ভূমিকম্পের ইতিবৃত্ত (সংক্ষেপিত)
লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ০৪ জানুয়ারি, ২০১৬, ০৭:২০:৪৭ সন্ধ্যা
ভূমিকম্পের ইতিবৃত্ত (সংক্ষেপিত)
প্রাথমিক কথা: ভূ-অভ্যন্তরে শিলায় পীরনের জন্য যে শক্তির সঞ্চয় ঘটে, সেই শক্তির হটাৎ মুক্তি ঘটলে ভূ-পৃষ্ঠ ক্ষনিকের জন্য কেঁপে ওঠে এবং ভূ-ত্বকের কিছু অংশ আন্দোলিত হয়। এই রূপ আকস্মিক ও ক্ষনস্থায়ী কম্পনকে ভূমিকম্প (Earthquake) বলে। কম্পন-তরঙ্গ থেকে যে শক্তির সৃষ্টি হয়, তা ভূমিকম্পের মধ্যমে প্রকাশ পায়। এই তরঙ্গ ভূ-গর্ভের কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে উৎপন্ন হয় এবং উৎসস্থল থেকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পরে। ভূমিকম্প সাধারনত কয়েক সেকেণ্ড থেকে এক/দু-মিনিট স্থায়ী হয়। মাঝে মাঝে কম্পন এত দূর্বল হয়, তা অনুভব করা যায় না। কিন্তু শক্তিশালি ও বিধ্বংসী ভূমিকম্পে ঘর-বাড়ি ও ধন-সম্পত্তির ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং অসংখ্য প্রাণহানি ঘটে।
ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট অসুবিধা:
১.মাটির কম্পন ও ভাঙ্গন
২.ভূমিধ্বস ও গর্ত, বিভিন্ন প্রাচীর ফাটল ও ধ্বস
৩. আগুন
৪. মাটির জলীয়করণ
৫. সুনামী
৬. বন্যা
৭. হিউম্যান প্রভাব
ভূমিকম্পের কেন্দ্র :
পৃথিবীর অভ্যন্তরে যেখান থেকে ভূকম্প-তরঙ্গ উৎপন্ন হয়, তাকে ভূমিকম্পের কেন্দ্র বলে। এই কেন্দ্র থেকে কম্পন ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গের মাধ্যমে সব দিকে ছরিয়ে পড়ে। শিলার পীড়ন-ক্ষমতা সহ্যসীমার বাহিরে চলে গেলে শিলায় ফাটল ধরে ও শক্তির মুক্তি ঘটে। তাই প্রায়শই ভূমিকম্পের কেন্দ্র চ্যুতিরেখা অংশে অবস্থান করে। সাধারনত ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১৬ কিমি.-র মধ্যে এই কেন্দ্র অবস্থান করে। তবে ৭০০ কিমি. গভীরে গুরুমণ্ডল (Mantle) থেকেও ভূ-কম্পন উত্থিত হতে পারে।
ভূমিকম্পের কারণ:
ছোটবেলায় গল্প শুনতাম, পৃথিবীটা একটা বড় ষাঁড়ের শিংয়ের মাথায়। ষাঁড়টা যখন এক শিং থেকে অন্য শিংয়ে পৃথিবীটা নিয়ে যায় তখন সবকিছু কেঁপে ওঠে। আর ভাবতাম, এজন্যই ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্পের কারণ এটা নয় বটে, তবে পৃথিবীর গভীরে ঠিকই একটা পরিবর্তন হয়।
সাধারণত তিনটি প্রধান কারণে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়ে থাকে…
১. ভূপৃষ্ঠজনিত
২. আগ্নেয়গিরিজনিত
৩. শিলাচ্যুতিজনিত
আমাদের ভূ -পৃষ্ঠ অনেকগুলো প্লেট এর সমন্বয়ে গঠিত ।এই প্লেট গুলো একটি আরেকটির থেকে আলাদা থাকে ফল্ট বা ফাটল দ্বারা ।এই প্লেটগুলোর নিচেই থাকে ভূ-অভ্যন্তরের সকল গলিত পদার্থ । কোন প্রাকৃতিক কারনে এই গলিত পদার্থগুলোর স্থান চ্যুতি ঘটলে প্লেটগুলোরও কিছুটা স্থান চ্যুতি ঘটে। এ কারনে একটি প্লেটের কোন অংশ অপর প্লেটের তলায় ঢুকে যায় যার ফলে ভূমিতে কম্পন সৃষ্টি হয়। আর এই কম্পনই ভূমিকম্প রূপে আমাদের নিকট আবির্ভূত হয়।
বাংলাদেশের ভূমিকম্প:
বাংলাদেশের ভূমিকম্প বলতে আসলে বাংলাদেশ ও তৎসংলগ্ন এলাকার ভূমিকম্পকে বোঝায়। কারণ বাংলাদেশ আসলে ভারত ও মায়ানমারের ভূঅভ্যন্তরের দুটি ভূচ্যুতির (faultline) প্রভাবে আন্দোলিত হয়, কেননা বাংলাদেশ, ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং বার্মার (মায়ানমারের) টেকটনিক প্লেটের মধ্যে অবস্থান করছে। ভারতীয় এবং ইউরেশীয় প্লেট দুটি (১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে) দীর্ঘদিন যাবত হিমালয়ের পাদদেশে আটকা পড়ে আছে, অপেক্ষা করছে বড় ধরণের নড়াচড়ার, অর্থাৎ বড় ধরণের ভূ-কম্পনের। বাংলাদেশে ৮টি ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি এলাকা বা ফল্ট জোন সচল অবস্থায় রয়েছে, যথা: বগুড়া চ্যুতি এলাকা, রাজশাহীর তানোর চ্যুতি এলাকা, ত্রিপুরা চ্যুতি এলাকা, সীতাকুন্ড-টেকনাফ চ্যুতি এলাকা, হালুয়াঘাট চ্যুতির ডাওকী চ্যুতি এলাকা, ডুবরি চ্যুতি এলাকা, চট্টগ্রাম চ্যুতি এলাকা, সিলেটের শাহজীবাজার চ্যুতি এলাকা (আংশিক-ডাওকি চ্যুতি) এবং রাঙামাটির বরকলে রাঙামাটি চ্যুতি এলাকা।
বুয়েটের গবেষকদের প্রস্তুতকৃত ভূ-কম্পন-এলাকাভিত্তিক মানচিত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশের ৪৩% এলাকা ভূমিকম্পের উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে (জোন-১), ৪১% এলাকা মধ্যম (জোন-২) এবং ১৬% এলাকা নিম্ন ঝুঁকিতে (জোন-৩) রয়েছে। যেখানে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের ভূ-কম্পন মানচিত্রে ২৬% উচ্চ, ৩৮% মধ্যম এবং ৩৬% নিম্ন ঝুঁকিতে ছিলো। নতুন মানচিত্র অনুযায়ী, মাত্রাভেদে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার অবস্থান নিম্নরূপ:
জোন-১: পঞ্চগড়, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সম্পূর্ণ অংশ, এবং ঠাকুরগাঁও, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারের অংশবিশেষ।[২]
জোন-২: রাজশাহী, নাটোর, মাগুরা, মেহেরপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী এবং ঢাকা।[২]
জোন-৩: বরিশাল, পটুয়াখালী, এবং সব দ্বীপ ও চর।
পরিমাপ:
সিসমোগ্রাফ আবিষ্কারের আগে মানুষ শুধু বলতে পারত ভূমিকম্প হয়ে গেছে। কিন্তু কোন মাত্রায় হলো, বলা সম্ভব ছিল না। আধুনিক সিসমোগ্রাফের বয়স প্রায় ১৫০ বছর। ভূমিকম্প মাপা হয় দুইভাবে- তীব্রতা এবং প্রচণ্ডতা বা ব্যাপকতা। ভূমিকম্পের মাত্রা মাপা হয় রিখটার স্কেলে। স্কেলে এককের সীমা ১ থেকে ১০ পর্যন্ত। রিখটার স্কেলে মাত্রা ৫-এর বেশি হওয়া মানে ভয়াবহ দুর্যোগের আশঙ্কা।
মনে রাখতে হবে, ভূমিকম্প এক ডিগ্রি বৃদ্ধি পেলেই এর মাত্রা ১০ থেকে ৩২ গুণ বৃদ্ধি পেতে পারে।
রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা
৫ - ৫.৯৯ মাঝারি
৬ - ৬.৯৯ তীব্র
৭ - ৭.৯৯ ভয়াবহ
৮ - এর ওপর অত্যন্ত ভয়াবহ।
সামগ্রিকভাবে কতটা ঝুঁকির মধ্যে আছে তা জানতে হলে বাংলাদেশ ও তার আশপাশের ভূতাত্ত্বিক গঠণের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। বাংলাদেশ হচ্ছে একটা বদ্বীপ যা কিনা যুগ যুগ ধরে পলি প্রবাহের মাধ্যমে গঠিত হয়েছে। অনেক সময় একে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপ নামেও অবিহিত করা হয়। অবস্থানের বিচারে এই বদ্বীপের অবস্থান তিনটি প্লেটের সংযোগস্থল ১) উত্তরে রয়েছে ইউরেশিয়ান (ইউরোপ এবং এশিয়া) প্লেট। ২) পূর্ব দিকে রয়েছে মায়ানমার বা বার্মা প্লেট। এবং ৩) ভারতীয় প্লেট যার উপরই বাংলাদেশ অবস্থিত।
এটা হচ্ছে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক অবস্থান। শুধুমাত্র বাংলাদেশ এবং এর একটু আশপাশের দিকে তাকালে দেখা যায় বাংলাদেশের উত্তর সীমান্ত বরাবর রয়েছে বিশাল এক ডাউকি চ্যুতি (Dauki fault) যা কিনা শিলং মালভূমির (Shillong plateau) কারণে গঠিত হয়েছে। শিলং মালভূমির মনোরম পাহাড়পুঞ্জ আমাদের মন কেড়ে নিলেও যেকোনো সময়ে এটা আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা:
সবচেয়ে ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা বা ভূমিকম্প এলাকা হচ্ছে-
ইরান, চিলি, জাপান এবং নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট এবং এর বাইরে ওয়েস্ট কোস্ট, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল সহ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল আগ্নেয় ঘটনা ও রেকর্ডিং ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা
বিশ্বের ভয়াবহ ১০টি ভূমিকম্প :
১. সেনসেই, চীন
১৫৫৬ সালের ২৩ জানুয়ারি চীনের সানজি (সাবেক সেনসেই) প্রদেশের রাজধানী জিয়ানে ৮ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্পে নিহত হয় প্রায় ৮ লাখ ৩০ হাজার। এই ভূমিকম্পে ব্যাপক ভ’মিধস হয়। শহরের বড় বড় সব ভবন মাটির সঙ্গে মিশে যায়।
২. তাংশান, চীন
১৯৭৬ সালের ২৭ জুলাই ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এতে নিহতের সংখ্যা ৬ লাখ ৫৫ হাজার। তবে সরকারি হিসেবে এই সংখ্যা ২ লাখ ৫৫ হাজার। ওই ভূমিকম্পের আঁচ বেইজিংয়েও পড়ে।
৩. আলেপ্পো, সিরিয়া
বর্তমানে যুদ্ধবিধস্ত দেশ সিরিয়ায় সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল ১১৩৮ সালের ৯ আগষ্ট। ওই ভূমিকম্পের মাত্রা কত ছিল সেটা জানা যায়নি। তবে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ২ লাখ ৩০ হাজার।
৪. সুমাত্রা, ইন্দোনেশিয়া
তারিখ ছিল ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর। ৯দশমিক ৮ মাত্রার ভ’মিকম্পে প্রাণ যায় ২ লাখ ২৭ হাজার ৮৯৮ জনের। ১৭ লাখ মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব আফ্রিকার ১৪টি দেশে এর প্রভাবে সুনামি হয়। এই ইন্দোনেশিয়ায় ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে ঘটা ভূমিকম্পে নিহত হয় ২ লাখ ৮৬ হাজার।
৫. হাইতির ভূমিকম্প
২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে মারা যায় ২ লাখ ২২ হাজার ৫৭০ জন। আহত হয় ৩ লাখ এবং প্রায় এক লাখ বাড়ি ধ্বংস হয়।
৬. দামঘান, ইরান
৮৫৬ সালের ২২ ডিসেম্বর ইরানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শহর দামঘানে এই ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটে। এর মাত্রা সম্পর্কে কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে নিহতের সংখ্যা ছিল প্রায় ২ লাখ।
৭. হাইজুয়ান, নিংজিয়া, চীন
১৯২০ সালের ৬৭ ডিসেম্বর এই উল্লেখিত অঞ্চলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটে। হাইজুয়ানে নিহত হয় ৭৩ হাজার। গুয়ান কাউন্টিতে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০ হাজারে। লংদি এবং হুইজিয়াংয়ের প্রায় সব ভবনই ধ্বং হয়ে যায়।
৮. আরদাবিল, ইরান
৮৯৩ সালের ২৩ মার্চ ঘটা ওই ভূমিকম্পে জীবন যায় প্রায় দেড় লাখ মানুষের। ১৯৯৭ সালেও এই এলাকায় ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঘটনার ঘটে।
৯. কান্তো, জাপান
১৯২৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর ৭ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে নিহত হয় ১ লাখ ৪২ হাজার ৮০০ জন। ভূমিকম্পের কারণে বিভিন্ন ভবনে অগ্নিকান্ডে অগ্নিদগ্ধ হয় ৩ লাখ ৮১ হাজার। ৬ লাখ ৯৪ হাজার বাড়ি ধ্বংস হয়।
১০. আশগাবাত, তুর্কেমেনিস্তান
১৯৪৮ সালের ৫ অক্টোবর ৭ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্পে ১ লাখ ১০ হাজার মানুষের প্রাণ যায়। আশগাবাতের বিভিন্ন গ্রাম মোটামুটি ধ্ব্ংস হয় বিশেষ করে ইটের তৈরি ঘর সবই ধ্বংস হয়ে যায়।
ভূমিকম্প হলে করণীয়:
ভূমিকম্প হলে সর্ব প্রথম যেটা করণীয় সেটা হল-মাথা ঠান্ডা রাখা,স্থির থাকা,উত্তেজিত না হওয়া। এটা জরুরী এই জন্য যে, উত্তেজিত হলে করণীয় বিষয় কী তা ঠিক করা কঠিন হবে। ভয় দ্রুত সংক্রামক বলে বিপদের মূহূর্তে একজনের সামান্য কথা বা কাজ দ্রুত অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে প্যানিকের মত পরিস্থিতি সৃস্টি করতে পারে।আতঙ্কের সময় জরুরি হলো আতঙ্কগ্রস্ত না-হওয়া। অন্যকে আতঙ্কিত না করা। মহান স্রষ্টাকে স্মরণ করুন।
সাধারণ ভূমিকম্পের ফলে বেশি লোক মারা যায় আতঙ্কিত হয়েই। তাই এই বিষয়ে সতর্ক হোন।
প্রথমত যা যা করনীয়-
বের হওয়ার ক্ষেত্রেঃ…
১. হুড়ো-হুড়ি না করে, সতর্কতার সাথে বের হোন…
২. খোলা স্থানে অবস্থান নিন…
৩. গ্যাস-এর লাইন… ইলেকট্রিসিটি-র লাইন… এ-সব থেকে দূরে থাকুন…
৪. জানালা হতে দূরে থাকুন…
৫. দেয়াল হতে দূরে অবস্থান নিন…
যদি বের না হতে পারেনঃ
১. হুড়ো-হুড়ি করবেন না…
২. ঘরের দরজা খুলে… ঠিক দরজা-র নীচ বরাবর অবস্থান করূন…
৩. গ্যাস-এর চুলা এবং ইলেকট্রিসিটি বন্ধ করে দিন…
৪. জানালা হতে দূরে থাকুন…
৫. কাচঁ-এর জিনিস… যেমনঃ ফুল-দানি / শো-কেস / ড্রেসিং-টেবিল… এ-সব থেকে দূরে থাকুন…
৬. ঘরের যে-কোনো ভারী দ্রব্য… যেমনঃ টেবিল-এর নীচ বরাবর অবস্থান নিতে পারেন…
ভুমিকম্পের সময় করণীয়ঃ
১. ভুমিকম্পের প্রথম ঝাঁকুনির সাথে-সাথে পরিবারের সবাইকে নিয়ে খোলা স্থানে আশ্রয় নিন।
২. যদি ঘর থেকে বের হতে না পারেন তবে, ইটের গাথুনির পাকা ঘর হলে- ঘরের কোনায়, কলাম ও বিমের তৈরী ভবন হলে- কলামের গোড়ায় আশ্রয় নিন।
৩. আপনার বাসস্থান আধাপাকা বা টিনের তৈরী হলে খাটের নিচে আশ্রয় নিন।
৪. ভুমিকম্প রাতের বেলায় হলে কিংবা দ্রুত বের হতে না পারলে সজাগ হওয়ার সাথে সাথে ঘরের কোনে, কলামের গোড়ায় কিংবা শক্ত খাট বা টেবিলের নিচে আশ্রয় নিন।
৫. ঘরে হেলমেট জতীয় কিছু থাকলে দ্রুত নিজের মাথায় পরুন ও অন্যদের পরতে বলুন।
৬. রাতে ঘুমানোর সময় ভুমিকম্প হলে কোন হুড়াহুড়ি না করে গড়িয়ে মেঝেতে কুন্ডলি পাকিয়ে শুয়ে পড়ুন বিছানাকে ঢাল বানিয়ে। খেয়াল রাখবেন যেন বিচানার নীচে চলে না যান, বিছানার পাশে আশ্রয় নিন।
৭. বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়ার সময় সিলিং যখন কোন অবজেক্টের ওপর পড়ে একে গুঁড়িয়ে দেয়, ঠিক তার পাশেই ছোট্ট একটি খালি জায়গা বা void-এর সৃষ্টি হয়। একে বলা হয় ‘সেফটি জোন’ বা ‘ট্রায়াঙ্গল অফ লাইফ’। তাই ভূমিকম্পের সময় বড় কোন সোফা বা বড় কোন অবজেক্ট যেটা কম কম্প্রেস করবে- এরকম কিছুর পাশে আশ্রয় নিলে বাঁচার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
৮. ভূমিকম্পের সময় জানালা বা বারান্দা দিয়ে লাফ দেয়া এসবও করবেন না। কোন সোফা বা সাত নাম্বার পয়েন্টে যেভাবে বলেছি সেভাবে ঘরের মধ্যেই কোন অবজেক্টের পাশে আশ্রয় নিন।
৯. ইন্ড্রাষ্টি কিংবা কারখানায় থাকলে দ্রুত বৈদ্যুতিক সুইচ ও গ্যাস লাইন বন্ধ করে দিন।
১০. টাকা-পয়সা, সোনা-দানা কোন কিছু সংগে নেওয়ার লোভে অযথা সময় নষ্ট করবেন না।
১১. এই সময় কোনমতেই লিফট ব্যবহার করবেন না। কেননা বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে লিফট বন্ধ হয়ে আপনি সেখানে আটকা পড়তে পারেন।
১২. ভূমিকম্পের সময় কখনই সিঁড়িতে আশ্রয় নেবেন না। সিঁড়ির ‘মোমেন্ট অফ ফ্রিকোয়েন্সী’ বিল্ডিং-এর চাইতে ভিন্ন হয় এবং অনেক সময় বিল্ডিং ভেঙ্গে না পড়লেও সিঁড়ি দ্রুত ভেঙ্গে পড়ে।
১৩. আপনি যদি গাড়ি চালানো অবস্থায় থাকেন, তবে সাবধানতার সাথে গাড়ি থামিয়ে দ্রুত ফাকাঁ স্থান দেখে গাড়িতেই অবস্থান করুন। চেস্টা করুন বিল্ডিং, গাছপালা, বিদ্যুৎ এর খুঁটি,লাইট পোস্ট হতে দূরে থাকতে।
১৪. বড় ভূমিকম্পের পরপরই আরেকটা ছোট ভূমিকম্প হয় যেটাকে ‘আফটার শক’ বলে। এটার জন্যও সতর্ক থাকুন।
ভূমিকম্প হওয়ার পর কয়েক ঘন্টার মধ্যে করণীয়ঃ
১. বৈদ্যুতিক,গ্যাস চালিত সব ধুরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহারে বিরত থাকুন।
২. যদি বহুতল ভবনের ওপরের দিকে কোনো তলায় আটকা পড়েন, বেরিয়ে আসার কোনো পথই না থাকে, তবে সাহস হারাবেন না। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন। আপনি এখানে আছেন সেটা উদ্ধারকারি দলের কাছে আওয়াজ পৌছানোর চেষ্টা করুন।
৩. ভুমিকম্পের কারণে যদি আপনি আহত হন বা বিম, দেয়াল, স্লাব বা কংক্রিটের তৈরী কোন অংশে আপনার শরীর আটকে গেলে বা চাপা পড়লে বের হবার সুয়োগ যদি না-ই থাকে তবে বেশী টানা-হেচড়া করবেন না এতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরন হয়ে আপনার দ্রুত মৃত্যু হতে পারে।
৪. ভূমিকম্পের ফলে after shocks,effect যেমন সুনামি হতে পারে। সেজন্য প্রয়োজনীয় প্রস্ততি নিন।
৫. রেডিও থাকলে দূর্যোগ সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য পাবার জন্য সেটি চালু রাখুন। টেলিফোন,মোবাইল চালু থাকলে প্রয়োজনীয় সাহায্য চাওয়ার জন্য এবং ক্ষয়ক্ষতি রিপোর্ট করার জন্য সেটি ব্যবহার করুন।
৬. ধুলাবালি থেকে বাঁচার জন্য আগেই সাথে রুমাল বা তোয়ালে বা চাদরের ব্যবস্থা করে রাখুন।
৭. ম্যাচ জ্বালাবেন না। দালান ধ্বসে পড়লে গ্যাস লিক হয়ে থাকতে পারে।
৮. ছোটখাট আঘাতে সম্ভব হলে নিজের পরিধেয় বস্ত্র ছিড়ে ক্ষতস্থান বেধে দিন।
৯. চিৎকার করে ডাকাডাকি শেষ অপশন হিসেবে বিবেচনা করুন। কারণ, চিৎকারের সময় মুখে ক্ষতিকারক ধুলাবালি ঢুকে যেতে পারে। পাইপে বা ওয়ালে বাড়ি দিয়ে বা মুখে শিস বাজিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতে পারেন। তবে ভাল হয় সাথে যদি একটা রেফারির বাঁশি বা হুইসেল থাকে, তার প্রিপারেশন নিয়ে রাখুন আগেই।
১০. একজায়গাতে,রাস্তাতে জড়ো না হয়ে বরং সড়কপথকে ফাকাঁ রাখুন যাতে জরুরী সাহায্যের যানবাহন দ্রুত চলাচল করতে পারে।
১১. আহত লোকদের যতটুকু সম্ভব সাহায্য করুন। কেউ আটকা পড়লে চেস্টা করুন উদ্ধারের। না পারলে তাকে বা তাদেরকে পানি ও খাবার দিন এবং অভয় দিন।
১২. মনে রাখবেন আপনার উত্তেজনা কিংবা ভয় আপনার জন্য সবচেয়ে বেশী ক্ষতির কারন হবে তাই যত বিপদেই পড়ুন না কেন কখনোই সাহস হারাবেন নাপ্রাথমিক কথা: ভূ-অভ্যন্তরে শিলায় পীরনের জন্য যে শক্তির সঞ্চয় ঘটে, সেই শক্তির হটাৎ মুক্তি ঘটলে ভূ-পৃষ্ঠ ক্ষনিকের জন্য কেঁপে ওঠে এবং ভূ-ত্বকের কিছু অংশ আন্দোলিত হয়। এই রূপ আকস্মিক ও ক্ষনস্থায়ী কম্পনকে ভূমিকম্প (Earthquake) বলে। কম্পন-তরঙ্গ থেকে যে শক্তির সৃষ্টি হয়, তা ভূমিকম্পের মধ্যমে প্রকাশ পায়। এই তরঙ্গ ভূ-গর্ভের কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে উৎপন্ন হয় এবং উৎসস্থল থেকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পরে। ভূমিকম্প সাধারনত কয়েক সেকেণ্ড থেকে এক/দু-মিনিট স্থায়ী হয়। মাঝে মাঝে কম্পন এত দূর্বল হয়, তা অনুভব করা যায় না। কিন্তু শক্তিশালি ও বিধ্বংসী ভূমিকম্পে ঘর-বাড়ি ও ধন-সম্পত্তির ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং অসংখ্য প্রাণহানি ঘটে।
ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট অসুবিধা:
১.মাটির কম্পন ও ভাঙ্গন
২.ভূমিধ্বস ও গর্ত, বিভিন্ন প্রাচীর ফাটল ও ধ্বস
৩. আগুন
৪. মাটির জলীয়করণ
৫. সুনামী
৬. বন্যা
৭. হিউম্যান প্রভাব
ভূমিকম্পের কেন্দ্র :
পৃথিবীর অভ্যন্তরে যেখান থেকে ভূকম্প-তরঙ্গ উৎপন্ন হয়, তাকে ভূমিকম্পের কেন্দ্র বলে। এই কেন্দ্র থেকে কম্পন ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গের মাধ্যমে সব দিকে ছরিয়ে পড়ে। শিলার পীড়ন-ক্ষমতা সহ্যসীমার বাহিরে চলে গেলে শিলায় ফাটল ধরে ও শক্তির মুক্তি ঘটে। তাই প্রায়শই ভূমিকম্পের কেন্দ্র চ্যুতিরেখা অংশে অবস্থান করে। সাধারনত ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১৬ কিমি.-র মধ্যে এই কেন্দ্র অবস্থান করে। তবে ৭০০ কিমি. গভীরে গুরুমণ্ডল (Mantle) থেকেও ভূ-কম্পন উত্থিত হতে পারে।
ভূমিকম্পের কারণ:
ছোটবেলায় গল্প শুনতাম, পৃথিবীটা একটা বড় ষাঁড়ের শিংয়ের মাথায়। ষাঁড়টা যখন এক শিং থেকে অন্য শিংয়ে পৃথিবীটা নিয়ে যায় তখন সবকিছু কেঁপে ওঠে। আর ভাবতাম, এজন্যই ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্পের কারণ এটা নয় বটে, তবে পৃথিবীর গভীরে ঠিকই একটা পরিবর্তন হয়।
সাধারণত তিনটি প্রধান কারণে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়ে থাকে…
১. ভূপৃষ্ঠজনিত
২. আগ্নেয়গিরিজনিত
৩. শিলাচ্যুতিজনিত
আমাদের ভূ -পৃষ্ঠ অনেকগুলো প্লেট এর সমন্বয়ে গঠিত ।এই প্লেট গুলো একটি আরেকটির থেকে আলাদা থাকে ফল্ট বা ফাটল দ্বারা ।এই প্লেটগুলোর নিচেই থাকে ভূ-অভ্যন্তরের সকল গলিত পদার্থ । কোন প্রাকৃতিক কারনে এই গলিত পদার্থগুলোর স্থান চ্যুতি ঘটলে প্লেটগুলোরও কিছুটা স্থান চ্যুতি ঘটে। এ কারনে একটি প্লেটের কোন অংশ অপর প্লেটের তলায় ঢুকে যায় যার ফলে ভূমিতে কম্পন সৃষ্টি হয়। আর এই কম্পনই ভূমিকম্প রূপে আমাদের নিকট আবির্ভূত হয়।
বাংলাদেশের ভূমিকম্প:
বাংলাদেশের ভূমিকম্প বলতে আসলে বাংলাদেশ ও তৎসংলগ্ন এলাকার ভূমিকম্পকে বোঝায়। কারণ বাংলাদেশ আসলে ভারত ও মায়ানমারের ভূঅভ্যন্তরের দুটি ভূচ্যুতির (faultline) প্রভাবে আন্দোলিত হয়, কেননা বাংলাদেশ, ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং বার্মার (মায়ানমারের) টেকটনিক প্লেটের মধ্যে অবস্থান করছে। ভারতীয় এবং ইউরেশীয় প্লেট দুটি (১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে) দীর্ঘদিন যাবত হিমালয়ের পাদদেশে আটকা পড়ে আছে, অপেক্ষা করছে বড় ধরণের নড়াচড়ার, অর্থাৎ বড় ধরণের ভূ-কম্পনের। বাংলাদেশে ৮টি ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি এলাকা বা ফল্ট জোন সচল অবস্থায় রয়েছে, যথা: বগুড়া চ্যুতি এলাকা, রাজশাহীর তানোর চ্যুতি এলাকা, ত্রিপুরা চ্যুতি এলাকা, সীতাকুন্ড-টেকনাফ চ্যুতি এলাকা, হালুয়াঘাট চ্যুতির ডাওকী চ্যুতি এলাকা, ডুবরি চ্যুতি এলাকা, চট্টগ্রাম চ্যুতি এলাকা, সিলেটের শাহজীবাজার চ্যুতি এলাকা (আংশিক-ডাওকি চ্যুতি) এবং রাঙামাটির বরকলে রাঙামাটি চ্যুতি এলাকা।
বুয়েটের গবেষকদের প্রস্তুতকৃত ভূ-কম্পন-এলাকাভিত্তিক মানচিত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশের ৪৩% এলাকা ভূমিকম্পের উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে (জোন-১), ৪১% এলাকা মধ্যম (জোন-২) এবং ১৬% এলাকা নিম্ন ঝুঁকিতে (জোন-৩) রয়েছে। যেখানে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের ভূ-কম্পন মানচিত্রে ২৬% উচ্চ, ৩৮% মধ্যম এবং ৩৬% নিম্ন ঝুঁকিতে ছিলো। নতুন মানচিত্র অনুযায়ী, মাত্রাভেদে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার অবস্থান নিম্নরূপ:
জোন-১: পঞ্চগড়, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সম্পূর্ণ অংশ, এবং ঠাকুরগাঁও, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারের অংশবিশেষ।[২]
জোন-২: রাজশাহী, নাটোর, মাগুরা, মেহেরপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী এবং ঢাকা।[২]
জোন-৩: বরিশাল, পটুয়াখালী, এবং সব দ্বীপ ও চর।
পরিমাপ:
সিসমোগ্রাফ আবিষ্কারের আগে মানুষ শুধু বলতে পারত ভূমিকম্প হয়ে গেছে। কিন্তু কোন মাত্রায় হলো, বলা সম্ভব ছিল না। আধুনিক সিসমোগ্রাফের বয়স প্রায় ১৫০ বছর। ভূমিকম্প মাপা হয় দুইভাবে- তীব্রতা এবং প্রচণ্ডতা বা ব্যাপকতা। ভূমিকম্পের মাত্রা মাপা হয় রিখটার স্কেলে। স্কেলে এককের সীমা ১ থেকে ১০ পর্যন্ত। রিখটার স্কেলে মাত্রা ৫-এর বেশি হওয়া মানে ভয়াবহ দুর্যোগের আশঙ্কা।
মনে রাখতে হবে, ভূমিকম্প এক ডিগ্রি বৃদ্ধি পেলেই এর মাত্রা ১০ থেকে ৩২ গুণ বৃদ্ধি পেতে পারে।
রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা
৫ - ৫.৯৯ মাঝারি
৬ - ৬.৯৯ তীব্র
৭ - ৭.৯৯ ভয়াবহ
৮ - এর ওপর অত্যন্ত ভয়াবহ।
সামগ্রিকভাবে কতটা ঝুঁকির মধ্যে আছে তা জানতে হলে বাংলাদেশ ও তার আশপাশের ভূতাত্ত্বিক গঠণের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। বাংলাদেশ হচ্ছে একটা বদ্বীপ যা কিনা যুগ যুগ ধরে পলি প্রবাহের মাধ্যমে গঠিত হয়েছে। অনেক সময় একে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপ নামেও অবিহিত করা হয়। অবস্থানের বিচারে এই বদ্বীপের অবস্থান তিনটি প্লেটের সংযোগস্থল ১) উত্তরে রয়েছে ইউরেশিয়ান (ইউরোপ এবং এশিয়া) প্লেট। ২) পূর্ব দিকে রয়েছে মায়ানমার বা বার্মা প্লেট। এবং ৩) ভারতীয় প্লেট যার উপরই বাংলাদেশ অবস্থিত।
এটা হচ্ছে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক অবস্থান। শুধুমাত্র বাংলাদেশ এবং এর একটু আশপাশের দিকে তাকালে দেখা যায় বাংলাদেশের উত্তর সীমান্ত বরাবর রয়েছে বিশাল এক ডাউকি চ্যুতি (Dauki fault) যা কিনা শিলং মালভূমির (Shillong plateau) কারণে গঠিত হয়েছে। শিলং মালভূমির মনোরম পাহাড়পুঞ্জ আমাদের মন কেড়ে নিলেও যেকোনো সময়ে এটা আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা:
সবচেয়ে ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা বা ভূমিকম্প এলাকা হচ্ছে-
ইরান, চিলি, জাপান এবং নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট এবং এর বাইরে ওয়েস্ট কোস্ট, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল সহ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল আগ্নেয় ঘটনা ও রেকর্ডিং ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা
বিশ্বের ভয়াবহ ১০টি ভূমিকম্প :
১. সেনসেই, চীন
১৫৫৬ সালের ২৩ জানুয়ারি চীনের সানজি (সাবেক সেনসেই) প্রদেশের রাজধানী জিয়ানে ৮ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্পে নিহত হয় প্রায় ৮ লাখ ৩০ হাজার। এই ভূমিকম্পে ব্যাপক ভ’মিধস হয়। শহরের বড় বড় সব ভবন মাটির সঙ্গে মিশে যায়।
২. তাংশান, চীন
১৯৭৬ সালের ২৭ জুলাই ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এতে নিহতের সংখ্যা ৬ লাখ ৫৫ হাজার। তবে সরকারি হিসেবে এই সংখ্যা ২ লাখ ৫৫ হাজার। ওই ভূমিকম্পের আঁচ বেইজিংয়েও পড়ে।
৩. আলেপ্পো, সিরিয়া
বর্তমানে যুদ্ধবিধস্ত দেশ সিরিয়ায় সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল ১১৩৮ সালের ৯ আগষ্ট। ওই ভূমিকম্পের মাত্রা কত ছিল সেটা জানা যায়নি। তবে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ২ লাখ ৩০ হাজার।
৪. সুমাত্রা, ইন্দোনেশিয়া
তারিখ ছিল ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর। ৯দশমিক ৮ মাত্রার ভ’মিকম্পে প্রাণ যায় ২ লাখ ২৭ হাজার ৮৯৮ জনের। ১৭ লাখ মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব আফ্রিকার ১৪টি দেশে এর প্রভাবে সুনামি হয়। এই ইন্দোনেশিয়ায় ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে ঘটা ভূমিকম্পে নিহত হয় ২ লাখ ৮৬ হাজার।
৫. হাইতির ভূমিকম্প
২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে মারা যায় ২ লাখ ২২ হাজার ৫৭০ জন। আহত হয় ৩ লাখ এবং প্রায় এক লাখ বাড়ি ধ্বংস হয়।
৬. দামঘান, ইরান
৮৫৬ সালের ২২ ডিসেম্বর ইরানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শহর দামঘানে এই ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটে। এর মাত্রা সম্পর্কে কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে নিহতের সংখ্যা ছিল প্রায় ২ লাখ।
৭. হাইজুয়ান, নিংজিয়া, চীন
১৯২০ সালের ৬৭ ডিসেম্বর এই উল্লেখিত অঞ্চলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটে। হাইজুয়ানে নিহত হয় ৭৩ হাজার। গুয়ান কাউন্টিতে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০ হাজারে। লংদি এবং হুইজিয়াংয়ের প্রায় সব ভবনই ধ্বং হয়ে যায়।
৮. আরদাবিল, ইরান
৮৯৩ সালের ২৩ মার্চ ঘটা ওই ভূমিকম্পে জীবন যায় প্রায় দেড় লাখ মানুষের। ১৯৯৭ সালেও এই এলাকায় ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঘটনার ঘটে।
৯. কান্তো, জাপান
১৯২৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর ৭ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে নিহত হয় ১ লাখ ৪২ হাজার ৮০০ জন। ভূমিকম্পের কারণে বিভিন্ন ভবনে অগ্নিকান্ডে অগ্নিদগ্ধ হয় ৩ লাখ ৮১ হাজার। ৬ লাখ ৯৪ হাজার বাড়ি ধ্বংস হয়।
১০. আশগাবাত, তুর্কেমেনিস্তান
১৯৪৮ সালের ৫ অক্টোবর ৭ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্পে ১ লাখ ১০ হাজার মানুষের প্রাণ যায়। আশগাবাতের বিভিন্ন গ্রাম মোটামুটি ধ্ব্ংস হয় বিশেষ করে ইটের তৈরি ঘর সবই ধ্বংস হয়ে যায়।
ভূমিকম্প হলে করণীয়:
ভূমিকম্প হলে সর্ব প্রথম যেটা করণীয় সেটা হল-মাথা ঠান্ডা রাখা,স্থির থাকা,উত্তেজিত না হওয়া। এটা জরুরী এই জন্য যে, উত্তেজিত হলে করণীয় বিষয় কী তা ঠিক করা কঠিন হবে। ভয় দ্রুত সংক্রামক বলে বিপদের মূহূর্তে একজনের সামান্য কথা বা কাজ দ্রুত অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে প্যানিকের মত পরিস্থিতি সৃস্টি করতে পারে।আতঙ্কের সময় জরুরি হলো আতঙ্কগ্রস্ত না-হওয়া। অন্যকে আতঙ্কিত না করা। মহান স্রষ্টাকে স্মরণ করুন।
সাধারণ ভূমিকম্পের ফলে বেশি লোক মারা যায় আতঙ্কিত হয়েই। তাই এই বিষয়ে সতর্ক হোন।
প্রথমত যা যা করনীয়-
বের হওয়ার ক্ষেত্রেঃ…
১. হুড়ো-হুড়ি না করে, সতর্কতার সাথে বের হোন…
২. খোলা স্থানে অবস্থান নিন…
৩. গ্যাস-এর লাইন… ইলেকট্রিসিটি-র লাইন… এ-সব থেকে দূরে থাকুন…
৪. জানালা হতে দূরে থাকুন…
৫. দেয়াল হতে দূরে অবস্থান নিন…
যদি বের না হতে পারেনঃ
১. হুড়ো-হুড়ি করবেন না…
২. ঘরের দরজা খুলে… ঠিক দরজা-র নীচ বরাবর অবস্থান করূন…
৩. গ্যাস-এর চুলা এবং ইলেকট্রিসিটি বন্ধ করে দিন…
৪. জানালা হতে দূরে থাকুন…
৫. কাচঁ-এর জিনিস… যেমনঃ ফুল-দানি / শো-কেস / ড্রেসিং-টেবিল… এ-সব থেকে দূরে থাকুন…
৬. ঘরের যে-কোনো ভারী দ্রব্য… যেমনঃ টেবিল-এর নীচ বরাবর অবস্থান নিতে পারেন…
ভুমিকম্পের সময় করণীয়ঃ
১. ভুমিকম্পের প্রথম ঝাঁকুনির সাথে-সাথে পরিবারের সবাইকে নিয়ে খোলা স্থানে আশ্রয় নিন।
২. যদি ঘর থেকে বের হতে না পারেন তবে, ইটের গাথুনির পাকা ঘর হলে- ঘরের কোনায়, কলাম ও বিমের তৈরী ভবন হলে- কলামের গোড়ায় আশ্রয় নিন।
৩. আপনার বাসস্থান আধাপাকা বা টিনের তৈরী হলে খাটের নিচে আশ্রয় নিন।
৪. ভুমিকম্প রাতের বেলায় হলে কিংবা দ্রুত বের হতে না পারলে সজাগ হওয়ার সাথে সাথে ঘরের কোনে, কলামের গোড়ায় কিংবা শক্ত খাট বা টেবিলের নিচে আশ্রয় নিন।
৫. ঘরে হেলমেট জতীয় কিছু থাকলে দ্রুত নিজের মাথায় পরুন ও অন্যদের পরতে বলুন।
৬. রাতে ঘুমানোর সময় ভুমিকম্প হলে কোন হুড়াহুড়ি না করে গড়িয়ে মেঝেতে কুন্ডলি পাকিয়ে শুয়ে পড়ুন বিছানাকে ঢাল বানিয়ে। খেয়াল রাখবেন যেন বিচানার নীচে চলে না যান, বিছানার পাশে আশ্রয় নিন।
৭. বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়ার সময় সিলিং যখন কোন অবজেক্টের ওপর পড়ে একে গুঁড়িয়ে দেয়, ঠিক তার পাশেই ছোট্ট একটি খালি জায়গা বা void-এর সৃষ্টি হয়। একে বলা হয় ‘সেফটি জোন’ বা ‘ট্রায়াঙ্গল অফ লাইফ’। তাই ভূমিকম্পের সময় বড় কোন সোফা বা বড় কোন অবজেক্ট যেটা কম কম্প্রেস করবে- এরকম কিছুর পাশে আশ্রয় নিলে বাঁচার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
৮. ভূমিকম্পের সময় জানালা বা বারান্দা দিয়ে লাফ দেয়া এসবও করবেন না। কোন সোফা বা সাত নাম্বার পয়েন্টে যেভাবে বলেছি সেভাবে ঘরের মধ্যেই কোন অবজেক্টের পাশে আশ্রয় নিন।
৯. ইন্ড্রাষ্টি কিংবা কারখানায় থাকলে দ্রুত বৈদ্যুতিক সুইচ ও গ্যাস লাইন বন্ধ করে দিন।
১০. টাকা-পয়সা, সোনা-দানা কোন কিছু সংগে নেওয়ার লোভে অযথা সময় নষ্ট করবেন না।
১১. এই সময় কোনমতেই লিফট ব্যবহার করবেন না। কেননা বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে লিফট বন্ধ হয়ে আপনি সেখানে আটকা পড়তে পারেন।
১২. ভূমিকম্পের সময় কখনই সিঁড়িতে আশ্রয় নেবেন না। সিঁড়ির ‘মোমেন্ট অফ ফ্রিকোয়েন্সী’ বিল্ডিং-এর চাইতে ভিন্ন হয় এবং অনেক সময় বিল্ডিং ভেঙ্গে না পড়লেও সিঁড়ি দ্রুত ভেঙ্গে পড়ে।
১৩. আপনি যদি গাড়ি চালানো অবস্থায় থাকেন, তবে সাবধানতার সাথে গাড়ি থামিয়ে দ্রুত ফাকাঁ স্থান দেখে গাড়িতেই অবস্থান করুন। চেস্টা করুন বিল্ডিং, গাছপালা, বিদ্যুৎ এর খুঁটি,লাইট পোস্ট হতে দূরে থাকতে।
১৪. বড় ভূমিকম্পের পরপরই আরেকটা ছোট ভূমিকম্প হয় যেটাকে ‘আফটার শক’ বলে। এটার জন্যও সতর্ক থাকুন।
ভূমিকম্প হওয়ার পর কয়েক ঘন্টার মধ্যে করণীয়ঃ
১. বৈদ্যুতিক,গ্যাস চালিত সব ধুরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহারে বিরত থাকুন।
২. যদি বহুতল ভবনের ওপরের দিকে কোনো তলায় আটকা পড়েন, বেরিয়ে আসার কোনো পথই না থাকে, তবে সাহস হারাবেন না। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন। আপনি এখানে আছেন সেটা উদ্ধারকারি দলের কাছে আওয়াজ পৌছানোর চেষ্টা করুন।
৩. ভুমিকম্পের কারণে যদি আপনি আহত হন বা বিম, দেয়াল, স্লাব বা কংক্রিটের তৈরী কোন অংশে আপনার শরীর আটকে গেলে বা চাপা পড়লে বের হবার সুয়োগ যদি না-ই থাকে তবে বেশী টানা-হেচড়া করবেন না এতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরন হয়ে আপনার দ্রুত মৃত্যু হতে পারে।
৪. ভূমিকম্পের ফলে after shocks,effect যেমন সুনামি হতে পারে। সেজন্য প্রয়োজনীয় প্রস্ততি নিন।
৫. রেডিও থাকলে দূর্যোগ সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য পাবার জন্য সেটি চালু রাখুন। টেলিফোন,মোবাইল চালু থাকলে প্রয়োজনীয় সাহায্য চাওয়ার জন্য এবং ক্ষয়ক্ষতি রিপোর্ট করার জন্য সেটি ব্যবহার করুন।
৬. ধুলাবালি থেকে বাঁচার জন্য আগেই সাথে রুমাল বা তোয়ালে বা চাদরের ব্যবস্থা করে রাখুন।
৭. ম্যাচ জ্বালাবেন না। দালান ধ্বসে পড়লে গ্যাস লিক হয়ে থাকতে পারে।
৮. ছোটখাট আঘাতে সম্ভব হলে নিজের পরিধেয় বস্ত্র ছিড়ে ক্ষতস্থান বেধে দিন।
৯. চিৎকার করে ডাকাডাকি শেষ অপশন হিসেবে বিবেচনা করুন। কারণ, চিৎকারের সময় মুখে ক্ষতিকারক ধুলাবালি ঢুকে যেতে পারে। পাইপে বা ওয়ালে বাড়ি দিয়ে বা মুখে শিস বাজিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতে পারেন। তবে ভাল হয় সাথে যদি একটা রেফারির বাঁশি বা হুইসেল থাকে, তার প্রিপারেশন নিয়ে রাখুন আগেই।
১০. একজায়গাতে,রাস্তাতে জড়ো না হয়ে বরং সড়কপথকে ফাকাঁ রাখুন যাতে জরুরী সাহায্যের যানবাহন দ্রুত চলাচল করতে পারে।
১১. আহত লোকদের যতটুকু সম্ভব সাহায্য করুন। কেউ আটকা পড়লে চেস্টা করুন উদ্ধারের। না পারলে তাকে বা তাদেরকে পানি ও খাবার দিন এবং অভয় দিন।
১২. মনে রাখবেন আপনার উত্তেজনা কিংবা ভয় আপনার জন্য সবচেয়ে বেশী ক্ষতির কারন হবে তাই যত বিপদেই পড়ুন না কেন কখনোই সাহস হারাবেন না
বিষয়: বিবিধ
১৪০২ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন