ইসমাইল হোসেন সিরাজী উপন্যাসসমগ্র
লিখেছেন লিখেছেন মুসা বিন মোস্তফা ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১১:০৭:১৭ রাত
বাঙ্গালী লেখকগনের যত্ন এবং চেষ্টায় বাংলা ভাষা আজ ভারতের সর্বপ্রধান ভাষায় পরিণত। বাংলা ভাষায় ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞানের গ্রন্থ যত সামান্যই হঊক, কিন্তু উপন্যাস এবং নাটক নভেলে বাংলা ভাষা আজ ভারাক্রান্ত। আর সেই সমস্ত গ্রন্থের পত্রে-পত্রে ছত্রে -ছত্রে মুসলমানের অলীক কলঙ্ক, কুৎসা - বিজাতীয় বিদ্বেষ এবং ঘৃণা পরিপূর্ণ। উপন্যাসগুলি মোসলেম বিদ্বেষের অনলকুন্ড। সে অনলকুন্ডে বিরাট-কীর্তি, বিপুল-যশ, সিংহতেজা মুসলমান জাতির গোলাম হইতে সম্রাট নবাব এবং বেগম ও শাহজাদীগণ পর্যন্ত নিতান্ত নিষ্ঠুরভাবে নিক্ষিপ্ত হইয়াছে!
বাঙালীদিগের পূর্বপুরুষগণ অবলুণ্ঠিত মস্তকে যাহাদের পদধুলি শিরে ধারণ করিয়া ধন্য হইয়াছিলো, নিখিল জগৎ যে মুসলমানের পদতলে লুণ্ঠিত হইয়াছিলো, যাহাদের চরিত্র-প্রভায়, জ্ঞান-গরিমায় এবং বীর্য-মহিমায় সমস্ত জগৎ মুগ্ধ হইয়াছিলো - হায়! আজ সেই বিশ্বপূজ্য মুসলমান, বাঙালী লেখকদিগের অপার কৃপায় অতি ঘৃণিত পিশাচ এবং অস্পৃশ্য কাম-কুকুররূপে চিত্রিত এবং বর্ণিত! হায়! যে নুরজাহান, রেজিয়া সোলতানা, জেবুন্নেসা, জাহানারা, মমতাজমহল, দৌলতুন্নেসা প্রভৃতি বেগম ও শাহজাদীগণের পুণ্যপ্রতিভায় ইতিহাসের পৃষ্ঠা আলোকিত হইয়া রহিয়াছে, যাহাদের নামকরণেও পূণ্য সঞ্চার হয়, হায়! সেই সব বিদূষী পুতচরিত্রা সম্মানিতা মহিলা-দিগকেও যার-পর-নাই হীন চরিত্রা এবং হিন্দু-প্রেমোন্মাদিনী রূপে অঙ্কিত করা হইয়াছে। এ অত্যাচার , এ অবিচার একেবারেই অসহ্য! এ যন্ত্রণা একেবারেই মর্মন্তুদ!
ইহা ঐতিহাসিক ধ্রুবসত্য যে, মুসলমানদিগকে পৃথিবীর সকল জাতিই কণ্যাদান করিয়াছিলেন এবং করিতেছেন, কিন্তু মুসলমান কখনও অমুসলমান বা কাফেরকে কন্যাদান করেন নাই। যে সমস্ত আরব, তুর্কী, ইরাণী এবং পাঠান ও মোগল ভারতবর্ষে বিজয়ী বেশে তরবারি হস্তে প্রবেশ করিয়াছিলেন, তাহারা প্রায়শঃই স্বপত্নীক আসিয়াছিলেন না। সতরাং বাধ্য হইয়া তাহাদিগকে হিন্দু ললনার পাণিপীড়ন করিতে হইয়াছিলো।
প্রথম অবস্থায় ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানের যুদ্ধবিগ্রহ হইলেও পরে ভারতের হিন্দু মুসলমানে গভীর সদ্ভাব ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিলো। ভারতের সর্বত্র্যই হিন্দু-মোসলেম বৈবাহিক সম্পর্ক পর্যন্ত স্থাপিত হইয়াছিলো। "রাজপুতেরা মুসলমানের মানুল কুল" - ইহা আজিও প্রবাদ বাক্যের ন্যায় প্রচলিত আছে ফলতঃ তদানীন্তন হিন্দু রাজরাজড়ারা পর্যন্ত মুসলমানকে কণ্যাদান করা অগৌরব বলিয়া আদৌ বোধ করেন নাই বলিয়া। বাদশাহদিগের জীবনী এবং ইতিহাস পাঠ করিলে দেখা যায় যে, হিন্দু নরপতিরা বাদশাহ - নবাব এবং বিজয়ী বীরদেরকে স্বেচ্ছায় উপঢৌকন স্বরূপও কন্যা প্রদান করিয়াছিলেন। আর ইহা ভারতবর্ষের অতীব প্রাচীন প্রথা।
কিন্তু আধুনিক নব্য-শিক্ষিত বাঙ্গালী হিন্দু লেখকের কল্পনায় ইহাকে জাতীয় কলঙ্ক মনে করিয়া নিদারুন রোষাবেশে অতুল পুণ্য-শ্লোকা মুসলমান মহিলাগণকে অন্তঃপুর হইতে টানিয়া বাহির করিয়া হিন্দু নায়কের প্রেমোণ্মাদিনী-রূপে চিত্রিত করিতে ঊঠিয়া - পড়িয়া লাগিয়াছেন! কার্যত ইহা কখনো ঘটেনাই, কল্পনায় তাহারা লেখনী পরিচালনা করিয়া সেই চিত্র অঙ্কিত করিতে একেবারে আদাজল খাইয়া লাগিয়াছেন। নীচমতি বঙ্কিমচন্দ্র এবং রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় হইতে আরম্ভ করিয়া প্রত্যেক উদ্ভট ঔপন্যাসিক লেখকই এই অতি জঘন্য চিত্র অঙ্কিত করিয়া বিশ্বপূজ্য মুসলমানের মুন্ডপাত এবং মর্মবিদ্ধ করিতে অসাধারণ প্রয়াস স্বীকার করিয়া আসিতেছেন। আমি নিজে এবং আরও কতিপয় মুসলমান লেখক এ সম্বন্ধে পুনঃ পুনঃ নানা পত্র-পত্রিকায় তীব্র প্রতিবাদ করিয়াছিলাম। কিন্তু তাহাতে বিন্দুমাত্র ফলোদয় হয়নাই। উত্তর-বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষদের অধিবেশনে আমি তীব্র এবং যুক্তিসঙ্গত তুমুল আন্দোলন করিয়াছিলাম। দেশের শান্তি ও মঙ্গলের জন্য, হিন্দু-মুসলমানের সখ্য ও সদ্ভাবের জন্য হিন্দু সুধীমন্ডলের নিকট মুসলমান চরিত্রকে কুৎসিত না করিবার বিনীত অনুরোধ করিয়াছিলাম। কিন্তু হায়! আমার সে অনুরোধ বিফল হইয়াছে।
বাঙ্গালার ছাপাখানা হইতে আজও শতধারে বর্ষার প্লাবনের ন্যায় রাশিরাশি হলাহলপূর্ণ নাটক-নভেল বাহির হইয়া অশান্তির সৃষ্টি করিতেছে। অন্যদিকে আবার কলিকাতা এবং মফঃস্বলে শত শত স্থানে যাত্রা ও থিয়েটারের এইসমস্ত অলীক কলঙ্ক-কুৎসা-পরিপূর্ণ ঘটনার অভিনয় হইয়া মুসলমান ছাত্র ও সাধারণ লোকের মনে হীনতা ও নীচতার বীজ বপন করিয়া মুসলমানের আত্মবিশ্বাস ও আত্ম-মর্যাদার মূলে এমন নিদারুন কুঠারাঘাত করিতেছে যে, তাহাতে মুসলমানের উন্নতি বা জাতীয় কল্যাণের আশা সুদুরপরাহত হইয়া পড়িতেছে।
বীর্যবান মহাপরাক্রান্ত শত্রুর সহস্র সহস্র তোপ-বন্দুকে লক্ষ লক্ষ মুসলমান নিহত হইলে যে ক্ষতি না হইতো, দুর্বল বাঙালীর ক্ষুদ্র লেখনী সঞ্চালনে তাহার অধিক ক্ষতি হইতেছে, পক্ষান্তরে বাঙ্গালী লেখকের এই কাপুরুষোচিত হীন আক্রমনে শিক্ষিত মুসলমানের অন্তঃকরনে যে সংক্ষোভ ও ভীষণ প্রতিহিংসার আগুন প্রজ্জ্বলিত হইতেছে, তাহার পরিণামও অতীব মারাত্মক। এ বিদ্বেষ যেরূপ দ্রুতগতিতে বর্ধিত হইতেছে, তাহার ফল উভয়ের পক্ষে নিশ্চয়ই সাংঘাতিক।
একই দেশের হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সদ্ভাব থাকা সর্বদা বাঞ্চনীয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাঙালী ভ্রাতারা কাল্পনিক আর্যামীর গৌরবগানে বিভোর হইয়া কান্ডাকান্ডজ্ঞানহীন অবস্থায় লেখনীর পরিচালনায় দারুন অসদ্ভাবের বীজ বপন করিতেছেন। দেশমাতৃকার কল্যানের নিমিত্তে তাহাদের সাবধানতার জন্য এবং মুসলমানদের আত্মবোধ জন্মাইবার জন্যই, উপন্যাসের ঘোর বিরোধী আমি, কর্তব্যের নিদারূন তাড়নায় "রায়-নন্দিনী" রচনা করিয়াছি। ইহাতে হিন্দু ও মুসলমানের যে চিত্র অঙ্কিত করিয়াছি, তাহাই অতীতের স্বাভাবিক চিত্র। মুসলমানের চরিত্রবল, মহত্ব এবং স্বজাতি-প্রেমের উণ্মাদনা সকল জাতি অপেক্ষা বেশি ছিল, ইহা সকলকে স্বীকার করিতেই হইবে। নতুবা সহস্র বৎসর পর্যন্ত মুসলমান কখনও নিখিল ধরনীর একচ্ছত্র আদিপতি, ধর্মগুরু ও সভ্যতার শিক্ষক-রূপে বিরাজ করিতে পারতেন না। আজও বিশ্ববক্ষ হইতে তাহার প্রতাপ ও প্রভাবের জ্যোতিঃ নিভিয়া যায় নাই!
বাঙ্গালীদিগের রচিত উপন্যাস পাঠ করিয়া যাহারা নিদারুন মর্মজ্বালা ভোগ করিয়াছেন, তাহারা এই উপন্যাস পাঠে কথঞ্চিত শান্তি পাইলেও শ্রম সফল জ্ঞান করিব। পক্ষান্তরে আশা করি, বাঙ্গালী লেখকগণ তাহাদের মোসলেম কুৎসাপূর্ণ জঘন্য উপন্যাসগুলি পরিবর্তণ করিয়া সুমতির পরিচয় দিবেন এবং ভবিষ্যতে মুসলমানের বীর্যপুষ্ট গৌরবমন্ডিত আদর্শ চরিত্র অঙ্কিত করিতে চেষ্টিত হইবেন। নতুবা তাহাদের চৈতন্য উৎপাদনের জন্য আবার ইসলামিক তেজঃদীপ্ত অপরাজেয় বজ্রমুখ লেখনী ধারণ করিতে বাধ্য হইবো।
সৈয়দ শিরাজী,
বাণীকুঞ্জ,
সিরাজগঞ্জ,
২০ শে ফাল্গুন, ১৩২২ সন।
[লেখকের প্রথম উপন্যাস রচণাকালীন এই উদাত্ত আহবান ফলপ্রসু হয়নাই, যার প্রমানস্বরূপ তার কলম থেকে এসেছে আরো বিপ্লবী ও বিখ্যাত উপন্যাসমূহ।]
রায়নন্দিনী
তারাবাঈ
ফিরোজা বেগম
নূরঊদ্দিন
বঙ্গ ও বিহার বিজয়
জাহানারা Download করুন
বিষয়: বিবিধ
১৩৮০ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন