একজন মীর কাসেম আলীর গল্প.. লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

লিখেছেন লিখেছেন বাকশাল ০৫ নভেম্বর, ২০১৪, ০৮:৪৪:৪৫ রাত

মীর কাসেম তখন পরম স্নেহে আমাকে তার রুমে ডেকে নিতেন নতুবা আমার রুমে আসতেন। তিনি কথা বলতেন কম এবং শুনতেন খুব বেশি।.. কয়েক দিন পর আমি বুঝলাম মীর কাসেম সমাজের অন্য মানুষের মতো নন। এ আমি বুঝেছিলাম তার আচার-আচরণ, চালচলন, কথাবার্তা, খাদ্যাভ্যাস ও ইবাদত বন্দেগির ধরন দেখে।..

জেলে যাওয়ার আগে বহুজনের কাছে বহুবার তার ব্যাপারে বহু কথা শুনেছি। তার নাকি আছে হাজার হাজার কোটি টাকা। তিনি জামায়াতের প্রধান অর্থ যোগানদাতা, দেশে-বিদেশে তার রয়েছে নামে বেনামে বহু প্রতিষ্ঠান। দেশের মধ্যে চলাফেরার জন্য তিনি সব সময় নাকি নিজস্ব হেলিকপ্টার ব্যবহার করেন ইত্যাদি।... বাংলাদেশের ধনীদের বসবাসের কয়েকটি এলাকা আছে তাদের মেলামেশার জন্য কয়েকটি ক্লাব আছে, তাদের ব্যক্তিগত বিলাসিতার গাড়ি, বাড়ি, নারী, বাগানবাড়ি, বন্ধু-বান্ধব, সভা-সমিতির এবং ব্যবসায়ী সংগঠনের নাম ধাম অনেকের মতো আমিও জানি। ওই সমাজে মীর কাসেম নামে কোনো লোক নেই। মিরপুরের কোনো এক জায়গায় পাঁচ কাঠার ওপর নির্মিত একটি পৈতৃক বাড়িতে স্বাধীনতার পর থেকেই তিনি অন্য ভাইদের সাথে ভাগাভাগি করে থাকেন।..... জামা-কাপড়, সাজসজ্জা, আসবাবপত্র কোনো কিছুই আমার কাছে অসাধারণ মনে হয়নি, বিশেষ করে ডিভিশনপ্রাপ্ত অন্য কয়েদিদের তুলনায়। আমরা সবাই জেলখানার ভেতরের দোকান থেকে কিনে মিনারেল ওয়াটার খেতাম। অন্য দিকে মীর কাসেম খেতেন সাধারণ ট্যাপের পানি। কোনো বিদেশী ফলমূল খেতেন না। জাম্বুরা, আনারস, আমড়া, কলা প্রভৃতি দেশী ফল সময় ও সুযোগ মতো খেতেন। আমাদের সবার রুমে ছয়টি করে সিলিং ফ্যান ছিল। আমরা নিজেরা সব সময় সব ফ্যান ছেড়ে রাখতাম। মীর কাসেম ভুলেও সে কাজটি করতেন না দরকার পড়লে একটি মাত্র ফ্যান ছাড়তেন। তার এই অবস্থা দেখে গিয়াস উদ্দিন আল মামুন প্রায়ই বলতেন স্যার, এত টাকা দিয়ে কী করবেন! তিনি জবাব না দিয়ে শুধু হাসতেন।...হঠাৎ আমি প্রশ্ন করলাম ভাই, আপনার ওজন কত? তিনি বললেন, ৯২ কেজি? আমি বললাম, সর্বনাশ, তাড়াতাড়ি কমান! না হলে সিরিয়াস ঘটনা ঘটে যাবে। কী ঘটনা ঘটবে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন। আমি বললাম হাবভাবে মনে হচ্ছে আপনার ফাঁসি হবে! ...হাসতে হাসতে আসমানের পানে তাকালেন এবং বললেন, এমপি সাহেব! সব ফয়সালা তো ওই আসমান থেকেই আসবে!...মীর কাসেমের দু’টি অভ্যাস নিয়ে আমরা হাসাহাসি করতাম। প্রতি ওয়াক্ত নামাজে তিনি একেক সেট পোশাক পরতেন। আমরা চার ওয়াক্ত নামাজ জামাতে আদায় করতে গিয়ে দেখতাম প্রতিবারই তিনি পোশাক পরিবর্তন করে আসতেন। মামুন ছিলেন দারুণ মুখপোড়া প্রকৃতির। বলতেন, কেন চার বেলা পোশাক পরিবর্তন করেন? তিনি বলতেন, চার বেলা নয় আমি তো পাঁচ বেলা পোশাক পরিবর্তন করি। একজন রাজা বাদশাহ বা সম্মানিত লোকের দরবারে আমরা যেমন পরিপাটি নতুন পোশাকে হাজির হই, তেমনি আল্লাহর দরবারে হাজির হতে গিয়ে আমি দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় পোশাক পরিবর্তন করি।..পোশাক পরিবর্তন ছাড়াও তার আরেকটি অভ্যাস ছিল প্রতি বিকেলে নিচে নেমে সবার সাথে সালাম বিনিময় ও করমর্দন করা। আমাদের সেলের প্রধান গেটের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি রাস্তা চলাচলকারী আসামি ও অন্য সেলের কয়েদিদের সাথে সালাম ও শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন। আসামিদের মধ্যে কিলার আব্বাসসহ বেশ কয়েকজনের বাড়ি ছিল মিরপুরে। তিনি তাদের সাথে একটু বেশি আন্তরিকতা দেখাতেন। মামুন টিপ্পনী কাটতেন স্যার, মিরপুর থেকে ইলেকশন করবেন তো! তাই জেলে বসেই সব কিছু ঠিকঠাক করছেন। তিনি শান্তশিষ্ট ভঙ্গিতে সিরিয়াস হয়ে উত্তর দিতেন আরে নাহ কোনো ইলেকশন না। আমি প্রতিবেশীর হক আদায় করার চেষ্টা করছি।... হঠাৎ একদিন নাশতার টেবিলে দেখলাম মীর কাসেমের মন খুব খারাপ। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম ব্যাপার কী? কী হয়েছে? তিনি বললেন একটি বিষয় চিন্তা করতে করতে রাতে আর ঘুম হলো না। আর সে কারণেই রাত থেকে মনটা ভার হয়ে আছে। আমরা তার কথায় সিরিয়াস হয়ে গেলাম। প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কী নিয়ে সারা রাত চিন্তা করলেন আর কেনোই বা এত মন খারাপ হলো? তিনি মুখ ভার করেই জবাব দিলেন কাল রাতে একটি জার্নালে পড়লাম সাইবেরিয়া, আইসল্যান্ড ও অ্যানটার্কটিকার বরফের স্তর বিশ্বব্যাপী পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে দ্রুত গলে যাচ্ছে। এভাবে গলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মতো দেশ সমুদ্রের জলরাশির মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে। বাংলাদেশ যদি বিলীন হয়ে যায় তবে, ১৭ কোটি মানুষের কী হবে? আমি পুরো বেকুব হয়ে গেলাম এবং তার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবলাম হায়রে মানুষ! যার নিজের জীবনের যেখানে ঠাঁইঠিকানা নেই, সেখানে তিনি কিনা ভাবছেন অ্যানটার্কটিকার বরফ নিয়ে।

বিষয়: বিবিধ

১০৬৮ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

281571
০৫ নভেম্বর ২০১৪ রাত ০৯:৩৪
শেখের পোলা লিখেছেন : আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসেনি মুমিন অবনী পরে৷

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File