বান্দাহর হকের গুরুত্ব (সত্যের সন্ধানে ৫ম পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন সামসুল আলম দোয়েল ১৭ নভেম্বর, ২০১৪, ০৭:৫১:১৫ সন্ধ্যা
আমাদের মুক্তির, পরকালে সফলতার একমাত্র পথ হচ্ছে, "সুন্নাহর" অনুসরণ। সুন্নাহকে মানলে কুরআন ও হাদীস মানা হবে। আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: আমার সব উম্মাত জান্নাতে প্রবেশ করবে, যারা অস্বীকার করে তারা ব্যতীত। জিগ্যেস করা হলো- কারা অস্বীকার করে হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন: যে আমার আনুগত্য করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার বিরোধিতা করে সে অস্বীকার করে। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত: ১৩৫)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন: " যে আমার সুন্নাতকে ভালোবাসে সে আমাকে ভালোবাসে, আর যে আমাকে ভালোবাসে সে জান্নাতে আমার সাথে থাকবে। (তিরমিযী, মিশকাত: ১৬৫)
বিচিত্র আমাদের এই সমাজে আমরা রাসূলের সুন্নাত শুধু পোষাকিতে সীমাবদ্ধ রেখেছি! আমরা শুধু জুব্বা, পাঞ্জাবি, টুপি, দাড়ি, পাগড়ি আর নামাযের ব্যাপারে সুন্নাতকে মজবুত করে আঁকড়ে আছি এবং মানুষদের এই ব্যাপারে জোর জবরদস্তি করছি। ইসলামী জিন্দেগীর বাকি বিষয়গুলোতে আমরা বড়ই উদাসীন!
আল্লাহ তাআলা আমাদের পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন মানুষের কল্যাণের জন্য ( জাহান্নাম থেকে তাদের বাঁচানো)। এই কথাটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু -
আমরা বেশিরভাগ মুসলমান কল্যাণের পথ বলতে শুধু তাদের নামায, রোযা, দাড়ি-টুপি আর পাগড়ির ফযিলত বর্ণনা করে সেই দিকে ডাকছি। সত্পথে ডাকা শুধু নামায পড়াই নয়, আরো যে অনেক কিছু আছে তা ভুলে গেছি। আর খারাপ কাজ থেকে নিষেধের ব্যাপারে তো খুবই উদাসীন।
একজন শূশ্রুমন্ডিত জুব্বা-টুপি পড়িহিত, হাতে তাসবীহ-মিসওয়াক, চিরুণী আর মসজিদে গিয়ে জামাতে পাঁচ ওয়াক্ত আদায়ি নামাযিকে আমরা ভালো মুসুল্লি বা পরহেয মনে করি, কিন্তু আমরা দেখি না তার উপার্জনে কী পরিমাণ ভেঁজাল। তার আচরণ, তার অন্যান্য আচার কেমন? অধিকাংশ (মুসুল্লীদের প্রতি সম্মান রেখে বলছি) এই সব পরহেযগার ব্যক্তি মানুষের উপর জুলম করছেন, দেনার খেলাপি, রক্তখেকো অথবা অফিসে দুর্নীতি করছেন, সময় মত অফিস করেন না, কাজকে গুরুত্ব দেন না, ঘুষ নিচ্ছেন বৈধতা দিয়ে, মানুষদের হয়রানি করছেন, ঠকাচ্ছেন অসহায়দের, বোকাদের, সরলদের।
আমরা শুধু মানুষদের বান্দাহ হিসেবে আল্লাহর হকের কথা বলছি, মানুষের হকের ব্যাপারে চুঁপ রয়েছি। অথচ-
মানুষের হক পুরোপুরি আদায় না করে কেউ কখনো মুক্তি পেতে পারে না। আল্লাহর হকের ব্যাপারে মূলকথা হলো, যদি তার সাথে শিরক না করা হয় তাহলে হয়তো আল্লাহ বান্দাহর সব গুনাহ ক্ষমা করতে পারেন! কিন্তু বান্দাহর হকের ব্যাপারে গুনাহ হলে তা কখনো ক্ষমা করবেন না, যতক্ষণ না বান্দাহ ক্ষমা করে।
(দ্রষ্টব্য: মুসলিম, মিশকাত: ২৬৪০, ২৬৬৬-২৬৬৮, আহমাদ, মিশকাত: ২৬৫২)
আমরা শুধু কিছু ইসলামী শেয়ার বা প্রধান ইবাদতকে মানার ব্যাপরে কঠোরতা দেখাচ্ছি আর বাকি জিন্দেগীতে সুন্নাহর ব্যাপারে বেখেয়ালি।
কিন্তু ইবাদত কবুল হবার জন্য সেই সবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন- হালাল উপার্জন, হালাল খাদ্য গ্রহণ ইত্যাদি।
মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য, সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার দায়িত্ব, পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য, পরিবারের প্রতি কর্তব্য, দায়িত্ব- একজন নাগরিক হিসেবে
সমাজের প্রতি, অসহায়ের প্রতি, দু:স্থ, নি:স্ব, অনাথ, মুসাফির, দূর্বল এবং সর্বোপরি দেশের প্রতি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি মিথ্যা শপথের মাধ্যমে কোনো মুসলমানের হত আত্মসাত করল, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নামের আগুন অনিবার্য করে দিবেন এবং জান্নাত তার জন্য হারাম করে দিবেন। বলা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! যদি তা তুচ্ছ জিনিসের ব্যাপারে হয়। তিনি বললেন: যদি তা পিলুগাছের একটা ডাল হোক না কেন (মানে যতোই সামান্য হোক)! (মুসলিম)
কারো উপর জুলম বা অত্যাচার করলে তার ভয়াবহতা কত, সে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন: যে ব্যক্তি এক বিঘত পরিমাণ জমিতে জুলম করল, সাত তবক জমিন তার গলায় পড়িয়ে দেয়া হবে। (বুখারী-মুসলিম)
আরো দেখুন:- সুরা হাজ্জ: ৩০/৮৯, সুরা হিজর: ৮৮, সুরা আল মায়িদা: ৩২, সুরা মুমিন: ১৮
আমরা পাঞ্জাবি-টুপি পড়তে, দাড়ি রাখতে, তাজবিদ সহকারে কুরআন তেলাওয়াতে, নিমের ডাল দিয়ে দাত মাজতে, তসবীহ হাতে ঘুরে, সুগন্ধি মেখে সওয়াব অর্জণে প্রতিযোগিতায় নামছি, কিন্তু-
মানুষদের অবহেলা করছি, তাদের হক আদায় করছি না, অসহায়দের আরো অসহায় করছি, নি:স্বকে আরো নি;স্ব বানাচ্ছি, কাজে ফাঁকি দিচ্ছি, উত্কোচ নিচ্ছি, মানুষের মাঝে আল্লাহর বিধান দিয়ে ফায়সালা করছি না, শাসনকাজে আল্লাহর হুকুম অনুপস্থিত, বিচারে সততা-ন্যায়ভ্রষ্ট, আল্লাহর আদেশ অবহেলিত।
(দ্রষ্টব্য: সুরা নিসা: ১/ ৩৬, ১৩৫, সূরা তালাক: ১৭, সুরা বানী ইসরাইল: ২৩-২৪., সুরা কাহফ: ২৮, সুরা আহযাব: ৫৮)
মানুষের সাথে সততা, ন্যায় আচরণ, সদ্ভাব এবং হক আদায় করার প্রয়োজনিয়তা, মানুষের অধিকার গ্রাসের পরিণতি সম্পর্কে একটি হাদীসই বুঝার জন্য যথেষ্ট।
আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিগ্যেস করলেন: তোমরা কি জানো " মুফলিস" কাকে বলে? (সাহাবীরা ) বললেন, আমাদের মাঝে ঐ ব্যক্তি যার অর্থ-কড়ি ও সহায়-সম্বল নেই। অত:পর রাসূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: আমার উম্মাতের মধ্যে ঐ ব্যক্তি দরিদ্র (মুফলিস) যে কিয়ামতের দিন বহু নামাজ, রোযা, যাকাত নিয়ে উপস্থিত হবে অথচ সে কাউকে "গালি দিয়েছে, কাউকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, কারো মাল আত্মসাত করেছে, কাউকে অন্যায় ভাবে হত্যা করেছে, কাউকে প্রহার করেছে (সর্বোপরি পরাধিকার গ্রাস!) তারপর (বিচারের সময়) তার থেকে এদের (দাবীদারদের) দাবী পূরণের জন্য নেকী দেয়া হবে। এভাবে যদি দাবীদারদের দাবী পূরণের আগেই তার নেকী শেষ হয়ে যায়, তখন তাদের গুনাহ তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে আর তাকে নিক্ষেপ করা হবে জাহান্নামে।
(মুসলিম, তিরমিযী)
সুতরাং আমাদের কতটা সচেতন হতে হবে মানুষের হকের ব্যাপরে তা আশা করি বুঝাতে পারলাম!
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: তোমরা আমার সন্তুষ্টি নি:স্ব আর দূর্বলদের মাঝে অন্বেষণ করো, কেননা তোমরা তাদের অসীলায় রিযক প্রাপ্ত হও। (আবু দাউদ)
আসুন আমরা মানুষের হকের ব্যাপারে সচেতন হই।
বিষয়: বিবিধ
১০৯৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন