বইয়ের ব্যবসা ও ভাবনা
লিখেছেন লিখেছেন মুসা বিন মোস্তফা ২১ নভেম্বর, ২০১৫, ০১:১২:৪৫ দুপুর
একটি পন্য উতপাদনে সবচেয়ে কে বেশি লাভ করে ?
উত্তর হলো উৎপাদক ।
উৎপাদক আপাত দৃষ্টিতে একটি পন্যে সবচেয়ে কম লাভে দিলেও তার লাভই সব থেকে বেশি । ব্যাপারটা এরকম, একটি পন্য উৎপাদনে খরচ ৫০ টাকা । উৎপাদক ৫ টাকা লাভে ৫৫ টাকায় বিক্রি করে হোলসেলারের কাছে । হোলসেলার ১০ টাকা লাভে ৬৫ টাকা বিক্রি করে রিসেলারের কাছে । রিসেলার ৩৫ টাকা লাভে ১০০ টাকা বিক্রি করে কাস্টমারের কাছে ।
উৎপাদক বিক্রি করে প্রত্যেক দিন ১০০০পিস*৫=৫০০০ টাকা লাভ
হোলসেলার বিক্রি করে প্রত্যেক দিন ১০০ পিস*১০= ১০০০ টাকা লাভ
রিসেলার বিক্রি করে প্রত্যেক দিন ১০পিস*৩৫= ৩৫০ টাকা লাভ
অর্থাৎ কম লাভে বেশি বিক্রি করেও বেশি লাভ হয় উৎপাদকের ।
এক্ষেত্রে হোলসেলার ও রিসেলার যতো বেশি বিক্রি করবে ততো বেশি লাভ হবে উৎপাদকের ।
লাভ লোকসানের সংজ্ঞা দেওয়ার জন্য লেখা নয় । লেখাটি হচ্ছে বইয়ের ব্যবসায় রিসেলারের লাভ নিয়ে কিছু ভাবনা ।
প্রত্যেকটি পন্যেই সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য থাকে । অর্থাৎ একজন রিসেলার সেই মূল্যের উপরে বেচতে পারবে না । কমে বেচলে তার ইচ্ছামতো । এমনকি লোকসান করে বেচলেও কারো আপত্তি নেই । মূল্যটা রাখা হয় প্রোডাক্টের মানের উপর নির্ভর করেই । বাংলাদেশই হয়তো পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে "সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যকে" বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখানো হয় । আর বই সম্ভবত একমাত্র পন্য যেখানে চলে মূল্য নিয়ে ধোকাবাজীর খেলা ।
একটি প্রকাশনী একটি বই প্রকাশ করে কত পার্সেন্ট লাভ করে তার ব্যবচ্ছেদ করতে চাই না । একটি বইয়ের গায়ের মূল্য যা রাখা হয় তার থেকে বিভিন্ন % ছাড়ে নেট মূল্য দেওয়া থাকে । হোলসেলারেরা তার থেকে ডিস্কাউন্ট পায় । আর নেট মূল্য প্রকাশনীর বিক্রয় কেন্দ্র গুলো বিক্রি করে থাকে । নিকটস্থ অন্য দোকানেও একই মূল্য পাওয়া যায় । দূরবর্তী এলাকায় কিছু বেশিতে দেওয়া হয় ।
একটি বইয়ের মূল্য ২০০ টাকা । কোন এক প্রকাশনীর নেট মূল্য ১০০ টাকা । সেই বই একজন রিসেলারের কিনতে পড়বে ৮৫ টাকা ।
[এক নজরে বাকী খরচ, ১০হাজার টাকার বই প্রকাশনীর বিক্রয় কেন্দ্র থেকে ট্রান্সপোর্টে তুলতে হয় এরকম দূরুত্বে হলে খরচ ১০০০ টাকার বেশি যায় (সর্বনিম্ন)]
অর্থাৎ একটি রিসেলার ১০ হাজার টাকার বই ক্রয় করলো সেখানে তার লাভ হলো ১৫০০ টাকা । অর্থাৎ কাস্টমারের কাছে নেট মূ্ল্যে বিক্রি করলে তার লাভ হবে ১৫০০ টাকা । যেখান থেকে তার বইটি আনতে খরচ পড়লো ১০০০ টাকা । লাভ থাকে ৫০০ টাকা ।
এক মাসে ১০ হাজার টাকার সকল বই বিক্রি করতে পারবে কিনা এটাও সন্দেহ আছে ।হ্যা সত্যি কথা ।বাংলাদেশে এরকম লাইব্রেরীর সংখ্যা হাতে গোনা হবে যারা (সৃজনশীল ও ইসলামী) বই এক মাসে ৩ লক্ষ টাকার বই বিক্রি করে ।
অনলাইন শপ গুলোও মেলা ছাড়া তিন লক্ষ টাকা সকলের সাধ্য হয় না । আমাদের তো নয়ই ।
তিন লক্ষ টাকার বই বেচে লাভ ১৫ হাজার টাকা :D একটু ভাবুন । বাক্যটি আবার পড়ুন তিন লক্ষ টাকার বই বেচে লাভ ১৫ হাজার টাকা । এটাকে টেনে টুনে বাড়ায়ে সর্বোচ্চ ২০ই করা যায় এর থেকে বেশি নয় ।
এবার নিজেকে প্রশ্ন করুন এমাসে আপনি কয় টাকার বই কিনেছেন ? তি লক্ষ টাকার বই বেচতে একটা প্রতিষ্ঠানকে কয়টা কাস্টমার পেতে হবে । একটু ভাবুন ।
এবার নিশ্চয় প্রশ্ন করবেন মাত্র ১৫-২০ হাজার টাকা লাভে কেমন করে একটি প্রতিষ্ঠান চলতে পারে ? জী আপনার উত্তর প্রুস্তুত । আমরা নেট মূল্য বই বিক্রি করি না । নেট থেকে ৫-১৫% লাভ করে বই দেই । তবে গ্রাহকের কাছে বই পোছানো এবং পেমেন্টের খরচ বাদ দিয়ে আমাদের ৫-৮% লাভই কঠিন হয়ে যায় । অর্থাৎ এক লক্ষ টাকায় ৫-৮ হাজার । তিন লক্ষ টাকায় ১৫-২৪ হাজার । আর পুর্বের ২০ হাজার । ৩৫-৪৪ হাজার টাকা আয় করি আমরা যদি ৩ লক্ষ টাকার বই বেচি করি ।
খরচের হিসাব শুনবেন ? আতকে উঠে বলবেন ভাই থাক ।
[আমাদের কাছে অনেকে অভিযোগ করে থাকেন এই বইটি অমুক দোকানে কম আর আপনাদের কাছে বেশি কেন ? এটার উত্তর হচ্ছে বেশির ভাগ লাইব্রেরীই একাধিক আইটেম বিক্রি করে । খাতা কলম থেকে শুরু করে স্টেশনারী । ইসলামিক বই হলে আতর সুরমা ,টুপি তো পাবেনই । তাদের মূল ব্যাবসা অগুলোই । বইটা ফোর সাবজেক্ট । বই শুধু রাখে কাস্টমারের জন্য । হালকা লাভের জন্য ।পেট চলার জন্য নয় ]
সাধারন কাস্টমারদের কাছে অনলাইনে বইয়ের বাজারের নেতিবাচক প্রভাব ফেলিয়েছে একটি প্রতিষ্টান । কখনো কখনো শুনতে হয় "ডট কম ?" না ভাই আপনারা গলাকাটা দাম রাখেন । যার কারনে বাজার মন্দা । লাইব্রেরী গুলোতেও কাস্টমারের সংকট । সেখানে "গলাকাটা" দাম রাখা অনলাইন প্রতিষ্ঠান গুলো কেমন করে ভালো ভাবে চলবে ???
একটি বই কিনতে গ্রাহকেরা যতো দাম দর করতে চায় অন্য কোন খানে এতটা দাম দর করে না । একটা সেলুনে গিয়ে চুল দাড়ি কামাইয়ে ১০০-১৫০ টাকা দেয় য। কখনো ভাবে না সেই নাপিতটি ১০ টাকা খরচ করে ১০০-১৫০ টাকা ইনকাম করলো ! বরং সে সময় দিয়েছে তাই ১০০-১৫০ টাকা লাভ স্বাভাবিক বলেই বিবেচিত হয় । অথচ একটি বই ডেলিভারী দিতে ৩ ঘন্টা লাগলেও ৫০ টাকা লাভ করেও কাস্টমারের ভতসনা শুনতে হয় "আমরা গলাকাটা দাম রাখি" ।
একটি ঔষুধের দোকানে ১২.৫% লাভ করে বিক্রি করেও দেওয়ালে লিখে রাখে "সরকার নির্ধারিত মূল্যে ঔষুধ বিক্রি করা হয়" আর জ্যাম ঠেলে ঘরে বই পৌছে দিয়েও আমরা ৫-৮% লাভ করতে পারি না ।
একটি ফুচকার দোকানে ৮ টাকা খরচ করে ৩০ টাকা রাখা হলেও চুপ করে খেতে পারি । কিন্তু গায়ের মূল্য থেকে কম রাখলেও চেচিয়ে উঠি "গলাকাটা" ।
প্রত্যেকদিন ১০০ টাকা ধুমপান করতে ব্যয় করলেও ৫০ টাকার বই কেনা হয় না ।
বাংলাদেশে খুব কম মানুষই আছে যাদের প্রত্যেক মাসে বই কেনার জন্য ১০০-১৫০ টাকা হলেও বাজেট আছে !
একটি বইয়ের কথা কোথাও বলা হলে প্রথম প্রশ্নটায় থাকে "পিডিএফ লিংক প্লিজ"
হয়তো কালের বিবর্তনে মানুষ বই পড়া ভুলে যাবে আর আমরাও পেটের দায়ে নেমে পড়বো অন্য কিছুতে ।না ! আহবান জানাবো না "প্রত্যেক মাসে অন্তত একটি হলেও বই কিনুন বলে" । না ! এটাও বলবো না "প্রিয়জনকে বই উপহার দিন" । অন্তত কিছু বলা উচিত হবে না ।
মুসা বিন মোস্তফা
সেলস এন্ড মার্কেটিং ম্যানাজার
www.AmaderBoi.com
পূর্বে প্রকাশিতঃ Click this link
বিষয়: বিবিধ
২৩৮৩ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
শুধু পাঠকদের দোষ নয়, আরো অনেকের দায়-দায়িত্ব আছে!
আমার কোন কোন শিক্ষক ক্লাস নেবার সময় আলোচনার ফাঁকে বলতেন "অমুকের অমুক বইটা তোমরা পড়তে পারো, খুব ভালো...."
কয়েকদিন পরে হয়তো প্রশ্ন করে বসতেন সেই বইএর কোন একটা বিষয়ে!
ভালো ছাত্ররা আত্মমর্যাদা ঠিক রাখতে বইটা অবশ্যই পড়তাম!!
এখন শিক্ষকদের সে তাগিদ দেবার সুযোগও সীমিত!
তাই শৈশবে বইপাঠের অভ্যাস তৈরী না হলে বড় হয়ে সেটা হয়ে ওঠা বেজায় কঠিন!
এমন বাবা-মা সংখ্যায় খুবই কম (শতকরা হারে হিসাবযোগ্য হবে কিনা সন্দেহ) যাঁরা সন্তানের পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অন্য বই পড়তে উতসাহ দেন বা কমপক্ষে নিষেধ করেননা!
এখনকার শৈশব এবং পাঠ্যক্রম এমনভাবে সাজানো যে অন্যকিছুতে নজর দেবার মত সময় শিশু-কিশোরদের হাতে থাকেনা!
আপনাদের বেশী বেশী প্রচারণা চালানো উচিত!
বাংলাদেশে আগামী বার এসে আপনাদের কাছ থেকে বই নিবো ইনশা আল্লাহ! ঘরে বসে বই ডেলিভারী পেলে খামাখা কষ্ট করে দূরে যাওয়া কেনো ?
আপনাদের ব্যাপক কাটতির অগ্রিম দোআ রইলো।
শুকরিয়া।
আমার উন্নয়ন বিষয়ক বইটি প্রকাশ করা যাবে? পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩২। A4 সাইজের মোট ৮টি কাগজ লাগবে প্রতিকপিতে। নিজে ছাপালে খরচ কেমন হতে পারে?
মন্তব্য করতে লগইন করুন