদি অনারব ভাষায় কোরআন করতাম, তবে অবশ্যই তারা বলত, এর আয়াতসমূহ পরিস্কার ভাষায় বিবৃত হয়নি কেন? কি আশ্চর্য যে, কিতাব অনারব ভাষায় আর রসূল আরবী ভাষী! বলুন, এটা বিশ্বাসীদের জন্য হেদায়েত ও রোগের প্রতিকার। যারা মুমিন নয়, তাদের কানে আছে ছিপি, আর কোরআন তাদের জন্যে অন্ধত্ব। তাদেরকে যেন দূরবর্তী স্থান থেকে আহবান করা হয়। (সূরা ফুসসিলাত: ৪৪)
দেখুন কী বলা হয়েছে? আমরা যদি বুঝতেই নাই পারলাম তাহলে তো আমরা অন্ধের মতো, আর কাফিরদের মতো হেদায়েত থেকে দূরে।
কুরআন যদি না-ই বুঝতে পারলাম, তাহলে আল্লাহ যে উদ্দেশ্যে কুরআন নাযিল করেছেন তা ব্যর্থ হয়ে যায়। আর তিনি বারবার আমাদের কুরআনের প্রতি লক্ষ্য করতে, তা নিয়ে ভাবতে, গবেষণা করতে বলেছেন।
তিনি বলেন-
এরা কি লক্ষ্য করে না কোরআনের প্রতি? পক্ষান্তরে এটা যদি আল্লাহ ব্যতীত অপর কারও পক্ষ থেকে হত, তবে এতো অবশ্যই বহু বৈপরিত্য দেখতে পেত। (সূরা নিসা: ৮২)
তারা কি কোরআন সম্পর্কে গভীর চিন্তা করে না? না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ? (সূরা মুহাম্মাদ: ২৪)
নিশ্চয় আমি আপনার প্রতি সত্য কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি মানুষের মধ্যে ফয়সালা করেন, যা আল্লাহ আপনাকে হৃদয়ঙ্গম করান। আপনি বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষ থেকে বিতর্ককারী হবেন না।
(সূরা আন নিসা: ১০৫)
আপনার কাছে আমি স্মরণিকা অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি লোকদের সামনে ঐসব বিষয় বিবৃত করেন, যে গুলো তোদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে, যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে। (সূরা নাহল: ৪৪)
আমি কোরআনে এমন বিষয় নাযিল করি যা রোগের সুচিকিৎসা এবং মুমিনের জন্য রহমত। গোনাহগারদের তো এতে শুধু ক্ষতিই বৃদ্ধি পায়। (সূরা ইসরা: ৮২)
মূলত আমরা কুরআন থেকে দূরে, আর যারা তিলাওয়াতে ব্যস্ত, হেফজে ব্যস্ত তারা মূলত খতম আর পড়ানোতেই সীমাবদ্ধ। মুসলমানদের মনে এই ধারণ দেয়া হয়েছে- এই কুরআন বুঝা সহজ কাজ নয়, অথবা কুরআন বুঝতে বা অর্থ অনুধাবন করতে অনেক রকম ইলম লাগে। অথচ আল্লাহ বলেন:-
وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِن مُّدَّكِرٍ
আমি কোরআনকে সহজ করে দিয়েছি বোঝার জন্যে। অতএব, কোন চিন্তাশীল আছে কি? (এই আয়তের যিকরের অর্থ মুখস্ত বা বুঝা দুটোই গ্রহণ করেছেন আলেমরা, সূরা কামার, আয়াত: ১৭/২২/৩২/৪০)
আয়াতটি বারবার উল্লেখ করে আল্লাহ আমাদের বারবার সতর্ক করছেন, আমাদের কুরআন বুঝার জন্য।
এই জন্য তার প্রথম ওয়াহী ছিল- "পড়ো"
অনেকে জামে তিরমিযীর একটি হাদীসের রেফারেন্স দিয়ে বলে থাকে , " অর্থ ছাড়া পড়লেও অনেক সওয়াব" অর্থ জানা জরুরী নয়।
আবদুল্লাহ্ ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করবে তার নেকী হবে। আর নেকী হয় দশ গুণ হিসাবে। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম মিলে একটি হয়ফ; বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ, এবং মীম আরেকটি হরফ। -তিরমিযী: ২৯১০, তাখরিজুল তাহাবিয়া ১৩৯, মিশকাত ২১৩৭
কুরআনের মর্যাদা সর্ম্পকে আরো একটি হাদীস-
উছমান ইবন আফ্ফান রাদিয়াল্লাহু আনহ থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সে ব্যক্তি যে কুরআন শিখে এবং তা শিখায়। - তিরমিযী: ২৯০৭, তাছাড়া আছে ইবনু মাজাহ , বুখারিতে।
এখানে লক্ষণীয় যে, কোথাও বলা হয় নি যে, অর্থহীনভাবে না বুঝে পড়লে সওয়াব হবে। তাহলে এটা কেন বুঝে গেলাম যে, এখানে না বুঝে পড়ার কথা বলা হয়েছে। অথচ অসংখ্য হাদীস রয়েছে যেখানে বলা হয়েছে, ধীরে ধীরে বুঝে শুনে কুরআন পড়ার জন্য।
এখন নিচের হাদীসের ব্যাপারে তারা কী বলবেন?
আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন, আল্লাহর কসম! যিনি ব্যতীত কোন ইলাহ্ নেই, আল্লাহর কিতাবের অবতীর্ণ প্রতিটি সূরা সম্পর্কে আমি জানি যে, তা কোথায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং প্রতিটি আয়াত সম্পর্কেই আমি জানি যে, তা কার সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। আমি যদি জানতাম যে, কোন ব্যাক্তি আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে আমার চাইতে অধিক জ্ঞাত এবং সেখানে উট গিয়ে পৌঁছতে পারে, তাহলে সওয়ার হয়ে আমি সেখানে গিয়ে পৌঁছতাম। (বুখারী: ৪৬৩৬)
তালহা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনু আবূ আউফ (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি কোন ওসীয়ত করে গেছেন? তিনি বললেন, না। তখন আমি বললাম, যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে কোন ওসীয়ত করে যাননি, তখন কি করে মানুষের জন্য ওসীয়ত করাকে (কুরআন মজীদে) বাধ্যতামূলক করা হল এবং তাদেরকে এজন্য নির্দেশ দেয়া হল। জবাবে তিনি বললেন, তিনি (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কিতাব (গ্রহণ) এর ওসীয়ত করে গেছেন। (বুখারী: ৪৬৫২)
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দু’ব্যাক্তি ব্যতীত অন্য কারও সাথে ঈর্ষা করা যায় না। এক ব্যাক্তি, যাকে আল্লাহ তা’আলা কুরাআন শিক্ষা দিয়েছেন এবং সে তা দিন-এরাত তিলাওয়াত করে। আর তা শুনে তার প্রতিবেশীরা তাকে বালে, হায়! আমাদেরকে যদি এরূপ জ্ঞান দেয়া হত, যেরূপ জ্ঞাণ অমুককে দেয়া হয়েছে, তাহলে আমিও তার মত আমল করতাম। অন্য আর এক ব্যাক্তি, যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন এবং সে সম্পদ সত্য ও ন্যায়ের পথে ব্যয় করে। এ অবস্থা দেখে অন্য এক ব্যাক্তি বলেঃ হায়! আমাকে যদি অমুক ব্যাক্তির মত সম্পদশালী করা হত, তাহলে সে যেরূপ ব্যয় করছে, আমিও সেরূপ ব্যয় করতাম। (বুখারী: ৪৬৫৬)
আমাদের মনে রাখতে হবে, যাদের সামনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই কথা বলেছেন তারা ছিলেন আরবীয়, তাদের কি তিনি বলবেন, অর্থসহ পড়তে হবে? তারা যখন পড়ে তা বুঝতে পারে, আর বিস্তারিত জানার জন্য অভিজ্ঞ কারো কাছে যান । আর আমাদের জন্য রয়েছে অসংখ্য তাফসীর আর হাদীসের গ্রন্থ। এরপরও কি আমরা গাফেল থাকবো? মূলত কুরআন নিয়ে গবেষণা বা তাফসীর করতে কয়েক প্রকার ইলম হাসিল করতে হয়, লিখিত বা পঠিতব্য তাফসির পড়তে, বুঝতে আলাদা জ্ঞান লাগে না। সাধারণ মানুষের জন্যই মণিষারা তাফসীর করছেন।
কুরআন নাযিল হয়েছে হেদায়েতের জন্য, মানুষদের বুঝার জন্য, সত্য-মিথ্যার পাথর্ক্যের জন্য। আর প্রথম অহী ছিল "পড়ো" তাছাড়া এখানে সম্বোধন করা হয়েছে এইভাবে যে,- হে বিশ্বাসীগণ (৮৯টি আয়াত)/ হে মানমন্ডলী" (সম্ভবত ১৩বার)
আমরা কুরআনের অর্থ বুঝতে না পারলে এইসব সম্বোধন ব্যর্থ! হয়ে যায়। কুরআন পাঠৈর ফযিলাত, ঝাড়ফুক আর প্রশান্তি তো বোনাস! কুরআনের উদ্দেশ্য নয়!
আল্লাহ যাদের হৃদয় প্রশস্ত করেছেন, তারা ঠিকই সত্য উপলব্ধি করতে পারবেন।
বিষয়: বিবিধ
১৬৮১ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন