যে ইতিহাসে রয় ইতিহাসের দায় (শেষ পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন এস এম আবু নাছের ০৮ নভেম্বর, ২০১৪, ০১:২৪:০৮ দুপুর
পূর্বের পর্ব পড়ুন এখান থেকে- যে ইতিহাসে রয় ইতিহাসের দায় (দ্বিতীয় পর্ব)
শুয়ে শুয়ে স্বাধীন ভাবতে থাকে। কেমন হবে শিউলীকে বিয়ে করলে? আমায় কিভাবে নেবে ও? ইত্যাদি ইত্যাদি। এর আগে অনেকবারই সে শিউলীকে দেখেছে। তবে তা ছোটবেলায়। সাহেব আলী ও আসাদ সাহেব ভালো বন্ধু হওয়ায় দুই পরিবারের সখ্যতাও ছিল মোটামুটি। তাছাড়াও ছোটবেলায় শিউলী, জরিনা, আছিয়া, মাহতাব, ফারুক ও স্বাধীন সবাই বেশ ভালো বন্ধু ছিল সবার। একসাথে লুকোচুড়ি, গোল্লাছুট অনেক খেলেছে। আর পরে মায়ের কাছে অনেকবারই শুনেছে শিউলীর ধার্মিকতার কথা, প্রতিভার কথা, ঘরকন্যা বা রান্নাবাড়িতেও তার ভালই হাত আছে। নিজের সাথে নিজের কিছুটা বুঝাপরা সেরে নেয়।
আচ্ছা? আমি নিজেই কি বিয়ে করার জন্য তৈরি? একটি বিয়ে তো ফেলনা কোন সম্পর্ক নয়। এ এক বন্ধুত্ব। নিজেকে অন্যের সাথে ভাগ করে নেওয়ার এক দলীল। আমার আমি থেকে আমাদের আমরাতে হয়ে যাওয়ায় বিয়ে। সুখে দুঃখে পাশাপাশি থেকে জান্নাতে যাওয়ার পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য এ যে এক অভাবনীয় চুক্তিপত্র। আমি কি পারবো? ভাবতে ভাবতেই চোখ দুট বুজে আসে স্বাধীনের।
দুইদিন পরে বিকেল বেলা শরিফা চাচী আবার খোঁজ নিতে এলো। জমিরন ও বৌমা। বাড়িতে আছো?
জমিরন কেবল আসরের সালাত আদায় করে বের হয়েছে ঘর থেকে। শরিফা চাচীর ডাক শুনে খুলে দিল দরজা।
আসসালামুয়ালাইকুম। কেমন আছো চাচী? বারান্দায় এসে একটা টুল এগিয়ে দিয়ে বললো, বস চাচী। আর নিজে পিড়ি টেনে নিয়ে বসলো জমিরন।
হ্যাঁ, মা। আছি ভালোই। তা তোমরা কেমন আছো? তোমার স্বাধীনের সাথে কথা কি কিছু হয়েছে?
হ্যাঁ, চাচী। ওর সাথে কথা যত্টুকু বলেছি তাতে অমত আছে বলে মনে হয়নি। বরং সম্মতিই বুঝতে পেরেছি। এখন বাঁকী কাজ আমাদের।
গতরাতে আমিও শিউলীর কাছে শুনেছি এ ব্যাপারে। ওকে তো একটু খুশি খুশিই মনে হল। এখন আমি আসাদের সাথে কথা বলে দিন তারিখের ব্যাপারে আলোচনা করবো। তুমি একটু সুযোগ পেলে এসো। আজ উঠি বৌমা। তুমি আইস সময় করে ঐদিকে।
আচ্ছা চাচী। দরজা বন্ধ করে জমিরন এসে আবার বারান্দায় বসে। কতদিনের পুরোনো সবকথা আজ তার মাথায় এসে যেন ভীঁড় করছে। স্বাধীনের বাবা বেঁচে থাকলে, নিজেই সবকিছু করতো। কত আনন্দ করতো কে জানে? আকাশের দিকে তাকিয়ে যেন কিছু খোঁজার চেষ্টা করে। একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে ভিতর থেকে।
কয়েকদিনের মাঝেই কথাবার্তা পাকাপকি হয়ে গেলো। বিয়েও সম্পন্ন হল। এখন জমিরন বিবির পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন জন। শিউলী আসার পর থেকে টুকটাক ঘরকন্যার কাজে সে সাহায্য করে মাকে। এটা সেটা এগিয়ে দেয়। এখন ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে আর জমিরন বিবি কুরআন শেখায়না। সেই দায়িত্ব যত্নের সাথে নিয়ে নিয়েছে শিউলী। অবসর সময়ে দুই শাশুড়ি আর বৌ মিলে জমিয়ে গল্প করে। জমিরন শোনায় তার দুঃখের ইতিহাস, সংগ্রামের ইতিহাস। কথার মাঝে শিখিয়ে দেয় জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার ছোটখাট পাঠগুলো।
সুখের সংসার স্বাধীন-শিউলীর। দু’বছর হয়ে গেলো দেখতে দেখতেই। দুজন যেন মিলেমিশে একে অপরের বন্ধু হয়ে গিয়েছে। সংসারের সব চিন্তা ভাবনা এখন তারা দুজনেই মাথায় তুলে নিয়েছে। শাশুড়িকে ফুরসত দিয়ে সব কাজ কর্মের ভার এখন শিউলীর। আর স্বাধীনও সংসারের সমস্যা আর অভাব অনটনের ব্যাপারেও শেয়ার করার পেয়েছে এক দারুন বন্ধু। মাকে আর সবকিছু নিয়ে চিন্তার ভার দেয়না স্বাধীন। বরং চেষ্টা করে মায়ের অগোচরেই সমস্যা বা ঘাটতিগুলো পুষিয়ে নেবার।
সময়ের স্রোত বেয়ে আল্লাহর অপার করুনায় শিউলীর কোল জুড়ে আসে এক ফুটফুটে সন্তান। সংসারে যুক্ত হয় নতুন সদস্য, নতুন অতিথি। ছেলে হয়েছে স্বাধীনের। সারা পাড়া মিষ্টি খাওয়ায়। আজ মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদেরও মিষ্টি বিতরণ করছে। কচি কাচা বাচ্চাগুলো যখন মিষ্টি মুখে দিয়ে গাল ফুলিয়ে দৌড়াচ্ছে তখন দুচোখ ভরে দেখে স্বাধীন। সে ও স্বপ্ন দেখে তার ছেলেও একদিন এভাবেই জুব্বা, টুপি পড়ে দৌড়াঝাঁপ করবে। চোখ যেন আনন্দে জলজল করে ওঠে। ঠোঁটের কোনেও খেলে যায় আনন্দের ঝিলিক। সপ্তম দিনে আকীকা করে ছেলের নাম রাখে আব্দুল্লাহ।
স্বাধীনের শ্বশুর বাড়ি ও তার বাড়িতে সবাই আব্দুল্লাহকে নিয়ে মহাব্যস্ত, মহাখুশি। সবচাইতে খুশি জমিরন বিবি। তার সময় কাটানোর নতুন সঙ্গী এসেছে। ছেলে আর ছেলের বউ ছাপিয়ে তার ভালোবাসা আর আদরের সবটুকু জুড়ে এখন নাতী আব্দুল্লাহ। তাকে খাওয়ানো, গোসল করানো সবকিছু জরিমন করে পরম মমতায়। গায়ে তেল মাখিয়ে দিতে দিতে গল্প করতে থাকে ঐটুকু বাচ্চার সাথে যেন সে সব বুঝতে পারছে। তার আনন্দে আনন্দিত হচ্ছে পুলকিত আর দুঃখে হচ্ছে সমব্যথী। দিনগুলো এগোতে থাকে সুন্দর এক আবর্তে।
সময়টা তখন ১৯৯০। দেশে শুরু হয়েছে স্বৈরশাসক পতনের আন্দোলন। তার উত্তাপ ক্রমশঃ ছড়িয়ে যাচ্ছে দেশব্যাপী। শহরে, গঞ্জে সবখানে জনতার গর্জন- স্বৈরাচার তুই কবে যাবি? স্বাধীন খুব সকালে উঠে শহরে গেছে মাদ্রাসার কাজে। জমিরন বিবি উঠোনে নাতিকে নিয়ে লুকোচুরি খেলছে। বউ আছে রান্নাঘরে। দুপুরের রান্না তুলে দিয়েছে।
হঠাৎই গ্রামের পূব পাড়ায় কেমন যেন সোরগোল বেড়ে গেল। কি এক আহাজারি যেন জমিরনের কানে এসে বিঁধছে। আচমকা ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। যেন সুরতালে থাকা কোন একাতারার তারটি ছিঁড়ে গেল।
খানিক বাদে উঠোনের ওপাশে দরজা দিয়ে ঢুকছে সাদা কাপড়ে জড়ানো একটি লাশ। কার লাশ? স্বাধীনের। শহরে স্বৈরপতনের মিছিলের ভীড়ে পড়ে সেনাবাহিনীর গুলিতে মারা গেছে স্বাধীন। সারা বাড়ীতে শুধু কান্না আর কান্না। মাঝে মধ্যেই শিউলী সঙ্গা হারিয়ে ফেলছে। আর বুড়ীতো বুকের ধন হারিয়ে পাগলপ্রায়। কেঁদে কেঁদে চোখের জল শুকিয়ে গেছে। মুখে শুধু আহাজারি। অবুঝ আব্দুল্লাহ কিছু বোঝার আগেই পিতৃহারা। সারা বাড়ী জুড়ে শোকের মূহ্যমান ছায়া। আব্দুল্লাহর ছুটোছুটি আর কান্নায় মাঝে মাঝে শুধু তার ছেদ হয়।
সন্তানহারা এক মায়ের, স্বামীহারা এক স্ত্রীর যক্ষের ধন রইল শুধু আব্দুল্লাহ। স্বাধীন যাওয়ার পরে হালের গরু দুটি বেচে দিয়ে শিউলী দুটো গাভী আর একটা সেলাই মেশিন কিনেছে। বাবা কিছু টাকা দিয়েছে যা দিয়ে এবারে জমিতে ফসল বুনেছে। আর মাদ্রাসা থেকে যা পেত সেগুলো সে সঞ্চয় করে রেখেছে ভবিষ্যতের জন্য। একা হাতে পুরো সংসারের হাল ধরেছে। বুকের মানিক আব্দুল্লাহ বড় হচ্ছে। লেখাপড়া শিখে বড় বড় ডিগ্রী নিয়ে একদিন মায়ের, দাদীর দুঃখ ঘোচাবে; দেশের গর্ব হবে। পড়াশুনায়ও বেশ ভাল সে। হিফজ শেষ করেই তাকে ভালো একটি আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেয়। কষ্ট করে হলেও পড়াশুনার খরচ একভাবে যোগায় শিউলী। আব্দুল্লাহর নানা মারা গিয়েছে গতবছর। বাবা বেঁচে থাকতে কখনও কখনও বাবার কাছে থেকেও সাহায্য পেয়েছে শিউলী। এখন ঐ বাড়ির অবস্থাও খুব ভালো নয়। সব দায়িত্ব পড়েছে শিউলীর উপর। সবদিক সামলিয়ে পড়াশুনার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে শিউলীকে। কিন্তু তা হলেও বুকের ধনকে সে করবেই উচ্চশিক্ষিত। ভালো মানুষ হয়ে, সে যেন দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে এই তার ব্রত।
সারাদিন সেলাই মেশিনে সেলাই করে, রান্না করে, আবার মাঝে মাঝে জমি বর্গা ওয়ালাদের সাথে ফসলের ব্যাপারেও আলোচনা করে। ব্যস্ততার মাঝে দিয়ে কাটতে থাকে দিন। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় গিয়ে তাকে সকল শূণ্যতা যেন ঘিরে ধরে। তার স্বামীর কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে তার ছেলের কথা। বাইরে পড়তে রেখে এসেছে। কী খাচ্ছে? কেমন আছে? একজনের বাড়িতে একটা লজিং ম্যানেজ করে দিয়েছে শিঊলীর এক দূর সম্পর্কের চাচা। সেখানে থেকেই পড়াশুনা চালিয়ে নিচ্ছে আব্দুলাহ। কিন্তু কতদিনই বা এভাবে চলবে? আর অও খরচ বেড়ে গেলে কীভাবে ব্যবস্থা হবে? এসব ভাবতে ভাবতে ঘুম আর আসেনা শিউলীর।
মাঝে মাঝে ভাবে পড়াশুনা না করিয়ে বাসায় এনে একটা দোকান করিয়ে দিবে ছেলেকে। পরক্ষণেই নিজেকে বলে, এ আমি কী ভাবছি? আমার ছেলেকে বড় করে তুলতেই হবে যেন সে আমার নয়, দেশের সম্পদ হয়। বাবার স্বপ্ন পূরণ হয়। এক্সময় চোখ দুটো বুজে আসে। ঘুমিয়ে যায় সে। পরদিন সকাল থেকে আবার শুরু হয় তার জীবন সংগ্রাম।
বিশ বছর পর-
আব্দুল্লাহর বাবা, আরও কত কারো বাবা, আর প্রিয়জনের রক্তের স্রোতে স্বৈরশাসক ভেসে গিয়ে দেশে এখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীনতা আর গণতন্ত্র- দুইয়ে মিলে চলছে বাংলাদেশ। আব্দুল্লাহ এখন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া। হলে থাকে। কয়েকটি বিষয়ে চান্স পেয়েও ও ফাইন্যান্সিং পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইসলামিক ফাইন্যান্সের উপরে তার আগ্রহ একটু বেশি। টিউশনী আর পড়াশুনা- এই নিয়েই কেটে যায় ব্যস্ত সময়। রেজাল্টও ভাল ওর। প্রথম বর্ষে প্রথম শ্রেণী পেয়েছে। ধর্মীয় মূল্যবোধের মাঝে বেড়ে উঠা আব্দুল্লাহ আর দশটা ছেলের মত নয়। ইসলামকে সে মেনে চলার চেষ্টা করে তার জীবন দিয়ে। কথায়, কাজে তার বিনম্র ছাপ আর সুন্নাহের অনুসরন বেশ অনুসরনীয়। নানী কষ্ট করে টাকা জমিয়ে একটা নোকিয়া ১১০০ মোবাইল ফোণ কিনে দিয়েছে আব্দুল্লাহকে। প্রতিদিনই মসজিদের পাশে স্বাধীনের ছাত্র আশরাফের মোবাইলের দোকান থেকে কথা হয় আব্দুল্লাহর সাথে। আশরাফ, আব্দুল্লাহর বন্ধু হয়। তাই ফোন দিলে সে নিজেও ফোন নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ি আসে। চাচী চাচী, আব্দুল্লাহ ফোন করছে। নেন কথা কন। মায়ের সাথে, দাদী-নানীর সাথে কথা বলে, খোজখবর নেয়।
গতকাল ফোনে কথা বলার সময়েই আব্দুল্লাহর কণ্ঠটা একটু ভারী ভারী মনে হওয়াতে মা শিউলী জিজ্ঞেস করেছিল-
কিরে বাবা, তোর কী মন খারাপ? কোন সমস্যা হয়েছে কী? ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করছিস ও?
হ্যাঁ, মা সবই ঠিক আছে। আলহামদুলিল্লাহ। তবে কয়েকদিন থেকে ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি ভাল মনে হচ্ছেনা। ইসলামী লেবাসকে, ইসলামী আমলকে একটি বিশেষ দলের সাথে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। সবাইকে চার্জ করা হচ্ছে কমবেশি।
শিউলী গ্রামে থেকে মানুষ, দেশের খবর তেমন জানেওনা। রেডিও, টিভিও বাড়িতে নেই। তাই কোন দল কী দল এসবের সে তেমন কিছুই বোঝেনা। শুধু বলে, দেখ, বাবা, তুই আমার বুকের ধন, তুই কোন ঝামেলায় যাবিনা। কারও সাথে গন্ডগোল করবিনা। কেউ ক্টু কথা বললেও প্রতিবাদ করবিনা। ভালোভাবে পড়াশুনাটা শেষ করতে হবে।
আব্দুল্লাহ মাকে আশ্বস্ত করে বলেছিল- না মা, আমি আর কী অরবো? দুই দিন হল প্রায় আমি ঘর থেকেই বের হইনি। তোমার দুয়া আমার সাথে আছে না...। ভালো থেকো মা। আসসালামুয়ালাইকুম। বলে ফোনটা রেখে দিয়েছিল আব্দুল্লাহ।
রাতে ঘুমোতে এসে আজ শিউলীর বারবার সেই কথাগুলোই মনে পড়ছে। ছেলেকে দেখতে খুব ইচ্ছা করছে। তিন মাস হয়ে গেল প্রায় আব্দুল্লাহ বাসায় আসেন্তে পারেনি। কী সব পরীক্ষা ছিল। মাঝে দুই দিনের ছুটি পেয়েছে কিন্তু এতগুলো টাকা খরচ করে আর বাসায় আসা হয়ে ওঠেনি। যাক, কাল কথা হলেই ওকে একবার ঘুরে যেতে বলবো বাড়ি থেকে।
পরেরদিন সকালে জুহরের নামাজ পড়ে কেবল মসজিদ থেকে রুমের দিকে এগোচ্ছে আব্দুল্লাহ। এরই মাঝে হুট করেই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস উত্তপ্ত। বিদ্যার্জনের পবিত্র বিদ্যাপিঠ এখন দলগুলোর রাজনীতি খেলার মাঠ। চলছে অস্ত্রের মহড়া, যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়, ছাত্র রাজনীতির নগ্ন রাজনীতি চর্চা- মিছিল,মিটিং, হল দখল, ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার ইত্যাদি ইত্যাদি। কবে থামবে কেউ জানে না। যারা জিতবে তারাই টিকে থাকবে এ ময়দানে। মেধা এখানে আড়ষ্ট, বিবেক এখানে পদদলিত; ইসলামের চর্চা এখন ভূলুণ্ঠিত। ছাত্র রাজনীতির হাতিয়ার এখন বিবেক-বিদ্যা, কলম নয়; অস্ত্র। যার বলি হয় শত নির্দোষ প্রাণ ও আব্দুল্লাহর মত নিরপরাধ ছেলে।
খেল তোমরা, খেলার মাঠে। মাঠের বাইরে কেন যাবে? আব্দুল্লাহ কেন তোমাদের এ বীভৎস খেলার শিকার হবে? অকালে ঝড়ে যাবে?
দুপুর গড়িয়ে বিকেল আসি আসি। সূর্যটা পশ্চিমে ঢলে পড়ছে। বউ-শ্বাশুড়ী দুপুরের খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। মায়ের মন প্রতীক্ষায় আছে আব্দুল্লাহর ফোনের, আজ ফোন দিলে ওকে বাড়ি আসার কথা বলবে। কতদিন দেখেনি ছেলেকে। হঠাৎ বাড়ীর গেটে গাড়ীর শব্দে খেয়াল ভাঙ্গে। উঠোন ভর্তি মানুষ; নিস্তব্ধ। কেন? আব্দুল্লাহ এসেছে মায়ের কোলে, বাড়িতে; মৃত্যুর কোলে মাথা রেখে।
বড় বড় ডিগ্রী আর নেয়া হলোনা ওর। ছেলেকে দেখে মা সঙ্গাহীন। পাড়া-প্রতিবেশী আর বন্ধু-বান্ধবের কান্না- রোনাজারিতে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে গেছে এখানে।
বৃদ্ধা জমিরন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়, কিন্তু কাঁদে না। কত কাঁদবে বুড়ি? ছোট্ট দু’চোখে কতইবা জল থাকতে পারে? এক জীবনে লাশের পর লাশ- আর কত ইতিহাসের সাক্ষী হবে বুড়ি? একে একে স্বামী, সন্তান, নাতি- সবাইকে কেড়ে নিয়েছে দেশ। হৃদয়ের ক্ষত তার বারংবার ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে।
স্বামীর রক্তে স্বাধীনতা আর সন্তানের রক্তে গণতন্ত্র কিন্তু নাতি আব্দুল্লাহর রক্তে কী পেল দেশ? আব্দুল্লাহর রক্তমাখা শার্টটি বুকে জড়িয়ে হয়ত এর উত্তরই খুঁজে ফেরে জমিরন বিবি। আদৌ কি দেশ-জাতি এর উত্তর দিতে পারবে?
স্বাধীনতার স্বাদ আজ বিষাদে পরিণত হতে চলেছে। এমনি হাজারো জমিরন বিবি, শিউলী আক্তারের জীবনগাঁথায় কালে কালে যে ইতিহাসের জন্ম হয়, তার খবর কেউ কি রাখে? হয়ত কোথাও কখনও লেখা হয়নি, হবেও না সে ইতিহাস। ইতিহাস রয়ে যায় ইতিহাসের দায় হয়ে। আর সাক্ষী হয়ে রয় শুধু প্রিয়জন হারানো হৃদয়গুলো।
বিঃদ্রঃ গল্পের প্রতিটি চরিত্র এবং ঘটনাপ্রবাহ কাল্পনিক।
বিষয়: বিবিধ
২০৭৮ বার পঠিত, ১৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্যের ভাষা ক্ষীণ থেকে ক্ষীন হয়ে অস্পষ্ট কয়েকটা শব্দই বেরুচ্ছে শুধু......এমনই কী স্বাধীনতা আর গনতন্ত্রের প্রতিদান!!!
ভালো লাগলো কথাগুলো। একটি স্বাধীনতার সংগ্রামে লক্ষ লক্ষ প্রাণ যায়। কারোরই অবদান অস্বীকার করবার নয় তবুও সবাইকে একসাথে স্মরণ করা যায় না।
- মনে হয় না পারবে।
তিনটি পর্বই ভালো লাগল। খুব ভালো লিখেন আপনি।
জাজাকাল্লাহু খাইর। ^^
স্বামীর রক্তে স্বাধীনতা আর সন্তানের রক্তে গণতন্ত্র কিন্তু নাতি আব্দুল্লাহর রক্তে কী পেল দেশ? আব্দুল্লাহর রক্তমাখা শার্টটি বুকে জড়িয়ে হয়ত এর উত্তরই খুঁজে ফেরে জমিরন বিবি। আদৌ কি দেশ-জাতি এর উত্তর দিতে পারবে?
না পারবে না ..............।
ধন্যবাদ ভাইয়া ।
প্রতিটি পর্বে সাথে থেকে মূল্যবান মতামত দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
বানভাসী কৃষকের মত জনতা বার বার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, বার বারই অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশ ভেঙ্গে দিয়ে যার তাদের স্বপ্ন। ওরা চায় শুধু একটা সুখের নীড়, পরিবারের ভালোবাসায় একটু ভাল থাকা। এই দেশ এটুকুও দিতে পারেনি তাদের। আর কতকাল চলবে এমন?
তবু আমরা স্বপ্ন দেখে যাই। হয়ত এর সমাধান কোনদিন হবেনা। তবু আশা নিয়েই মানুষ বাঁচে।
চমৎকার উপাখ্যান্টির জন্য মনের গভীর থেকে ধন্যবাদ। আপনার আঁকা মানুষগুলোর সহজতা ভাল লাগল। সবাই এমন হলে হয়ত এই দেশটা এমন হতনা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে কোন এক স্বাধীনতা দিবসের দেয়ালিকায় প্রকাশের জন্য ছোট্ট করে লিখেছিলাম গল্পটা। সেরা লেখা হিসেবে মনোনীতও হয়েছিল। তাই এখানে আরও কিছুটা বড় করে সবার সাথে শেয়ার করেছি।
জাযাকিল্লাহু খাইর আপু। দোয়া করবেন, আমরা যারা এখনও এই দেশে থেকে এর একটি শান্ত পরিবেশ দেখতে চাই আল্লাহ যেন আমাদের আশা পূরণ করেন। মাঝে মাঝে সত্যিই বড্ড হতাশ হয়ে যাই কিন্তু তাতে তো লাভ নেই। ভবিষ্যতের কোন সুখময় অরুণ রাঙ্গা প্রভাতের সূচনা যেন হয় আমাদের হাত ধরেই সেই দোয়ার ফরিয়াদ রইলো। মা'আসসালামাহ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন