সংস্কৃতির আগ্রাসন: খাদের কিনারায় দেশ ও জাতি, প্রশাসনের টনক নড়বে কখন?
লিখেছেন লিখেছেন খান জুলহাস ০৮ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৭:২৮:৩৫ সন্ধ্যা
দুপুর বেলা। শ্রান্ত-ক্লান্ত রিকশাচালক স্বামী বাসায় এসে খাবার চাইলেন। বউ স্টার জলসা চ্যানেলে ধারাবাহিক নাটক ‘বোঝে না, সে বোঝে না’ দেখায় ব্যস্ত। সিরিয়াল শেষ হলেই কেবল টিভি সেটের সামনে থেকে উঠবেন তিনি। ক্ষুধার্ত স্বামী ক্ষুব্ধ হয়ে টিভি সেটটি ভেঙে ফেললেন। আরো বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে ধারালো বটি দিয়ে স্বামীকে কুপিয়ে আহত করলেন স্ত্রী। পরে স্বামীর পাল্টা আক্রমণে স্ত্রীও আহত। তারপর দুজনই হাসপাতালে।
না, এটা কোনো ধারাবাহিক নাটকের গল্প নয়। গত ৬ ডিসেম্বর ঠিক এমনটিই ঘটেছে যশোরের ঘোপ বেলতলা এলাকার একটি বাড়িতে।
ঘটনাটি আপাতদৃষ্টিতে আর দশটা দাম্পত্য কলহের ঘটনার মতো মনে হতে পারে। অনেকে বলতেই পারেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ওরকম একটু-আধটু তো হয়ই।
একটু গভীরভাবে ভাবুন তো। ‘বোঝে না, সে বোঝে না’ কী বুঝিয়েছে ওই নারীকে? ভারতীয় সিরিয়ালে কতটা আসক্ত হয়েছেন তিনি? স্বামীকে উপোস রেখে সিরিয়ালে বুঁদ হয়ে থাকা বাঙালি নারীর স্বভাবের সঙ্গে যায় না। স্বামীসেবার স্বাভাবিক প্রবণতাকে যে বিষয়টি প্রভাবিত করেছে- তা ওই ভারতীয় ধারাবাহিকে আসক্তি। স্বামীসেবার কথা না হয় বাদই দিলাম- একজন ক্ষুধার্ত মানুষকে অপেক্ষায় রেখে টিভি দেখার মতো অসৌজন্য দেখাতে পারে না কোনো নারী তো দূরের কথা কোন মানুষই।
অবশ্য, এটাই প্রথম ঘটনা নয়। বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক পরিবারেই রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইসের দখল নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি একটি সাধারণ ব্যাপার। এর এক পক্ষ ভারতীয় সিরিয়াল দেখা নারী। অনেক পুরুষও এ দলে রয়েছেন।
আরো কিছু ঘটনার দিকে নজর দেওয়া যাক।
গত ঈদুল আজহায় তোকিম মিয়া তার দুই পুত্রবধূর জন্য এক হাজার ৪০০ টাকা দিয়ে দুটি শাড়ি কিনে নিয়ে যান। ছোট ছেলে সাইদুলের স্ত্রী শারমিন শাড়ি নিতে আপত্তি জানান। তিনি স্বামীর কাছে পাখি ড্রেস কিনে দেওয়ার বায়না ধরেন। সাইদুল শারমিনকে বলেন, ‘আব্বা শাড়ি এনেছে, তুমি এটা নাও। পরে তোমাকে পাখি থ্রি-পিস কিনে দেব।’ এ নিয়ে উভয়ের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়। ঝগড়ার এক পর্যায়ে শারমিন তার বাবা ও ভাইকে ফোন করে ডেকে আনেন এবং স্বামীকে তালাক দিয়ে বাপের বাড়ি চলে যান। শারমিন তালাক দিয়ে চলে যাওয়ার সময় বলেন, ‘ঈদের আগেই বিয়ে করে নতুন স্বামীকে সঙ্গে করে পাখি থ্রি-পিস পরে তোমার বাড়ির এলাকা থেকে ঘুরে যাব।’
পাখি জামা না পেয়ে শিবগঞ্জের কানসাটে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে হালিমা (১২) নামের ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রী। বাবার কাছে পাখি জামার আবদার করার পর সেটার জন্য বকা খেয়ে অভিমানে আত্মহত্যা করে হালিমা।
অন্যদিকে, গত ১৪ অক্টোবর ভারতীয় চিত্রতারকা দেবের জন্য ছাদ থেকে লাফ দেয় স্কুলছাত্রী সুমি দাশ। সে রাজধানীর জুরাইনের আল ফারাহ ইন্টারন্যাশন্যাল স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী।
এসব ঘটনার খবর গণমাধ্যমে আসে এবং এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। সংবাদ মাধ্যমে আসেনি এরকম অনেক ঘটনাই রয়ে গেছে আমাদের অজানা।
ভারতীয় এসব সিরিয়াল ও সিনেমা আমাদের মগজে-মননে এমনভাবে প্রভাব ফেলেছে যে, ‘বোঝে না, সে বোঝে না’ ধারাবাহিকের পাখি চরিত্রে রূপ দেওয়া তরুণীটি কী কাপড়, কোন অলঙ্কার পড়েন, সেটাই অনুকরণ করতে হবে, নইলে জাত থাকবে না। কোনো নাট বা সিনেমার পরিধেয় বস্ত্র-অলঙ্কার যদি প্রভাবিত করে, তাহলে তার স্বভাব, চলা-বলাও প্রভাব ফেলবে, এটাই স্বাভাবিক। এসব ধারাবাহিকে দেখানো বউ-শাশুড়ির যুদ্ধ, ননদ-ভাবির কামড়াকামড়িও বাংলাদেশি নারীদের মধ্যে সংক্রমিত হবে, তাতে সন্দেহ নেই (সিরিয়ালগুলো দেখে মনে হয়- বউ আর শাশুড়ির মধ্যে দ্বন্দ্বটাই স্বাভাবিক, সৌহার্দ্য নয়।)
এ তো গেল ভারতীয় বাংলা সিরিয়ালের কথা। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন শুধু এতেই সীমাবদ্ধ নেই। হিন্দি ও অন্য ভাষার গান, চলচ্চিত্রও ধীরে ধীরে বাংলা ভাষায় রচিত গান, নির্মিত চলচ্চিত্রকে কোনঠাসা করে ফেলছে। যারা বাংলাদেশি সিনেমা দেখেন, তারা খ্যাত, আনস্মার্ট - এরকমই ধারণা আজকালকার অনেক তরুণ-তরুণীর। বাংলা গানের নাকি মজা নাই। তারা গড়গড় করে হিন্দি বা ইংলিশ গান ও সিনেমার নাম বলে যান, যেন এটা বলতে পারার মধ্যে কৃতিত্ব আছে। শাকিরা নতুন কী গান গাইলেন, পিটবুল কোন গানে র্যাপ করলেন তা আজকালকার ছেলেমেয়ের নখদর্পণে। অথচ তাদের অনেকেই সমকালীন বাংলা গানের খবর রাখেন না। কোরিয়ান চলচ্চিত্রকার কিম কি দুক কিংবা ইরানের মাজিদ মাজিদির সিনেমা দেখি- এটা বলে তারা গৌরব বোধ করেন। কিন্তু বাংলা সিনেমার নাম শুনলে নাক সিটকান। তারা কথায় কথায় ইংলিশ আর হিন্দি শব্দ উচ্চারণ করে পাণ্ডিত্য জাহিরের চেষ্টা করেন। অথচ শুদ্ধভাবে বলতে জানেন না, লিখতে জানেন না। এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে!
শাকিরা বা পিটবুল জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী, কিম কি দুক আর মাজিদ মাজিদি গুণী চলচ্চিত্রকার- এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। যারা বাংলা গান, নাটক, চলচ্চিত্র করেন তারাও তো কমবেশি গুণী। বাংলা গান বা চলচ্চিত্র হয় তো খুব মানসম্পন্ন নয় কিন্তু একেবারে ফেলনাও তো নয়। বাংলা বাউল গানকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাবসংগীতের আখ্যা দিয়েছে ইউনিসেফ, এ খবর আমরা অনেকেই জানি না।
আমার মা বেশি সুন্দর নন, তাই বলে কি অন্য সুন্দরী নারীদের মা বলে ডাকব আমি? মায়ের কোলে বসে অন্যকে মা ডাকা কি মায়ের অপমান নয়? মায়ের অপমান কি আমার অপমান নয়?
এখন সময় এসেছে, বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন ঠেকানোর। মা, মাতৃভূমি এবং মাতৃভাষার প্রতি সম্মান জানাতে হবে। এতে আমাদের গৌরব কমবে না বরং বাড়বে।
বিষয়: বিবিধ
১২৬৫ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সরকারি উদ্যোগে তো সানি লিউন আসতাছে!!!
তাই ছেলেদেরও উচিত এসব সিরিয়াল দেখা যাতে মেয়েদের কূটনামীর কাউন্টার দিতে পারে ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন