কাঁদে মন পরবাসে (১ম পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ০৪ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৮:১৫:৪১ রাত
আমাদের সম্মানিত পিতা-মাতা, বড় ভাই-বোন! যাদের সন্তানেরা, ভাই কিংবা বোনেরা বিদেশে আছে, স্নেহের বিবিরা, আদরের ভাই-বোনেরা, আত্মিয়-স্বজন কিংবা বন্ধুরা! একবারও কি ভেবে দেখেছো? (যারা কখনো পরবাসী হয় নি তাদের জন্য প্রযোজ্য) আমরা যারা পরবাসী, পরের গুহায় বাস করে রোজগার করছি, তারা কতটা কষ্ট, ব্যদনা, যাতনা, বঞ্চনা আর লাঞ্চণার মাঝে আছি?
তোমরা শুধু চাও টাকা আর টাকা! উপহার আর উপহার। কেউ দেশে গেলে, কখনো নিজে গেলে সবারই সুপ্ত ইচ্ছে থাকে তার জন্য কিছু নেওয়া হৌক।
বিচিত্র পৃথিবীতে বিচিত্র আমাদের দেশের বিচিত্র সংস্কৃতি! দেশে কেউ বড় চাকুরী করলে, ব্যবসা করলে, যার আয় ৫০ হাজার থেকে লাখের উপর তার কাছে কেউ প্রত্যাশা করে না, কেউ বলে না আমাকে একটা ঘড়ি, সেলুলার, কম্বল দিস! শুধু একজন কেউ পরবাসী হলে তার কাছেই সবার প্রত্যাশা (বাবা, মা, ভাই-বোন, পেয়ারা বিবি, দাদা-দাদী/নানা-নানী...সবার) থাকে কিছু একটা দেবে। সে হোক ভালো কর্মজীবি অথবা রাস্তার ঝাড়ুদার! (হয়তো বিদেশি জিনিসের প্রতি আমাদের আলাদা মমত্বের জন্য।)
তোমরা এখন শোনো- পরবাসে আমরা কী করে এতো এতো মাল (টাকা-পয়সা/অর্থ-কড়ি) কামাই!
ইতালির অবস্থা বর্ণনা করছি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। ২০০৭ সালের মাঝামাঝিতে রোম প্রশাসন রাস্তায় হকারগিরির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। অন্যান্য শহরে আগে থেকেই এই কাজ নিষিদ্ধ ছিল। ফলে রোম শহরের বেকারদের উপর বাড়তি চাঁপ পড়ে কাজের উপর। আগে যারা হকারি করতো তারাও কাজ খুঁজছে। যদিও হকারিতে আয় বেশি ছিল। কিন্তু মামুদের (পুলিশ) উত্পাতে তা আর যুত্সই ভাবে করা যাচ্ছিল না।
এখন বাইরের শহরের ( মিলান, ভেনিস, ভিসেন্সা )অনেক কল-কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়াতে রোম শহরে আরো বেশি করে চাঁপ পড়ছে। যারা কাজ করে এখানে তা বেশির ভাগই- রেস্টুরেন্ট (পিজ্জারিয়া pizzeria, পাস্তারিয়া pasteria, বার bar, tavola calda ইত্যাদি), হোটেল, আলবেরগো, সুপার মার্কেট, কাঁচাবাজারের সব্জি-ফল, ফুল, মাছের, মাংসের দোকানে, কম্যুনির পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায়, পেট্রোল পাম্পে, দেশিয় ভাইদের দোকান- ট্রাভেল, এজেন্সী বা স্কুল, কিছু শপিংমল ইত্যাদিতে।
যারা পেট্রোল পাম্পে কাজ করেন, তারা গন্ধে আর গাড়ি ওয়াশের সময় কোমড়ের ব্যথায় মরেন আর যারা বিভিন্ন ম্যাগাজিন বা কাঁচাবাজের দোকানে কাজ করেন তাদের মেরুদন্ডের হাড় ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যায়।
অনেকে ব্যবসা করে আবার কোটিপতি, লাখপতি-হাজারপতি! লালবাতিতে আছে। তাদের বেশিরভাগ- বিজুত্তেরিয়া, আলেমেন্টারি, সুপার মার্কেট ( এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট), ট্রাভেল এজেন্সী- মানি এজেন্সী, কাঁচাবাজারে দোকান, কম্যুনির নির্ধারিত স্থানে বিভিন্ন বাংকার (জুতা-কাপড়-প্রসাধনী-তৈজস-রান্নাঘরীয়) সাজানো, ফোন-ফ্যক্স-ইন্টারনেট (যদিও মন্দাভাব) এরা হয়তো অনেকেই ভালো আছেন।
আর যারা কাজ করেন না বা কাজ নেই তারা যা করেন-
(০১) ডান্ডা মারা:
এক সময় এই কাজ করে ( হাতে ডান্ডা নিয়ে বিভিন্ন সিগনালে অথবা পেট্রোল পাম্পে গাড়ি পরিষ্কার করে দেয়া) অনেকে কোটিপতি হয়েছেন (লিরার মানে ইউরো আসার আগের আমলে)। এখন তো তা অবৈধ হয়ে গেছে। তারপরও অনেকে এই কাজ করছেন সতর্ক হয়ে! পয়সা দেয়া কমে গেছে ইতালিয়ানদের!
(০২) সেলফ সার্ভিস:
বিভিন্ন পেট্রোল পাম্পে ( সেলফ সার্ভিসের সময় যখন মালিক না থাকেন) গাড়িতে তেল ভরিয়ে দিয়ে গাড়ির মালিকের দেয়া নগণ্য উপহারে অনেক আয় হতো এক সময়। এখন কমে গেছে।
(০৩) ভিক্ষা
সরাসরি এই কাজ আমরা বাঙ্গালিরা করি না। অনেক বিদেশি সিগনালে, মার্কেটের সামনে হাত বাড়িয়ে, ক্যাপ পেতে , ট্রেনে বাসে গান গেয়ে ভিক্ষা করছেন। তবে দেশিয় ভাইয়েরা একটু ভিন্ন পদ্ধিতে এই কাজ করছেন। যেমন- বিভিন্ন টুরিষ্ট পয়েন্টে স্ট্যচু হয়ে থাকা, অদ্ভুত ভঙ্গি করা, যাদু (ফালতু)-খেলা দেখানো বা শূণ্যে ভেসে বসে থাকা। কোনো টুরিষ্ট বা পথচারি মন চাইলে কিছু দেয়া! এই সবে আগে অনেক ইনকাম হতে (প্রাক ইউরোর সময়)।
(০৪) হকারি
এখানে বিশেষ কিছু এলাকার লোকদের বলা হয়"পা ফাটা" (এখানে জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণে বললাম না, যারা থাকেন তারা জানেন। ) বলা হয়, কারণ- তারা বিছানায় পা লাগিয়ে ঘুমান না, অনেকটা রেডি হয়ে জুতা পড়ে অর্ধেক পা বাইরে রেখে শুয়ে থাকেন যাতে বৃষ্টি নামা (শীতকালের প্রায় সময় যে কোনো মুহূর্তে) মাত্র ছাতা-প্লাস্টিক জামা নিয়ে বের হতে পারে।
তাছাড়া- ঘড়ি, ব্যাগ, বিজুত্তেরিয়ার মাল, কলম, খেলনা, টিস্যু পেপার, মোজা, জুতা ইত্যাদি নিয়ে বিভিন্ন টুরিষ্ট পয়েন্ট, টার্মিনাল, বাসের প্রধান স্টপিছ, সিগনালে, মেট্রো স্টপিছে অস্থায়ী ভাবে পসরা সাজানো বা হাতে নিয়ে বিক্রি করা। এখন তা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
(০৫) ফুল বিক্রি
কেউ রাতে ফুল বিক্রি করে, খেলনা বা লাইটার বা কলম হাতে নিয়ে (এক্ষেত্রে অনেকটা পাবলিকদের, প্রেমীদের, টুরিষ্টদের হয়রানী করা হয়! কেউ হয়তো চায় না, তারপরও বলা হবে এমনিতেই দিচ্ছি, কোনো টাকা লাগবে না, তারপর সে হাতে নিয়ে চলে গেলে বলবে আমাকে কিছু খাবারের জন্য পয়সা দে, তার পিছু পিছু হাঁটবে, সে যদি কিছুই না দেয় এক সময় হকারটি তার দেয়া ফুল ফিরিয়ে নেবে ঐ লোকের প্রেমী বা সন্তান বা বিবিদের সামনে।কেউ হয়তো বাচ্ছাদের সামনে খেলনা মেলে ধরবে এক্ষেত্রে অভিভাবক অনেকটা বাধ্য হোন তা কিনতে। এই কারণে আমাদের বাংগালি কমুনিটির বদনাম হচ্ছে।) বিভিন্ন টুরিষ্ট জোন বা রেস্টুরেন্ট ঘুরে।
এই কাজ সবাই পারে না যারা পারে তারা লালে লাল! এবং দেশের জন্য বদনাম কামান।
আসুন এই কাজ ছেড়ে ভালো কোনো উপার্জনের পথ খুজি। হে আমার দেশের দেশি! একটু চিন্তা করুন! কত না পরিশ্রমের পর একজন পরবাসী একটা পয়সা কামান এবং কত না ধান্ধায় তাকে থাকতে হয়।
রেমিটেন্স ভালোবাসেন আর আমাদের মতো হকার কিংবা ঝাড়ুদারদের ঘৃণা করেন? একবার চিন্তা করে দেখুন- আমরা যারা কোনো রেস্টুরেন্টের কুক বা টেবিলবয় তাদের সাথে মোছামুছির কাজ করেন (পার্ট টাইম) একজন কলেজের প্রফেসর বা কোনো ছাত্র, কোনো অফিসের কর্মকর্তা বা কর্মচারী। তারা কিন্তু হীনমন্যতায় ভোগে না।
বি.দ্র: নিজেদের দোষে বতর্মানে মুল স্পন্সর বা সিজনাল স্পন্সরে বাংলাদেশি কোটা আপাতত:বাতিল করে দিয়েছে ইতালি সরকার।
বিষয়: বিবিধ
১২৪৭ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমি কেনই বা মধ্যপ্রাচ্যে যাব?
সেখানে অনেক বাংলাদেশী আপনারই মত আছে অন্তত ইউরোপের তুলনায় । তাদের সাথে ভালই সময় কেটে যেত । মন কাঁদা /বোরিং ভাব অনেকটা কম হত।
সেটা ফুলের বাগিচা হোক আর আস্তাঁকুড়ে হোক।
মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থা কি ভালো?
...
প্রবাস নিয়ে লিখে যান সাথে আছি
মন্তব্য করতে লগইন করুন