সম্মান ও মর্যাদার মানদন্ডঃ বস্তুবাদী ও ইসলামি দৃষ্টিকোন (দ্বিতীয় পর্ব)

লিখেছেন লিখেছেন মোঃ মাসুম সরকার আযহারী ০৮ নভেম্বর, ২০১৪, ০৮:০৭:৩৫ রাত



সুস্বাস্থ্য, সুঠামদেহ, মায়াবী চেহারা, লাবণ্যময় ত্বক তথা দুধে আলতা গায়ের বরণ, ডাগর ডাগর আঁখি, সুদর্শন ব্যক্তিরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল সমাজেই সমভাবে সমাদ্রিত।

পক্ষান্তরে, প্রাকৃতিকভাবে বাহ্যিক গঠন যার আকর্ষণীয় নয়, কিংবা দুর্ঘটনা যার রূপসৌন্দর্য কেড়ে নিয়েছে তাকে আমরা শুধু অবজ্ঞা, অবহেলা ও দু'চোখভরা ঘৃণাই দিতে শিখেছি। আর অসুস্থতা যার বেঁচে থাকার আশার প্রদীপকে নিস্প্রভ করে দিয়েছে। ফলে পৃথিবীর আলো-বাতাস যার কাছে নিমের চেয়েও অধিক তিক্ত মনে হচ্ছে। মনোরঞ্জন কিংবা চিত্তবিনোদনের উপায় উপকরণগুলো যার মনে কাটা-ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে যাচ্ছে। তার সাথে আমরা কি সুন্দর আচরণইনা করছি। তার দুঃখ-কষ্ট আমদের কোমল হৃদয় ব্যথাতুর(!)করে ফেলেছে। তাই আমরা গবেষণা করে তার জন্য Euthanasia বা Mercy Killing এর মত মনুষ্যত্ববিবর্জিত অত্যাধুনিক উপহার নিয়ে এসেছি। এসবের পশ্চাতে যে জিনিসটি মুখ্য ভূমিকা পালন করছে তাহলো আমরা আমাদের মূল্যায়নে মানুষের ভেতরের সৌন্দর্যের সুবিশাল সৌধকে দৃষ্টির অন্তরালে আচ্ছাদিত রেখে শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্যের ক্ষুদ্র ইস্টকের মোহে মুগ্ধ হয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে শিখেছি।

আর এখানেই আমাদের সীমিত ও অদূরদর্শী দৃষ্টির সাথে ইসলামের সুদূরপ্রসারী দৃষ্টির মৌলিক পার্থক্য। অথচ প্রকৃত অবস্থা এমন ও হতে পারে যে, আমাদের বিচারে সুস্থ সবল লোকটি আধৌ কোন ভাল মানুষ নাও হতে পারে। একটু মনোযোগ নিবিষ্ট করুন নিন্মোক্ত আয়াতে। আল্লাহ বলেনঃ "আপনি যখন তাদেরকে দেখেন, তখন তাদের দেহাবয়ব আপনার কাছে প্রীতিকর মনে হয়"(সূরা আল-মুনাফিকুনঃ৪)।

মুসনাদে আহমদে হযরত আবু হুরায়রা হতে বর্ণিত এক হাদীস থেকে জানা যায় এক আরব বেদুইন রাসূল (সাঃ)এর কাছে প্রবেশ করলে রাসূল তার কখনো জ্বর বা মাথা ব্যথা হয়েছিল কিনা জিজ্ঞেস করেন। জবাবে লোকটি কখনো তা হয়নি বলে জানান। লোকটি চলে গেলে রাসূল বলেনঃ "যে ব্যক্তি কোন জাহান্নামীকে দেখতে পছন্দ করে, সে যেন এই ব্যক্তিকে দেখে নেয়"।

তাই বাহ্যিক সৌন্দর্য ও সুস্থতাকেই ভাল-মন্দ যাচাইয়ের একমাত্র মানদন্ড স্থির করা উচীত নয়। কারণ বিশ্বনবী (সাঃ) বলেছেনঃ অনেক দুর্দশাগ্রস্ত, ধূলি-ধূসরিত ছিন্নবস্ত্র পরিহিত লোক এমনও রয়েছে (যারা আল্লাহর প্রিয়)তারা যদি কোন কাজের জন্য আল্লাহর নামে শপথ করে, তবে আল্লাহ তাদের সে শপথ (উক্ত কাজ বাস্তবায়নের মাধ্যমে) অবশ্যই পূর্ণ করেন।(সহীহ মুসলিম)

ইসলাম প্রতিবন্ধীদের সকল প্রকার অধিকার প্রদানে সদা জাগ্রত। তাদের প্রতি সামান্যতম অবহেলাও বরদাস্ত করেনি কখনো। এমনকি তা যদি স্বয়ং বিশ্বনবীর(সাঃ) পক্ষ থেকেও হয়। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রাঃ) একদা বিশ্বনবী (সাঃ) কে কিছু প্রশ্নের জওয়াবের জন্য এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তে পীড়াপীড়ি করছিলেন যখন বিশ্বনবী (সাঃ) আবু জাহ্‌ল, ওত্বা, শাইবাহ, উমাইয়্যা, উবাই ও পিতৃব্য আব্বাসের (তিনি তখনো মুসলমান হননি) মত মক্কার শীর্ষস্থানীয় মুশরিক নেতৃবৃন্দকে দ্বীনের দাওয়াত দানে ব্যস্ত ছিলেন। তাই তিনি আবদুল্লাহর (রাঃ)কথায় কর্ণপাত না করে স্বীয় দাওয়াতী কাজে মনোনিবেশ করেন। যা আল্লাহ সুব্‌হানাহু অ-তায়ালার কাছে পছন্দ হয়নি। তাই তিনি বিশ্বনবীর মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ববাসীকে শিক্ষা দিলেন, ঘোষণা করলেন শাশ্বত অমোঘ বিধানঃ

"তিনি ভ্রূকুঞ্চিত করলেন এবং মুখ ফিরিয়ে নিলেন। কারণ তার কাছে এক অন্ধ আসলো। তিনি কি জানেন, সে হয়তো পরিশূদ্ধ হতো অথবা উপদেশ গ্রহণ করতো এবং উপদেশ তার উপকার হতো। পক্ষান্তরে যে বেপরোয়া, আপনি তার চিন্তায় মশগুল। সে পরিশুদ্ধ না হলে আপনার কোনো দোষ নেই। আর যে ভীত অবস্থায় আপনার কাছ দৌড়ে আসলো আপনি তাকে অবজ্ঞা করলেন। কখনো এরূপ করবেন না। এটা উপদেশবাণী, যার ইচ্ছা সে একে গ্রহণ করবে" (সূরা আবাসাঃ১-১২)।

একটু গভীর ভাবে চিন্তা করুন। গরীব, অন্ধ সাহাবী আবদুল্লাহ(রাঃ) কে একটু অবহেলা করার কারণে, তার প্রশ্নের জওয়াব একটু বিলম্বিত হওয়ার কারণে, স্বয়ং বিশ্বনবী (সাঃ) কে আল্লাহ তায়ালা কিভাবে ধমকের সুরে বলেছেনঃ "কক্ষনো এরূপ করবেন না। এটা উপদেশবাণী, যার ইচ্ছা সে একে গ্রহণ করবে"। অথচ বাহ্যিক দৃষ্টিতে এধরণের ক্ষণিক বিলম্ব বিশ্বনবীর(সাঃ) জন্য বিন্দুমাত্র দোষনীয় কাজ তো নয়ই বরং আবদুল্লাহ (রাঃ) গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বিশ্বনবীকে(সাঃ) বিরক্ত করায় এবং অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য কাজে (মুশরিকদের দ্বীনের দাওয়াত) প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কারণে তিরস্কৃত হওয়ার কথা ছিল।

কিন্তু বাস্তবে তার ব্যতিক্রম হওয়ার কারণ সম্ভবত এই যে, ঘটনার মধ্যে ঈমানদার, গরীব, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর উপর নিকটাত্মীয়, সমাজের সম্মানীত, সম্ভ্রান্ত, উচ্চপদস্থ, ধনাঢ্য, প্রভাবশালী ও নেতৃস্থানীয় অমুসলিমদের প্রাধান্য প্রতিপাদ্য হয়েছে, যা আল্লাহ তায়ালার কাছে অপছন্দনীয়।(মাফাতীহুল গাইবঃ আল্লামা ফখরুদ্দীন আর্রা'যী)।

এ ঘটনার পর বিশ্বনবী(সাঃ) আবদুল্লাহ (রাঃ) কে অত্যন্ত ভালবাসতেন, সাক্ষাতে খোজখবর নিতেন, বলতেনঃ "স্বাগতম!যার ব্যাপারে আমার প্রভু আমাকে ভর্ত্‌সনা দিয়েছেন। তোমার কোন কিছুর প্রয়োজন আছে কি?(রূহুল মা'য়ানীঃ আলুসী)।

চলবে--------

আগের পর্বঃ http://www.bdmonitor.net/blog/blogdetail/detail/10280/masumsarker/56557

বিষয়: সাহিত্য

১৭৪৮ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

282462
০৮ নভেম্বর ২০১৪ রাত ১০:৪৮
সন্ধাতারা লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ খুব খুব ভালো লাগলো লিখাটি ভাইয়া। জাজাকাললাহ।
282630
০৯ নভেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:২৬
মোঃ মাসুম সরকার আযহারী লিখেছেন : ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য @সন্ধাতারা

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File