উসামা বিন লাদেন ও আমেরিকার সম্পর্কের ব্যাপারে সি,আই,এ এর সাবেক কর্মকর্তা এবং ওসামা বিন লাদেন ইউনিটের প্রধান মাইকেল শ’ইয়া র এর বক্তব্য।

লিখেছেন লিখেছেন কাউয়া ০৩ নভেম্বর, ২০১৪, ০৫:৩৯:১৮ বিকাল

নিচের আলোচনাটুকু ২০০৮ সালের ১২ মার্চে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বার্কলি) আন্তর্জাতিক শিক্ষা বিভাগ (Institution of International Studies) কর্তৃক আয়োজিত Conversations with History - শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে সি,আই,এ (সি,আই,এ - Central Intelligence Agency) – এর সাবেক কর্মকর্তা এবং ওসামা বিন লাদেন ইউনিটের প্রধান মাইকেল শ’ইয়া র (Michael Scheuer) এর বক্তব্য থেকে নেওয়া।

অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু ছিল - “মার্কিন বৈদেশিক নীতি এবং সন্ত্রাসবাদের হুমকি”। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ও সঞ্চালক হিসেবে ছিলেন হ্যারি ক্রাইসলার।

অনুষ্ঠানের ৯:০১ থেকে ১৫:৩৬ মিনিটে এই আলোচনাটি রয়েছে। পুরো অনুষ্ঠানটি ইউটিউবে দেখে নিতে পারেন এখান থেকে:

http://www.youtube.com/watch?v=gxdb5nnRMrU

হ্যারি ক্রাইসলার: আমি এ পর্যায়ে বিন লাদেন ইউনিটের একদম শুরুর দিকে একটু দৃষ্টিপাত করতে চাই। ঠিক কোন প্রেক্ষাপটে, কি পরিস্থিতিতে প্রথম ওসামা বিন লাদেন আপনাদের (সি,আই,এ) নজরে আসে? এটা কি সৌদি স্থাপনাগুলোতে (আল কায়েদার) হামলার পরপর? নাকি তারও আগে থেকেই আপনারা তার সম্পর্কে বিপদজনক তথ্য পাচ্ছিলেন?

মাইকেল শ’ইয়ার: আসলে সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফগান জিহাদ চলাকালীন সময়েই আমরা বিন লাদেনকে নিয়ে বিস্ময়কর সব তথ্য পাওয়া শুরু করি। সত্যি বলতে কি, এই সময়ে আমরা (সি,আই,এ) তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করছিলাম। আশির দশকের প্রায় শেষ পাঁচ বছর ধরে আমরা তার সাথে যোগাযোগ করার যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়েছি। কিন্তু বিন লাদেন আমাদের সাথে, আমেরিকার সাথে বিন্দুমাত্র সংস্পর্শও ঘৃণা করতেন। আমাদের কাছ থেকে ধুলো পরিমান কিছু নিতেও তিনি আগ্রহী ছিলেন না।

তার নিজের বিশাল সম্পত্তি এবং অর্থবিত্ত ছিল। তিনি খুব সহজেই তার নিজের সোর্সের মাধ্যমে অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারতেন। সেজন্য আসলে তার কাছে আমাদের কোন মূল্যই ছিল না এবং আমাদের সাহায্যেরও তার দরকার ছিল না।

৮৯ সালে সোভিয়েত রাশিয়া আফগান মুজাহিদীনের কাছে পরাজিত হবার পরপরই আমরা গুরুত্বের সাথে এবং গভীরভাবে তার কার্যকলাপ ও গতিবিধির দিকে মনোযোগ দেওয়া শুরু করি।

বলকান, ইরিত্রিয়া, কাশ্মীর, মিন্দানাও – এরকম অসংখ্য জায়গায় ইসলামী আন্দোলনের সাথে আমরা তার নাম দেখতে শুরু করি। এক্ষেত্রে ব্যাপারটা এমন ছিল না যে উনি সরাসরি এইসব জায়গার আন্দোলন গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছিলেন।

বরং অনুপ্রেরণামূলক অডিও বার্তার মাধ্যমে, মুজাহিদীনের জন্য প্রয়োজনীয় দলিল-কাগজপত্র-পাসপোর্ট, আর্থিক সাহায্য, সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান, পরিস্থিতি অনুযায়ী এরকম বিভিন্নভাবে তিনি বিশ্বব্যাপী জিহাদের আন্দোলনকে সহায়তা করছিলেন।

সুতরাং নব্বইয়ের দশকের মাঝমাঝি সময়টাতে এসে তাকে নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে চিন্তা করা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় ছিল না।

এসময়ে তিনি আফগানিস্তান থেকে খার্তুম (সুদান) চলে যান। তখন সুদানে ক্ষমতায় ছিল হাসান তুরাবীর নেতৃত্বাধীন একটি ইসলামিক দল। এবং এসময় অনেক ইসলামী চরমপন্থী দল সুদানে অবস্থান গ্রহণ করে। এক অর্থে সুদানেই আমরা ওসামা বিন লাদেনের উপর অফিসিয়ালি ফোকাস করা শুরু করি।

শুরুর দিকে আমাদের (সি,আই,এ) এই ইউনিট তৈরি করার পেছনে মূল চালিকাশক্তি ছিল সন্ত্রাসবাদের অর্থায়ন নিয়ে বিল ক্লিনটনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (National Security Adviser) মি. লেইকের তীব্র আগ্রহ।

তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল অর্থায়ন বন্ধ করা গেলেই সন্ত্রাসবাদ বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি মনে করতেন না যে, এক্ষেত্রে ধর্মীয় বিশ্বাসের কোন ভূমিকা থাকতে পারে। মূলত তারই উদ্যোগে ৯৬ এর নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে আমরা শুধুমাত্র ওসামা বিন লাদেনকে ধরার জন্য একটি পৃথক ইউনিট তৈরী করি।

---

হ্যারি ক্রাইসলার: ঠিক কোন পর্যায়ে আপনারা বুঝতে শুরু করেন যে বিন লাদেনের ব্যাপারটা অন্য দশটা সাধারণ সমস্যার মতো না এবং তিনি আমেরিকার জন্য একটা অত্যন্ত বিপদজনক এবং একটা বাস্তব হুমকি?

মাইকেল শ’ইয়ার: ৯৯ –এর শেষের দিকে।

১৯৯৬-এর শেষ নাগাদ আমরা বিন লাদেন সম্পর্কে অনেক তথ্য-উপাত্ত যোগাড় করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

আমাদের পাওয়া তথ্যানুযায়ী বিন লাদেন আর দশজন টাকা উড়ানো সৌদি শেইখের মত ছিলেন না।

তিনি নিছক কোন তাত্ত্বিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় ব্যক্তি যিনি তার বিশ্বাসকে কাজে পরিণত করতেন, যার ছিল একটি সুক্ষ্ণ ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। এবং তার নিয়ন্ত্রনে ছিল এমন একটি সংগঠন (আল কায়েদা) যা ছিল আমাদের দেখা অন্য যেকোন সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের চাইতে অনেক বেশী বড়, বিপজ্জনক এবং সুসংগঠিত।

এবং ভাগ্যই বলতে হবে, ঠিক এ সময়টাতেই আফ্রিকাতে আমাদের সাথে এমন একজন ব্যক্তি যোগযোগ করেন ও আমাদের সাহায্য চান, যিনি ছিলেন ইতোপূর্বে ওসামা বিন লাদেনের সংগঠনের একজন সদস্য। এই লোক আল কায়েদার কাছ থেকে অর্থ আত্মসাৎ করেছিল। সে বিন লাদেনের কাছে গিয়ে তার কৃতকর্ম স্বীকার করলে, লাদেন জবাব দেন – “ঠিক আছে, তুমি টাকা ফেরত দাও এবং তোমার সব অপরাধ ক্ষমা করা হলো”।

কিন্তু ওইলোক এরই মধ্যে সব টাকা খরচ করে ফেলেছিলো। ঐ পরিস্থিতিতে আমাদের (সি,আই,এ) কাছে সাহায্য চাওয়া ছাড়া তার অন্য কোন উপায় ছিল না।

তার কাছ আমরা থেকে বিন লাদেন সম্পর্কিত যেসব তথ্য পেলাম সেগুলো আমাদের নিজস্ব তদন্ত থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্তকেই সমর্থন করল।

এভাবে ৯৬-এর শেষ নাগাদ আমরা বিন লাদেন সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে দুটো ব্যাপার জানতে পারলাম-

প্রথমত, ওসামা কোন টাকাওয়ালা উশৃঙ্খল সৌদি পেট্রো-শেইখ নন।

তিনি একজন অত্যন্ত সুদক্ষ এবং বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব - যিনি নিজে সক্রিয়ভাবে এবং তার সংগঠনের (আল কায়েদা) মাধ্যমে আমেরিকার বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী এবং সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করছেন এবং কার্যক্রম চালাচ্ছেন।

উত্তর আমেরিকাসহ কমপক্ষে চারটি মহাদেশে তার সংগঠন ও প্রভাব বিস্তৃত এবং তার উদ্দেশ্য হল আমেরিকাকে আক্রমণ করা।

দ্বিতীয়ত, আর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে তথ্যটা আমরা পাই সেটা হল, ১৯৯৬ সালেই বিন লাদেন, দক্ষ বিজ্ঞানী, টেকনিশিয়ান এবং প্রকৌশলীদের সমন্বয়ে একটি ইউনিট তৈরি করেন, যেটার লক্ষ্য ছিল পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা।

সুতরাং ৯৬-এর শেষ নাগাদ আমরা (সি,আই,এ) বুঝে গিয়েছিলাম যে ওসামা বিন লাদেন এবং আল কায়েদার ব্যাপারটা একটা সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এবং ভিন্ন পর্যায়ের হুমকি।

---

হ্যারি ক্রাইসলার: বিন লাদেন এবং আল কায়েদা সংক্রান্ত বিশ্লেষণ ও আলোচনায় দুটি প্রশ্ন বা মতামত প্রায়ই উঠে আসে, এবং যেহেতু বিন লাদেন ইউনিটের প্রধান হবার আগে আপনি আফগান মুজাহিদীন সংক্রান্ত সি,আই,এ ইউনিটের সাথেও জড়িত ছিলেন, তাই আমি আপনার কাছে এই দুটো প্রশ্ন রাখছি ... আপনার মতে কোনটি সঠিক?

এই মতটি যে, বিন লাদেন আমাদেরই (আমেরিকা) একটা সৃষ্টি, যে এখন ঘুরে দাঁড়িয়ে আমাদেরকেই আক্রমণ করা শুরু করেছে? নাকি আপনার মতে বাস্তবতা এর চাইতে আরও বেশি জটিল?

যেমন আপনার বইতে (Marching Toward Hell: America & Islam after Iraq) আপনি বলছেন যে, বিন লাদেনের উত্থান ঘটেছে মুসলিম বিশ্ব থেকে উঠে আসা একটা শক্তি হিসেবে এবং আমাদের (আমেরিকা) একজন এজেন্ট হিসেবে না ...

মাইকেল শ’ইয়ার: ওসামা বিন লাদেন কখনই আমাদের এজেন্ট ছিলেন না। এবং এটা কেবল এজন্য না যে আমরা তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি নি, বরং তিনিই কখনো, কোন অবস্থাতেই আমাদের সাথে কথা বলতে বা আলোচনা করতে ইচ্ছুক ছিলেন না।

ওসামা বিন লাদেন এবং আল কায়েদার মতো এরকম মারাত্মক ধরনের একটা শক্তিকে আমেরিকা সৃষ্টি করতে পারে, এটা বিশ্বাস করা চরম আমেরিকান ঔদ্ধত্য ছাড়া আর কিছুই না।

সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমাদের (সি,আই,এ) ভূমিকা ছিল এতটুকুই যে, আমরা আফগানদেরকে লী অ্যানফিল্ড রাইফেলের বদলে একে-৪৭ দিয়ে রাশিয়ানদের মারার সুযোগ করে দেই। আফগানরা রাশিয়ানদের মারতোই, সেটা যেভাবেই হোক।

আমাদের ভূমিকা ছিল তাঁদের হাতে একে-৪৭ তুলে দেবার সুযোগ তৈরি করা।

এ কারনে সোভিয়েত রাশিয়াকে পরাজিত করার গৌরব পুরোপুরিভাবেই আফগান মুজাহিদীনের – এখানে আমেরিকার বিন্দুমাত্র কৃতিত্ব নেই।

ওসামা বিন লাদেন, আমেরিকার সৃষ্টি – এই পুরো ধারণাটাই, মুসলিম বিশ্বে ইসলামের যে কতোটা প্রভাব সেটা বুঝতে আমাদের (আমেরিকা) দৃষ্টিভঙ্গির ব্যর্থতার একটা প্রতিফলন।

আফগানিস্তানে সোভিয়েত রাশিয়া পরাজিত হবার পর সুন্নী ইসলামে যে নবজাগরণের সৃষ্টি হয়েছে ওসামা বিন লাদেন এবং আল কায়েদা তারই ফলাফল।

মুসলিম বিশ্বের জন্য আফগানিস্তানে দুই বৃহৎ পরাশক্তির (superpower) একটি সোভিয়েত রাশিয়ার পরাজয়, আল্লাহ্র পক্ষ থেকে মুসলিম উম্মাহর জন্য এক অসামান্য উপহার, এক অসামান্য বিজয়।

আমাদের (আমেরিকান) আরেকটি প্রবণতা হলো আমরা মনে করি, যদি আমরা বিন লাদেনকে নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলি, শুধু তাহলে হয়তো তার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়ে যাবে।

কিন্তু সত্য হলো, মুসলিম বিশ্বে ওসামা বিন লাদেনের অবিশ্বাস্য রকমের জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা আছে। এবং এর পেছনে বেশ কিছু কারণ আছেঃ

- ওসামা বিন লাদেন এক যুগেরও বেশি সময় ধরে প্রকাশ্যভাবে আমেরিকার বিরোধিতা করেছেন, অবাধ্যতা দেখিয়েছেন, আমেরিকাকে আঘাত করেছেন এবং তাতে আহত করেছেন এবং এত কিছুর পরও তিনি এখনো (ইন্টারভিউটি ২০০৮ সালের) জীবিত আছেন।

- তিনি মুসলিম বিশ্বের কাছে রবিন হুডের মতো এক ধরনের নায়কোচিত চরিত্রে পরিণত হয়েছেন।

- তিনি বিশ বিলিয়ন ডলারের উত্তরাধিকার এবং এক মহাপ্রাচুর্যের জীবনকে পায়ে ঠেলে, জিহাদের জন্য আফগানের পানি পান করাকে বেছে নিয়েছেন এবং ২৫ বছর আফগানের রুক্ষ ভূমিতে জীবন কাটিয়েছেন – এবং সম্মুখ জিহাদে চারবার আহতও হয়েছেন।

ওসামা বিন লাদেন আমাদের (আমেরিকা) সৃষ্টি এটা ভেবে আমরা আমাদের নিজেদেরই মারাত্মক ক্ষতি করছি।

আমেরিকার পক্ষে সৃষ্টি করা সম্ভব এরকম যেকোন কিছুর চাইতে ওসামা বিন লাদেন অনেক, অনেক বেশি ভয়ঙ্কর এবং বিপজ্জনক।

বিষয়: বিবিধ

১৪৬০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File