মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল : যে যুদ্ধ তিনি শেষ করে যেতে পারেননি
লিখেছেন লিখেছেন শরাফতুল্লাহ ১১ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৭:৩৯:১৯ সকাল
দেশের একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই তাঁর রয়েছে ব্যাপক পরিচিতি৷ এর বাইরেও তিনি ছিলেন একজন রাজনীতিক ও সামরিক কর্মকর্তা৷ বরিশাল জেলার উজিরপুরে ১৯৪২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি নানার বাড়িতে মোহাম্মদ আব্দুল জলিলের জন্ম ( তিনি পরবর্তীতে মেজর এম এ জলিল নামেই সবার কাছে পরিচিতি লাভ করেন)৷ তাঁর পিতা জোনাব আলী চৌধুরী ও মা রাবেয়া খাতুন৷ জন্মের ৩ মাস আগে বাবা জোনাব আলি মারা যান৷ উজিরপুরেই তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটে যায়৷ উজিরপুর ডব্লিউবি ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশন থেকে ১৯৫৯ সালে মেজর এম এ জলিল কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক পাস করেন৷ এরপর ফিশারিজ ডিপার্টমেন্টে কিছুদিন চাকরি করেন৷ কিছুদিন পর চাকরি ছেড়ে পড়াশোনা করতে পশ্চিম পাকিস্তানে যান তিনি৷ ১৯৬১ সালে সেখানকার মারি ইয়ং ক্যাডেট ইনস্টিটিউশন থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন৷ পাশাপাশি গ্রহণ করেন সামরিক শিক্ষা৷ এরপরই আব্দুল জলিল ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে ট্রেনি অফিসার হিসেবে যোগদান করেন৷ সামরিক বাহিনীতে চাকুরিরত অবস্থায় তিনি বি.এ পাস করেন৷ ১৯৬৫ সালে তিনি কমিশন প্রাপ্ত হন এবং ১২নং ট্যাঙ্ক ক্যাভারলি রেজিমেন্টের অফিসার হিসেবে তত্কাসলীন পাক-ভারত যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন৷ ১৯৬৬ সালে যুদ্ধবিরতির পর পাকিস্তান একাডেমি থেকে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করেন৷ পরে মুলতানে কর্মরত থাকাকালে তিনি ইতিহাসে এম. এ ডিগ্রি লাভ করেন৷ ১৯৭০ সালে তিনি মেজর পদে উন্নীত হন৷ তিনি ১৯৭১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মায়ের অসুস্থতার জন্য এক মাসের ছুটি নিয়ে বরিশালে আসেন এবং মার্চে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন৷ মুক্তিযুদ্ধে তিনি নবম সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব লাভ করেন । তিনিই একমাত্র সেক্টর কমান্ডার যাঁকে রাষ্ট্র কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধের কোন খেতাব পর্যন্ত দেয়া হয়নি।
চিত্রঃ "মেজর মোহাম্মদ আবদুল জলিল"
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকাল দশটায় খুলনার দৌলতপুরের থুকড়া স্কুলে কতকগুলো মুক্তিযোদ্ধার সাথে দাঁড়িয়ে ছিলেন মেজর এম এ জলিল৷ সহ-অধিনায়ক ক্যাপ্টেন হুদার জিপ এসে থামতে না থামতেই তিনি একটা দুষ্টু ছেলের মতো লাফ দিয়ে জড়িয়ে ধরেন জলিলকে৷ তাঁর কন্ঠে ভাসে সুখবর 'স্যার, পাক সেনারা আত্মসমর্পণ করেছে৷' এ সংবাদটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে এম এ জলিল চিত্কাধর করে মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার উদ্দেশ্যে বললেন, 'আমরা বিজয়ী হয়েছি৷ 'আমরা বিজয়ী হয়েছি৷'
ইতিপূর্বেই কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের ভবেরপাড়ার আম্রকাননে মুজিব নগর সরকার গঠিত হয়৷ মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন এম এ জি ওসমানী ৷ মুক্তিযুদ্ধের হাইকমান্ড থেকে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে বৃহত্তর বরিশাল, খুলনা, ফরিদপুরের একাংশ, পটুয়াখালী-বরগুনাসহ ৯নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত করে মেজর জলিলকে ওই সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে ঘোষণা করা হয়৷ এই সেক্টরের হেডকোয়ার্টার স্থাপিত হয় টাকিতে৷ হিঙ্গলগঞ্জে ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে সেক্টর অপারেশন ক্যাম্প এবং শমসের নগরে একটা নজরদারি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়৷ এরপরই শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ৷ ১৮ এপ্রিলের পর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে মেজর জলিল একটি বড় বাহিনী গড়ে তোলেন৷ কিন্তু সামান্য কিছু রাইফেল ছাড়া তাঁর ভারী কোনো অস্ত্রপাতি ছিল না৷ প্রাথমিকভাবে বরিশালের পুলিশ অস্ত্রাগার ভেঙ্গে কিছু রাইফেল যোগাড় করা হয়৷ ২২ এপ্রিলের পর মেজর জলিল ভারত থেকে কিছু অস্ত্র আনার পরিকল্পনা করেন৷ হানাদারের চোখ ফাঁকি দিয়ে মেজর জলিল কয়েকজনকে সঙ্গী করে নিজেই ভারত থেকে কিছু অস্ত্র নিয়ে আসেন৷
জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত 'হিট এ-রান' অর্থাত্ আঘাত করো ও পালিয়ে যাও নীতিতে অংশ নেন মেজর জলিল ও তাঁর বাহিনী৷ এ আক্রমণ পরিচালনার জন্য জলিল তিনটি জায়গা বাছাই করেন৷ পশ্চিমবঙ্গের উত্তরদিকের বনগাঁর নিকট বাগদাতে একটা, হাসনাবাদের দক্ষিণে শমসের নগরে একটা এবং আর একটা টাকিতে৷ এই তিনটি ঘাঁটির মধ্যে বাগদাই সবচেয়ে ব্যস্ততম৷ ৫ মাসে প্রায় ৮ হাজার গেরিলাকে হালকা অস্ত্রপাতি ও বিস্ফোরক দ্রব্যসহ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠান মেজর জলিল৷ এক পর্যায়ে তাঁর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ালো ২০ হাজারে৷ শুরু হলো মুক্তিযোদ্ধা ও সশস্ত্র গেরিলাদের বিজয় অভিযান৷ নিজের চেষ্টা ও দক্ষতায় মেজর জলিল প্রত্যেকটা সাব সেক্টরকে গড়ে তুলেছেন দক্ষ ও চৌকসবাহিনীরূপে৷
দেশ স্বাধীন হলো৷ কিন্তু মেজর জলিল ভোগ করতে পারেননি স্বাধীনতার স্বাদ৷ কারণ ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর মেজর জলিলকে গ্রেফতার করা হয়৷ ভারতীয় সেনাদের লুটপাট ও খুলনা সীমান্ত এলাকা দিয়ে দেশের সম্পদ পাচারের তীব্র প্রতিবাদ করাই ছিল তাঁর অপরাধ৷ তাঁকে ধরে প্রথমে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে অবস্থিত সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়৷ পরে তাঁকে কার্যত নজরবন্দি করে রাখা হয়৷
এ বিষয়ে তিনি এক আত্মকথায় বলেন
আমারই সাধের স্বাধীন বাংলায় আমিই হলাম প্রথম রাজবন্দী। ২১শে ডিসেম্বর বেলা ১০টা সাড়ে দশটায় আক্রমণকারী বাহিনীর হাতে বন্দী হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আসল রূপের প্রথম দৃশ্য দেখলাম আমি। ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর মদদে বাংলাদেশ স্বাধীন করার অর্থ এবং তাৎপর্য বুঝে উঠতে আমার তখন আর এক মিনিটও বিলম্ব হয়নি।
১৯৭১ সনের সেই ৩১শে ডিসেম্বর রাত ১২টা ১ মিনিটের কথা আমি কোন দিনই ভুলতে পারব না। যশোর সেনা ছাউনির অফিসার কোয়ার্টারের একটি নির্জন বাড়ীতে আমাকে সকাল ১১টায় বন্দী করা হয়। বাড়ী না যেন হানাবাড়ী। ঘুটঘুটে অন্ধকার, আশে-পাশে বেশ কিছু নর-কংকাল পড়ে আছে। ঘরের ভিতর মানুষের রক্তের দাগ। কোন ধর্ষিতা বোনের এলোমেলো ছেঁড়া চুল। বাইরে কাক, শকুন, শেয়াল একযোগে ব্যস্ত। ভেতরে মশারা কামান দাগিয়ে আছে। বাথরুমে পানি নেই। ডিসেম্বরের ভিজে শীত। বাইরে সেন্ট্রির বুটের কটমট আওয়াজ। সারাদিন গেল কোন খাওয়া বা খাবার পানি পর্যন্ত এলো না। ৫ রুম বিশিষ্ট বাড়ীটির রুমে রুমে যেন কান্না আর হাহাকার। সন্ধ্যা হতেই প্যাটার গোঙ্গানি শুরু হয়। সহযোগী ভুতুকও পেছনে পড়ে নেই। বাড়ীটার একটা রুমেও লাইট নেই। একটা খাটের উপর একটা আধছেঁড়া কম্বল এবং তখন সেটাই আমার আপন একমাত্র আশ্রয়স্থল। কোনমতে কম্বলটা জড়িয়ে বসে আছি। রাত ১২টা ১ মিনিটে যশোর সেনাছাউনি নতুন বছরের উজ্জীবনী গীতিতে মুখর হয়ে উঠল। নারী-পুরুষের যৌথ কন্ঠের মন মাতানো সংগীত নাচ, হাত হালি, ঘুঙুরের ঝনঝনানি, উল্লাস, উন্মাদনা সবই ভেসে আসছিল কর্ণকুহরে। আমার মাটিতে প্রথম নববর্ষেই আমি অনুপস্থিত। এ কথা ভাবতেই আমি কানে আর কিছুই শুনতে পেলাম না। শুনলাম কেবল একটা ব্যাঙ্গাক্মক অট্টহাসি। -’রক্ত দিয়ে এই স্বাধীনতা আনলে তোমরা” যার অর্থ দাঁড়ায় কতকটা এরকম।
রাতের ঘুটঘুটে সেই অন্ধকারে আমি সেদিন কম্বল জড়িয়েও ঘেমে উঠেছিলাম, শিহরিয়ে উঠেছিলাম পুনঃ পুনঃ। স্বাধীনতার সতের বছর পরেও আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। অন্ধকারে আজো আমি একইভাবে শিহরে উঠি আর যেন শুনতে পাই- 'রক্ত দিয়ে এই স্বাধীনতা আনলে তোমরা।'
-----------------------অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা : মেজর জলিল
১৯৭২ সালের ২ সেপ্টেম্বর তিনি মুক্ত হন এ বন্দিদশা থেকে৷ এর পর মেজর জলিল রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন৷ তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক পরিক্রমায় দেখা গেছে, ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন৷ তিনি ছিলেন এ দলেন যুগ্ম আহ্বায়ক৷ ২৬ ডিসেম্বর দলের কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন এবং তিনিই ছিলেন জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি৷ তাঁর নেতৃত্বে জাসদ দেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মকান্ড পরিচালনা করেন৷ সরকার বিরোধী রাজনীতিতে তিনি ছিলেন সক্রিয়৷১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল বাকেরগঞ্জ উজিরপুরসহ ৫টি আসনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনে তাঁর বিজয় ছিল নিশ্চিত। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত শেখ মুজিবের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিলেন মেজর জলিল।১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ জাসদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও কর্মসূচিতে পুলিশ গুলি করলে বেশ কয়েকজন নিহত হয়। মেজর জলিল নিজেও আহত হন। আওয়ামী লীগ সরকার তাকে গ্রেফতার করে। ১৯৭৫ সালে ৮ নভেম্বর তিনি মুক্তিলাভ করেন।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন সত্ত্বেও মেজর জলিল ক্ষমতাসীনদের রোষানল থেকে রেহাই পাননি। ১৯৭৫ সালে ২৩ নভেম্বর তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়। সামরিক ট্রাইবুনালে কর্নেল তাহের ও মেজর জলিলের ফাঁসি হয়। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য মেজর জলিলের মৃত্যুদন্ড মওকুফ করে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়।
মেজর জলিল ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাজবন্দি৷ তৎকালীন সামরিক সরকার তাঁর বিরদ্ধে সরকার উত্খাতের ষড়যন্ত্র এবং অবৈধ পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল প্রচেষ্টার অভিযোগ আনে৷ বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিচার করা হয়৷ ১৯৭৬ সালের ১৮ জুলাই আদালতের দেয়া রায়ে তিনি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হন৷ তবে ১৯৮০ সালের ২৪ মার্চ তিনি মুক্তি লাভ করেন৷ জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও কৃষক শ্রমিক সমাজবাদী দলের সমন্বয়ে গঠিত ত্রিদলীয় জোটের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মেজর জলিল ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন৷ ১৯৮৪ সালে তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন৷এরপর তিনি জাসদ ত্যাগ করে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন নামে একটি দল গঠন করেন এবং এই দলের মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করেন৷
এরপর থেকেই মেজর জলিলের চিন্তা চেতনায় পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৪ সালের ৩ নভেম্বর তিনি জাসদ থেকে পদত্যাগ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি তাঁর ‘কৈফিয়ত ও কিছুকথা’ গ্রন্থে লিখেছেনঃ
দলীয় জীবনে জাসদের নেতা-কর্মীরা ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিসর্জন দেয়ার ফলে নৈতিকতার ক্ষেত্রে অবক্ষয় ঘটে, ব্যক্তিজীবনে আসে বিশৃঙ্খলা এবং ধর্মীয় নৈতিকতা এবং মূল্যবোধে পরিচালিত সমাজদেহ থেকে নিজেরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেও সমাজে বসবাসরত জনগণকে ঐতিহ্যবাহী ইসলামী সাংস্কৃতিক জীবন এবং মূলবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে মোটেও সক্ষম হয়নি। প্রচলিত পারিবারিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনধারা থেকে কেবল নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রাখলেই বিকল্প সংস্কৃতি জন্ম নেয় না, বরং এই ধরনের রণকৌশল অবলম্বন সমাজে প্রচলিত নীতি, নৈতিকতা, আচার-অনুষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রতি তাচ্ছিল্য, উপহাস এবং ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়, যা প্রকারান্তরে বিপ্লবী আন্দোলনের বিপক্ষে চলে যায়।
ইসলাম ধর্ম এ দেশের শতকরা ৯০ জন গণমানুষের কেবল ধর্মীয় বিশ্বাসই নয়, ইসলাম ধর্মভিত্তিক নীতি-নৈতিকতা, আচার-অনুষ্ঠান, উৎসব-পর্ব, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং এদেশের সাধারণ গণমানুষের দৈনন্দিন জীবনের নানান ঘটনার সাথে ইসলাম ধর্ম অঙ্গাঅঙ্গিভাবেই জড়িত। জন্মপর্ব থেকে শুরু করে জানাযা পর্যন্ত ইসলামের নীতি-নির্দেশের আওতায় নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন। এমন একটি জীবন দর্শনকে অবহেলা, উপেক্ষা কিম্বা সম্পূর্ণভাবে পরিহার করে চলার নীতিকে বাস্তবসম্মত কিম্বা বিজ্ঞানসম্মত বলা যায় না। প্রগতিশীল আন্দোলনের স্বার্থেই ইসলাম ধর্মের বিজ্ঞানসম্মত মূল্যায়ন অত্যাবশ্যকীয় বলে আমি মনে করি, কারণ ইসলাম শোষণ-জুলুম, অন্যায়, অসুন্দরসহ সর্বরকম স্বৈরশাসন এবং মানুষের উপর অবৈধ প্রভুত্বের ঘোর বিরোধী। ইসলাম পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, রাজতন্ত্র উচ্ছেদের নির্দেশ দেয়। সম্পদের ব্যক্তি মালিকানা ইসলামে নিষিদ্ধ, কারণ সকল সম্পদের মালিকানা একমাত্র আল্লাহরই। মানুষ হচ্ছে তার কেবল প্রয়োজন মেটানোর জন্য আমানতদার বা কেয়ার টেকার।
লেখক হিসেবে মেজর জলিল উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন৷ ছাত্রজীবনেই তাঁর লেখালেখির অভ্যাস ছিল৷ স্কুল জীবনে তিনি 'পথের কাঙ্গাল' ও 'রীতি' নামে দুটি উপন্যাস লেখেন৷ কিন্তু পরে এ পান্ডুলিপি দুটি হারিয়ে যায়৷ একটু অবসর পেলেই তিনি বই পড়তেন৷ স্ত্রী ও সন্তানদের সর্বদা বই পড়ার উপদেশ দিতেন৷ পরবর্তীতে তিনি মূলত রাজনৈতিক বিষয়েই লেখালেখি করেন৷ মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা তাঁর বইগুলো ছিল প্রামাণ্য রচনা৷ তাঁর রচিত রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গ্রন্থ : সীমাহীন সমর (১৯৭৬), দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনদর্শন, সূর্যোদয় (১৯৮২), অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা (১৯৮৯), Bangladesh Nationalist Movement for Unity: A Historical Necessity.এছাড়া তিনি বেশকিছু কবিতাও লিখেছেন৷
মেজর এম এ জলিলের নামে ঢাকা মহানগরী এবং বরিশাল মহানগরীতে একটি করে সড়কের নামকরণ করা হয়েছে৷ এ ছাড়াও বরিশালের উজিরপুরের শিকারপুর ব্রিজটি মেজর জলিলের নামে করা হয়েছে৷ ২০০১-২০০৬ সালে বি.এন.পি-জামায়াত জোট শাসনামলে এ ব্রিজটি তাঁর সম্মানে নামকরন করা হয়৷ নগরীর কাঁটাবন মোড় থেকে ফুলবাড়িয়া পর্যন্ত সড়কটি এখন থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জলিল সড়ক নামে পরিচিত হচ্ছে৷ ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র সাদেক হোসেন খোকা ২০০৭ সালের ২৮ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে মেজর জলিল সড়কের নামফলক উন্মোচন করেন৷ এ ছাড়া বরিশালে তাঁর নামে একটি অডিটোরিয়াম ও একটি ভাস্কর্যও রয়েছে৷ মেজর জলিল তাঁর জীবদ্দশায় রাষ্ট্রীয় কোনো পুরস্কার বা সম্মাননা পাননি৷ এমনকি রাষ্ট্র কর্তৃক তাঁকে মুক্তিযোদ্ধার খেতাবটি পর্যন্ত দেয়া হয়নি৷
আমৃত্যু কেবল দেশের স্বার্থকে ঊর্ধ্বে রেখে কাজ করে গেছেন মেজর জলিল৷ তিনি ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অর্থাত্ পূর্ণ মেয়াদে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন৷ ধনদৌলতের প্রতি তাঁর ছিল না কোনো মোহ৷ দেশ, দেশের মাটি ও দেশের জনগণই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় সম্পদ৷ সাধারণ জীবনযাপনেও তিনি ছিলেন অভ্যস্ত৷ সব সময় পাজামা-পাঞ্জাবি পড়তেন৷ ১৯৮৯ সালের ৫ নভেম্বর একটি ইসলামিক কনফারেন্সে যোগ দিতে মেজর জলিল পাকিস্তান যান৷ ১০, ১১ ও ১৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন৷ পাকিস্তানে অবস্থানকালেই ইসলামাবাদে ১৯ নভেম্বর হঠাত্ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রাত ১০টা ৩০ মিনিটে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন৷ পরে ২২ নভেম্বর তাঁর মৃতদেহ ঢাকায় আনা হয় এবং সামরিক মর্যাদায় দাফন সম্পন্ন করা হয়৷ ঝাঁকড়া চুলের টকবগে সেই মুক্তিযুদ্ধের নেতা মিরপুরের বুদ্ধিজীবী/মুক্তিযোদ্ধা কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন৷
আমাদের নতুন প্রজন্ম শুধু রাজাকার(!)দেরই ফাঁসি চায়, কিন্তু এই মুক্তিযোদ্ধার প্রতি একবার দৃষ্টিপাত করেছে কি? যে ব্যাক্তি আমরন দেশের কথা দেশের জনগনের কথাই ভেবে গেলেন, জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করলেন, একজন সেক্টর কমান্ডার হওয়া স্বত্বেও দেশ তাকে কি মুল্যায়ন করেছে?
এই বিজয়ের মাসে এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে জানাই সালাম ও শুভেচ্ছা এবং দোয়া করি যেন আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করেন।
তথ্যসূত্র :
বাংলাপিডিয়া, স্বাধীনতাযুদ্বের দলিলপত্র-১০ম খন্ড,
সীমাহীন সমর : মেজর জলিল
মুক্তিযুদ্ধে নবম সেক্টর ও আমার যুদ্ধকথা : ওবায়দুর রহমান মোস্তফা (স্টাফ অফিসার)
বিষয়: বিবিধ
৩৬৫২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন