যে ইতিহাসে রয় ইতিহাসের দায় (প্রথম পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন এস এম আবু নাছের ০৬ নভেম্বর, ২০১৪, ০২:২৭:১০ রাত
সূর্যটার ঘুম ভেঙ্গেছে খানিক আগে। পূব দিগন্তের বুক চিরে উঠেছে লাল সূর্য। মনে হয় রক্তের সাগরে ডুব দিয়েছে। তার লালিমা এখনও লেগে আছে ওর শরীরে। বৃদ্ধা জমিরন বিবির ঘুম ভেঙ্গেছে তারও আগে- সেই শেষ রাতে, তাহাজ্জুদের সময়। যখন মোরগগুলো দিনের শুরুর জানান দেয় ডেকে ডেকে; প্রকৃতির অমোঘ নিয়মাধীনে এলার্ম ঘড়ির মত। জমিরন বিবি সেই ওঠে। নামায আদায় করে, খানিক কুরআন পড়ে, ঘর-দোড় ঝাড়– দেয়, মুরগীগুলোকে ছেড়ে দেয় রুটিন মাফিক। তারপর উঠোনের কোনে জমিয়ে রাখা আবর্জনাগুলো ফেলে দিয়ে আসে।
সাহেব আলীর বউ জমিরন বিবি। বিধবা। একাত্তরে স্বামীকে হারিয়েছে। সেই কবে কার কথা। এক রাতে স্বামীসহ জমিরন সবে ঘুমিয়েছে। কাঁচা ঘুম। হঠাৎই বিকট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। দরজায় কারা কড়া নাড়ছে ভূমিকম্পের মত। ছোট্ট মাটির ঘর। জমিরন বিবি দরজা খুলল। স্বামীকে অনেক ভালবাসত সে। বছরখানেক হলো বিয়ে হয়েছিল। বাতির আবছা আলোয় আচমকা মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেল। রাইফেলের বাটের আঘাত। সঙ্গাহীন হয়ে পড়ে রইলো মাটিতে।
জ্ঞান ফিরে দেখে সকাল হয়ে গেছে। মাথায়, শরীরে ছোপ ছোপ রক্ত। ঘরের আসবাব ছন্ন-ছাড়া পড়ে
আছে। কিছুই ঠাওড় করতে পারছে না, কী হয়েছে? বিছানায় তাকিয়ে দেখে, স্বামী নাই; ঘর ফাঁকা। গত রাতের কথা মনে করার চেষ্টা করে। আস্তে আস্তে মনে পড়ছে সবকিছু-
জমিরন বিবি আস্ফালন করে ওঠে। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। কারা যেন গত রাতে ওর স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছে। সেই যে গেছে সাহেব আলী। ফিরে এল তিনদিন পরে লাশ হয়ে। খানাপিনা বন্ধ। পাগলপ্রায় জমিরন বিবি। পাড়া-প্রতিবেশীরা আসে, সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে। তাতে কী আর হয়! নির্বাক জমিরন বারান্দায় কাঠের ছোট্ট টুলটাতে বসে উদাস হয়ে চেয়ে রয় দরজার দিকে। কখন তার স্বামী আসবে পায়ে পায়ে হেঁটে, হাতে হাটের জিলাপি আর আলতা নিয়ে। তারপর রাতের খাবার শেষে উঠোনে জোছনার আলোতে বসে সারাদিনের সব কথা জানাবে স্বামীকে, সুখ-দুঃখের গল্প জমাবে। প্রতীক্ষা তার দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় শুধু....
তারপর দেশ স্বাধীনের পর জমিরনের কোল জুড়ে আসে পুত্রসন্তান। ফুটফুটে, একেবারে বাবার মত দেখতে। স্বাধীন দেশে বাস করে মা শখ করে নাম রাখে ‘স্বাধীন’। পুরো নাম শফিকুল ইসলাম ইবন সাহেব ওরফে স্বাধীন। বিধবা জমিরনের সমস্ত আশা আকাঙ্খার কেন্দ্র, স্বাধীন। লেখাপড়া করাবে ছেলেকে। পাঁচ বছর বয়সে, পাড়ার মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে পরামর্শ করে ভর্তি করিয়ে দেয় পাশের এক মাদ্রাসায়। মসজিদের ইমামের নাম আসাদ। নিপাট ভদ্রলোক ও ধার্মিক মানুষ। স্বাধীনের বাবার সাথে বেশ ভাব ছিল। ছোটবেলায় পড়েছে একই মক্তবে। সেই সাথে দুজনে ছিল আত্মার আত্মীয়। তাই আজও জমিরন বিবি কোন পরামর্শের জন্য ইমাম সাহেবের স্মরণাপন্ন হয়।
শান্ত ও মেধাবী স্বাধীন দুই বছরের মধ্যেই হিফজ করে ফেলে পবিত্র কুরআনুল কারীম। পড়াশুনা এগিয়ে যেতে থাকে। এর বাড়ী ওর বাড়ীতে ঝিয়ের কাজ করে যা উপার্জন হয় তাই দিয়ে চলত ছেলের লেখাপড়ার খরচ। দেখতে দেখতে আর বসতভিটার পাশের এক চিলতে জমিতে চাষাবাদ করে চালাত সংসার। গেরস্ত ছিল জমিরনের স্বামী। বিঘা কয়েক জমি, হালের বলদ সবই ছিল তাদের। স্বামীর মৃত্যুর পর শরীক-ভাগীরা ভোগ দখল করে নেয় জমি-জিরাত। অভাবে হালের বলদগুলো বেচে দেয় ব্যাপারী ডেকে। তারই কিছু টাকা ব্যাংকে সঞ্চয় করে জমিরন। ছেলেকে শিক্ষিত করতে অনেক খরচ হবে। জমিরনের স্বপ্ন ছেলে বড় হয়ে আলেম হবে, মানুষকে দ্বীনের ছবক দিবে। ভালো কোন দারুল উলূমে পড়াশোনা করাবে। টাকা-পয়সার যোগান দিতে হবে। তাই ওগুলো জমা রাখে।
অর্থাভাবে আর ঘরে একা বিধবা মা রেখে সব সামলিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়না স্বাধীনের। দাওরাহ পাশ করে আর পড়াশুনা এগোয়না। আর কত! এবারে নিজে সংসারের হাল ধরতে হবে শক্ত করে। ব্যাংকে গচ্ছিত টাকাগুলো দিয়ে বাজারে দোকান করে। মুদি দোকান। হাতে এখন কিছু টাকা এসেছে। তাই মা আর ছেলে নানানরকম পরামর্শ করে তাদের আগামীর দিনগুলি নিয়ে।
এরই মাঝে বাড়ির পাশের মাদ্রাসা থেকে ডাক আসে শিক্ষকতা করানোর জন্য। এক কথায় লাফিয়ে রাজি হয়ে যায় স্বাধীন। যাক এতদিনে তাও অন্তত নিজের শিক্ষা কিছুটা হলেও অন্যের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার সুযোগ পাবে। ভাবতেই মনের মাঝে এক প্রশান্তি অনুভব করে। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠে ছোটবেলায় রাতে পিদিম জ্বালিয়ে মা বলেছিলেন যে, আজকের এই পিদিম যেমন তোর চোখে আলো জ্বেলে দিচ্ছে, তুই পড়ছিস; ঠিক তেমনিভাবে একদিন তোকে জ্বালাতে হবে সবার অন্তরে দ্বীনের আলো। যে আলোয় সবাই চিনবে পরকালের পথকে আর সংগ্রহ করবে পাথেয়।
বাজারের দোকানটি বিক্রি করে দেয় মা জমিরনের পরামর্শে। মাদ্রাসা আর দোকান একসাথে দুদিক সামলানো সম্ভব নয়। তাই ক্ষেত ফসল করে আর দোকান বিক্রয় করে যা পেয়েছিল তা দিয়ে মৌসুমী ফসল স্টক করে ব্যবসা টিকিয়ে রাখে। ভালোই চলতে থাকে মা-ছেলের সংসার।
প্রতিদিন তাহাজ্জুদের সময় উঠে স্বাধীন। মায়ের অযুর পানি তুলে ঘরের সামনে রেখে দেয়। নিজে অজু করে সকলের অগোচরে আল্লাহর সাথে সেরে নেয় মনের কথাগুলি। বাবাকে চোখেই দেখেনি, বাবার ভালোবাসা কী সে তা বুঝতে পারেনা। শুধু মায়ের কাছে শুনেছে, তার বাবাও নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়তেন। অভাব আর কষ্ট সব জানাতেন সেই সত্ত্বার কাছে। আনন্দ আর কষ্ট সব জানাতেন স্বামী-স্ত্রী একসাথে। বাবা নাকি প্রায়ই বলতেন যে, আমাদের সব কথা, আবেগ আর ভালোবাসা এই দুনিয়ায় কেউ না জানুক, কেউ না চিনুক, আমরা চাই শেষ রাতের কথাগুলো লেখা থাক আরশের খাতায় সোনায় মোড়ানো পাতায়। সেও তাই অল্প বয়স থেকেই চেষ্টা করে নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়ার, দ্বীনের অনুশাষন মেনে চলার।
স্বাধীনের দুনিয়ায় আসার আগাম বার্তায় বাবা সেদিন কী করেছিলেন তা মনে করার চেষ্টা করে মায়ের কথা থেকে স্মৃতি হাতড়িয়ে।
শীতের এক রাতে, চারিপাশ শুনসান। সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে। কিন্তু জমিরনের ঘুম নেই। যেভাবেই হোক কথাটা জানাতেই হবে। কিন্তু কীভাবে? পাশে প্রায় ঘুমিয়ে পড়া সাহেব আলীকে একটু হাত দিয়ে ধাক্কা দেয়।
কী হল? বল? ভাঙ্গা কন্ঠে বলে সাহেব আলী।
কানের কাছে মৃদুস্বরে জমিরন বলে, হ্যাঁ গো শুনছো। আল্লাহ আমাদের উপর দয়া করেছেন। আমাদে ঘরে মেহমান আসবে।
তন্দ্রাচ্ছন্ন সাহেব আলী তেমন কিছুই বলেনা। আচ্ছা, আগে আসুক, তখন দেখা যাবে। ঘুমাও এখন। কাল সকালেই আবার হাল জুড়তে হবে।
জমিরন বিবি কিছুটা দমে যায়। কিছুই বললনা? কিন্তু তাতে কী? এত ভালো খবর না জানিয়ে ঘুমাবোনা।
আবার একটু খোঁচা দিয়ে বলে- শুনছো? আমাদের ঘরে নতুন মেহমান আসবে।
নতুন মেহমান? কে? জিজ্ঞেস করে সাহেব আলী।
সুযোগ পেয়ে জমিরনও কম যায়না- সে কে? তাতো জানিনা। ছেলে না মেয়ে? ফর্সা না কালো? কিছুই না। শুধু জানি তাকে দিয়ে আল্লাহ আমাদের ধন্য করবেন, পূর্ন করবেন, আল্লাহর অনুগ্রহের ধারায় সিক্ত করবেন ইনশাআল্লাহ।
এবারে সাহেব আলী একেবারে লাফ দিয়ে উঠে বসে। কী কইলা? ও বঊ তুমি কী কইলা? আবার কও দেহি। খানিক গল্প করে। চোখ থেকে ঘুম উধাও।
সলজ্জ বদনে থাকা জমিরন আর তেমন কোন কথা বলেনা। সাহেব আলী তার হাত ধরে বাইরে নিয়ে যায়। যেতে যেতে শুধু বলতে থাকে আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ। একবার খোলা আকাশের পানে তাকায়, আর একবার বউয়ের দিকে তাকায়। কুয়োর পাশে গিয়ে নিজে পানি তুলে অজু করে আর বউকেও করতে বলে। অজু করে গিয়ে সালাতে দাঁড়িয়ে যায় দুজনেই। সাহেব আলী তার সুললিত কন্ঠে কিরায়াত শুরু করে। আজ সে পড়ছে সুরা আল কাহাফ। একটি আয়াতে এসেঅ অনেকবার অনেকবার তিলাওয়াত করতে থাকে। যেন আর সামনে এগোতে পারেনা। দুজনেই কাঁদছে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কথা স্মরন করে। মহান আল্লাহ বলেছেন- “ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য এবং স্থায়ী সৎকর্মসমূহ আপনার পালনকর্তার কাছে প্রতিদান প্রাপ্তি ও আশা লাভের জন্যে উত্তম” ।
এই ঘটনা অনেকবার শুনেছে স্বাধীন। মা তার মত করে ছেলের কাছে বাবার স্মৃতি, আদর্শ জ্বাজল্যমান রাখার চেষ্টা করেছে প্রতিনিয়ত। শুনিয়েছে, স্বাধীনকে নিয়ে তার বাবার স্বপ্ন। জানতইনা যে ছেলে না মেয়ে হবে কিন্তু স্বপ্ন দেখতো যে তার সন্তান হাফেজ বা হাফিজা হবে এবং আলেম বা আলিমা হবে। আজ এই কথাগুলো মনে করে চোখ দুটো জলে ভিজে উঠছে স্বাধীনের। অবাধ্য লোনাজল গড়িয়ে পড়ছে অঝোর ধারায়। দুহাত পেতে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে তার বাবার শান্তির জন্য। আবার সবাই একসাথে জান্নাতে জায়গা পাবার আশায়।
পরের পর্ব পড়ুন এখান থেকে-
যে ইতিহাসে রয় ইতিহাসের দায় (দ্বিতীয় পর্ব)
বিষয়: বিবিধ
১৮০১ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
চিন্তার গভীরতায়-
ভাল লাগার মুগ্ধতায়-
আজকের মত কখন যে শেষাংশে পৌছে গেছি-
'চলবে...(ইনশা আল্লাহ)' শব্ধত্রয়ে তা অনুধাবিত হল! অসাধারণ ও সুন্দর লেখনী!জাযাকাল্লাহু খাইরান আপনাকে!
অপেক্ষায় রইলাম পরের পর্বের......
সাবলীল বর্ণনা লিখা শেষ পর্যন্ত সাথে রাখল।
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম। আর এই পর্বটির জন্য ভালো লাগা রেখে গেলাম।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
শুভকামনা রইলো।
মন্তব্য করতে লগইন করুন