একজন ক্ষণজন্মা বিদ্যোত্সাহিনীর ভালবাসায় সিক্ত জ্ঞানের বাগান
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ মাসুম সরকার আযহারী ২২ মার্চ, ২০১৫, ১০:৪৮:৫২ সকাল
পৃথিবীর ইতিহাসে যে সকল মহীয়সী নারী তাদের অসামান্য অবদানের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন তাদের মধ্যে জেইন এলিজাবেথ অন্যতম। শিক্ষার প্রতি অনুরাগী ক্ষণজন্মা এই বিদ্যোত্সাহিনী ২৫ আগষ্ট ১৮২৮ ইং সালে অ্যামেরিকার নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণ করেন।
৩০ সেপ্টেম্বর ১৮৫০ইং সালে বাইশ বছর বয়সে তরুন আইনজীবী লিল্যান্ড স্ট্যানফোর্ড এর সাথে জেইন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের প্রায় ১৪ বছর পর জেইনের বয়স যখন ৩৯ তখন জেইন দম্পতি ১৪ মে ১৮৬৪ ইং সনে একটি পুত্র সন্তান লাভ করেন। যার নাম রাখেন লিল্যান্ড ডুয়েট স্ট্যানফোর্ড জুনিয়র ।
জেইন এবং স্ট্যানফোর্ড সন্তানকে সাথে নিয়ে ১৮৮৪ইং সালে ইটালিতে এক ভ্রমনে বের হন। এই ভ্রমনের এক পর্যায়ে লিল্যান্ড জুনিয়র মারাত্মক টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হয়। কয়েক সপ্তাহ রোগে ভোগে অবশেষে মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৩ মার্চ, ১৮৮৪ইং সালে ইটালিতেই মৃত্যু বরণ করে।
একমাত্র সন্তানের অকস্মাৎ মৃতুটি যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়ে মাথর উপর পড়ল। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই যারপরনাই ব্যথিত হলেন। ছেলের শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। শোক কাটিয়ে উঠার পর দু'জন মিলে ভাবতে লাগলেন কিভাবে কলিজার টুকরা সন্তানের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখা যায়। এ ব্যাপারে উত্তম পরামর্শের সন্ধানে বের হলেন এই দম্পতি। তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শের জন্য দেশে-বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভিসিট করতে থাকেন।
ভ্রমনের এক পর্যায়ে এই দম্পতি বিশ্ববিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টরের অফিসে যান। উদ্দেশ্য হলো, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে জন্য কিছু দান করেবেন। যা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্ট্যানফোর্ড জুনিয়রের স্মৃতির জন্য কিছু নির্মান করবেন।
রেক্টরের অফিস সেক্রেটারীর কাছে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। কিন্তু তাদের সাদা-মাটা পোশাক দেখে তাদেরকে কোন পাত্তাই দিলেন না। সোজা বলে দিলেন- "রেক্টর মহোদয় অত্যন্ত ব্যস্ত আছেন। এই মুহূর্তে কাউকে সাক্ষাৎ দিতে পারবেন না"। কিন্তু যে করেই হোক তাদের যে সাক্ষাৎ করতেই হবে। তাই তারা সেক্রেটারীকে বললো- "ঠিক আছে, তাহলে আমরা না হয় কিছু সময় অপেক্ষা করি। ওনার ব্যস্ততা সারার পরেই না হয় সাক্ষাৎ করি"। সেক্রেটারী আন্তরিক ভাবেই চাচ্ছিলেন না যে, ওরা সাক্ষাৎ করুন। ওদের পোশাক, কথাবার্তা শুনে ভাবলেন কোথাকার না কোথাকার ক্ষেত শুধু শুধু বিরক্ত করছে। তাদের কথায় কর্ণপাত না করে নিজের কাজে মনোনিবেশ করেন। আর মনে মনে ভাবলেন- অপেক্ষার এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে হয়ত চলে যাবে। কিন্তু না। ওরা তো একেবারেই নাছোড়বান্দা। কয়েক ঘন্টা যাবৎ বসেই আসেন। অগত্যা সেক্রেটারী বিষয়টা রেক্টরের কানে দিলেন। রেক্টরও তাদের তেমন কোন গুরুত্ব দিলেন না। আরো কয়েক ঘন্টা অপেক্ষার প্রহর গুণলেন। অবশেষে সাক্ষাতের অনুমতি পেলেন।
রেক্টর মহোদয় ওদের বেশভূষা দেখে নাক সিটকানোর মত অবস্থা। আগমনের কারণ জানতে চাইলেন। ওনারা ওনাদের একমাত্র সন্তান লিল্যান্ড জুনিয়রের মৃত্যুর কথা জানালেন এবং তার স্মৃতির জন্য ডোনেশান দেয়ার প্রস্তাব পেশ করলেন। রেক্টর মহোদয় বলেলেন- সবার স্মৃতির জন্য একটি করে মূর্তি বানাতে থাকলে এটা আর বিশ্ববিদ্যালয় থাকবেনা একটা আস্ত যাদুঘরে পরিণত হবে। আপনারা এক কাজ করেন- আপনাদের সন্তানের জন্য একটা যাদুঘর তৈরী করেন, যেখানে তার স্মৃতি সংরক্ষিত থাকবে।
ওনারা বললেন- আমরাতো মুর্তি বানানোর কথা ভাবছি না। আমরা চাচ্ছি ওর নামে একটা বিল্ডিং তৈরী করে দিতে। রেক্টর মহোদয় বলেন- বিল্ডিং! একটা বিল্ডিং এর নির্মান খরচ কত জানেন? এই বিশ্ববিদ্যালয় তৈরী করতে সাড়ে সাত মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে, জানেন?। পরিমানটা একটু বাড়িয়েই বললেন। যাতে তারা টাকার কথা শুনেই কেটে পড়েন। স্বামী-স্ত্রী একজন আরেক জনের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন। বললেন তাহলে একটি বিল্ডিং কেন? একটা বিশ্ববিদ্যালয়ইতো তৈরী করতে পারি। রেক্টরের আচরণে অসন্তুষ্ট হয়ে আশাহত মনে তারা কেলিফোর্ণিয়ায় ফিরে আসেন। এসে একই সাথে একটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং একটি যাদুঘর নির্মান করে ফেলেন।
১৮৯১ইং সালে যথারীতি বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধনের আয়োজন করা হলো। জেইন একটি উদ্বোধনি বক্তৃতা প্রস্তুত করে নিয়ে অনুষ্ঠানে আসেন। কিন্তু এতটাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন যে তার পক্ষে আর বক্তৃতা দেয়া সম্ভব হয় নি।
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধনের অল্প কিছুদিন পরেই জেইনের স্বামী মৃত্যু বরণ করেন। বিধবা জেইন ছিলেন উচু মানের বিদ্যোত্সাহিনী। শিক্ষার প্রতি এতই অনুরগী ছিলেন যে, যুবকদের জন্য একট বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় তৈরী এবং এর ফান্ডের জন্য তার ব্যক্তিগত সমস্ত অলংকার বিক্রি করতে সর্বদা প্রস্তুত ছিলেন।
পৃথিবীর অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় এমন মহৎ ভালবাসা আর সুদৃঢ় সংকল্পের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়নি।
আজ লিল্যান্ড স্ট্যানফোর্ড জুনিয়ের স্মৃতিবিজড়িত স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় আট হাজার এক শত আশি (৮,১৮০) একর জমির উপর ৭০০ বিল্ডিং নিয়ে স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে সারা বিশ্বে।
বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুন।
http://janestanford.stanford.edu/
http://janestanford.stanford.edu/timeline.html#c3
http://janestanford.stanford.edu/biography.html#c4
https://library.stanford.edu/spc/faq#snubbed
http://www.stanford.edu/about/history/
বিষয়: সাহিত্য
১৪৭১ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কলিজার টুকরা সন্তানের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার এটি একটি চমৎকার প্রেরণামূলক উদ্যোগ নিঃসন্দেহে।
দারুন শিক্ষণীয় ও উপভোগ্য লিখাটির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন