যে ইতিহাসে রয় ইতিহাসের দায় (দ্বিতীয় পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন এস এম আবু নাছের ০৭ নভেম্বর, ২০১৪, ০৪:০৩:৫২ বিকাল
প্রথম পর্ব পড়ুন এখান থেকে-(যে ইতিহাসে রয় ইতিহাসের দায় (প্রথম পর্ব))
জমিরন বিবি এখন আর ঝিয়ের কাজ করেনা। সারাদিন বাড়িতেই থাকে আর পাড়ার ছোট ছোট মেয়েদের ডেকে কুরআন শিক্ষা দেয়। শোনায় জীবনের উঠতি পড়তির গল্পগুলো শিশুতোষ আকারে। ছোট মেয়েরা শুধু নয়, অনেকে মেয়েরাই তার কাছে আসে কুরআন শিখতে। কেউবা আসে আমল সংক্রান্ত কোন বিষয় নিয়ে যেন সে ছেলের কাছে থেকে একটু জেনে জানায় তাদের। আগ্রহভরে জমিরন বিবি সকলের আবদার পূরণ করে। স্বর্গীয় এক প্রশান্তিতে তার মন ভরে উঠে।
প্রতিদিনের মত আজ সকালেও কচি কাচার মেলা বসেছে জমিরন বিবির আঙ্গিনায়। কেউ পড়ছে আলিফ জবর আ, কেউবা, আলিফ লাম যবর আল- লাম যবর লা- হা পেশ হু= আল্লাহু। এভাবে ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে বানান করে পড়ার চেষ্টা করছে। আরও কয়েকজন আছে যারা গত রমাদ্বানেই কুরআন পড়া ধরেছে। ৫-৭ পারা করে এগিয়েও গিয়েছে। মেয়েরা পড়াশুনা করছে আর জমিরন বিবি বিভিন্নজনকে বিভিন্নভাবে শিখিয়ে যাচ্ছেন। এমন সময়ে বৃদ্ধা শরিফা চাচী এসে বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতেই ডাকছে-
জমিরন, ও জমিরন। তা বাড়ি আছো?
হ্যাঁ, চাচী। আসসালামুয়ালাইকুম। এসো, বস।
বৃদ্ধা, মসজিদের ইমাম সাহেবের মা। যেকোন বিপদ-আপদে সে সবসময়েই পাশে থেকেছে জমিরনের। সব হারিয়ে যখন চোখে শর্ষে ফুল দেখছিল জমিরন তখন এই মহিলা ও তার পরিবার তাকে অভিভাবকের মত পরামর্শ দিয়ে আপন করে নিয়েছিল।
ওয়া আলাইকুম আসসালাম। তা তোমার স্বাধীন কই?
স্বাধীন? ও তো সকালেই মাদ্রাসায় চলে গিয়েছে।
তোমার সাথে একটা কথা আছিলো মা। তোমার এই পিচ্চি পাচ্চা গুলোকে পড়ানো শেষ হবে কখন?
এইতো চাচী, এখনই ছেড়ে দিব, বলেই জমিরন সবাইকে পরের দিন আসার কথা বলে ছেড়ে দিল। বাচ্চারাও হৈ হুল্লোড় করতে করতে চলে গেল।
এবার বল চাচী? কি বলবে? তুমিতো এদিকে আর তেমন আসইনা। কয়দিন আমারও ওদিকে যাওয়া হয়ে ঊঠছেনা। ভাই, ভাবী, শিউলী সবাই কেমন আছে?
আছে, সবাই ভালোই আছে। আলহামদুলিল্লাহ।
তোমাদের দেখেই শান্তি লাগে মা। কী কষ্টটাই না করলে জীবনে। আল্লাহ মুখ তুলে চেয়েছেন। দেখতে দেখতে স্বাধীন বড় হয়ে গেলো। মাদ্রাসায় চাকুরীটাও হয়েছে আর ক্ষেত ফসলগুলো দিয়ে স্বচ্ছলতাও এসেছে। খুব শান্তি লাগে মা এসব ভাবলে। তা বলি কী? মায়ে-ছেলেতে আর কতদিন? নতুন কাউকে তো দরকার এই বাড়িতে। নাতীটা বড় হয়ে গিয়েছে, তোমারও বয়স হয়ে যাচ্ছে। সারাদিন একা একা থাকো। বাড়িতে একটা বউ নিয়ে এসো। ছেলের মত করে ছেলের বউকেও গড়ে তোলনিজের চেষ্টায়। নিজের শরীর ভালো থাকতে থাকতেই ওদের মত করে ওদের গুছিয়ে দাও।
এবারে জমিরন একটু মুচকি হেসে বলে- তা চাচী, দেখ তোমার নাতীর জন্য তুমিই একটা ভালো মেয়ে খুঁজে দাওনা। জানইতো আমার স্বাধীন কেমন ছেলে। ওর জন্য ধার্মিক মেয়ে হলেই ভালো হয়। আমার আর ওর ইচ্ছা যে কোন হাফিজা মেয়ে বিয়ে করার। যাহোক, তোমরা একটু দেখো, তাক্বদীরে যা আছে তাই হবে।
হুম, ঠিক আছে। আমি দেখবো। তা জমিরন আমাগো শিউলী মানে আমার নাতনীকে তোমার কেমন লাগে? আমারতো ইচ্ছা যদি স্বাধীনের আর তোমার আপত্তি না থাকে তাহলে শিউলীকে তোমার বাড়িতে বউ করে পাঠাবো। কী বল তুমি?
নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা জমিরন। আসাদ ভাইয়ের মেয়ে! মানে ইমাম সাহেবের মেয়ে! মাশাআল্লাহ দেখতে সুন্দরী, ধার্মিকতায়ও এ পাড়ায় জুড়ি মেলা ভার। বাবার কাছে থেকেই দ্বীনের ছবক নিয়েছে বেশ ভালোভাবেই। সে হবে আমার স্বাধীনের বউ? মনে মনে আল্লাহর কাছে কিছুটা শুকরিয়া আদায় করলো। ভাবনার খেয়া নিয়ে আবার হারিয়ে গেল তার স্বামীর স্মৃতিতে।
শরিফা চাচীর ডাকে একটু ধাতস্থ হয়ে নিল আবার। যেন সম্বিত ফিরে পেল। কী কও বউ। তোমার কোন আপত্তি আছে?
না চাচী, আমার আর কি আপত্তি। শিউলী বেশ ভালো মেয়ে। কিন্তু আমি বলছিলাম যে, আসাদ ভাই আর সাজেদা ভাবী কি আমার ছেলের সাথে............? আর শিউলীর ব্যাপারটাও তো জানিনা। কে পছন্দ করবে মায়ের আঁচল ধরে বেড়ে ওঠা ছেলেটাকে?
ওসব তুমি একদম চিন্তা করোনা। গতরাতে আসাদ, বৌমা আর আমি কথা বলেই আজ তোমার কাছে প্রস্তাবটা নিয়ে আসলাম। এখন তুমি ভেবে দেখো আর স্বাধীন আসলে ওর মতামতটাও জেনে নিও। ক্যামন? আজ তাহলে আসি রে মা। আবার আসব ক্ষণ।
সন্ধ্যার পরে স্বাধীন বাড়ির দরজায় এসেই সালাম দেয় মাকে। আসসালামুয়ালাইকুম, আম্মা, আম্মা।
তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিতে এগিয়ে আসে জমিরন। মাথায় শুধু একটা চিন্তায় ঘুরপাক করছে। স্বাধীনকে আজ বিয়ের কথাটা বলতে হবে। নিজের মাঝে কথাগুলো গুছিয়ে নেয়। দরজা খু্লে দিয়ে ছেলের সাথে দুই একটা কথা বলে চলে যায় নিজের ঘরে।
স্বাধীন হাত পা ধুয়ে আসে। দাওয়ায় বসে মা-ছেলে খাওয়া শেষ করে। খাওয়া শেষে সবকিছু গুছিয়ে রাখে জমিরন। এরপরে নিজের ঘরে চলে যায়। প্রতিদিনের মত সারাদিনের খোঁজখবর নেওয়া আর দেওয়ার জন্য মায়ের ঘরে বসে থাকে স্বাধীন। খাওয়া দাওয়া সেরে মা আর ছেলের ছোটখাটো একটা বৈঠক প্রতি রাতেই হয়। সারাদিন কোথায় কি হল? মাদ্রাসার খবরাখবর জানায় মাকে। আবার পরেরদিন কোথাও যেতে হলে তাও মাকে জানিয়ে রাখে গল্পের মাঝে দিয়েই। টুকটাক আলাপ করতে করতে জমিরন বিবি বলে-
বাবা, তোর সাথে আমার একটু কথা ছিল।
সাবলীলভাবেই স্বাধীন জবাব দেয়- হ্যাঁ, মা বল? কী বলবে?
না আসলে কীভাবে তোকে বলবো তা ঠিক বুঝছিনা। দেখ , বাবা, ছোটবেলা থেকে তিলতিল করে তোকে মানুষ করেছি। চেষ্টা করেছি কখনও বাবা আর মায়ের ভূমিকায় একসাথেও থাকতে। কতটুকু পেরেছি জানিনা। তবে আল্লাহর দরবারে শোকর এতটুকু যে আল্লাহ আমার ছেলেকে অমানুষ করেননি। অন্তত একজন মা হিসেবে এটুকু শান্তি আমি পাই। কিন্তু তারপরেও......
কিন্তু তারপরেও? কী মা? থেমে গেলে কেন? কী বলবে মা, যার জন্য এভাবে কথা শুরু করছো? তুমি আমার জীবনে কতখানি আর আমি তোমার জীবনে কতখানি জায়গা জুড়ে আছি তা আর নতুন করে বলতে হবে? বলেই মায়ের পা দুটোতে হাত বুলাতে বুলাতে আরও কাছে আসে স্বাধীন।
জমিরন আবারও বলতে শুরু করে, বাবা জীবনে মানুষের অনেকগুলো ধাপ আছে। বিভিন্ন ধাপের পূর্ণতা প্রাপ্তির জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিভিন্নভাবে মানুষকে সাহায্য করেন। জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক যেমন প্রয়োজন হয় চলার পথে, তেমনি অভিভাবক, বন্ধু, আত্মীয় সবকিছুরই দরকার আছে। এতদিন তুই ছোট ছিলি, তোর সকল কিছুর দায়িত্ব, সব আবদার বা প্রয়োজন আমি পূরণ করে এসেছি সাধ্যমত। আমার বয়স বেড়েছে। তুইও বড় হয়েছিস। এখন নিজের মত করে চলতে শিখতে হবে। আর সেই চলার পথে সার্বক্ষণিক একজন সহচর, একজন বন্ধু জীবনে খুব প্রয়োজন। তাই, বলছিলাম যে, এবার একটা বিয়ে থা কর। অনেকে প্রস্তাব নিয়েও এসেছে।
স্বাধীন সুবোধ বালকের মত চুপচাপ শুনে বলে- যা তোমার ইচ্ছা।
জমিরন বলতে থাকে- আজ শরিফা চাচী এসেছিল। তোর সাথে একটা সম্বন্ধ নিয়ে। আমায় বলেও গিয়েছে। আমি তোর মতামত না জেনে কিছুই বলিনি। ইমাম সাহেবের মেয়ে, মানে তোর আসাদ চাচার মেয়ে শিউলীর কথা নিজে এসে শরিফা চাচী বলে গিয়েছেন। এমনকি চাচী, আসাদ ভাই ও ভাবীর সাথে কথা বলেই আমাকে জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে তুই কি বলিস? যদি শিউলীকে পছন্দ হয় তাহলে আগামীতে কোন দিনক্ষণ ঠিক করে শুভ কাজটা সেরে ফেলবো।
স্বাধীন আর তেমন কিছু বলেনা। অধোবদনে মাকে জানায়, যা তুমি ভাল মনে কর। প্রতিদিনের চাইতে আজ একটু তাড়াতাড়িই বের হয়ে যায় মায়ের গর থেকে। মা, আমি ঘুমোতে গেলাম। কাল সকালে আবার আমায় একটু চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে যেতে হবে। তুমি ঘুমাও। আসসালামুয়ালাইকুম।
পরের পর্ব পড়ুন এখান থেকে- যে ইতিহাসে রয় ইতিহাসের দায় (শেষ পর্ব)
বিষয়: বিবিধ
২১৯১ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মানে চালাতে পারবোনা আর কী। হা হা হা। দুয়ার ফরিয়াদ রইলো।
উপ্রের লাইনে শিউলীর স্থানে জমিরন হবে মনে হয়। তাই না ভাইয়া।
সুন্দর! খুবি ভালো লাগলো। পরের পর্বের অপেক্ষায়.......
দেখুন না কান্ড! আমি তখন আপনার রিপ্লাই দিয়ে আর এডিট না করেই চলে গিয়েছি। স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য আবারও মোবারকবাদ। জাযাকাল্লাহু খায়রান।
শুধু বিয়ের ক্ষেত্রে নয় জীবনের প্রতিটি ক্ষণে প্রকৃত ধর্মপ্রাণ একজন মানুষ যেন আল্লাহর খাস রহমত হয়ে ধরা দেয়!
আপনার লেখার প্রতিটা শব্ধও যেন সমাজের অর্থবহ পরিবর্তনে মানুষকে এগিয়া আসতে বাধ্য করে!
"জীবনে চলার পথে সার্বক্ষণিক একজন সহচর,একজন বন্ধুর খুবই প্রয়োজন!তাই বলছিলাম যে,এখন একটা বিয়ে থা কর...."
এখানেও একজন 'স্ত্রী'শব্ধের পরিবর্তে'সহচর ওবন্ধু' ব্যবহার লেখায় অনন্য মাত্রা দিয়েছে!
শ্রদ্ধেয় এস এম আবু নাছের ভাই! পরিপুর্ণ সুস্হ্যতায় সর্বাংগীন সাফল্য আল্লাহ আপনাকে দান করুন এই দুয়া আমার।অপেক্ষায় রইলাম সুন্দর আগামী পর্বের............
মন্তব্য করতে লগইন করুন