তাওয়াক্কুলঃ আল্লাহর উপরে ভরসা
লিখেছেন লিখেছেন এস এম আবু নাছের ২৯ অক্টোবর, ২০১৪, ১২:৩৬:০৩ রাত
পরম করুনাময় ও দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
তাওয়াক্কুল আরবি শব্দ। এর অর্থ হল, ভরসা করা, নির্ভর করা। তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ অর্থ হল: আল্লাহ তাআলার উপর ভরসা করা। ইসলামে আল্লাহ তাআলার উপর তাওয়াক্কুল একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি একটি ইবাদত।
একজন ঈমানদার মানুষ ভাল ও কল্যাণকর বিষয় অর্জনের জন্য সকল ব্যাপারে নিজের সাধ্যমত চেষ্টা করবে, সার্বিক প্রচেষ্টা চালাবে আর ফলাফলের জন্য আল্লাহ তাআলার উপর ভরসা করবে, তাঁর প্রতি আস্থা ও দৃঢ় একিন রাখবে। বিশ্বাস রাখবে যে, আল্লাহ যা লিখে রেখেছেন ফলাফল তা-ই হবে। আর তাতেই রয়েছে কল্যাণ চূড়ান্ত বিচার ও শেষ পরিণামে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে যদি আমরা তা অনুধাবন না-ও করতে পারি। এটাই তাওয়াক্কুলের মূল কথা।
১. আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন-
“তোমরা যদি মুমিন হয়ে থাক, তাহলে একমাত্র আল্লাহর ওপরই ভরসা কর”। (ক)
২. আল্লাহ তা’আলা আরও ঈরশাদ করেছেন-
“সাচ্চা ঈমানদার তো তারাই আল্লাহকে স্মরণ করা হলে যাদের হৃদয় কেঁপে ওঠে৷ আর আল্লাহর আয়াত যখন তাদের সামনে পড়া হয়, তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা নিজেদের রবের ওপর ভরসা করে”। (খ)
৩. আল্লাহ তা’আলা বলেন-
যে ব্যক্তিই আল্লাহকে ভয় করে চলবে আল্লাহ তার জন্য কঠিন অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় সৃষ্টি করে দেবেন৷ এবং এমন পন্থায় তাকে রিযিক দেবেন যা সে কল্পনাও করতে পারে না৷ যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর নির্ভর করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট৷ আল্লাহ তাঁর কাজ সম্পূর্ণ করে থাকেন৷ আল্লাহ প্রতিটি জিনিসের জন্য একটা মাত্রা ঠিক করে রেখেছেন৷ (গ)
৪. ইবনে আব্বাস রাযিঃ থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন-
ইবনে আব্বাস রাযিঃ বলেন, ‘হাসবুনাল্লাহ ওয়ানি’মাল ওয়াকীল’ এই আয়াতটি ইবরাহীম আঃ বলেছেন, যখন তাকে লোকেরা অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। আর মুহাম্মদ সাঃ বলেছেন, যখন তাকে লোকেরা বলল যে, আপনাদের বিরুদ্ধে জনগণ বিরাট বাহিনি জমা করেছে, আপনারা তাদেরকে ভয় করুন’।
এতে মু’মিনগণের ঈমান আরও বর্ধিত হল” আয়াতের শেষ পর্যন্ত। হাদীসটি বুখারী ও নাসায়ী বর্ননা করেছেন।
এ কথা ইবরাহীম আঃ তখন বলেছিলেন, যখন তাঁকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। আর মুহাম্মদ সাঃ একথা বলেছিলেন তখন, যখন তাঁকে বলা হলো,
“লোকেরা আপনাদের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী বাহিনী জড়ো করেছে। অতএব তাদেরকে ভয় করুন। তখন তাঁদের ঈমান আরও বৃধি পেল”। (ঘ)
৫. আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘বনী ইসরাঈলের কোন এক ব্যক্তি বনী ইসরাঈলের অপর ব্যক্তির নিকট এক হাযার দীনার ঋণ চাইল। তখন সে (ঋণদাতা) বলল, কয়েকজন সাক্ষী আন, আমি তাদের সাক্ষী রাখব। সে বলল, সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট। তারপর ঋণদাতা বলল, তাহ’লে একজন যামিনদার উপস্থিত কর। সে বলল, যামিনদার হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট। ঋণদাতা বলল, তুমি সত্যিই বলেছ। এরপর নির্ধারিত সময়ে পরিশোধের শর্তে তাকে এক হাযার দীনার দিয়ে দিল। তারপর ঋণ গ্রহীতা সামুদ্রিক সফর করল এবং তার প্রয়োজন সমাধা করে সে যানবাহন খুঁজতে লাগল, যাতে সে নির্ধারিত সময়ের ভেতর ঋণদাতার কাছে এসে পৌঁছতে পারে। কিন্তু সে কোন যানবাহন পেল না। তখন সে এক টুকরো কাঠ নিয়ে তা ছিদ্র করল এবং ঋণদাতার নামে একখানা পত্র ও এক হাযার দীনার তার মধ্যে ভরে ছিদ্রটি বন্ধ করে সমুদ্র তীরে এসে বলল, হে আল্লাহ! তুমি তো জান, আমি অমুকের নিকট এক হাযার দীনার ঋণ চাইলে সে আমার কাছে যামিনদার চেয়েছিল। আমি বলেছিলাম, আল্লাহই যামিন হিসাবে যথেষ্ট। এতে সে রাযী হয়। তারপর সে আমার কাছে সাক্ষী চেয়েছিল, আমি বলেছিলাম, সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট। তাতে সে রাযী হয়ে যায়। আমি তার ঋণ (যথাসময়ে) পরিশোধের উদ্দেশ্যে যানবাহনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, কিন্তু পাইনি। তাই আমি তোমার নিকট সোপর্দ করলাম। এই বলে সে কাষ্টখন্ডটি সমুদ্রে নিক্ষেপ করল। আর কাষ্ঠখন্ডটি সমুদ্রে ভেসে চলল। অতঃপর লোকটি ফিরে গেল এবং নিজের শহরে যাওয়ার যানবাহন খুঁজতে লাগল। ওদিকে ঋণদাতা এই আশায় সমুদ্রতীরে গেল যে, হয়ত ঋণগ্রহীতা কোন নৌযানে করে তার মাল নিয়ে এসেছে। তার দৃষ্টি কাষ্ঠখন্ডটির উপর পড়ল, যার ভিতরে মাল ছিল। সে কাষ্টখন্ডটি তার পরিবারের জ্বালানীর জন্য বাড়ী নিয়ে গেল। যখন সে তা চিরল, তখন সে মাল ও পত্রটি পেয়ে গেল। কিছুদিন পর ঋণগ্রহীতা এক হাযার দীনার নিয়ে হাযির হ’ল এবং বলল, আল্লাহর কসম! আমি আপনার মাল যথাসময়ে পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে সব সময় যানবাহন খুঁজেছিলাম। কিন্তু আমি যে নৌযানে এখন আসলাম, তার আগে আর কোন নৌযান পাইনি। ঋণদাতা বলল, তুমি কি আমার নিকট কিছু পাঠিয়েছিলে? ঋণগ্রহীতা বলল, আমি তো তোমাকে বললামই যে, এর আগে আর কোন নৌযান আমি পাইনি। সে বলল, তুমি কাঠের টুকরোর ভিতরে যা পাঠিয়েছিলে, তা আল্লাহ তোমার পক্ষ হ’তে আমাকে আদায় করে দিয়েছেন। তখন সে আনন্দচিত্তে এক হাযার দীনার নিয়ে ফিরে চলে এল’ (ঙ)
৬. জাবের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি নবী করীম (ছাঃ)-এর সাথে নজদের (বর্তমানে রিয়াদ অঞ্চল) দিকে জিহাদে রওয়ানা হ’লেন। যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বাড়ী ফিরতে লাগলেন, তখন তিনিও তাঁর সঙ্গে ফিরলেন। রাস্তায় প্রচুর কাটাগাছে ভরা এক উপত্যকায় তাঁদের দুপুরের বিশ্রাম নেওয়ার সময় হ’ল। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) (বিশ্রামের জন্য) নেমে পড়লেন এবং ছাহাবীগণও গাছের ছায়ার খোঁজে বিক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি বাবলা গাছের নীচে অবতরণ করলেন এবং তাতে স্বীয় তরবারি ঝুলিয়ে দিলেন। আর আমরা অল্পক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে গেলাম। অতঃপর হঠাৎ (আমরা শুনলাম যে,) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে ডাকছেন। সেখানে দেখলাম, একজন বেদুঈন তার কাছে রয়েছে। তিনি বললেন, আমার ঘুমের অবস্থায় এই ব্যক্তির হাতে আমার তরবারিখানা খোলা অবস্থায় দেখলাম। (তারপর) সে আমাকে বলল, আমার নিকট হ’তে তোমাকে (আজ) কে বাঁচাবে? আমি বললাম, আল্লাহ। এ কথা আমি তিনবার বললাম। তিনি তাকে কোন শাস্তি দিলেন না। অতঃপর তিনি বসে গেলেন। (অথবা সে বসে গেল) (চ)।
অন্য বর্ণনায় আছে, জাবের (রাঃ) বলেন যে, আমরা ‘যাতুর রিক্বা’-তে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে ছিলাম। অতঃপর (ফেরার সময়) যখন আমরা ঘন ছায়া বিশিষ্ট একটি গাছের কাছে আসলাম, তখন তা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্য ছেড়ে দিলাম। (তিনি বিশ্রাম করতে লাগলেন।) ইতিমধ্যে একজন মুশরিক আসল। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর তরবারি গাছে ঝুলানো ছিল। তারপর সে তা (খাপ থেকে) বের করে বলল, তুমি কি আমাকে ভয় করছ? তিনি বললেন, না। সে বলল, তোমাকে আমার হাত থেকে কে বাঁচাবে? তিনি বললেন, আল্লাহ।
আবু বকর ইসমাঈলীর ছহীহ গ্রন্থে রয়েছে, সে বলল, আমার হাত থেকে তোমাকে কে বাঁচাবে? তিনি বললেন, আল্লাহ। বর্ণনাকারী বলেন, তারপর তার হাত থেকে তরবারিটি পড়ে গেল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তরবারিখানা তুলে নিয়ে বললেন, (এবার) তোমাকে আমার হাত থেকে কে বাঁচাবে? সে বলল, তুমি উত্তম তরবারিধারক হয়ে যাও। অতঃপর তিনি বললেন, তুমি কি সাক্ষ্য দিচ্ছ যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ উপাস্য নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল? সে বলল, না। কিন্তু আমি তোমার কাছে অঙ্গীকার করছি যে, তোমার বিরুদ্ধে কখনো লড়বো না। আর আমি সেই সম্প্রদায়ের সঙ্গীও হব না, যারা তোমার বিরুদ্ধে লড়বে। সুতরাং তিনি তার পথ ছেড়ে দিলেন। অতঃপর সে তার সঙ্গীদের নিকট এসে বলল, আমি তোমাদের নিকটে সর্বোত্তম মানুষের নিকট থেকে আসলাম (ছ)।
এ অধ্যায় থেকে ছয়টি মাসয়ালা জানা যায়ঃ
--------------------------------------------
১. আল্লাহর উপর ভরসা করা ফরজ।
২. আল্লাহর উপর ভরসা করা ঈমানের শর্ত
৩. সূরা আনফালের ২ নং আয়াতের বাখ্যা।
৪. আয়াতটির তাফসীর শেষাংশেই রয়েছে।
৫. শুরা তালাকের ৩ নং আয়াতের তাফসীর।
৬. কথাটি ইবরাহীম আঃ ও মুহাম্মদ সাঃ বিপদের সময় বলার কারনে এর গুরুত্ব ও এর মর্যাদা।
পরিশেষে বলব, আল্লাহর উপরে ভরসা করলে তিনি মানুষের জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। উপরোক্ত হাদীছ দু’টি তার বাস্তব প্রমাণ। আল্লাহ আমাদেরকে উপরোক্ত হাদীছদ্বয়ের উপর আমল করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
====================০====================
ক। সূরা মায়েদাঃ আয়াত-২৩
খ। সূরা আনফালঃ আয়াত-২
গ। সূরা তালাকঃ আয়াত-২ ও ৩
ঘ। সূরা আলে-ইমরানঃ আয়াত-১৭৩
ঙ। বুখারী হা/২২৯১, ‘কিতাবুল কিফালাহ’
চ। বুখারী ও মুসলিম
ছ। বুখারী হা/২৯১০, ২৯১৩, ৪১৩৫, ৪১৩৭
==============================
কিতাবুত তাওহীদঃ ৩৩ শ অধ্যায়
মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব
বিষয়: বিবিধ
১৬১১ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জাযাকাল্লাহু খাইরান।
মন্তব্য করতে লগইন করুন