বঙ্গভঙ্গ ও আমাদের ভুলে যাওয়া ইতিহাস
লিখেছেন লিখেছেন মুজাহিদুল ইসলাম আখুঞ্জি ১৭ অক্টোবর, ২০১৪, ১০:১৩:২৪ সকাল
১৮৫৩ সালে স্যার চার্লসগ্রান্ট এবং ১৮৫৪ সালে লর্ড ডালহৌসি বঙ্গবিভাগের প্রস্তাব করেন। বাংলা ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের সর্বপ্রধান ও সবচেয়ে বড় প্রদেশ। প্রায় ২,৪৮,১২০ বর্গমাইলব্যাপী এ বিশাল প্রদেশের শাসনকার্য সহজ ও দ্রুততরকরণ এবং অবহেলিত ও অনুন্নত পূর্বাঞ্চলকে উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত করার উদ্দেশ্যেই মূলত বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা গৃহীত হয়।
রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ পূর্বাঞ্চলে বদলী হওয়াকে দন্ড মনে করত।
১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়। নতুন প্রদেশের নাম রাখা হয় ‘‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ’’। প্রথম গবর্নর নিযুক্ত হন ব্যামফিল্ড ফুলার (১৮৫৪-১৯৩৫)।
নানা প্রতিকূলতা আর ঘাত-প্রতিঘাতে বিধ্বস্ত ও অধঃপতিত মুসলিম সমাজের জন্য বঙ্গবিভাগ অত্যন্ত কল্যাণকর প্রমাণিত হলেও এর পেছনে তাদের কোন প্রচেষ্টা ছিল না। কেননা শাসনকার্য সহজ, দ্রুততর ও সুষ্ঠু করার জন্যই বঙ্গবিভাগ করেছিল ইংরেজ শাসকরা। মুসলমানরা নয়। তবে এর ফলে মুসলমানদের যে প্রভূত মঙ্গল সাধিত হবার দ্বার উন্মোচন হতে যাচ্ছিল তা তারা কল্পনাও করেনি। ফলে মুসলমানদের মধ্যে অভূতপূর্ব প্রাণচাঞ্চল্য পরিলক্ষিত হয়। অপরদিকে প্রায় পৌনে দু’শ বছরের ব্যবধানে ঢাকা আবারও প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা লাভ করায় রিক্ত পূর্ববঙ্গ আবার নতুন করে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সুযোগ পেল। সমগ্র উপমহাদেশের ন্যায় বাংলার পূর্বাঞ্চলের নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনসাধারণ ছিল অনগ্রসর, ঈঙ্গ-হিন্দু শোষণ আর জুলুমে নিঃশেষিত তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক। উইলিয়াম হান্টার তাই তার বিখ্যাত ‘ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘‘খুব কম সরকারি অফিস আছে, যেখানে মুসলমানরা দারোয়ান, সংবাদ বাহক, দোয়াত সংরক্ষক নয়তোবা কলম মেরামতকারীর ঊর্ধ্বে কোনপদ আশা করতে পারে…..’’।
হিন্দু জমিদারগণ এ অঞ্চলের প্রজাদের শোষণ করে সে শোষণলব্ধ অর্থ কলকাতায় বসে বিলাসীতায় উড়াতেন। প্রজাদের শিক্ষা-দীক্ষা, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এবং নানাবিধ মৌলিক অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে তারা ছিলেন চরম উদাসীন। এককথায় বঙ্গবিভাগের আগে ঢাকাকেন্দ্রিক পূর্ববঙ্গ ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক তথাকথিত
প্রগতি বঙ্গের ‘‘লুণ্ঠনক্ষেত্র’’। পূর্বের কাঁচামালে পশ্চিমে গড়ে উঠেছিল শিল্প-কারখানা, পূর্ব বাংলাকে লুণ্ঠন করে পশ্চিম বাংলায় এনেছিল রেনেসাঁ, সেখানে গড়ে তুলা হয়েছিল স্কুল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-হাসপাতাল। ফলে বাঙ্গালি মুসলিম সমাজ বঙ্গভঙ্গকে তাদের বঞ্চনার অবসানের সূচনা হিসেবেই দেখেছিল।
বঙ্গবিভাগের ফলে মুসলিম সমাজে যে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো- মুসলমানরা অধিকার সচেতন হয়ে উঠেন। নিজস্ব স্বার্থ-সংরক্ষণ ও উন্নতি বিধানের লক্ষ্যে মোহামেডান লিটারেসী সোসাইটি, মোহামেডান প্রভিন্সিয়াল ইউনিয়ন প্রভৃতি সামাজিক, কল্যাণধর্মী সংগঠন হতে শুরু করে ফলে
ঢাকাকেন্দ্রিক বাঙ্গালি মুসলিম মধ্যবিত্তশ্রেণীর বিকাশ ঘটে, যারা পরবর্তীকালে জাতীয়ভাবে অবদান রাখতে সক্ষম হন।
বঙ্গভঙ্গ পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্য রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠনকে ত্বরান্বিত করেছিল। ফলে ১৯০৬ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় সর্বভারতীয় মুসলিম শিক্ষাসম্মেলন শেষে ‘‘অল-ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ’’ নামে একটি অভিন্ন প্লাটফরমে মুসলিমরা ঐক্যবদ্ধ হয়।
১৯০৫-১৯১১ মেয়াদে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এ অঞ্চলে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। বঙ্গভঙ্গের পর মাত্র পাঁচ বছরে মুসলিম ছাত্রের সংখ্যা ৩৫ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছিল।
শিক্ষার জাগরণের ফলে সরকারি চাকরিতে মুসলমানগণ দ্রুত অগ্রসর হতে থাকে। এ ক্ষেত্রে তারা ন্যায্য হিস্যা আদায়ে সচেষ্ট হয়।
১৯০৯ সালে স্বতন্ত্র নির্বাচনের অধিকার আদায়ের মধ্যদিয়েই গঠিত হয় ‘‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম ব্যবস্থাপক পরিষদ’’ এভাবে সকল ক্ষেত্রে মুসলমান প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো বঙ্গভঙ্গ এবং পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ মুসলমান সমাজে এমন গভীর রেখাপাত করে যার ফলশ্রুতিতে তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ
করণীয় নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়। বিশেষত প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের যে চরম সাম্প্রদায়িক ও বীভৎসরূপ তারা প্রত্যক্ষ করে যার ফলে তাদের মধ্যে স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বার চেতনা বদ্ধমূল হয়।
আমাদের ভুলে যাওয়া ইতিহাস
বঙ্গ বিভাগের ফলে হিন্দু ও মুসলিম জাতির মধ্যে পরস্পরবিরোধী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং রাজনীতি দুটি সুস্পষ্ট পৃথক ধারায় প্রবাহিত হয়। দু’চারজন
হিন্দু জমিদার ও বুদ্ধিজীবী ব্যতীত সকল হিন্দু জমিদার, নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী এবং জনসাধারণ বঙ্গভঙ্গের চরম বিরোধিতায় লিপ্ত হন। অপরপক্ষে, মুষ্টিমেয়
মুসলিম বিশিষ্টব্যক্তি ব্যতীত সমগ্র মুসলিমসমাজ বঙ্গ বিভাগ সমর্থন করে নিজেদের ভাগ্য বদলের আশায়। শুধু পূর্ব বাংলার মুসলমানরাই নয় উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানরাও এই নতুন প্রদেশ গঠনের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করে।
পক্ষান্তরে, বাংলার হিন্দুসমাজ এ পরিবর্তনকে মোটেই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারল না। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বর্ণ হিন্দুরা দেড়শ’ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো তাদের ভাগ্যবিধাতাদের বয়কট করার কর্মসূচি ঘোষণা করে। গড়ে তোলে সহিংস আন্দোলন, প্রথমে বাংলায় পরবর্তীতে উপমহাদেশ জুড়ে। এটাকে তারা ‘জাতীয় ঐক্যের প্রতি আঘাত’, ‘মুসলমানদের প্রতি সরকারের পক্ষপাতিত্ব’, ‘মুসলমানদের ইংরেজদের দালালীর ফসল’, ‘বঙ্গ মাতার অঙ্গচ্ছেদ’ প্রভৃতি আখ্যায় আখ্যায়িত করে পরিবেশ বিষাক্ত করা শুরু করল।
ইংরেজদের সম্পূরক শক্তি হিসেবে এতকাল যাদের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল, বঙ্গ বিভাগের মধ্যে তাদের কায়েমী স্বার্থ বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনায় ইংরেজদের বিরোধিতা করার ঝুঁকিও নিল বর্ণ হিন্দুরা। বঙ্গভঙ্গকে তারা আখ্যায়িত করে ‘দেড়শ’ বছরের মধ্যে বৃহত্তম’ জাতীয় বিপর্যয় হিসেবে। উপমহাদেশের একের পর এক স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাক যাদেরকে কখনো শিহরিত করেনি, মুসলমানদের ভাগ্যোদয়ের সম্ভাবনায় এবার তারা ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে নেমে পড়ে। নতুন প্রদেশের সূচনা দিবসকে কলকাতার হিন্দুরা জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করে কালোব্যাজ ধারণ করে, মাথায় ভস্ম মাখে। এ আন্দোলনের বীজ ছিল পুরোপুরি সাম্প্রদায়িকতার বীজতলায় গ্রোথিত।
কিন্তু লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো : চরম সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা অন্তপুরে লুকিয়ে রেখে হিন্দু নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের শ্লোগান নিয়ে মাঠে নামেন। বঙ্কিম চন্দ্রের মতো গোঁড়া সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিকে গুরু মেনে, কালি মন্দিরকে কেন্দ্র করে আন্দোলন জমানোর প্রচেষ্টা নেয়া হলেও প্রকাশ্যে তারা ভেক ধরলেন অভিন্ন বাঙালি সংস্কৃতির রক্ষক হিসেবে।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গ বিরোধী একাধিক সভায় সভাপতিত্ব করেন এবং ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ বাস্তবায়নের দিনকে ‘‘রাখিবন্ধন’’ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেন। এ রাখিবন্ধনের দিন সকালে গঙ্গাস্নানের মিছিলে কবি স্বয়ং নেতৃত্ব দেন। শুধু তাই নয়, বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনকে সামনে রেখে কবি বেশ কয়েকটি হিন্দু ধর্মাশ্রিত গানও রচনা করেন। কলকাতার তৎকালীন পার্শীবাগান মাঠে অনুষ্ঠিত এক সভায় রবীন্দ্রনাথ এক জ্বালাময়ী বক্তব্যে বলেন : ‘‘আমরা প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, বঙ্গের
অঙ্গচ্ছেদের কুফল নাশ করিতে এবং বাঙ্গালি জাতির একতা সংরক্ষণ করিতে আমরা সমস্ত বাঙ্গালী আমাদের শক্তিতে যাহা কিছু সম্ভব তাহার সকলই প্রয়োগ করিব।’’
১৯০৭ সাল বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন চরম পর্যায়ে উঠে। হিন্দু নেতৃবৃন্দের সাম্প্রদায়িক প্রোপাগান্ডার প্রতি অন্ধ সমর্থন দেন হিন্দু লেখক, বুদ্ধিজীবী আর সাংস্কৃতিক কর্মীরা। সংবাদপত্রগুলোও (যেগুলোর অধিকাংশের মালিক ছিল বর্ণ হিন্দুরা) হিন্দুদের সমর্থন করে নানা উস্কানিমূলক সংবাদ-নিবন্ধ প্রকাশ করতে থাকে।
ফলে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন সরকার বিরোধিতার সাথে সাথে মুসলিমবিরোধী আন্দোলনে রূপ পরিগ্রহ করে। সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে দেয়া হয় সর্বত্র। শুরু হয় হিংসাত্মক কর্মকান্ড ও রক্তের হোলিখেলা। ‘স্বদেশী’ আন্দোলনের মাধ্যমে বিলাতী পণ্য বর্জনের ডাক দেয়া হয়। এর মাধ্যমে অনগ্রসর মুসলিম সম্প্রদায় ও
নিম্নবর্ণের হিন্দুদের বাধ্য করা হয় বেশি দামে দেশী পণ্য ক্রয় করতে। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন খুব দ্রুত চরমপন্থী হিন্দু নেতৃবৃন্দের হাতে চলে যায়। ফলে
সমগ্র প্রদেশজুড়ে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ‘যুগান্তর’, ‘অনুশীলন’ প্রভৃতি নামে সন্ত্রাসী সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটতে থাকে। এসব সংগঠনের কর্মীরা বোমা তৈরি ও আগ্নেয়াস্ত্র আমদানির মাধ্যমে নানা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাতে শুরু করে। এমনকি গুপ্তহত্যা ও আক্রমণের পন্থাও তারা বেছে নেয়। এ সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন ইংরেজদের বিরুদ্ধে হলেও এর দ্বারা এক ঢিলে দুই পাখি মারার লক্ষ্য নিয়েই আন্দোলনকারীরা এগুতে থাকে। অর্থাৎ, ইংরেজদের পাশাপাশি মুসলমানদের ইংরেজদের দালাল হিসেবে চিত্রিত করে তাদের নির্মূল করা। এরই ফলশ্রুতিতে নবাব সলিমুল্লাহ দক্ষিণাঞ্চলে সফরে গেলে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলী ছোড়া হয়, তিনি রক্ষা পেলেও সাঈদ নামে এক যুবক প্রাণ হারায়। হিন্দু যুবনেতা বাবু সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ও বিপিনচন্দ্র পালের নেতৃত্বে কর্মী বাহিনীকে বোমা তৈরি ও মারণাস্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ফলে সরকারি স্থাপনা ধ্বংস, সভা-সমাবেশ বানচাল, লুটতরাজ, গুপ্তহত্যা শুরু হয় পূর্ণ উদ্যমে।
পরিস্থিতি এমন হল যে, বঙ্গ বিভাগবিরোধী আন্দোলন কেউ সমর্থন না করলে তার রক্ষা ছিল না, সে যে ধর্মেরই হোক না কেন। ১৯০৯ সালে জনৈক হিন্দু সরকারি উকিলকে গুলী করে হত্যা করা হয়। ১৯১০ সালে ডিএসপি শামসুল আলমকে হত্যা করা হয়। বোমাবাজির ঘটনা তো নিত্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হিন্দু দেবতাদের নামে এসব হত্যাকান্ড উৎসর্গীকৃত হতো। এছাড়া প্রশিক্ষিত যুবক বাহিনী ব্যাপক দস্যুবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ে। হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণের উদাত্ত আহবান সম্বলিত সাহিত্য ও প্রচার পুস্তিকাসমূহ বিতরণ করা হতো মহোৎসাহে। ‘স্বদেশী’ আন্দোলনের জন্য শপথ গ্রহণ করান হতো কালী মন্দির প্রাঙ্গণে।
১৯০৮ সালের ৩০ মে কলকাতার ‘যুগ্মান্তর’ পত্রিকা হিন্দুদের এ সকল কর্মকান্ডকে সমর্থন করে চরম উস্কানিমূলক এক নিবন্ধে উল্লেখ করে : ‘‘…. মা জননী পিপাসার্ত হয়ে নিজ সন্তানদেরকে জিজ্ঞেস করছে, একমাত্র কোন বস্তু তার পিপাসা নিবারণ করতে পারে। মানুষের রক্ত এবং ছিন্ন মস্তক ব্যতীত অন্য কিছুই তাকে শান্ত করতে পারে না…’’।
মুসলিম বিদ্বেষী প্রচার এতদূর গড়ালো যে, জাতীয়তাবাদী হিন্দুমহল থেকে এমন ঘোষণাও শোনা যেত যে, স্পেন থেকে কয়েক শতাব্দীর পূর্বে যেমন মুসলমানদেরকে নির্মূল করা হয়েছিল, তেমনি ভারত থেকেও তাদের নির্মূল করা হবে। এসব সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বৃটিশ সরকার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তাদের আন্দোলন ক্রমশ স্তিমিত হতে থাকে। কিন্তু ইংরেজদের সেই বিখ্যাত ‘‘ভাগ কর- শাসন কর’’ নীতির কারণেই হোক কিংবা হীনবল মুসলমানদের স্বার্থে অধিকতর শক্তিশালী পুরনো মিত্র হিন্দুদের চটিয়ে কোন বিপদ ডেকে আনার ভয়েই হোক ইংরেজরা রণেভঙ্গ দেয়।
১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান উপলক্ষে দিল্লীর দরবার থেকে সম্রাট পঞ্চম জর্জ স্বয়ং বঙ্গবিভাগ রদ ঘোষণা করেন। এ ঘোষণায় গোটা ভারতবর্ষের মুসলমানগণ স্তম্ভিত হয়ে পড়েন।
মুসলমানগণ তাদের ঐতিহ্য, তাহজীব-তামাদ্দুন রক্ষার ব্যাপারে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। তারা এ ঘোষণাকে তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার শামিল বলে আখ্যায়িত করেন। অপরদিকে হিন্দুগণ বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোণায় আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়ে। বৃটিশ সম্রাট বাংলায় এলে তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে রাজার প্রতি তথা
বৃটিশ গোলামির প্রতি পুনরায় তাদের অদম্য আনুগত্য প্রদর্শন করে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত বৃটিশ ভক্তিতে গদগদ হয়ে পঞ্চম জর্জের বন্দনায় রচনা করলেন : ‘‘জনগণমনঅধিনায়ক-জয় হে ভারত ভাগ্যবিধাতা’’ নামক বিখ্যাত গানটি। কোন কোন হিন্দু সংবাদপত্র এতদূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে প্রস্তাব করে যে, হিন্দু মন্দিরে বৃটিশ সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীর মূর্তি স্থাপন করা যেতে পারে!!
১৯১১ সালে যখন বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয় তখনও কিন্তু বাংলাকে ভাগ করা হয়। হিন্দুপ্রধান বিহার ও উড়িষ্যাকে তখন বাংলা থেকে পৃথক করা হয়। আসাম ও কলকাতা শোষণের আওতা থেকে বেরিয়ে যায়। ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত হয়। এ সমস্ত কিছুই বর্ণ হিন্দুরা বিনা ওজর-আপত্তিতে মেনে নেয়। এতেই তাদের মতলব বুঝতে কারও অসুবিধা হবার কথা নয়। এখানে আরও লক্ষণীয় যে, বঙ্গভঙ্গ রদের পর মুসলমানদের ক্ষোভ প্রশমিত করতে বড়লাট হার্ডিঞ্জ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিলে হিন্দু নেতৃবৃন্দ তার বিরুদ্ধেও মাঠে নামে এবং এটাকে তারা ‘অভ্যন্তরীণ বঙ্গবিভাগ’ বলে আখ্যায়িত করে।
বিষয়: বিবিধ
১২৯০ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন