চলে গেলেন কাজী নেহলিনঃ আমি তৈরি তো???
লিখেছেন লিখেছেন গোলাম সারোয়ার চৌধুরী ১৪ আগস্ট, ২০১৬, ১০:২১:০৯ সকাল
১১ আগস্ট ২০১৬, এক মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত হন “আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম” এর ইংরেজি বিভাগের ৭ম সেমিস্টারের ছাত্রী কাজী নেহলিন। ক্যাম্পাসে বইছে শোকের মাতন, চির বিদায়ের শোকে আজ সবাই প্রায় বেকুল। চারদিকে শুধু যেন প্রিয়জন হারিয়ে ফেলার অনুভূতি। কঠিন হৃদয়ের হয়তো অনেকেই আছেন যাদের সাথে কোন দিন দেখা হয়নি নেহলিনের কিন্তু তবুও যেন শোকের কাতরে চোখ থেকে দু’ফোটা পানি গরিয়ে পরেছে নিজের অজান্তেই। এমন কি আমার মত অনেক শিক্ষকও আছেন যাদের কাছে এই নামটি ছিল একেবারেই অজানা, অচেনা কিন্তু মুহুর্তেই যেন সবার কাছে আপন হয়ে গেল এই নামটি আর ভাসিয়ে দিল শোক সাগরে সবাইকে।
নেহলিনের পদচারনায় মুখরিত হবে না আর ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাসগুলো কিংবা ক্যাম্পাসে ফটোকপির দোকানের সন্ধান চেয়ে আর কোন দিন দেয়া হবে না তার ফেইসবুক আইডি থেকে কোন পোস্ট। এমনকি নেহলিনের মাও আর কোন দিন বসে থাকবে না প্রিয় মেয়ের বাড়ি ফিরে ভাত খাওয়ার অপেক্ষায়।
শোকাহত হয়ে ইতোমধ্যে অনেকেই পরিবর্তন করেছেন নিজের ফেইসবুক প্রোফাইল পিকচার, গ্রুপের কাভার ফটো এবং ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বজোরে নেহলিনের শোক বার্তা। কিন্তু কোথায় আজ নেহনিল ? কেমন আছেন তিনি? কি বার্তা দিয়ে গেলেন আমাদেরকে? কখনো কি হৃদয়ের গহীনে জন্ম দিয়েছে এই প্রশ্নগুলো আর কিইবা হতে পারে এসব প্রশ্নের উত্তর? এক দিন সব কিছুতেই পরিবর্তন আসবে, থাকবে না আর শোকের প্রোফাইল পিকচার, রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে বিলিন হয়ে যাবে ঝুলতে থাকা শোকের ব্যানারগুলো অথবা কেউ এক দিন এসে বলবে “অনেক দিন তো হল এবার ব্যানারটা খুলে ফেল”। এটাকে এখন নির্মমতা মনে হলেও- এটাই প্রকৃতির নিয়ম । চোখের পানি ক্ষনিকের মধ্যে শুকিয়ে গেলেও চোখের নিচের কাল দাগটা কিন্তু থেকে যায় অনেক দিন। কারোরটা কিছু দিন, কারোরটা হয়তো আরো কিছুটা বেশি আবার কারোরাটা মুছে গিয়ে দাগ পরে নতুন করে কিন্তু এক জনের দাগটা কোন দিনই মুছে যায় না। একবার ভাবোনত সে মানুষ কে- যার দাগটা কোন দিন মুছে যায় না? আশা করি মায়ের কথাটাই সবার মনে এসেছে। সে দিন শোকাহত মায়ের মনের বেদনা, হৃদয়ের ক্রন্দন ও চোখের পানি দেখে কাঁদতে দেখেছি অনেক সন্তান কে। শোক দেখেছি আমি তবে এমন শোকের বেদনা কখনো দেখেনি। কিন্তু এক দিন সবার মনের গভীর থেকে পালিয়ে যাবে শোক, শুধু মায়ের হৃদয়ে বাসা বেঁধে থাকবে আজীবন। এই শোক থেকেই বুঝতে পারার কথা ‘মা’ ই সব চেয়ে আপনজন। যদি বেঁচে থাকতে নিজের পুরোটা দিয়ে ভালবাসতে পারি নিজের মা কে, মায়ের চক্ষু শীতল করে ক্রয় করে নিতে পারি পরম সুখের স্থান জান্নাত তবেই হবে ক্রন্দন সার্থক। না হয় চোখের পানি ঝরে কি হবে তাতো শুকিয়ে যায় নিমিষেই।
মৃত্যু বলে কয়ে আসে না । তার নেই কোন আগমনী বার্তা। কিন্তু ৮০ বছরের বৃদ্ধের বিছানায় শুয়ে সজনের সামনে চিরবিদায় আর ২২ বছরের সন্তানের মৃত্যুর শোক এক নয়। তাও যদি হয় মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায়। মৃত্যু মানেই শুধু শোক, বেদনা কি্ংবা ক্রন্দন নয়। অবাস্তব হলেও সত্য যে – এই সবগুলোই সাময়িক। মৃত্যু মানে- অনন্ত কালের দিকে যাত্রা, মহান প্রভুর সামনে নিজের আমলনামা হাজির করার প্রথম ধাপ। প্রত্যেকটি মৃত্যুই আমাদেরকে দিয়ে যায় কিছু বার্তা, কিছু সতর্কতা। ভেবে দেখেছি কি নেহলিনের মৃত্যু কি বার্তা দিয়ে গিয়েছে আমাকে? আমরা খুব অল্পতেই ভুলে যাই যে- “নেহলিনের বসে থাকা বাসের সিটটি হতে পারত আমার জন্যও”। নেহলিন কি জানত আজই হবে তার জীবনের শেষ দিন? তারও ত মায়ের সাথে বাসায় গিয়ে ভাত খাওয়ার কথা ছিল। সেও তো মৃত্যুর কিছুটা পূর্বে বলেছিল- “আম্মু আমি আসছি তুমি ভাত রেডি কর খুব খিদে পেয়েছে আমার”। তার মায়ের হয়তো প্রতিবার খেতে গেলেই মনে পরবে মেয়ের এই কথাটি। মায়ের কানে বার বার প্রতিধ্বনি হতে থাকবে এই বাক্য। এই মায়ের শোক কি দিয়ে প্রশান্ত করা যায় আমার জানা নেই। নেহলিনেরও কিন্তু আমাদের মতই স্বপ্ন ছিল অনেক। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন সব শেষ হয়ে গেল বুঝে উঠার পূর্বেই। এক জন মানুষের কাছে জীবনের চেয়ে বেশি মূল্যবান কি হতে পারে আমার জানা নেই। আজ আমরা এই জীবনকেই বানিয়ে ফেলেছি সব চেয়ে সস্তা। সময়ের সাথে জীবনকে যেন কোন ভাবেই আর খাপখাওয়াতে পারছি না। কোন এক অজানা প্রান্ত থেকে নেহলিনের বিদায়ি আত্মা যেন বলছে- “তোমরা আর অযথা সময় নষ্ট কর না, তুমি কি ভেবেছো তুমি বেঁচে থাকবে আরো অনেক দিন? আমি সত্যি বলছি না না না এ হতেই পারে না! দেখনি কেমন হঠাৎ করেই চলে গেলাম তোমাদের ছেড়ে। সত্যি করে বলছি তোমাদের কাদাঁনোর আমার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে ছিল না। আমি তো চলে গেলাম এবার তুমি তৈরি তো? কিন্তু আসার সময় কি নিয়ে আসছ সেটা ভেবে দেখেছো কি তুমি বার বার? কি জমা করেছ তুমি ওপারের সম্ভল? তোমার কিন্তু এখনো সুযোগ আছে ভাল কিছু করার। আর হেলায় ফেলায় সময়গুলো নষ্ট কর না তুমি। আমার মত হঠাৎ করে বিদায় তোমারও হয়ে যেতে পারে তাই এখনি নিজকে গুছিয়ে নাও”। এসব কথা শোনার পরও কি একটু জাগ্রত হবে না আমার বিবেক? আমি কি সত্যিই নেহলিনের পথে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত? নাকি শুধুই অবকাশের পালা। আমি কি এখনো ফজরের নামাযের সময়টা ঘুমের মধ্যে হারিয়ে থাকি নাকি স্রষ্টার স্বরণে সাড়া দেই? কেন ভুলে যাই বার বার এই জীবন শেষ নয়। আমি কি পারি না নিজেকে একটু বদলাতে? পারি না কি একটু খোদার পথে অগ্রসর হতে? কি আমাকে বাঁধা দিচ্ছে বার বার? এই পৃথিবীর সব কিছুর চেয়েও কি খোদার সন্তুষ্টি অর্জন করে চির সুখের জান্নাত প্রাপ্তি বড় কিছু নয়? যে জান্নাতে থাকবে না কোন দুঃখ-বেদনা শুধু শান্তি আর শান্তি। আমি কি মৃত্যুর কথা ভুলে গিয়ে জীবনের সীমিত সময়গুলো অযথা নষ্ট করে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাচ্ছি না তো নিজেকে? যে জাহান্নাম সম্পর্কে তার স্রষ্টা নিজেই বলেন – “এটা খুব খারাপ স্থান”। যদি মৃত্যুর প্রকৃত উদ্দেশ্য উপলব্ধি করে নিজের সাথে স্রষ্টার সম্পর্কটা দৃঢ় করতে পারি তবেই হবে ক্রন্দনের প্রকৃত সফলতা না হয় নিমিষেই আখির জল শুকিয়ে শেষ হয়ে যাবে শোক।
“আপনারা প্রতিদিন নামাজ পরে আমার মেয়ের জন্য দোয়া করবেন এটাই আপনাদের কাছে আমার অনুরুধ”। নেহলিনের বাবার এই আকুতি টুকু যেন আমরা ভুলে না যাই। আল্লাহ যেন তার পিতা-মাতা সহ সবাইকে ধৈর্য ধারন করার তাওফিক দান করেন। আর কর্তৃপক্ষের কাছে একটি আবদার - বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন একটি হল কিংবা কোন একটি স্থাপনার নামকরন যেন করেন “কাজী নেহলিন” নামে। তাহলে অন্তত শোকের ব্যানারগুলো প্রকৃতির মাঝে বিলিন হয়ে গেলেও শেষ স্মৃতিটুকু অবশিষ্ট থাকবে যুগ যুগ ধরে। এমনটাই প্রত্যাশা করছি।
কাজী নেহলিনের জন্য মহান প্রভুর কাছে সাহাদাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা চেয়ে এখানেই শেষ করছি। হে আল্লাহ! আপনি এই বান্দীকে ক্ষমা করে জান্নাতুল ফেরদাউসের মেহমান বানিয়ে নিন। আমীন আমীন আমীন। ইয়া রাব্বুল আলামিন।
বিষয়: বিবিধ
৫২৫০ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমি প্রস্তুত তো?
মাবুদ এলাহী আমার প্রস্তুতি খুব সামান্য l
আমাকে কিছু সময় দাও l
মন্তব্য করতে লগইন করুন