সম্মান ও মর্যাদার মানদন্ডঃ বস্তুবাদী ও ইসলামি দৃষ্টিকোন (প্রথম পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ মাসুম সরকার আযহারী ০৭ নভেম্বর, ২০১৪, ০৭:১১:১৬ সন্ধ্যা
বস্তুবাদী জীবনদর্শন, ভোগবাদী চিন্তা-চেতনা, স্বার্থবাদী মন-মানসিকতা এবং আত্মসর্বস্ব ধ্যান-ধারণা আজ মানবতাকে অক্টোপাসের ন্যায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। মানব সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, শিরায় শিরায় মহামারীর জীবাণুরূপে অনুপ্রবেশ করেছে।মানুষের আচার-আচরণ, চাল-চলন, বিচার-বিশ্লেষণ, কাজ-কর্ম, কথা-বার্তা, পারস্পরিক সম্পর্ক, সর্বোপরি সবকিছুতেই সে ক্ষুদ্র জীবাণুর প্রলয়ংকরী নৃত্য সতত সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হচ্ছে।ফলশ্রুতিতে ভাল-মন্দ, মান-অপমান, সম্মান-অসম্মান, মর্যাদা-অমর্যাদা, ভদ্রতা-ইতরতা, শ্রেষ্ঠতা-নীচতা, ধনাঢ্যতা-দীনতা, যোগ্যতা-অযোগ্যতা, সফলতা-ব্যর্থতা এবং পূর্ণতা-অপূর্ণতার মূল্যায়নও হচ্ছে বস্তুবাদী তুলাদন্ডের ঝোঁকপ্রবণতার উপর ভিত্তি করে। বাহ্যিক অবয়ব, দৈহিক সৌন্দর্য, সাজ-সজ্জার সৌকর্য, পোশাকের সু্নিপুণ কারুকার্য, বংশীয় কৌলিন্য, গোত্রীয় আভিজাত্য, জন্মভূমির শ্রেষ্ঠত্ব, সম্পদের প্রাচুর্য, শক্তির আধিক্য, ভাষার অলংকারিত্য, পেশার উন্নতি, দেশের সমৃদ্ধি, যাতায়াত মাধ্যমের বিলাসিতা, বাসস্থানের আধুনিকতা, পানাহারের বৈচিত্র্য এসবই হচ্ছে পার্থিব মান-সম্মান, শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার বস্তুবাদী মানদন্ড।
পক্ষান্তরে, যে মহান সত্ত্বার সম্মান-মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব-বড়ত্ব, ব্যাপ্তী ও বিশালতার পূর্ণতা, উচ্চতার সর্বোচ্চ সোপানে উপনীত, সে মহান আল্লাহ সুব্হানাহু অ তা'য়ালার কাছে সম্মান ও মর্যাদার মানদন্ড মাত্র একটি, শুধুমাত্র একটি- যার নাম 'তাকওয়া', যার আধার হলো ক্বল্ব বা অন্তর, যার অন্তর্নিহিত অবস্থা ও নিগুঢ়ার্থ একমাত্র তিনিই অবগত।আর এ মহাসত্যটি সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়েছে পবিত্র কুরআ'ন ও হাদীসের একাধিক স্থানে। ইরশাদ হচ্ছেঃ "নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই বেশী সম্মানীত, মর্যাদাবান যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক তাকওয়াবান" (সূরা হুজুরাতঃ১৩)। বিশ্বনবী (সাঃ) বলেনঃ "নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের দেহাবয়ব ও সম্পদের দিকে দৃষ্টিপাত করেন না; তিনি দেখেন তোমাদের অন্তর এবং তোমাদের কৃতকর্ম"(সহীহ মুসলিম)। আপন বক্ষের দিকে তিনবার ইশারা করে বিশ্বনবী (সাঃ)বলেনঃ "তাক্ওয়া এখানে"(সহীহ মুসলিম)।
বস্তুবাদী দর্শন একজন সরুকায়, কৃষ্ণকায়, বিকলাঙ্গ ,টেরা, কানা, খোঁড়া, পঙ্গু, স্থুলকায়, শরীরের কোন অঙ্গের বা অংশের ত্রুটি-বিচ্যুতি, তথা শারীরিক প্রতিবন্ধীর সাথে কথা বলতে, বসবাস করতে, দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হতে, স্বাভাবিক আচরণ করতে, এমনকি পরিচিত হতেও দ্বিধা করে। কারণ প্রচলিত সমাজব্যবস্থা তাকে এতটুকু ত্রুটি-ঘাটতির (যেখানে তার নিজস্ব কোন হস্তক্ষেপ নেই) কারণে একজন মানুষ হিসেবে, সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে তার মানবীয়, নৈতিক এবং চারিত্রক গুণাবলীর সর্বোত্তম উণ্মেষ ঘটা সত্ত্বেও তাকে তার ন্যায্য, ন্যায়সঙ্গত, প্রাপ্য সামাজিক অধিকার ও মর্যাদা দিতে কুন্ঠাবোধ করছে। তার দিকে আড়চোখে, কটুচোখে তাকিয়ে নাক সিটকাচ্ছে, হাসি তামাসা করছে, ঠাট্টা বিদ্রূপ করছে। যারাও মহানুভবতার পরিচয় দিতে কদাচিৎ সুনজরে তাকাচ্ছে তাদের সে দৃষ্টিও করুনা, দয়া ও অনুকম্পার পর্দা বেধ করতে সক্ষম হয়না। আর এ অন্যায়, অমানবিক ও অশুভ আচরণের বিষ বৃক্ষটি সমূলে উৎপাটন করে তদস্থলে মানবিক মুল্যবোধের সবুজ সতেজ বৃক্ষ প্রোথিত করে সমাজ ব্যবস্থাকে নবরঙ্গে রাঙ্গাতে, নতুন সাজে সাজাতে বিশ্বনবী দিয়েগেছেন নতুন মানদন্ড। নিন্মোক্ত ঘটনা যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তঃ
"একদা প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদের (রাঃ) সরু, হ্রস্ব পদযুগল দেখে উপস্থিত সাহাবারা হাসা-হাসি করতে থাকেন। বিশ্বনবী (সাঃ) হাসার কারণ জিজ্ঞেস করলে সাহাবারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে বিনয়ের সাথে জবাব দিলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল(সাঃ)! আমরা ওনার সরু পদযুগল দেখে হেসেছি।
একথা শুনে বিশ্বমানবতার শিক্ষক(সাঃ) সাহাবা সহ অনাগত ভবিষ্যতের সমগ্র মানবজাতিকে বিচার বিশ্লেষণের মানদন্ড শিক্ষাদিয়ে ঘোষণা করেনঃ "যার হাতে আমার প্রাণ সেই সত্তার কসম করে বলছিঃ নিশ্চয়ই ক্বিয়ামতের দিন মিযানের পাল্লায় আবদুল্লাহর পদযুগল উহুদ পাহাড় অপেক্ষা অধিকতর ভারী হবে''(মুস্নাদঃ ইমাম আহমাদ)।
যে বেঁটে-সরু পদযুগল দেখে মানুষ হাস্যসংবরণ করতে পারেনা সেই হাস্যাস্পদ পা-দুটিই আল্লাহর কাছে এতো মূল্যবান।সুবহানাল্লাহ!
অনাকাঙ্ক্ষীত অসুন্দর দেহের ব্যক্তির প্রতি সামাজিক অবহেলা, তুচছদৃষ্টি ও হ্যায়জ্ঞান প্রতিনিয়ত তাকে তার আত্মমূল্যায়নে ব্যর্থতার পরিচয় দিতে বাধ্য করে। যার ফলে তার সত্তায় বিরাজিত সুপ্ত প্রতিভাগুলো আলোর মুখ দেখতে না পেয়ে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়, নিমিষেই মিশে যায় নিশীথ আঁধারে খসেপড়া তারকার ন্যায় অজানার পানে। মনোরাজ্যের গুপ্ত ঐশ্বর্যের সন্ধান লাভ তার কাছে সিন্ধু সেচে মুক্তো লাভের নামান্তর। তাই নিজেকে আপন দৃষ্টিতে, স্বীয় বিচার বিশ্লেষণে পরিবারের বিষফোঁড়া, সমাজ কন্ঠের কন্টক কিংবা রাষ্ট্রের ঘাড়ে জগদ্দল পাথরপ্রমাণ বোঝা ছাড়া আর কিছুই কল্পনা করতে পারেনা। নিজের ঈমান, আমল, আখলাক, সততা, সৎচরিত্র, মনুষত্য, মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা ও মহৎগুণাবলী এসবকিছু বস্তুবাদী সৌন্দর্যের বাজারে সস্তা কিংবা মূল্যহীন পণ্য হিসেবে পরিগণিত হয়।
এ সত্যটি আঁচ করা যায় হযরত যাহের (রাঃ) জীবনের এক ঘটনা হতে। তিনি ছিলেন সৃষ্টিগতভাবে কুশ্রী, আকর্ষণহীন দেহের এক গ্রাম্য ব্যবসায়ী। তাসত্বেও বিশ্বনবী (সাঃ) তাঁকে ভালবাসতেন। একদিন নবী করীম (সাঃ) তার কাছে এসে দেখেন তিনি বাজারে পণ্য সামগ্রী বিক্রি করছেন। এমতাবস্থায় রাসূল (সাঃ) তাঁকে পেছন দিক থেকে এমনভাবে ধরলেন যাতে তিনি রাসূল (সাঃ) কে দেখতে না পান। তিনি বললেনঃ আপনি কে? আমাকে ছেড়ে দিন। পেছন ফিরে যখন রাসূলকে (সাঃ) চিনতে পারলেন, তখন রাসূলের (সাঃ)বক্ষে তাঁর পিঠের যে অংশ লেগেছিল তা সড়ালেন না। আর রাসূল (সাঃ) (কৌতুক কুরে) বলতে লাগলেনঃ
" কে আছো গোলাম খরিদ করবে"?
যাহের (রাঃ) বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! তাহলে আল্লাহর কসম আমাকে সস্তা পণ্য হিসেবে পাবেন।(কারণ কে এই শ্রীহীন, আকর্ষণহীন গরীব লোককে কিনতে আগ্রহী হবে?)। তখন রাসূল (সাঃ) বললেনঃ "তুমি আল্লাহর কাছে সস্তা পণ্য নও, তুমি অনেক মূল্যবান পণ্য। (মুসনাদঃ ইমাম আহ্মাদ)।
(চলবে---)
সম্মান ও মর্যাদার মানদন্ডঃ বস্তুবাদী ও ইসলামি দৃষ্টিকোন (দ্বিতীয় পর্ব)
http://www.bdmonitor.net/blog/blogdetail/detail/10280/masumsarker/56648
বিষয়: সাহিত্য
১৯৪৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভাই, ছোট্ট একটা পরামর্শ ছিল, যদি কিছু মনে না করেন তাহলে বলি যে, এই লেখাটি দুই পর্বে ভাগ করে দিলে বেশি ভাল হত। আরও বেশি মানুষ আগ্রহ বোধ করতো। অনেকে আছেন যারা বড় লেখা দেখেই চলে যান।
অনেক ভালো লেগেছে লেখাটি। । ভালোবাসা রইলো আপনার প্রতি ও লেখার প্রতি।
আপনার পরামর্শ অনুযায়ী কয়েক ভাগে প্রকাশ করলাম।
মন্তব্য করতে লগইন করুন