ইসলামী ছাত্রী সংস্থার এক বোনের কথা। পড়ে দেখুন এদের ব্যাপারে আপনার ধারণা পাল্টে যেতে বাধ্য হবে।
লিখেছেন লিখেছেন শরাফতুল্লাহ ২০ অক্টোবর, ২০১৫, ১০:২৪:০৭ রাত
ছাত্রীসংস্থার সাথে আমার পরিচয় ১৯৯২ সালে। আমার বয়স তখন সাত। আম্মু আমার প্রিয় লাল জামাটা পরিয়ে ছোট্ট একটা স্কার্ফ বেঁধে নিয়ে গেলেন একটা বাসায়। গিয়ে দেখি দুই তিনটা আপু বসে আছেন ফ্লোরে চাদর বিছিয়ে। আমি যাবার পর আরও কয়েকজন আসলো, এরপর একটা আপু আলোচনা শুরু করলেন। কি আলোচনা হয়েছিলো মনে নাই। শুধু মনে আছে আলোচনার পর আপুটা কোরানটা বন্ধ করে বললেন,এবার আমি একটা গান গাই।কি গান সেটাও মনে করতে পারছি না, কিন্তু সেই ভালোলাগাটা এতো সুন্দর করে আমার মনে জমা ছিলো আজকে লিখতে বসে জানলাম!
সে থেকে শুরু। আমার আম্মু বরাবরই একটু কেমন যেন! ছোটবেলায় খুব লজ্জ্বা পেতাম আমার বান্ধবীদের আম্মাদের সামনে। আইডিয়াল স্কুলের গার্ডিয়ান হয়েও কেমন যেন উদাসীন মনে হত আম্মুকে। স্কুলের কাছে হওয়ায় আমাদের এলাকায় অনেক টিচার থাকতেন। অন্যরা যখন বাসায় দু’তিনজন টিচার রেখেও স্কুলের সব সাবজেক্ট টিচারদের কাছে পড়ে পড়ে সন্ধ্যা সাতটায় স্কুল ড্রেস পরে আমাদের এলাকা থেকে বাসায় যেত, আমি তখন স্কুল থেকে এসে বিশাল ঘুম দিয়ে নিচে খেলতে নেমে ঘর্মাক্ত কলেবরে বাসায় যাই। আন্টিদের দেখলে লুকিয়ে যেতাম। মনে হত যদি উনারা আমার আম্মুকে ভাবে, দেখো কেমন মা, মেয়েকে একদম যত্ন নেয়না। তবু রেজাল্ট মোটামুটি খারাপ ছিলো না। এরপর কলেজে উঠে তো আরেক অবস্থা। মেয়েদের ভিকারুন্নেসা কলেজে দিয়ে মা’দের সেকী দুশ্চিন্তা। শান্তিনগরে যাদের বাসা তাদের আম্মুরাও নিতে আসতেন কলেজ থেকে। আর আমার মা কি নিশ্চিন্ত! তবে এইটা ঠিক, ছাত্রীসংস্থার কোন প্রোগ্রামে না গেলে আম্মুর মুখে যে মেঘ জমতে দেখতাম তার তুলনা নাই। এসএসসির আগে, তখন আমি কর্মী, আপুদের কাছে ছুটি চাইলাম। পরীক্ষার মধ্যে কাজে নিয়মিত থাকতে পারবো না এজন্য। কাজই বা কি, দু একদিন পরিচিত বাসায় গিয়ে মেয়েদের তাফসীরে আসতে বলা, তাফসীরে আলোচনা করা বা বই দেয়া, আগের বই জমা নেয়া এই তো! কিন্তু রাতে আম্মুকে বলতেই আম্মু আমাকে সাথে করে দায়িত্বশীল আপুর বাসায় নিয়ে গেলেন। আমাকে উনার সামনে বসিয়ে বললেন, এই কাজে কোনদিন ছুটি নিওনা, তোমার গোসল খাওয়া সব হবে কিন্তু আল্লাহর আনুগত্য থেকে এক মুহুর্ত দূরে যাওয়াও তোমার জন্য নিরাপদ না। শয়তান অনেক বড় সুযোগ পেয়ে যাবে।
আম্মুর এই কথাগুলো বারবার উচ্চারিত হত কানের কাছে। পড়ালেখা, পরিচিতদের দাওয়াত দেয়া, আপুদের দেয়া কাজ এইগুলার মাঝে কোন সময় যে আমার টিনএজ কেটেছে, কোন সময় পার হয়েছি বয়ঃসন্ধির সময়টা আমি জানি না। শুধু মনে আছে আমি কি ভীষণ স্বাধীন ছিলাম। পরীক্ষা দিয়ে এসে জবাবদিহী করতে হত না, সংগঠনের কাজে কত জায়গায় গিয়েছি, কত খালাম্মাদের দোয়ার হাত স্পর্শ করেছে আমার মাথা। কোনদিন মনে হয়নি আমি একলা। এইচএসসির পর পুরো পরিবারের আজন্ম লালিত স্বপ্নের সাথে যখন আমার স্বপ্ন মিলছিলো না, তখন এই ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো আপুরাই পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। নিজেদের উদাহরণ দিয়ে আম্মুকে বুঝিয়েছেন মেডিকেলের জীবন আমার জন্য না,আমাকে যেন বুয়েটে ভর্তি করা হয়। এই ঋণ কোনদিন শোধ হবার না। এমনকি বুয়েটের সহশিক্ষা ব্যবস্থার যন্ত্রণায় যখন অনভ্যস্ত আমার শ্বাসরোধের দশা, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আপুরা কি অসাধারণ মায়ায় আপন করে নিয়েছিলেন! বিকেলে আমার হলে এসে ফোন করতেন, বাইরে আসো, গল্প করবো। এক সন্ধ্যায় নিয়ে গেলেন বইমেলায়। বই কিনে বললেন আসো মানুষকে বই কিনতে উৎসাহ দিই। তারপর বই হাতে মেলায় ঘুরে বেড়ালাম। হলে কোন নির্জন রাতে অন্যায়ের হাতছানি আমার কাছে আকর্ষণীয় লাগেনি, যদিও হাতের কাছেই ছিলো ফোন। হঠাত কোন না কোন আপু ফোন করে গল্প করেছেন। নিজে ভালো থাকার, আরেকজনকে ভালো রাখার সে কী চেষ্টা!
আমাদের গ্রীনভ্যলীর অফিস নেয়া হয় ২০০২ সালে। কী কষ্ট করে সেই টাকা জোগাড় করা হয়েছে সেটা কহতব্য না। বড়দের সাহায্যের পরও আরও কত কী যে দরকার ছিলো। পরীক্ষার পরে গিফট পাওয়া টেবিল ঘড়ি, ঘরের ব্যবহৃত ফুলদানী, বিছানার চাদর, এমনকি প্লেট গ্লাসও নিয়ে একএকজন উপস্থিত হত। পুরানো শোকেসে সাজানো হল পুরানো বই। কিন্তু সবার সে কী উতসাহ! আমরা যারা এসএসসির পর অবসর, কয়েকজন গেলাম অফিস গুছাতে। আমার হাঁচি থেকে সবার হাঁচি এরপর গণহারে সর্দি, তবু যে আনন্দ লেগেছিলো আজকে নিজের সংসার গুছাতেও এতো ভালো লাগে না। অফিসের প্রতিটা কাগজে, প্রতিটা বইয়ের মলাটে, প্রত্যেক পুরানো ফাইলের নতুন মোড়কে আছে কোন না কোন মেধাবি হাতের ছাপ। আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, এই আপুরা বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেলে পড়ে, অহংকারে তো মাটিতে পা-ই পড়ার কথা না, কিভাবে হাঁটু গেঁড়ে বাথরুম ধুচ্ছে, কিভাবে রান্নাঘরের মেঝেয় বসে আলু-পেঁয়াজ কাটছে? টিউশনির করে যার দিন যায়, বাসার ভাড়া বা হোস্টেলের সিট ভাড়া দিতে হয় এমন বোনটা কেন ঘন্টার পর ঘন্টা অফিসের ঝাড়পোঁছ করছে? এই ভালোবাসা কি কোন মানুষ মেপে দিতে পারবে? না দিতে পারবে এর প্রতিদান? না, এই বোকা মেয়েগুলা কারও কাছে কিচ্ছু চায়না, এমনকি লোকদেখানো সমাজসেবা করে মানুষের বাহবা কুড়াতেও না। এজন্য আজকে ছাত্রীসংস্থাকে অনেকেই চিনে না। কিন্তু বিপন্ন ছাত্রীদের জিজ্ঞেস করেননা, যে কলেজে প্রথমদিন ক্লাস করতে এসে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে, কিংবা বাবা মারা যাওয়ায় পড়া বন্ধ করে বাসায় যে বসে ছিলো ওকেই প্রশ্ন করেন, কোন মেয়েটা আরেক খালাম্মার কাছ থেকে যাকাত চেয়ে এনে ওকে মাসিক স্টাইপেন্ডের ব্যবস্থা করে দিয়েছে? কি স্বার্থে? কারা টিউশনির টাকায় বান্ধবীকে দামি ঘড়ি না দিয়ে কোরান দিয়েছে? হাদিসের বই দিয়েছে? আজকের সমাজেও এইরকম ঘটনা ঘটে? না, ঘটে না। আর এজন্যই এই মেয়েরা হাজতে পচলেও সমাজের মাথাদের কিচ্ছু এসে যাচ্ছে না। উনারা অনেক ব্যস্ত ‘চোরাবালি’র প্রিমিয়ার নিয়ে। কালকে হয়ত যাবেন ‘বাংলা সিনেমায় মেয়েদের অংশগ্রহণ’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তৃতা ঝাড়তে। নারী অধিকার মানেই উনাদের কাছে ‘নারীত্বের যথেচ্ছ ব্যবহার’। ছাত্রীসংস্থা দেশের শীর্ষস্থানীয় অডিটরিয়ামে যখন দুই তিন হাজার অতিথি নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান করে যেখানে লাইটিং, সাউন্ড সবকিছু মেয়েরাই পরিচালনা করে তখন নারীনেত্রীরা ব্যস্ত থাকেন, এখানে আসার সময় কোথায় তাঁদের?
আল্লাহর কাছে অনেক শোকর আল্লাহ আমাকে এমন একটি সংগঠনের সন্ধান দিয়েছেন, যেটা আমার সবচে বড় বন্ধু। আমি একটা মেয়ে এটাকে সুযোগ না বরং নিয়ামত হিসেবে ভাবতে শিখিয়েছে। আমার স্বাধীনতা কি, কোন পথে সেটা পেতে হবে তা-ও জানিয়েছে, জানিয়েছে একজন পুরুষ আমার শত্রুও না বা অকর্মণ্য প্রশংসাকারী ভাঙ্গা রেকর্ড না। আমার চরিত্রকেই সবচে বড় সম্পদ ভাবতে শিখিয়েছে। দীর্ঘদিনের পথচলার সাথীদের অনেকেই আজকে চরম পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন। আল্লাহর কাছে হাত উঠিয়ে সাহায্য চাই তাঁদের জন্য। আল্লাহ আমাদের ধৈর্য দিন, সাহস দিন। যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করছে না তাদের দায়িত্ব তো আল্লাহরই, যেমন আবরাহার দায়িত্ব তিনি নিয়েছিলেন।
-লেখকঃ
ইসলামী ছাত্রীসংস্থার এক বোন ।
লেখাটি ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।
বিষয়: বিবিধ
৩৪৯৯ বার পঠিত, ২১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ছাত্রীসংস্থা যে কত্তবড় নিয়ামত!
আলহামদুলিল্লাহ...
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
সত্যিই ছাত্রীসংস্থা আমাদের দেশের কলুষিত সমাজে আল্লাহর অনেক বড় একটি নেয়ামত। কিন্তু হায়! এর মর্যাদাটা যদি সবাই বুঝত?
'চাদনী রাতের দুশমন যেমন কুত্তা,তেমনি সকল কল্যাণময় প্রচেষ্টার শত্রু এই ফাকরুল ব্যাটা'
উনি আমার এই পোস্টটি পরে যদি সামান্যতম হেদায়াতের দিশা পায় তবে সেটা আমার সফলতা হবে
ভাই এটুকু বুঝছি। কিন্তু, 'চাদনী রাতের দুশমন যেমন কুত্তা' এটুকু বুঝিনাই। যদি বুঝাইতেন।
আপনারা কেউ কি বলতে পারেন এই গাধাটা কে ? যার একমাত্র কাজ হলো শিবির জামায়াত বা ছাত্রি সংস্থার বিপক্ষে লেখা ?
তারা আল্লাহ এবং মুমিনদের সঙ্গে প্রতারনা করে, আসলে তারা নিজেদেরকে ছাড়া আর কারো সঙ্গে প্রতারনা করে না অথচ তারা তা অনুভব করতে পারে না। তাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে তাই আল্লাহ তাদের ব্যাধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি কারণ তারা মিথ্যা বলে।
(সুরা আল-বাকারা, ২/৯-১০)
এই আয়াতটা কাদের উদ্দেশ্য করে নাযিল হয়েছে তা জানেন নিশ্চয়।
সুতরাং তাদের জন্য আমাদের আল্লাহই যথেষ্ট।
মন্তব্য করতে লগইন করুন