সাংবাদিকতা-৩
লিখেছেন লিখেছেন সাম্য বাদী ০৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:৫৩:০৮ দুপুর
ভারতীয় উপমহাদেশঃ
ভারতের বিখ্যাত ইংরেজী দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা প্রথম বেরিয়েছিল একটি বাংলা সাপ্তাহিকী হিসেবে, ১৮৬৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী, বর্তমান বাংলাদেশের যশোর জেলার পলুয়া-মাগুরা গ্রাম থেকে। এটি ছাপা হত কাঠের টাইপের একটি প্রেসে, কলকাতা থেকে ৩২ টাকা দিয়ে যা কিনে আনা হয়েছিল। পত্রিকার জন্য কাগজও তৈরি হত যশোরের ওই গ্রামেই। সে-সময় সম্পাদক শিশিরকুমার ঘোষ কখনো কখনো নিজ হাতে পত্রিকা কম্পোজ ও ছাপার কাজ করতেন। ব্রিটিশ-ভারতে সম্পাদক হিসেবে শিশিরকুমার ছিলেন এক জীবন্ত কিংবদন্তী। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি (রাজনীতি, সঙ্গীতসহ নানা ক্ষেত্রে ছিল যাঁর অবাধ বিচরণ) তাঁর স্বাধীনচেতা স্বভাব ও প্রখর আত্মমর্যাদাবোধের জন্য বারবার ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়েন। কিন্তু তিনি কখনো নতি স্বীকার করেন নি। বরং সরকারকেই বহুবার তাঁর কাছে হার মানতে হয়েছে। ‘সংবাদপত্র সমাজের দর্পণ’ কথাটার সঙ্গে আমরা পরিচিত। কিন্তু শিশিরকুমার তাঁর পত্রিকাকে তুলনা করতেন ক্যামেরার সঙ্গে। তিনি লিখেছিলেন, ‘এই ক্যামেরার ছবিতে যদি অন্যায়, অবিচার ও বঞ্চনার বাস্তব ছবি ফুটে ওঠে তাহলে আমি নাচার।’
সমকালে শিশিরকুমার ঘোষের মতো ও-রকম দেশজোড়া খ্যাতি বা পরিচিতি না পেলেও, তাঁরই মতো বহুমুখী প্রতিভা ও কীর্তির অধিকারী আরেকজন নির্ভীক সাংবাদিক ছিলেন হরিনাথ মজুমদার। ‘কাঙাল হরিনাথ’ নামে যিনি আজ সমধিক পরিচিত। অমৃতবাজার-এরও পাঁচ বছর আগে পূর্ব বাঙলারই আরেক মফস্বল অঞ্চল কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে তিনি বের করেছিলেন গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা। আজীবন কঠিন দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করেও (জীবিকার জন্য তাঁকে কখনো স্কুল শিক্ষকতা, কখনো মহাজনের গদিতে খাতা লেখা আবার কখনো নীলকুঠিতে চাকরি করতে হয়েছে), পত্রিকার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তিনি প্রাণান্ত করেছেন। পত্রিকাকে তলোয়ার করে জমিদার, মহাজন, নীলকর ও ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে এক হাতে লড়ে গেছেন।
১৯৫১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান অবজার্ভার-এর সম্পাদক আবদুস সালাম তাঁর পত্রিকায় ‘ক্রিপ্টো ফ্যাসিজম’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় লেখেন। তাতে গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দীনের স্বজনপ্রীতির সমালোচনা করতে গিয়ে হজরত ওসমানের (রাঃ) তুলনা টানা হয়। আর এই ‘অপরাধে’ আবদুস সালাম ও পত্রিকার মালিক
জুলফিকার হায়দার, বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা, নবযুগ প্রকাশনী, ঢাকা, ৩৩০ টাকা
হামিদুল হক চৌধুরীকে গ্রেপ্তার এবং পত্রিকার প্রেস তালাবদ্ধ করে দেওয়া হয়। দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে আবদুস সালাম ও হামিদুল হক চৌধুরী উভয়েই ছিলেন দক্ষিণপন্থী, কিন্তু সাংবাদিক স্বাধীনতা বা মত প্রকাশের অধিকারের প্রশ্নে তাঁরা সেদিন আপোস বা আত্মসমর্পণ করেননি। এরও আগে, পাকিস্তান সৃষ্টির প্রায় পরপরই, ১৯৪৮ সালের জুনে, সরকারের আরোপিত প্রি-সেন্সরশীপের প্রতিবাদ জানাতে চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান পত্রিকার সম্পাদক আবদুস সালাম খান আমরণ অনশন করেছিলেন। এ সবই আমাদের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার গৌরবময় ঐতিহ্যের অংশ। কিন্তু আমাদের নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকরা কজন এই ঐতিহ্য বা ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত? তাঁদের সে সুযোগই বা কোথায়?
বাংলা সংবাদ ও সাময়িকপত্রের সেই গোড়ার যুগ থেকে বলা যায় ১৯৮০ এর দশক পর্যন্ত এদেশে সাংবাদিকতা বা সংবাদপত্র প্রকাশের সঙ্গে ব্রত বা নেশার কমবেশী সম্পর্ক ছিল। এ-পর্বে যাঁরা পত্রিকা প্রকাশে এগিয়ে এসেছেন কিংবা সাংবাদিকতার অনিশ্চিত পেশায় নিজেদের জড়িত করেছেন, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সামাজিক-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা দায়বদ্ধতা কিংবা ছাপার অক্ষরের প্রতি এক রকম আকর্ষণ বা মোহই তাঁদেরকে পরিচালিত করেছে। তার মানে অবশ্য এ নয় যে, পেশাদারিত্বের কোনো ভূমিকা বা গুরুত্ব তখন ছিল না। বরং পেশাদারী দক্ষতায়ও সে-সময়ের বহু সাংবাদিক ও সংবাদপত্র ব্যবস্থাপকের সঙ্গে তুলনীয় মানের ব্যক্তিত্ব আজ এদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। যদিও ভৌত অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে গত কয়েক বছরে আমাদের সংবাদপত্রশিল্পের অনেকই উন্নতি হয়েছে। সাংবাদিকতার প্রাতিষ্ঠানিক পঠন-পাঠনও যথেষ্ট বেড়েছে, অনেকেই সাংবাদিকতায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে এই পেশায় আসছেন। সাংবাদিকদের চাকুরিকালীন প্রশিক্ষণ, বিদেশ ভ্রমণ ও বিভিন্ন সেমিনার-কর্মশালায় অংশগ্রহণের সুযোগও বহুগুণে সমপ্রসারিত হয়েছে। তারপরও, শুধু পাকিস্তান আমলের কথাই যদি ধরি, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া), আবদুস সালাম, জহুর হোসেন চৌধুরীর মতো সম্পাদক; মাহবুবুল হক, আবদুল গনি হাজারীর মতো সংবাদপত্র ব্যবস্থাপক কিংবা আহমেদুর রহমান, শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজউদ্দীন হোসেন, এম আর আখতার মুকুল, সৈয়দ নূরুদ্দিন, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, এ এল খতিব, আহমেদ হুমায়ুন, সন্তোষ গুপ্ত, আসফদ্দৌলা রেজার মতো সাংবাদিক আজও কি আমাদের প্রিন্ট মিডিয়ায় বেশী আছে? সাংবাদিকতায় বিধিবদ্ধ জ্ঞানের পাশাপাশি পূর্বসূরীদের এই অবদানের সঙ্গেও কি নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের পরিচয় থাকা উচিত নয়? কিন্তু আমাদের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার একটি পূর্ণাঙ্গ ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাসগ্রন্থের অভাবে এই পরিচয়ের কাজটি এতদিন বলতে গেলে অসম্ভবই ছিল। আর এই অভাব বা শূন্যতা পূরণ করতেই এগিয়ে এসেছেন জুলফিকার হায়দার কিছুদিন আগে প্রকাশিত তাঁর বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা গ্রন্থের মাধ্যমে।
বাংলা সাময়িকপত্রের সেই প্রথম যুগ থেকে বিভাগ পূর্ব বাঙলা, বিভাগোত্তরকালের পূর্ব বাঙলা বা পূর্ব পাকিস্তান এবং স্বাধীনতা পরবর্তী প্রায় মধ্য-১৯৯০ দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের সকল সংবাদপত্র ও সাময়িকীর বছরওয়ারি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য তথ্য এ-বইটিতে তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তী সংবাদ ও সাময়িকপত্র বিষয়ক তথ্যের জন্য, সমকক্ষ অন্য কোনো ইতিহাস বা আকরগ্রন্থের অভাবে, জানা মতে এ-বইটিই এখন পর্যন্ত আমাদের প্রধান নির্ভর। এ-পর্বের তথ্যের জন্য লেখককে অনুমান করা যায় মূলত সরকারি চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের দলিলপত্রের ওপরই নির্ভর করতে হয়েছে। এ-পর্যায়েও রাজধানী ও মফস্বল শহর থেকে প্রকাশিত প্রায় প্রতিটি পত্রিকার নাম, বিষয় বা ধরন, প্রকাশকাল, সম্পাদক প্রকাশক ও মুদ্রকের নাম, পৃষ্ঠাসংখ্যা ও দাম বইটিতে পাওয়া যাবে। এসব পত্রিকার অনেকগুলোই আজ হয়তো বিলুপ্ত (এমন কি অনেক পত্রিকার পুরনো কোনো কপিও কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না), কিছু পত্রিকা হয়তো পরিবর্তিত মালিকানায় বা চরিত্র নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে। আলাদাভাবে যার প্রতিটি সম্পর্কে বিশদ তথ্য সংগ্রহ বা সংকলন করা নিঃসন্দেহে খুব দুরূহ কাজ। প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ বা পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া স্রেফ ব্যক্তি উদ্যোগে ও এককভাবে যা করার কথা ভাবাই যায় না। আশা করব জুলফিকার হায়দারের এই বুনিয়াদি পর্যায়ের কাজের ওপর নির্ভর করেই কিংবা এর সূত্র ধরে আগামীতে তিনি নিজে কিংবা অপর কেউ আমাদের সংবাদপত্র ও সাময়িকীসমূহ সম্পর্কে স্বতন্ত্র, বিষয়ভিত্তিক ও আরও তাৎপর্যপূর্ণ কাজে এগিয়ে আসবেন।
এদেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা সংশ্লিষ্ট খুব কম গুরুত্বপূর্ণ তথ্যই আছে এই গ্রন্থের প্রায় সাড়ে তিনশো পৃষ্ঠার পরিসরে যা উল্লেখিত হয় নি। এমন কি সংবাদপত্র জগতের অনেক কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা বা কাহিনীকেও লেখক সযত্নে বইয়ে ঠাঁই করে দিয়েছেন। যেমন ফররুখ আহমদ ও আবদুল গফুর সিদ্দিকীর রচনা আকরম খাঁর নিজের নামে ছেপে দেওয়া, জেলগেটে সাংবাদিক আনোয়ার জাহিদ ও কামরুন নাহার লাইলির বিয়ে প্রভৃতি। আমরা কজন জানি যে, ১৯৫০এর দশকের মাঝামাঝি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে শেখ মুজিবের মালিকানায় ‘নতুন দিন’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়? পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন লুৎফর রহমান জুলফিকার। তবে মুজিব নাকি নিজেও কিছুকাল এই পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। মজার ব্যাপার হলো পত্রিকাটির সংবাদ, মন্তব্য-প্রতিবেদন ইত্যাদির শিরোনাম দেওয়া হত নজরুলের কবিতার লাইন দিয়ে।
সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ইতিহাস লিখতে গিয়ে জুলফিকার হায়দার সমসাময়িক রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস বা ঘটনাপ্রবাহকেও প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় ও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বইটিতে তুলে ধরেছেন। মোটামুটি সংক্ষেপে কিন্তু সহজ-সাবলীল ভাষায় ও প্রায় ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠভাবে তিনি এই দায়িত্বটি পালন করেছেন। ফলে যাঁরা হয়তো সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ইতিহাস সম্পর্কে ততটা আগ্রহী নন, তাঁরাও বাঙলার গত সোয়া দু’শো বছরের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি সংক্ষিপ্ত ধারাভাষ্য এ-বইটিতে পাবেন। সেদিক থেকে সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার ছাত্রদের জন্য তো বটেই, বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনীতি সম্পর্কে আগ্রহী পাঠক মাত্রেরই জন্য এটি একটি অবশ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পাঠযোগ্য বই। তথ্যবহুল এ-বইটি সবার পক্ষে একবারে আগাগোড়া পড়া হয়তো সম্ভব হবে না। তবে টেবিলে রেখে মাঝে মাঝে পৃষ্ঠা ওল্টালে, তাতে ইতিহাস-বিস্মৃত জাতি হিসেবে আমাদের যে কুখ্যাতি, তা দূর হলেও হতে পারে।
ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে, পুরো পাকিস্তান আমল জুড়ে এবং তারপর স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৯০ এর দশক অবধি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের জন্য সরকারের নেয়া নানা নিবর্তনমূলক পদক্ষেপের পাশাপাশি সে-স্বাধীনতার জন্য সাংবাদিক সমাজের লড়াই-সংগ্রামের সংক্ষিপ্ত বিবরণও বইটিতে স্থান পেয়েছে। আইযুবী দশকে প্রেস ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সরকারী মালিকানাধীন সংবাদপত্র প্রকাশের ব্যবস্থা এবং এভাবে আর্থিক বা পেশাগত নিশ্চয়তা ও বর্ধিত সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে একদল প্রতিভাবান সাংবাদিককে পোষ মানানোর প্রচেষ্টার বিষয়টি যেমন আছে, তেমনি আছে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৫-এ বাকশাল গঠনের পর ‘নিউজপেপার ডিক্লারেশন এনালমেন্ট অর্ডিন্যান্স’ জারির মাধমে চারটি ছাড়া দেশের বাকি সব দৈনিকের প্রকাশনা বন্ধ করার ঘটনার উল্লেখও। আছে সে-সময় নয়জন সম্পাদকসহ ৩৭৪জন বিশিষ্ট সাংবাদিকের বাকশালের সাংবাদিক ফ্রন্টে যোগদানের তথ্যও। এঁদের কারো কারো নাম দেখে ও তাঁদের বর্তমান অবস্থান ও বক্তব্যের সঙ্গে মেলাতে গিয়ে পাঠক হয়তো বিভ্রান্ত বোধ করবেন। তাঁরা কি (চাপ বা হুমকির মুখে) যোগদান করতে বাধ্য হয়েছিলেন, নাকি সুবিধাবাদ ও তোষামুদি মনোবৃত্তি দ্বারা চালিত হয়েছিলেন? সাংবাদিকদের মধ্যেও শামসুর রাহমান, নির্মল সেনসহ অনেকে যে শেষ পর্যন্ত বাকশালে যোগদান করেন নি সে-তথ্যটিরও উল্লেখ এ-সূত্রে অপ্রাসঙ্গিক হত না।
‘একাত্তরের পত্রিকা’ শিরোনামের অধ্যায়টি, যেখানে অধিকৃত বাংলাদেশের ও মুক্তাঞ্চলের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, আরও তথ্যসমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ ছিল। এই অধ্যায়ে লেখক মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় ও গণহত্যার সপক্ষে দৈনিক সংগ্রাম-এর ভূমিকার পরিচয় যেভাবে দিয়েছেন একইভাবে না হোক আরেকটু সংক্ষেপে কিন্তু দৃষ্টান্ত বা উদ্ধৃতিসহ ওই সময়ের অন্যান্য পাকিস্তানপন্থী পত্রিকা যেমন দৈনিক পূর্বদেশ, পাকিস্তান অবজার্ভার প্রভৃতির ভূমিকাও তুলে ধরতে পারতেন। লেখক আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘দুর্ভাগ্য এই যে, গোটা পাকিস্তান আমলে যেসকল বরেণ্য সাংবাদিক শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেছেন তাদের একটা বড় অংশ দখলদার বাহিনীর হয়ে পত্রিকা বের করেছেন।’ লেখকের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত না করেও বলব, সেদিন অধিকৃত দেশে বসেও, চূড়ান্ত ঝুঁকির মুখে, যে-সকল সাংবাদিক কৌশলী সংবাদ পরিবেশনার মাধ্যমে এবং ব্যক্তি পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তার চেষ্টা করেছেন তাঁদের ভূমিকারও কিঞ্চিৎ উল্লেখ বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হত না। অন্যদিকে, পাকিস্তানী আমলের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ইত্তেফাক-এর সাহসী ও অগ্রণী ভূমিকার পাশাপাশি, ১৯৭০-এ পত্রিকাটির কোনো এক সংখ্যায় তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ‘কেন আমি অখণ্ড পাকিস্তান চাই’ শিরোনামে একটি পুরনো উপসম্পদকীয়র পুনর্মুদ্রণ, ২৬ মার্চ পাকবাহিনীর আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর মে মাসে (খুব সম্ভব সোহরাওয়ার্দি-তনয়া আখতার সোলায়মানের মধ্যস্থতায়) আবার সরকারী অর্থানুকূল্যে পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা, পাকিস্তান সংবাদপত্র সমিতির সভায় যোগ দিতে ইত্তেফাক সম্পাদকের পাকিস্তান সফর ইত্যাদির মতো বিপরীত তাৎপর্যবহ ঘটনাগুলোরও উল্লেখ করা যেত। কারণ এগুলোও আমাদের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ইতিহাসের অংশ।
বইটির নাম ‘বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা’, ‘বাংলাদেশের বাংলা ভাষার সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা’ নয়। সেদিক থেকে বাংলা ছাড়াও এই ভূখণ্ড থেকে প্রকাশিত অন্যান্য ভাষার পত্রপত্রিকা ও তৎসংশ্লিষ্ট সাংবাদিকতার তথ্যও এই বইটিতে স্থান পাওয়ার কথা। একেবারে পায় নি যে তা-ও নয়। তবে স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত কয়েকটি উর্দু পত্রিকার কথা যদি বাদও দিই, সারওয়ার মুরশিদ সম্পাদিত নিউ ভ্যালুজ, রেহমান সোবহান সম্পাদিত ফোরাম, আলমগীর কবির সম্পাদিত সিক্যুয়েন্স ও এঙপ্রেস কিংবা স্বাধীনতা পরবর্তীকালে কে বি এম মাহমুদ সম্পাদিত ওয়েভ ও জহুর হোসেন চৌধুরী সম্পাদিত কাউন্টার পয়েন্ট-এর মতো উঁচুমানের কিছু ইংরেজী পত্রিকার নাম কেন বা কোন বিবেচনায় বাদ পড়েছে বোঝা গেল না।
খুবই প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থ হিসেবে বইটির দু’টি ত্রুটির উল্লেখ না করলেই নয়। আগেই বলেছি, বইটিতে লেখক বিপুল তথ্যের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্দিষ্টভাবে তার সূত্র বা উৎস নির্দেশ করা হয় নি। এ ধরনের একটি বইয়ের জন্য যা অপরিহার্য। আর বইয়ের শেষে একটি গ্রন্থপঞ্জি সংযোজন করাই এ ব্যাপারে যথেষ্ট নয় বলে মনে করি। দ্বিতীয়ত বইটিতে একটি নির্ঘণ্ট থাকাও অত্যাবশকীয় ছিল। যার অভাবে শিক্ষার্থী, গবেষক, সাধারণ কৌতূহলী পাঠক সকলেই বইটি ব্যবহার করতে গিয়ে যার পর নেই বিপন্ন বোধ করবেন। তাছাড়া পত্রিকার নাম বাঁকা হরফে বা (একক-) ঊর্ধ্বকমার মধ্যে (যে-কোনো একভাবে) দেওয়ার রীতিটি অনেকক্ষেত্রেই অনুসৃত হয় নি। আশা করি পরবর্তী সংস্করণে এ ত্রুটিগুলি সংশোধনে লেখক ও প্রকাশক উভয়েই সচেষ্ট হবেন।
ইতিহাস রচনায় লেখকের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটবে না এমন কথা বলা মোটেও আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে কোথাও তা প্রকট হয়ে পড়লে তাতে নিঃসন্দেহে রচনার গ্রহণযোগ্যতা ক্ষুণ্ন হয়। বিশেষ করে নিকট সময়ের রাজনৈতিক পটভূমি বর্ণনা বা ব্যাখ্যায় লেখক এই পক্ষপাতের পরিচয় দিয়েছেন। আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলের বিদ্যমান প্রবণতাকেই যা তুলে ধরে। একইভাবে হয়তো লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা সংশ্লিষ্টতার স্মৃতিও দু’একটি ক্ষেত্রে তাঁর বস্তুনিষ্ঠতা ও নৈর্ব্যক্তিকতা রক্ষার সহায়ক হয়নি। বইটি জুড়ে লেখকের যে-সক্ষমতার পরিচয় ছড়িয়ে আছে তার ভিত্তিতে নির্দ্বিধায় বলা যায়, একটু সচেতন হলেই তিনি এই দুর্বলতা জয় করতে পারতেন। বইয়ের এক জায়গায় গ্রন্থকার লিখেছেন, ‘১৯৭৬ সালের ২২ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাক মালিকের কাছে ফেরত দেয়া হয়। এ বছর ৩০ ডিসেম্বর সংবাদ পুনঃপ্রকাশিত হয়। এভাবে নানা কায়দায় বন্ধ পত্রিকাগুলো প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৭৭ সালের ২৭ এপ্রিল যখন দৈনিক সংগ্রাম পাঁচ বছর পর নবপর্যায়ে পুনঃপ্রকাশের অনুমতি দেয়া হয় তখন সরকারের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কেন তারা বন্ধ পত্রিকাগুলো তড়িঘড়ি করে পুনঃপ্রকাশের ব্যবস্থা করলেন।’ লেখকের অনুমান বা ব্যাখ্যা যদি সঠিকও হয়, তা হলেও তাঁর বক্তব্য নিয়ে এক রকম অস্পষ্টতা বা সংশয় থেকে যায়, তিনি কি নীতি হিসেবে বাকশাল আমলে বন্ধ করে-দেওয়া পত্রিকাগুলোর (তড়িঘড়ি) পুনঃপ্রকাশের বিরোধিতা করছেন?
আজকের দিনে যখন কম পরিশ্রমে সহজসাফল্য লাভের দিকেই সবার ঝোঁক, যখন মননের জগতেও দৃষ্টি আকর্ষণ বা স্বীকৃতি লাভের অজস্র পথ উন্মুক্ত, তখন আলোচ্য গ্রন্থের লেখক যে এ রকম একটি কঠিন, শ্রমসাধ্য ও আপাত ধন্যবাদহীন কাজে নিজেকে যুক্ত করেছেন সেজন্যই তিনি আমাদের একটি বাড়তি ধন্যবাদ পেতে পারেন। আমাদের প্রকাশনা জগতের সাম্প্রতিককালের একটি বড় ঘটনা বা খবর হলো জুলফিকার হায়দারের বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা বইটির প্রকাশ। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হল বইটি নিয়ে এ-পর্যন্ত কোথাও কোনো আলোচনা-সমালোচনা চোখে পড়ে নি। আরও আশ্চর্য হই বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ইতিহাস জানার পক্ষে অপরিহার্য, এ-রকম একটি বইয়ের ব্যাপারে খোদ সংবাদপত্র জগতেরই নীরবতা বা ঔদাসীন্য দেখে। ইতিহাস-অসচেতন জাতি হিসেবে আমাদের পরিচয় কিংবা আমাদের প্রচার-মাধ্যমের ব্যাপারে মননবিযুক্তির অপবাদকেই কি ব্যাপারটা প্রতিষ্ঠা দেয়?
বিষয়: বিবিধ
১১৫০ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন