মরতে রাজি; পড়তে নয় (গল্প-১ম পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ মাসুম সরকার আযহারী ২২ মে, ২০১৫, ০৮:৫৮:২৩ সকাল
ভীষণ অভাবের সংসার। "নুন আনতে পান্তা ফুরায়" অবস্থা। এই টানাপোড়নের সংসারে চারটি কন্যা সন্তানের পিতা কৃষক আব্দুল্লাহ। ছয় সদস্যের সংসারের ঘানি টেনে একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছেন। শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না ইদানিং। দীর্ঘদিন যাবৎ হাঁপানি রোগে আক্রান্ত। চুন্নু ডাক্তার দেখে বলেছেন- "যক্ষ্মার লক্ষণ মনে হচ্ছে"। তিনবেলা ঔষধ যোগার করাই যার জন্য দুঃসাধ্য তার যক্ষ্মা হলেতো রক্ষ্মা না থাকারই কথা। অজানা আশংকায় মনটা কেঁদে উঠে। "আমি মরে গেলে এই মেয়েগুলো কে দেখবে? আমার বিবি কি পারবে এই সংসারের হাল ধরতে? জায়গা-জমি বড় ভাইয়েরা দখল করে স্ত্রী সন্তানদের তাড়িয়ে দিবে নাতো?" ... ইত্যাদি নানান দুঃশ্চিতা জড়ো হয় আব্দুল্লাহর মাথায়। ঘনকালো মেঘেঢাকা আকাশে হঠাৎ সূর্যের আলো উঁকি দেয়ার মত আব্দুল্লাহর মনের কোনে একটু স্বপ্ন-সাধ জিলিক দিয়ে উঠে। মনে মনে ভাবে- আল্লাহ যদি আমাকে একটা ছেলে দিতেন তাহলে হয়তো অনেক সমস্যার সমাধান হতো। তাহাজ্জুদ পড়ে কায়মনো বাক্যে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতে থাকেন। "ও আল্লাহ! তোমার কাছে দুনিয়াতে শুধু একটাই চাওয়া- আমাকে একটা ছেলে সন্তান দান কর। তাহলে আমি কবরে গিয়েও শান্তি পাবো। কারণ আমার ছেলে আমার জন্য দু'হাত তুলে রাব্বির হামহুমা...বলবে। আলেম হবে। তোমার গুণগান করবে। আমি তাকে তোমার দ্বীনের জন্য উৎস্বর্গ করে দিবো... ।
আল্লাহ তায়ালা দু'আ কবুল করলেন। আব্দুল্লাহ যারপরনাই খুশী। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। সবাইকে বললেন- আমি যদি বেঁচে থাকি তাহলে "লাবীব"কে একজন আলেম বানবো ইনশাআল্লাহ্।
ধীরে ধীরে আব্দুল্লাহর অবস্থার অবনতি হতে থাকে। বহুদিন অসুস্থ বিছানায় পড়ে থাকেন। অবস্থা খুব খারাপ দেখে চুন্নু ডাক্তারকে বাসায় ডেকে আনা হল। সব দেখে বললেন- রোগীর অবস্থা খুব খারাপ। বাঁচাতে হলে এখনই ইনজেকশন দিতে হবে। কিন্তু ডাক্তার সাহেব ভাবলেন, রোগী মারা গেলে আমার টাকা পাব না। তাই মুমূর্ষু রোগীর সামনে ইনজেকশন হাতে নিয়ে বসে রইলেন। একটাই কথা অগ্রীম টাকা না দিলে সূই পুশ করা হবে না। অবশেষে ধার- করে কোন রকমে টাকা জোগার হল। কিন্তু রোগীকে আর বাঁচানো গেল না। মৃত্যুর আগে স্ত্রীকে হাতে হাত রেখে ওয়াদা করালেন, বললেন-" আমি মরে গেলে, আমার এই লবীবকে তুই আলেম বানাবি"। বিবি রুপবান অশ্রু ভেজা চোখে শুধু মাথা নেড়ে একমত প্রকাশ করলেন।
তিন বছরের ছোট্ট ছেলে লবীব, ছোট-ছোট চারটি মেয়ে। বড়টির বয়স মাত্র এগার বছর। ছয় সদস্যের এই অভাবের সংসারে স্বপ্নের জাল বুনতে থাকেন রুপবান বিবি। সংসারের বোঝা হালকা করার জন্য দ্বিতীয় মেয়েকে নানার বাড়ীতে পাঠিয়ে দেন। বড় মেয়ে প্রাইমারি শেষ করলে পাশের গ্রামে হাইস্কুলে ভর্তি করেন। বাকী দুই মেয়েকে প্রাইমারিতে ভর্তি করেন। স্বামীর স্বপ্ন বাস্তবায়নে ছেলের প্রতি এক্সটা কেয়ার নিতে থাকেন। প্রতিদিন রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে ছোট-ছোট সূরাহ, মাসনুন দোয়াগুলো শিখাতে থাকেন। বোনদের সাথে মাঝে-মধ্যে সকালের মক্তবেও পাঠান । বাড়ীর আশেপাশে কোন মাদ্রাসা না থাকায় চার বসর বয়সেই প্রাইমারি স্কুলে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু বার্ষিক পরীক্ষার আগে ঘটে যায় এক লঙ্কা কাণ্ড।
স্কুলের হেডমাস্টার খুবই কড়া মেজাজের লোক। ওনার বেতকে ছাত্ররা বাঘের চেয়েও বেশী ভয় পেত। তিনি পাঁচ বছরের ছোট্ট বাচ্চা লবীবকে বেধড়ক পিটিয়ে, সরকারী বইগুলো কেড়ে নিয়ে স্কুল থেকে বেড় করে দেন। তার অপরাধ? অপরাধ একটাই- মাত্র "পাঁচ টাকা" পরীক্ষার ফী তাও কেন পরিশোধ করতে দেরী?!
লবীব বাসায় এসে জামা খুলতেই মা তার শরীর দেখে হবাক। পায়ে, পিঠে বেতের প্রহারের লম্বা-কালো দাগ। এ কী? সকাল বেলা সুস্থ ছেলে স্কুলে পাঠালাম এই কয়েক ঘন্টায় কী হল?! কারো সাথে মারামারি করেছো বাবা? মাথা নেড়ে না-সূচক জাবাব দেয় লবীব। তাহলে কী হয়েছে বল? কিছুই বলছেনা সে। কারণ স্যারের ভয় তখনো তার কচি মন থেকে মুছে যায়নি।
মায়ের মন অস্থির হয়ে পড়ে। ছুটে যান পাশের বাড়ী লবীবের ক্লাসমেটদের বাসায়। বিস্তারিত শোনার পর তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেন রুপবান বিবি।
মাটির চুলায় তখন দুপুরের রান্না হচ্ছিল। রান্না বন্ধ করে ছেলেকে কোলে নিয়ে ছুটলেন মা। স্কুল কমিটির সভাপতি, সেক্টেটারি সহ এলাকার গণ্যমান্য লোকদের বাড়ীতে বাড়ীতে গিয়ে হেডমাস্টারের বিরুদ্ধে নালিশ করেলেন। বিচার চাইলেন। কিন্তু তাদের জবাব রুপবানের মনের আগুণ আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিল। তারা বলল- "হেড মাস্টার মেরেছে, তার বিচার কী করবো? আমরা কি মাস্টারকে ধরে পিটাতে পারবো। তুমি টাকা সময়মত দেয়ার পরেও যদি পেটাতো তাহলে হয়ত আমরা কিছু বলতে পারতাম...দোষতো তোমারই"।
বুকভরা কষ্ট নিয়ে, নিরাশ হয়ে রওয়ানা দিলেন বাসার দিকে। কিছুদূর আসতেই বিড়বিড় করে কি যেন বললেন। আর অমনি লবীবকে নিয়ে ছুটে চললেন স্কুলের দিকে। স্কুলের মাঠে পৌঁছে দেখেন স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। ছাত্ররা সবাই চলে গেছে। স্যারেরাও অনেকে চলে গেছেন। শুধু হেডমাস্টার আর হিন্দু বাবু আছেন।
হেডমাস্টার অফিসের তালা লাগাচ্ছেন। এক্ষণি বেড়িয়ে পড়বেন। এমন সময় একমাত্র ছেলে লবীবকে কোলে নিয়ে হেডমাস্টারে সামনে এসে হাজির রুপবান বিবি। কী করবেন, কী বলবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। মনের ভিতরে রাগ-ক্ষোভ যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে ছিটকে পড়ছে। মনের আগুণে একটু ঠাণ্ডা পানি দেয়ার জন্য শুধু একটা কটু কথা শুনিয়েই চলে আসলেন। বললেনঃ-............(চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১৭৬২ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন