মানুষের লোভ এবং একটি সমুদ্রের করুন মৃত্যু (ছবি এবং তথ্য ব্লগ)

লিখেছেন লিখেছেন শরাফতুল্লাহ ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ১১:০৫:৩৮ সকাল

শিরোনাম দেখে চমকে গেছেন? সাগরের আবার মৃত্যু হয় কিভাবে? হ্যাঁ এটাই সত্যি একটি আস্ত সমুদ্রের মৃত্যু হয়েছে মানুষের লোভের কারনে, এবং সেটি আমাদের এশিয়া মহাদেশেই।

এককালে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সর্ব বৃহৎ দেশ ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়ন, যার বর্তমান নাম রাশিয়া।

এখনো এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দেশ। এই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিলো উজবেকিস্তান এবং কাজাখস্তান, এবং এই দুটো দেশের মাঝে অবস্থিত ছিলো এক বিশাল সমুদ্র যাকে বলা হয় হ্রদ বা অন্তসমুদ্র কারন এর চারপাশ ছিলো কাজাখস্তান এবং উজবেকিস্তানের ভুখন্ডে ঘেরা।

এর নাম ছিলো অ্যারল সাগর

অ্যারল সাগরঃ অ্যারাল ছিল একটি অন্তর্সমুদ্র । কেননা এর চারপাশটা কাজখস্তান ও উজবেকিস্তানের ভূখন্ডে ঘেরা। এটিকে লবাণাক্ত হ্রদ বলেও অনেকে চিহ্নিত করেন। ১৯৬০ সালেও এটি ছিল পৃথিবীর ৪র্থ বৃহৎ অন্তর্সমুদ্র। এর আয়তন ছিল ২৬ হাজার ২শ ৫০ বর্গমাইল। বিশালতম হ্রদ অ্যারাল

সাগরের মাঝে একদা ১,১০০টি দ্বীপ ছিল। হ্রদের বুকে ভেসে বেড়াত অজস্র জাহাজ, প্রমোদতরী ও মাছ ধরার নৌকা।৪০ বছর আগেও উজবেকিস্তানের মুইনাক ছিল সবচেয়ে ব্যস্ততম বন্দর, আজ সেখানে প্রাণের কোনও স্পন্দন নেই। আজ সেখানে কোনও জাহাজের জেটি নেই, নেই কর্মব্যস্ততা, যতদূর চোখ যায়- বালি আর লবণের ধুধু মরুভূমি। সমুদ্র এখন বাচ্চাদের খেলার মাঠ।



১৯৮৫ সালের অ্যারাল হ্রদের স্যাটেলাইট ফটো।

যেভাবে শুরুঃ মধ্য এশিয়ার অন্যতম জীবিকা কৃষিকাজ, কাজখস্তান ও উজবেকিস্তান আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত ছিল। দেশ দুটি স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৯১ সালে। তার আগে ১৯৬০-এর দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন তুলা ও ধান চাষের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। তা বাস্তবায়নে তৎকালীন সোভিয়েত সরকার প্রধান জোসেফ স্তালিনের নির্দেশে নতুন সেচ নীতির প্রনয়ন হয়, এ নীতিতে অঞ্চলের আমুদরিয়া ও সিরদরিয়া নামের নদী দুটির গতিপথে বেশ কিছু বাঁধ তৈরি করে। এই আত্মঘাতী উদ্যোগের ৩০ বছরের মধ্যে নেমে আসে ভয়াবহ মানববিপর্যয়। নদীর গতিপথ বাধাগ্রস্থ হওয়াই অ্যারালের মৃত্যুর প্রধান কারণ। নদীর পানি না পাওয়ায় অ্যারাল সাগর শুকাতে শুরু করে।

এছাড়াও জলাশয়টি জঞ্জালের (বাতিল লোহালক্কর, আবর্জনা) আড়ত্‍ হিসেবেও ব্যবহার হতে শুরু হয়। ফলে মাত্র ৩০ বছরের মধ্যে হ্রদ শুকিয়ে গিয়ে সেখানে রুক্ষ মরুভূমি জন্ম নেয়।

সাগর হয়ে যায় ইতিহাস।



২০০৯ সালের স্যাটেলাইট ফটো।

মৃত্যু যাত্রাঃ নদীর পানি না পাওয়ায় অ্যারাল সাগর শুকাতে শুরু করে, ২০১০ সাল নাগাদ এর ৯০ শতাংশ শুকিয়ে যায়, ফলে স্থলভাগে লবণের পরিমাণ বাড়ে। লবণের কারণে একদিকে গাছপালা ও ফসল নষ্ট হয়ে যায়, অন্যদিকে জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের মৃত্যু ঘটে। মৎসশিল্প সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় বেকার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। শুধু তাই নয়, সেখানে তীব্র পানি সঙ্কট দেখা দেয়। যতটুকু পানি পাওয়া যায় তার পুরোটাই তুলার সার, কীটনাশক ও লবণে দূষিত। গবেষকরা বলেছেন, মুইনাক ও তার আশপাশের এলাকায় ক্যান্সার, ফুসফুসজনিত রোগ ও অকাল মৃত্যু আগের চেয়ে ৩০ গুণ বেড়ে গেছে। মুইনাক এখন একটি মরুভূমির শহর, সমুদ্রস্থল থেকে ১শ কিলোমিটার পর্যন্ত মরুভূমি বিস্তৃত। এখানেই শেষ নয়, গবেষণায় দেখা গেছে, এই শুকিয়ে যাওয়া সমুদ্র থেকে প্রতি বছর ৭শ ৫০ লাখ টন বিষাক্ত ধুলিকণা ও লবণ বাতাসে উড়ে মধ্য এশিয়া অঞ্চলে চলে আসে। আরও বলা হয়েছে, অ্যারাল পুরোপুরি শুকিয়ে গেলে প্রায় ১৫শ কোটি টন লবণ পড়ে থাকবে যা পুরো পৃথিবীর জন্যই হুমকি স্বরূপ।



বাম পাশের ছবিটি ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তোলা এবং ডানপাশের ছবিটি গত বছরে তোলা।

এভাবেই মানুষের লোভ, অপরিনামদর্শী সিদ্ধান্ত আর বৈজ্ঞানিক গবেষনার অভাবে মৃত্যু হলো এক বিশাল জলাধারের। অ্যারাল সাগরের এই করুণ পরিণতি নিয়ে তোলপাড় গোটা বিশ্ব। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তার অতীত কলেবর ফিরিয়ে দিতে কোনও সদার্থক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

৪ এপ্রিল, ২০১০ জাতি সংঘের মহাসচিব বান কি মুন মুমূর্ষু অ্যারাল সাগর দেখে বিস্মিত হন, একে তিনি ‘বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক বিপর্যয়’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। এই বিপর্যয় ঠেকাতে তিনি মধ্য এশিয়ার নেতাদের প্রতি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়েছেন

আশার আলোঃ এ অঞ্চলের কৃষিপদ্ধতিতে পরিবর্তন আনলে সমুদ্রে যতটুকু পানি (১০%) অবশিষ্ট আছে ততটুকু সংরক্ষণ করা সম্ভব এবং চাইলে অ্যারাল সাগরকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন মধ্য এশিয়ার নেতাদের সদিচ্ছা এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা।

এবার অ্যারাল সাগরের বর্তমান কয়েকটা ছবি দেখুনঃ



পানির জাহাজ মরুভূমিতে।



পশ্চিম প্রান্তে যাওবা একটু পানি আছে তাও দুষিত।



যদি এমন দৃশ্য দেখতে চান, তাহলে অ্যারাল সাগরে চলে যান।



পানির জাহাজ মরূতে।



সেই বিশাল সাগরের স্বাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে বালুতে আটকে মরচে পরে নস্ট হয়ে যাওয়া কিছু জাহাজ।



পানির জাহাজের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে মরুর জাহাজ।



সকাল বেলা আমীররে ভাই ফকির সন্ধ্যা বেলা। সেই অ্যারাল সাগর এখন ধু ধু মরুভূমি।



১৮৫৩ সালের অ্যারাল সাগর সার্ভে রিপোর্ট।



অ্যারাল সাগর ১৯৬০-২০০৮।

সবশেষে ক্ষমাপ্রার্থী এতবড় একটি বাজে ব্লগ করার জন্য।

আর ধন্যবাদ সময় নষ্ট করে ব্লগটি পড়ার জন্য।

বিষয়: বিবিধ

২৭৯৮ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

305889
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সকাল ১১:৪৬
হতভাগা লিখেছেন : ফারাক্কার প্রভাবে আমাদের পদ্মার অবস্থাও তথৈবচ
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ দুপুর ১২:২৭
247486
শরাফতুল্লাহ লিখেছেন : ফারাক্কা বাধ যদি আরো ৫০ বছর এভাবেই থাকে তাহলে আমাদের পদ্মা নদী বিলীন হয়ে যাওয়ার আশংকা আছে।

পদ্মা এতদিনেই যাত কিন্তু আমাদের আবওহাওয়া মধ্য এশিয়ার মত অতোটা রুক্ষ না বলে টিকে আছে।
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ দুপুর ০২:০১
247497
হতভাগা লিখেছেন : পদ্মা সেতু হলেও সেটা তখন আর কাজের থাকবে না । এটা হয়ে যাবে বিনোদন স্পট ।
305928
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ বিকাল ০৪:০৫
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : এমন কিছু মানবসৃষ্ট বিপর্যয় আমাদেরও গ্রাস করবে অচিরেই।
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ রাত ১১:২২
247601
শরাফতুল্লাহ লিখেছেন : আল্লাহ্‌ না করুন।
305942
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সন্ধ্যা ০৬:৩৭
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : চমৎকার শিক্ষনিয় পোষ্টটির জন্য অনেক ধন্যবাদ।
মানুষের লোভ আর দুরদৃষ্টিহিনতা কিভাবে ধ্বংস করে পরিবেশবে আরল সাগর এর একটি উদাহরন। এটি রাজনৈতিক শোষন এর ও একটি উদাহরন। আরল সাগর এর তিরবর্তি উজবেক ও কাজাখ দের কথা চিন্তা না করে সোভিয়েট আমলে শুধু রুশ শ্বেতাঙ্গদের উন্নতির জন্য তৈরি করা বাঁধগুলি তথাকথিত সাম্যভিত্তিক কম্যুনিজম এর অসাড়তা দেখিয়ে দেয়।
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ রাত ১১:২১
247600
শরাফতুল্লাহ লিখেছেন : আপনাকেও পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File