আদর্শ নারী উম্মে সুলাইমের নজিরবিহীন ধৈর্য্যের চরম পরাকাষ্ঠা ও পুরস্কার
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ মাসুম সরকার আযহারী ২০ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০১:৪৯:১৬ রাত
হযরত রুমাইছা বিনতে মিলহান (উপনাম উম্মে সুলাইম) ইসলাম গ্রহণে অগ্রগামী সাহাবীদের মধ্যে একজন। হাদীস, ইতিহাস ও জীবনীগ্রন্থগুলোতে তার বীরত্ব, সাহসিকতা, ধার্মিকতা, প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার অনেক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তবে তিনি মুসিবতের সময় ধৈর্য্যশীলতা ও বুদ্ধিমত্তার যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ইতিহাসের পাতায় তার নজির খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন।ইমাম বুখারী তার বিখ্যাত হাদীসগ্রন্থ সহীহ বুখারীতে তার এক নজিরবিহীন ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন এভাবেঃ-
হযরত আবু তালহার সাথে উম্মে সুলাইমের বিবাহ হওয়ার পর তাদের খুব সুন্দর ফুটফুটে একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। তার নাম রাখা হয় উমাইর। তার ছোট একটি পাখিও ছিল, যার সাথে সে খেলত। রাসূলুল্লাহ (সা) মাঝেমধ্যে সেই শিশুটির সাথে কৌতুক করতেন এবং বলতেন,
হে উমাইর! তোমার পাখির কী খবর!’আবু তালহা (রা.) তাকে অত্যাধিক ভালবাসতেন। একদিন ছেলেটি অসুস্থ হয়ে পড়ল। আবু তালহা এ নিয়ে খুব চিন্তিত ও অস্থির হয়ে পড়লেন। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় রাসূলুল্লার দরবারে আসা যাওয়া ছিল তার অভ্যাস। এক বিকেলে তিনি ঘর থেকে বের হলেন। ইত্যবসরে তার অসুস্থ ছেলে মৃত্যুবরণ করল।
এ দিকে উম্মে সুলাইম (রা.) মৃত্ ছেলেকে গোসল করালেন, কাফন পরালেন, সুগন্ধি মেখে দিলেন। কাপড়-চোপড় দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দিয়ে ঘরের এক কোণে সুন্দরভাবে শুইয়ে রাখলেন। আর আনাস কে পাঠিয়ে স্বামিকে ডেকে পাঠালেন এবং তাকে পুত্রের মৃত্যুসংবাদ না জানাতে সাবধান করে দিলেন।
আবু তালহা সেদিন রোযা রেখেছিলেন। উম্মে সুলাইম রা. তার জন্য খানা তৈরি করলেন। আবু তালহা ঘরে ফিরেই সন্তানের কথা জিজ্ঞেস করলেন। উম্মে সুলাইম বললেনঃ
"সে এখন আগের চেয়ে শান্ত"। ক্লান্ত স্বামীকে তৎক্ষণাৎ পুত্রের মৃত্যুসংবাদ জানালেন না। ঘরের লোকদেরকেও নিষেধ করে রেখেছিলেন। তিনি ছাড়া অন্য কেউ যেন এ সংবাদ তাকে না জানায়। আবু তালহা স্ত্রীর কথা শুনে ভেবেছিলেন ছেলে তাঁর সুস্থ হয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। তাই তিনিও নিশ্চিন্ত মনে রাতের খাবার খেলেন এবং বিশ্রাম নিলেন। এমনকি রাতে তাদের মিলনও হলো।
সকালে আবু তালহা বের হওয়ার আগে উম্মে সুলাইম তাকে বললেনঃ
"বলুন কেউ যদি কারো কাছে কোনো কিছু গচ্ছিত রাখে অতপর তার কাছে তা ফেরত চায় তবে তার কি অধিকার আছে তা ফেরত না দিয়ে নিজের কাছে আটকে রাখার? আবু তালহা বললেন, না তার এ অধিকার নেই। হযরত উম্মে সুলাইম এবার শান্ত কণ্ঠে বললেন, "আপনার পুত্রের ব্যাপারে সবর করুন। আল্লাহ তাকে আমাদের কাছে গচ্ছিত রেখেছিলেন তারপর তিনি ফিরিয়ে নিয়েছেন"।
আবু তালহা এতে রাগান্বিত হলেন (ঘরে মৃতসন্তান রেখে এতকিছু হয়ে গেল!! কার রাগ না উঠব)। রাতের আচরণে অসন্তুষ্ট হয়ে তিনি রাসূলুল্লাহর নিকট স্ত্রীর নামে অভিযোগ করলেন। রাসূলুল্লাহ তাদের ঘটনা শুনে বিমুগ্ধ হলেন এবং এই বলে দুআ করলেন-
"আল্লাহ তোমাদের এ রাতে বরকত দান করুন"।’ তারপর আল্লাহ তাআলা তাদেরকে আবদুল্লাহ নামে আরেকটি পুত্র সন্তান দান করলেন। সেই আবদুল্লাহকে পরবর্তীতে আল্লাহ তাআলা সাত পুত্র দান করলেন, যাদের প্রত্যেকেই কুরআনের আলেম হয়েছেন।–
(সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৩০১; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১২০৮; ফাতহুল বারী ৩/২০১; তবাকাতে ইবনে সাদ ৮/৪৩১-৩২)
********************************************************
এই হাদীসের শিক্ষাঃ
উক্ত ঘটনার মাধ্যমে উম্মে সুলাইমের প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা, সহিষ্ণুতা ও নেক গুণাবলি ফুটে উঠেছে।
প্রথমে স্বামীকে পুত্রের মৃত্যু সংবাদ না জানিয়ে তাকে নিশ্চিন্তে রাত্রিযাপনের সুযোগ দিয়েছেন।
সন্তানের মৃত্যুকে গচ্ছিত বস্তুর ফেরৎ নেয়ার সাথে উদাহরণ দিয়ে শোকার্ত স্বামীকে যেমন সান্ত্বনা দিয়েছেন তেমনি আল্লাহর ফয়সালাকে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন।
আল্লাহ তাআলা যখন তার উদ্দেশ্য ও নিয়তের সততা সম্পর্কে জানলেন তার মর্যাদা বৃদ্ধি করলেন এবং তিনি আল্লাহর রাসূলের বরকতের দুআ লাভ করলেন।
নবী করীম (সা) ইরশাদ করেছেন, স্বপ্নে আমি জান্নাতে প্রবেশ করলাম। হঠাৎ কারো নড়াচড়ার শব্দ শুনতে পেলাম। আমি ফেরেশতাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, ইনি কে? তারা বললেন, ইনি হলেন রুমাইছা বিনতে মিলহান, আনাস ইবনে মালিকের আম্মা।
(সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৪৫৬; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১১৯৫৫; তবাকাতে ইবনে সাদ ৮/৪২৯; মুসনাদে তয়ালিসী, হাদীস : ১৭১৫) আরো দেখুন (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৩৬৭৯; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৫০০২; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৭০৮৪; সুনানে নাসায়ী কুবরা, হাদীস : ৮১২৪)
********************************************************
এক্ষেত্রে শিক্ষণীয় বিষয় হল আল্লাহ তাআলার ফয়সালাকে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেওয়া। বিপদ-আপদে ধৈর্য্য ধারণ করা এবং আল্লাহর কাছে উত্তম বিনিময় প্রত্যাশা করা। প্রয়োজনের ক্ষেত্রে দ্ব্যর্থবোধক বাক্য ব্যবহার করা। স্বামীর সন্তুষ্টির জন্য সাজসজ্জা গ্রহণ করা ইত্যাদি।
বিষয়: রাজনীতি
১২৫১ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন