তাফসীর শাস্ত্রে কবিতার প্রভাব
লিখেছেন লিখেছেন udash kobi ১৮ ডিসেম্বর, ২০২০, ০১:৩৮:০১ রাত
আল কুরআন আরবী ভাষায় অবতীর্ণ আসমানী গ্রন্থ। অন্যান্য ভাষার মতো আরবীতেও বিদেশি ভাষার ব্যবহার রয়েছে। যেমন, হিব্রু, হাবশী (আবিসিনীয়), ফারসী ইত্যাদি ভাষার কিছু শব্দ হুবহু বা অপভ্রংশাকারে ব্যবহার রয়েছে। তেমনি আল কুরআনেও অনারবী শব্দের উপস্থিতি রয়েছে। আল কুরআনের সঠিক ব্যখ্যা বা তাফসীরের জন্য প্রয়োজন শব্দের উৎপত্তিগত, মৌলিক ও ব্যবহারিক অর্থ জানা। তাফসীরে ব্যবহারিক অর্থ জানার জন্য রাসূলের হাদীস ও সাহাবীদের আসার প্রাধান্য পায়, তেমনি শব্দগত বিশ্লেষণ ও বাক্যালঙ্কারের জন্য দরকার সাহিত্যিকভাবে শব্দের মূল্যায়ন। তাই প্রাচীন থেকে আধুনিক সকল আরবী তাফসীরে আমরা কবিদের কবিতার পংক্তির ব্যবহার দেখতে পাই। এর কারণ হলো-
প্রথমত কুরআনে ব্যবহৃত শব্দটি পূর্ব থেকেই যে তৎকালীন আরব সমাজে প্রচলিত ছিলো তা বুঝানোর জন্য।
দ্বিতীয়ত শব্দের সঠিক অর্থ নিরূপণে এবং সহজ ভাবে বুঝানোর জন্য।
তৃতীয়ত শব্দের ব্যবহার তথা ব্যকরণগত দিক আলোচনার জন্য।
চতুর্থত শব্দের সঠিক উচ্চারণ ও শব্দনির্গত প্রাসঙ্গিক আলোচনার জন্য।
পঞ্চমত ভাষার সৌন্দর্য ও শব্দালংকারের ভিত্তিতে কুরআনে ব্যবহৃত শব্দের নানাবিধ অর্থ জানার জন্য।
নিচে কিছু প্রাচীন ও মধ্যযুগের তাফসীর গ্রন্থে কবিতার পংক্তি ব্যবহার সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করবো। আরবী ভাষায় ব্যাপক জ্ঞান না থাকায় পংক্তিগুলোর যথাযথ অর্থ হয়তো করতে পারি নি, তবে পাঠকদের সুবিধার্থে কিছুটা চেষ্টা করেছি। আগ্রহী পাঠকগণ এই বিষয়ে আরো গবেষণা করতে পারেন। এখানে উদ্দেশ্য হলো তাফসীর শাস্ত্রে কবিতার উপস্থিতি সম্পর্কে জানানো। আশা করি সেটা পূরণ হবে।
#আল কুরআনের তাফসীরে কবিদের পংক্তি:
১.#তাফসীরে তাবারী:আবু জাফর ইবনে জারীর তাবারী রহ.(৮৩৯-৯২৩) এর বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ যা "তাফসীরে তাবারী" নামে পরিচিত। এটি কুরআনের একটি প্রাচীন ও মৌলিক তাফসীর গ্রন্থ। এই তাফসীরে আল্লামা আবু জাফর (রহ.) বিভিন্ন স্থানে শব্দের অর্থ, উৎপত্তি, পরিচিত ও ব্যবহারের উদাহরণ দিতে কবিতার উদাহরণ নিয়ে এসেছেন, কবিদের পংক্তি উদ্ধৃত করেছেন। যেমন-
"রহমান" শব্দটি যে কুরআন নাযিলের পূর্ব থেকেই আরবদের মাঝে প্রচলিত ছিলো তার উদাহরণে একটি পংক্তি এনেছেন-
ألا ضربت تلك الفتاة هجينها ألا قضب الرحمن ربي يمينها
(যুবতী মেয়েটি) কি অসভ্যকে আঘাত করে নি? আমার প্রভু দয়াময় কি তার হাত কি টুকরা টুকরা করেন নি? (তাবারী, প্রথম খন্ড, বিসমিল্লাহর তাফসীর)
http://quran.ksu.edu.sa/tafseer/tabary/sura1-aya1.html
"আলহামদু লিল্লাহি রব্বিল আলামীন" এর তাফসীরে তিনি কবিদের অনেক পংক্তি নিয়ে এসেছেন, যেমন-
وأَعْلَــمُ أَنَّنِــي سَــأَكُونُ رَمْسًـاআমি জানি আমি অচিরেই মেরু (কবরস্থ) হবো, যখন ভ্রমণে অনভ্যস্ত গৌরবর্ণ মহিলারা ভ্রমণ করবে। প্রশ্নকারী বলে, কার জন্য গর্ত(কবর) খুড়লে? সংবাদদাতা বলে, মৃত ব্যক্তি হলো উযির। এখানে মৃতব্যক্তি শব্দটি লুকায়িত রয়েছে.... (এই পংক্তিটি তাফসীরে সা'লাবীতেও আছে)
إذَا سَـــارَ النَّـــوَاعِجُ لا يَسِــيرُ
فَقَــالَ السّــائلون لِمَــنْ حَـفَرْتُمْ?
فَقَــالَ المُخْــبِرُون لَهُــمْ: وزيـرُ
"রব" শব্দের ব্যখ্যায় কবি লবিদ ইবনে রবিয়ার নিম্নের পংক্তিটি উদ্ধৃত হয়েছে-
وأَهْلكْــنَ يومًــا ربَّ كِنْـدَة وابنَـه"সেদিন ধ্বংস হবে কিন্দাহর প্রভু ও তার সন্তানেরা এবং মাআ'দের প্রভু খাবত এবং আরআরের মাঝে"। এখানে রব বলতে নেতা/সর্দার উদ্দেশ্য। কিনদাহর নেতা হলো হাজার আবু ইমরুল কায়েস এবং মা'দের নেতা বলতে হুজাইফা ইবনে বদর উদ্দেশ্য। (সূরা ফাতেহার তাফসীর দ্রষ্টব্য)
ورَبَّ مَعـدٍّ , بيـن خَـبْتٍ وعَرْعَـرِ
https://quran.ksu.edu.sa/tafseer/tabary/sura1-aya2.html#tabary
২. #তাফসীরে বাগাভী:আবু মুহাম্মদ আল-হুসাইন ইবনে মাস’উদ ইবনে মুহাম্মদ আল-ফাররা’ আল-বাগাভীর জন্ম ৪৩৩ অথবা ৪৩৬ হিজরিতে ইরানে এবং মৃত্যু ১১২২ খ্রিঃ। তার রচিত তাফসীরটি "তাফসীরে বাগাভী" নামে পরিচিত। এটিও মৌলিক তাফসীর গ্রন্থ। তিনি তার তাফসীরের বিভিন্ন অংশে কবিদের উক্তি ব্যবহার করেছেন।
"বিসমিল্লাহির রাহমানির রহীম" এর তাফসীরে ব্যবহৃত পংক্তি-
আল্লাহ শব্দের উৎপত্তি ইলাহ থেকে, এর ব্যবহারের পক্ষে কবিদের পংক্তি তিনি নিয়ে এসেছেন।
ألهت إليها والحوادث جمة
আমি তার কাছে বাস করেছি, ঘটনাটি ছিলো বিশাল
ألهت إليها والركائب وقف
"আমি ভয় পেছিলাম এবং বাহনটি থেমে গিয়েছিলো" (তাফসীরে বাগাভী, বিসমিল্লাহর তাফসীর)
https://quran.ksu.edu.sa/tafseer/baghawy/sura1-aya1.html#baghawy
৩.#তাফসীরে কুরতবী: ইমাম আবু আবদুল্লাহ আল কুরতুবি (রহ.), তিনি ১২১৪ খৃষ্টাব্দে স্পেনের কর্ডোবায় জন্মগ্রহণ করেন। ১২৭৩ তিনি কায়রোতে মারা যান। তার বিখ্যাত কুরআনের তাফসীরটি "তাফসীরে কুরতবী" নামে পরিচিত। তার তাফসীরেও কবিতার পংক্তির ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে।
বিসমিল্লাহর তাফসীরে কবির পংক্তি এনেছেন-
ورحنا بكابن الماء يجنب وسطنا
"আমরা আমাদের মাঝখানে রেখে পানিপতির সাথে গেলাম" (ইমরুল কায়েসের পংক্তি হিসেবে পরিচিত)
https://quran.ksu.edu.sa/tafseer/qortobi/sura1-aya1.html
সূরা বাকারার ৭ নম্বর আয়াতের ব্যখ্যায় কবির পংক্তি তিনি ব্যবহার করেছেন-
بها جيف الحسرى فأما عظامها فبيض وأما جلدها فصليب"আল-হোসারির মৃতদেহটিতে এটি রয়েছে, তার হাড়গুলি সাদা এবং ত্বকে রয়েছে দাগ"
لا تنكر القتل وقد سبينا في حلقكم عظم وقد شجينا"হত্যাকে অস্বীকার করো না, আমরা কন্ঠনালীর একটি হাড়কে ক্ষয় করেছি এবং নিরাময় লাভ করেছি"
https://quran.ksu.edu.sa/tafseer/qortobi/sura2-aya7.html#qortobi
৪.#তাফসীরে ইবনে কাসীর: ইসমাঈল ইবন উমর ইবন কাসীর ইবন দূ ইবন কাসীর ইবন দিরা আল-কুরায়শী (রহ.) যিনি ইবনে কাসীর নামে পরিচিত। তার সংকলিত তাফসীরটি "তাফসীরে ইবনে কাসীর" নামে পরিচিত। তিনিও কখনো কখনো কবিদের পংক্তি ব্যবহার করেছেন।
সূরা বাকারার প্রথম আয়াতের ব্যখ্যায়, শব্দ সংক্ষেপ ও শব্দের সংক্ষিপ্ততায় কখনো শব্দের প্রথম অক্ষরের ব্যবহারের উদাহরণে কবির পংক্তি-
قلنا قفي لنا فقالت قاف لا تحسبينا قد نسينا الإيجاف"আমরা বলেছিলাম, আমাদের জন্য দাঁড়াও, তারা বলেছিলো, থামো, আমরা ভুলে যাই নি কষ্টের কথা"
অথবা
بالخير خيرات وإن شرا فا ولا أريد الشر إلا أن تا
"ভালোর সাথে ভালো, মন্দের জন্য মন্দ, তুমি না চাইলে আমি মন্দ চাই না"(দ্রষ্টব্য: তাফসীরে ইবনে কাসীর, সূরা বাকারার প্রথম আয়াত)
https://quran.ksu.edu.sa/tafseer/katheer/sura2-aya1.html
৫.#তাফসীরে বায়যাভী: কাযী নাসিরুদ-দীন আবদুল্লাহ আল-বায়যাবীর বিখ্যাত কুরআনের তাফসীরটি "তাফসীরে বায়যাবী/বায়যাভী নামে পরিচিত। তার রচিত তাফসীরে তিনি অনেক কবিতার অংশ ব্যবহার করেছেন।
সূরা ফাতেহার তাফসীরের শুরুতে বিসমিল্লাহর ব্যখ্যায় তিনি কবিদের কিছু পংক্তি ব্যবহার করেছেন। যেমন- "ইসম" শব্দের ব্যবহার সংক্রান্ত আলোচনায় নিচের পংক্তিগুলো এনেছেন।
والله اسماك سمي مباركا"আল্লাহ তোমার একটি বরকতময় নাম রেখেছেন এবং নাম নির্বাচনে প্রাধান্য দিয়েছেন সবার উপরে যেমন প্রাধান্য দিয়েছেন তোমার ব্যক্তিত্বকে" (এটা কবি খালিদ তাফতাযানীর কবিতার অংশ)
آثرك الله به إيثاركا
الى الحول ثم اسم السلام عليكما
"বছর পূর্ণ হবার পর আমার পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি বিদায়ী সালাম" (এটা কবি লবীদের উক্তি যা সে মৃত্যুকালে তার মেয়েদের উদ্দেশ্যে বলেছিলো)
আল্লাহ শব্দের তাফসীরে নিচের পংক্তি এনেছেন-
كحلفه ابي رباح يشهدها لاهه الكبار"আবু রাবাহের শপথের মতো যা তার প্রভু শ্রবণ করেছেন!" (এখানে লাহ শব্দটি ইলাহের সংক্ষিপ্তরূপ যার অর্থ শীর্যস্থান লাভ করা, যা মাবুদ অর্থে ব্যবহার হয়)
https://books.google.it/books?id=lOKHDQAAQBAJ&printsec=frontcover&redir_esc=y#v=onepage&q&f=false
৬. #তাফসীরে কাবীর: আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে উমর ইবনে আল-হুসাইন আত তায়েমি ফখর আদ-দীন আর-রাযী (১১৪৯-১২০৯) যিনি ফখরুদ্দীন রাযী নামে পরিচিত। তার রচিত তাফসীর "তাফসীরে কাবীর বা তাফসীরে রাযী" নামে পরিচিত।
সূরা ফাতিহার "ইহদিনাস সিরাত্বল মুস্তাকিম" আয়াতের ব্যখ্যায় পংক্তি ব্যবহার করেন-
وَفي كُلِّ شَيءٍ لَهُ آيَةٌ"এবং সব কিছুতেই তার একটা নিদর্শন রয়েছে, যেটাতে প্রমাণিত হয় যে তিনি একক" (এটি কবি লবীদ ইবনে রবীয়ার কবিতার পংক্তি হিসেবে পরিচিত)
تَدُلُّ عَلى أَنَّهُ واحِدُ
পুনশ্চ: পংক্তির অর্থের শুদ্ধতার প্রশ্নে ব্যর্থতা আমার! আরো অনেক তাফসীর গ্রন্থে কবিতার ব্যবহার দেখা যায়। আলোচনা সংক্ষেপের জন্য উল্লেখ করি নি।
#উদাসকবি
বিষয়: বিবিধ
৮৩৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন