যে লেখাটি পড়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না...........
লিখেছেন লিখেছেন মুসা বিন মোস্তফা ২১ নভেম্বর, ২০১৪, ০৬:১১:৫৭ সন্ধ্যা
বেওয়ারিশ
আহমাদ কাফী
২১ নভেম্বর ২০১৪, শুক্রবার, ৯:২১
রাত ২টার সময় যখন আমার কাছে ফোন এলো, নোমান ভাই মহিলাটি ‘মরে গেছে’। শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। মানুষের শেষ সময়ে কত রকমের স্বাদ জাগে। সম্পদের হিসাব, সন্তানের চিন্তা, পরকালসহ কত কিছু মনে জড় হয়। কিন্তু সে এসব কিছুই চিন্তা করেনি এমনকি তার বাচ্চা মেয়েটার জন্যও না। আমাকে কাছে ডেকে বলল, ‘বাই আমার খুব বাইং মাছ খাইতে জানে খয়’। পাঁচ ভাই, পানসীসহ সিলেট শহরের সব রেস্টুরেন্ট তন্নতন্ন করে কোথাও বাইন মাছ পেলাম না। তবে কি একজনের শেষ ইচ্ছা অপূর্ণ থাকবে বলেই আজ সিলেট শহরে কোনো বাইন মাছ রান্না হয়নি? শেষে বড় দেখে এক পিস রুই মাছ নিয়ে এলাম; কিন্তু খেতে পারল না।
সেদিন শনিবার। কমলগঞ্জ থেকে আমার নানীকে নিয়ে এসে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করলাম। নানান ঝক্কি-ঝামেলার পর ওয়ার্ডবয়কে খুশি করে দিয়ে একটা সিটও পেয়ে গেলাম। ইদানীং সিলেটে থাকা হচ্ছে না, তাই দ্রুত এক বন্ধুর মেসে থাকার ব্যবস্থাও করে ফেললাম। নানীর শরীর অপারেশনের জন্য প্রস্তুত না থাকায় ডাক্তার আরো কিছু দিন দেরি করতে পরামর্শ দিলেন। মেডিক্যালের ব্যাপারে বিশেষ করে সরকারি মেডিক্যালের ব্যাপারে ভালো অভিজ্ঞতা থাকায় তেমন সমস্যা হচ্ছিল না। পরদিন সকালে রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার নিয়ে এসেছি, শুনি পাশের সিটের রোগীকে ডাক্তার আচ্ছামতো বকছে, অথচ রোগীর কোনো অংশগ্রহণই নেই। আমি কৌতূহল সামলাতে না পেরে এগিয়ে গেলাম। ‘আজকের মধ্যে পরীক্ষাগুলো করাতে না পারলে আপনার ভর্তি বাতিল করে দেবো’ বলে ডাক্তার ফাইল ফেলে দিয়ে চলে গেলেন। কাছে গিয়ে দেখলাম রোগী ত্রিশ-বত্রিশ বছরের এক মহিলা, সাথে এগারো-বারো বছরের একটি মেয়ে। রোগীকে প্রশ্ন করে কোনো সদুত্তর না পেয়ে পাশের সিটের মহিলাকে জিজ্ঞেস করায় বললেন, এ মহিলা গত পনেরো দিন থেকে এখানে পড়ে আছে; কিন্তু দেখার কেউ নেই। ডাক্তার বেরিয়ে যেতে যেতে আমিও পিছু নিয়ে ডাক্তারের কাছে জানতে চাইলে ডাক্তার বললেন, মহিলাটি পনেরো দিন থেকে এ সিটে অথচ এখন পর্যন্ত কোনো আত্মীয়স্বজন আসেনি। আমরা এ পর্যন্ত যত টেস্ট দিয়েছি তার কোনোটাই করেনি, ঠিকমতো ওষুধ পর্যন্ত খাচ্ছে না, এ দিকে দিন দিন অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। এখন সিট কেটে দেয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই। আমি অনুরোধ করলাম আরেকটু সময় দেয়ার জন্য, আমি চেষ্টা করে দেখব টেস্টগুলো করাতে পারি কি না। ‘ঠিক আছে আপনি একটু দেখেন, না হলে আমাদের আর কিছুই করার থাকবে না’।
ওয়ার্ডের দিকে ফিরে আসতে আসতে কেমন যেন একটা বিষণœতা চেপে ধরল, এই মহিলাটি এমন একা পড়ে আছে কেন এভাবে, সত্যিই কি ওর কেউ নেই? ওয়ার্ডে এসে তার ফাইল হাতে নিয়ে দেখি ডাক্তার তিন-চারটা পরীক্ষা বারবার লিখে দিয়েছে; কিন্তু সে একটাও করায়নি এমনকি ফাইলটা কাউকে দেখায়নি পর্যন্ত। মহিলার কাছে ভিড়ে বুঝলাম কেন কেউ তার কাছে আসছে না। নোংরা মানুষ অনেক দেখেছি, কিন্তু এমন দেখিনি। খুবই সুন্দর চেহারা, সুস্থকালে নিশ্চয় খুবই আকর্ষণীয় মহিলা ছিল। হাঁটতে পারছে না, উঠে বসতে পারে কি না তা-ও সন্দেহ। মনে হলো প্রস্রাব-পায়খানাও বিছানায় করছে কি না, নইলে শরীর ও বিছানা থেকে এত গন্ধ ছড়াত না। এতই প্রকট যে ডাক্তার কাছে এসে ভালোমতো পরীক্ষাও করতে পারছে না। আমি এক রকম নাক বন্ধ করেই তার সাথে কথা বললাম, কথা বলবে কী, কান্নাই থামাতে পারছিল না। এতটুকু বুঝতে পারলাম যে তার কেউ নেই, আমি যেন দয়া করে ভাই হয়ে তাকে একটু সাহায্য করি। সাথে থাকা মেয়েটি ছাড়া তার আর কেউ নেই। এগারো-বারো বছরের মেয়ে আর মাকে কী-ই বা দেখবে, কেউ একজন যে তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করে রেখে গেছে সেটাই ভালো করে বলতে পারছে না। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না, আমার রোগীকে দেখব না এদেরকে দেখব, তা ছাড়া এই মহিলা হাঁটতেও পারে না। চেষ্টা করে তো দেখা যায়। একটা ট্রলি এনে মহিলাকে তুললাম, আমি সামনে ধরে মেয়েকে পেছনে ধরতে বললাম। চারতলা থেকে নিচে নিয়ে দুই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও পরীক্ষাগুলো করাতে পারলাম না। কারণ সময় যে শেষ, একটার পর আর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার কোনো নিয়ম রাখেননি। বাধ্য হয়ে ফিরে এলাম। রাতে ডাক্তারকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে কাল সকাল পর্যন্ত সময় নিলাম। সারা দিনরাত এমন ব্যস্ততার মধ্যেই কেটে গেল। এমনিতেই পকেটে তেমন টাকা-পয়সা নেই, তার ওপর মহিলার জন্য উপরি খরচ হলো কিছু টাকা। ওয়ার্ডের সবার কেমন যেন আমার দিকে চেয়ে নাক সিঁটকানো ভাব। আমি অবশ্য এর কারণ কিছু বুঝলাম না, বোঝার চেষ্টাও করলাম না। আমি এ দিকে মনোযোগ না দিয়ে সকালে পরীক্ষাগুলো করে রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম।
ডাক্তার রিপোর্ট দেখে হকচকিয়ে গেলেন। আমাকে বললেন আপনি রোগীর কে হন? আমি বললাম কেউ না, রোগীর কেউ না থাকায় তাকে একটু সাহায্য করছি। ডাক্তার বললেন, আপনি যদি দুই সপ্তাহ আগে অর্থাৎ রোগী ভর্তির সাথে সাথে এই কাজটা করতে পারতেন, তাহলে হয়তো আমরা কিছু করতে পারতাম; কিন্তু এখন অবস্থা বিপরীত। এখন আমরা কর্তব্য আর মানবতার খাতিরে শুধু চেষ্টা করে দেখতে পারি। আমার পীড়াপীড়িতে ডাক্তার বিষয়টা খুলে বললেন, এই রোগী গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং ধর্ষণের ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়েছে। রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, তার কিডনি দুটোই নষ্ট হয়ে গেছে। তা ছাড়া এখন তাকে বাঁচিয়ে রাখার মতো রক্তও তার শরীরে নেই। এখন তাকে কতক্ষণ বাঁচিয়ে রাখা যায়, এটাই ডাক্তারদের চেষ্টার সুযোগ আছে। আমি বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করে দুই ব্যাগ রক্ত জোগাড় করে দিলাম। রক্ত দেয়ার পর মহিলা মোটামোটি কথা বলতে পারছে। কিন্তু তার এই বেঁচে থাকাটা যে এখন একটা অলৌকিক ব্যাপার এবং ডাক্তারের ভাষ্য অনুযায়ী মৃত্যু যে শুধু সময়ের অপেক্ষা তা কেউ জানল না। তাকে খাইয়ে গিয়ে মাত্র শুয়েছি অমনি আবার নানী ফোন করলেন, ‘নোমান, মহিলাটি তো মরে গেছে’। সারা রাত আর ঘুম হলো না। আমার কেউ নয়, তাকে চিনিও না, তার পরও কেনো যে ঘুম এলো না। খুব ভোরে উঠেই হাসপাতালের দিকে রওনা দিলাম।
হাসপাতালে এসে পড়লাম কী এক বিব্রতকর অবস্থায়। ভালোমতো সূর্যও ওঠেনি, কর্মচারীও নেই তেমন। লাশটাকে তো অন্তত ওয়ার্ড থেকে বের করতে হবে। কিন্তু কেউই এগিয়ে আসতে চাচ্ছে না, সবাই কেমন একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। আমি বুঝলাম না একটা মৃত মানুষকে ধরতে সাহায্য না করার কী কোনো কারণ থাকতে পারে। হাসপাতালের নিয়মকানুনের পেছনে দৌড়ে ডেড সার্টিফিকেট আর আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে লাশ বের করতে করতে দুপুর চলে এলো। এখন বড় সমস্যা এই লাশ আমি কী করব, একে নেবে কে? কিংবা কার কাছে পাঠানো যায়। মহিলার সাথে থাকা বিপর্যস্ত একটা ব্যাগ আতিপাতি করে কোনো সম্পর্কের এক ভাইয়ের ফোন নম্বর পেলাম যে কি না সিলেটে কোথায় দারোয়ানির চাকরি করে। ফোনে সে আসারও আশ্বাস দিলো। মনে মনে ভাবলাম, যাক এবার লাশটাকে বাড়ি পাঠিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচা যাবে।
মৃত মহিলার ভাইয়ের কাছে পেয়ে গেলাম অজানা অনেক প্রশ্নের উত্তর।
মহিলার স্বামীর খোঁজ কেউ জানে না। খাওয়াতে না পেরে নাকি অন্য কাউকে বিয়ে করে পালিয়েছে কেউ বলতে পারে না। স্বামীর অনুপস্থিতিতে সে দুই মেয়ে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়ে। কাজ করার শক্তি তার আছে; কিন্তু কাজ পায়নি, আর এমন অজপাড়াগাঁয়ে কে-ই বা তাকে কাজ দেবে, কাজ ছাড়াই মানুষ তাকে পয়সা দিতে রাজি; কিন্তু কাজ দিতে চায় না। এক একজন একেকভাবে বড়শি পোঁতে; অমন সোনার শরীর কাজ করে ভাঙবে কেন, পান মুখে দিয়ে পালঙ্কে বসে থাকাই তোমাকে মানায়। এমন সময় কেউই যে পাশে দাঁড়ায়নি তা নয়। গ্রামের মেম্বার কিংবা তার ভাই বা আরো দু-একজন তার ঘরে এসেছে, ভাঙা পিঁড়িতে বসে কত কথা বলেছে, যাওয়ার সময় বাচ্চাদের হাতে শ’ পঞ্চাশ টাকা গুঁজে দিয়েছে। দারিদ্র্যের সাথে অসহায়ত্ব জমজ ভাইয়ের মতো তাকে আঁকড়ে ধরেছে। নিজের বেঁচে থাকা আর সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখতে গিয়ে কখন যে সাধন, প্রদীপ, মেম্বার, মেম্বারের ভাই তাসকিনদের ছায়ায় ঢাকা পড়েছে বুঝতেই পারেনি। এই গোপন সারা গাঁয়ে জানাজানি হতেও সময় লাগেনি। গ্রামজুড়ে প্রবল আয়োজনে সালিস বসাতেও সময় লাগেনি, যেখানে বিচারকের আসনে মেম্বার, মেম্বারের ভাইয়ের চেয়ারও আছে। মেম্বারের ভাই তাসকিন মহিলাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে আসার সময় কী বলে তা কেউ না জানলেও একটা রিয়াল শো দেখার জন্য সবাই উন্মুখ। বিচারে তার মুখ থেকে একটি কথাও বের করা যায়নি। কে কে তার ঘরে যায় তাও না। দশটা জুতার বাড়ি দিয়ে আর কঠিন সাবধান করে বিদায় করা হয়। কিন্তু সে খাবে কী, বাচ্চারা খাবে কী, কাজ কেন পাবে না তার কোনো বিচার হয়নি।
এক দিন রাতে গ্রামের পাহারাদার মহিলার ঘরের ভেতরে পুরুষের গলা শুনে পেছনের বেড়ার তারের বাঁধ খুলে ভেতরে ঢুকে হতভম্ব, হালকা আলোয় তাসকিনকে চিনতে তার সমস্যা হচ্ছে না। মিনিটখানেক পর তাসকিন পাহারাদারকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে অন্ধকারে মিশে যায়। কিছুক্ষণ পরে তাসকিন দুই বন্ধুসহ পাহারাদারকে নিয়ে মহিলার ঘরে প্রবেশ করে। পরদিন যথারীতি দিন আসে, দিন যায়, আগের মতোই। সারা দিন তাসকিনকে কোথাও দেখা না গেলেও বিকেলে বাজারে তাকে দেখা যায়। একঘরে মহিলাকে খোঁজ নেয়ার দরকার পড়ে না কারো, পড়ার কথাও না। তিন-চার দিন কোনো নড়াচড়া পাওয়া না যাওয়ায় কিছু কানাঘুষা শুরু হলে মেম্বারের নেতৃত্বে মহিলার ঘরে অভিযান চালায় একদল অতি উৎসাহী বৃদ্ধ। ঘরের সব কিছুই জায়গায় আছে; কিন্তু কোনো মানুষের অস্তিত্ব নেই। শুকনো রক্ত মাখানো বিছানার ছাদর ছাড়া মানুষের আর কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না, যদিও চাদরখানা ঘরের বাইরে আসার আগেই নাই হয়ে যায়। মহিলার নিখোঁজ হওয়ার মধ্য দিয়ে একটা অভিশপ্ত অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটায় গ্রামের সবাই দু-এক দিন আলোচনা করে ক্ষান্ত হয়।
এই গল্প এখানেই শেষ হয়ে যেত এবং আমরা এ রকম একটা কাহিনীর কোনো হদিসই পেতাম না, আর আমাদের এতটা সময়ও ব্যয় করতে হতো না যদি না কোনো অজ্ঞাত ব্যক্তি এই মহিলাকে হাসপাতালে এনে ভর্তি করত। হয়তো হাসপাতালের বাইরেই মরে পড়ে থাকত কিংবা হাসপাতালে পৌঁছতেই পারত না।
জানি না লাশের জন্য আর কী ঘটনা অপেক্ষা করছে। আমাদের অজ্ঞাতে ছোট মেয়েটার জীবন কোথায় গিয়ে ঠেকবে তাও জানতে পারব না কোনো দিন।
মূল লেখা
বিষয়: বিবিধ
১২০৮ বার পঠিত, ১৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন