“হারিয়ে যাওয়া এক সুন্নাহ -খালি পায়ে হাঁটা”
লিখেছেন লিখেছেন এস এম আবু নাছের ২২ অক্টোবর, ২০১৪, ০২:১৮:২৬ রাত
ছোট্ট ছেলে হাবিব। বয়স বছর ছয়েক হবে। বাবা-মায়ের সাথে ঈদ করতে গ্রামের বাড়ি এসেছে। বাইরে বাগানে কুরবানী দেওয়া হয়েছে গরু, খাসী। পাড়ার অনেক ছেলেমেয়ে এসে ভিড় করেছে সেই বাগানে। কেউ বা খেলার জন্য আর কেউ কুরবানীর মাংস থেকে কিছু ভাগ নেওয়ার আশায়। ঈদের নতুন জামা, জুতো ঈদগাহ থেকে এসে আর খোলেনি হাবিব। তাকে খুলতেও দেয়নি তার মা। এভাবেই ঘুরে বেরাচ্ছে বাগানের মাঝে আর তার সমবয়সীদের সাথে খেলাধূলা করছে। হঠাৎ পাশের বাড়ির আমিন কে খালি পায়ে দেখে হাবিবেরও খুব ইচ্ছে হল খালি পায়ে মাটিতে খেলতে। বাসায় দৌড়ে গিয়ে মাকে বলছে-
- মামনি, আমি জুতো খুলে রেখে বাইরে যাই? ঐ যে আমিনও জুতো পরে নেই।
- না না না। জুতো খোলা যাবেনা। অনেক ময়লা আবর্জনা আছে। পায়ে লেগে অসুখ করবে। ঘা হবে বাবা। কাঁটা ফুটবে পায়ে।
- না মামনি, আমি যাবো, জুতো খুলেই যাবো খেলতে।
- একদম চড় লাগাবো। সবকিছুতেই জিদ করে। যাও ওভাবেই খেল গিয়ে। মামনির কড়া ধমকে কিছুটা চুপসে গেল হাবিব।
হাবিব এর কান্নাকাটি শুনে তার বাবা বাইরে থেকে আস্তে আস্তে বাড়ির ভিতরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করল-
- কি হয়েছে বাবা? কাঁদছো কেন?
- আমি জুতো ছাড়া বাইরে যেতে চেয়েছি আর আম্মু আমায় দিবেনা। ঐ দেখোনা, আমিন জুতো পরে নেই।
- ও ... এই ব্যাপার? আচ্ছা তুমি যাও। জুতো বাসায় রেখে খালি পায়েই বাইরে যাও।
- তুমি ওকে খালি পায়ে বাইরে যেতে বলছ? মায়ের গভীর অনুযোগ।
- হুম, যাকনা একটু। একটু আধটু খালি পায়ে থাকাটা স্বাস্থ্যের জন্য ভাল।
- তা কি ভালটা শুনি? এখন যদি পায়ে কাঁটা বিধিয়ে চলে আসে তাহলে? কই থাকবে তোমার ভালটা?
হাবিবের বাবা ডাক্তার মানুষ। স্ত্রীর এই কথার জবাব দিতে গিয়ে বললেন-
- মানুষের শরীরে বিভিন্ন ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আধান পারস্পারিক সাম্যতা রক্ষা করে থাকে। শরীরের মাঝে যখন ধনাত্মক আধান বেশি হয়ে যায় তখন তা ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবীর উপরিভাগ তথা ভুপৃষ্ঠ আয়ন পরিবাহী হিসেবে কাজ করে যা ঋণাত্মক আয়নের আধার হিসেবে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পরিবেশ ও জীবের শরীরে আয়ন সমতা নিয়ন্ত্রন করে থাকে। Journal of Environmental Science and Public Health এর বরাত দিয়ে বললেন, “শরীরের সাথে ভূপৃষ্ঠের সংযোগে এক ধরনের বায়ো-ইলেকট্রিক্যাল বিনিময় ঘটে যা পুরো শরীরে স্বাভাবিক কার্যক্রমের জন্য সহায়ক ভুমিকা পালন করে। ভুপৃষ্ঠ থেকে শরীরে গৃহীত ঋণাত্মক আয়নগুলো মুক্ত ধণাত্মক আয়নকে নিরপেক্ষ করে দেয় যা দীর্ঘকালীন ব্যাথা ও অবসন্নতা কমাতে সহায়তা করে। এছাড়াও কিছু শারীরিক সমস্যায় খালি পায়ে হাঁটা টনিক হিসেবে কাজ করে যেমন- ঘুমের বিঘ্নতা, মাংসপেশির ব্যাথা, অস্থিসন্ধির ব্যাথা, শ্বাসকষ্ট ও শ্বাসনালীর প্রদাহ, বাতজ্বর, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন জনিত অস্বাভাবিকতা।
- হ্যাঁ, রাখো তোমার ডাক্তারি। সব জায়গায় ফলাওনা বলেই চলে গেল হাবিবের মা।
এতক্ষণ সব মনযোগ দিয়ে শুনছিল পাশে বসে থাকা নাফিস। সে হাবিবের ছোট চাচা, ভার্সিটিতে পড়ে। এতক্ষণে রা শব্দটি করল-
- ভাইয়া, আমি একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
- হ্যাঁ, কি বলবি বল? ভাইয়ের সাহসে নাফিস বলল-
- এতক্ষণ তুমি খালি পায়ে হাঁটার যত উপকারিতার কথা বললে তা কি সব ঠিক?
- হ্যাঁ, ঠিক হবেনা কেন?
- না, আমি ভাবছিলাম, যে আজ থেকে সেই ১৪০০ বছর আগেও আমাদের রাসুলে কারীম (সাঃ) আমাদের মাঝে মাঝে খালি পায়ে হাঁটার পরামর্শ দিয়েছেন, উৎসাহিত করেছেন। ডাক্তারি ও বিজ্ঞান জানার পাশাপাশি আমাদের সেই বিষয়েও সম্যক জ্ঞান থাকা আবশ্যক বৈকি।
- কি বলেছেন রাসুল (সাঃ) এ ব্যাপারে? বল দেখি-
- নাফিস বলতে লাগলো-
- “আব্দুল্লাহ ইবন বুরাইদাহ বলেন, তিনি মিশরে থাকাকালীন সময়ে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর একজন সাহাবী ফালাদাহ ইবন উবাইদ (রাঃ) এর কাছে সফর করলেন। তিনি তাঁর কাছে পৌঁছালেন আর আরজ করলেন-
‘আমি আপনার সাথে সাক্ষাতের জন্য আসিনি বরং আপনি এবং আমি উভয়েই রাসুলুল্লাহ (শাঃ) থেকে হাদীস শুনেছি। আমি আশা করি এ ব্যাপারে আপনার নিকট কিছু ইলম আছে’।
-তিনি জিজ্ঞেস করলেন এটা কি?
-উনি বললেন; এমন ও এমন।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমি কেন আপনাকে উস্কখুস্ক দেখছি? অথচ আপনি এ এলাকার শাসক।
-উনি বললেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আমাদের বেশি বিলাসিতা করতে বারন করেছেন।
-তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমি আপনাকে জুতোবিহীন দেখছি কেন?
-উনি বললেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আমাদের মাঝে মধ্যে খালি পায়ে থাকার আদেশ করতেন।
-[আবু দাউদ- ৩৫/২। তাহক্বীক (আলবানী রাহিঃ)- সনদ সহীহ]
(এ হাদীসের ব্যাপারে শাইখ আলবানী রাহিঃ বলেন- “এটা এমন একটি সুন্নাহ যার ব্যাপারে বেশিরভাগ মানুষই অজ্ঞাত; অল্পকিছু সংখ্যক ব্যতীত। এমনকি হয়তো কেউ যদি তা আজকে পালন করতে শুরু করে তাহলে লোকদের মাঝে এইটা অদ্ভুত মনে হবে। কেউ কেউ হয়তো সমালোচনাও করবে)
ভাই শুনে কিছুটা অবাকও হলেন আবার নাফিসকে ধন্যবাদও জানালেন। নাফিস বলল-
- ভাইয়া, আমাদের জীবনে চলার পথে প্রতিমুহুর্তে কুরআন ও সহীহ সুন্নাহের জ্ঞান অনেক গুরুত্বপুর্ন। আজকের এই বিষয়টাই চিন্তা কর, তুমি জানতেওনা যে এ ব্যাপারেও ইসলামের কোন দিক নির্দেশনা থাকতে পারে। তাইনা? অথচ ইসলাম কত সুন্দর সে ব্যাপারেও নির্দেশনা দিয়েছে। এভাবেই হেঁসেল ঘর থেকে শুরু করে টয়লেট, মসজিদ থেকে জিহাদের ময়দান সবজায়গাতেই ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। আর এর মাঝেই আছে প্রকৃত কল্যান। তাই বিজ্ঞান আবিষ্কার করতে পারুক আর না পারুক ইসলামের নির্দেশনা শ্বাশ্বত ও সুন্দর। আর একারনেই আমাদের ছোট বাচ্চাদের সাথে কথা বলতে, চলতে, তাদের জীবন গড়তে দরকার ইসলামের পরিপুর্ণ অনুসরণ। চলার পথে তাই তাদের শিক্ষা দিতে হবে ইসলামের শিক্ষার উপর থেকে, জানিয়ে দিতে হবে রাসুলের সুন্নাহ, উৎসাহিত করতে হবে মেনে চলার ব্যাপারে, তৈরি করতে হবে এ ব্যাপারে অন্তর থেকে ভালবাসা। তাহলে না আছে ক্ষতির সম্ভাবনা, না আছে ভবিষ্যতে আফসোসের সম্ভাবনা।
সে কাহিনী প্রায় বছরখানেক আগের। আবারও রমযান আসন্ন প্রায়। শহরে থাকে বলে নাফিসেরও আর তেমন সুযোগ হয়না খালি পায়ে হাঁটার। প্রযুক্তি আর ইঁট কাঠে মোড়া এ শহরে সে যেন আজ দশম প্রজাতির রোবট হয়ে গিয়েছে। চাইলেই ফিরে পায়না সেই ছাঁয়া সুনিবিড়, শান্তির নীড় গ্রামের শ্যামলিমা। ভুলতে বসেছে কবে বা কতদিন আগে শিশিরস্নাত দুর্বাঘাসের উপর দিয়ে খালি পায়ে হেঁটেছে। গ্রীষ্মের ছুটিতে দু’দিন হল গ্রামের বাড়ি এসেছে। হঠাৎ করেই আজ দুপুরের পর থেকে মুষলধারায় বৃষ্টি নেমেছে। আসরের নামায পড়ে নাফিস হাঁটা ধরল নদীর দিকে। নদীর পাড়ে এসে খালি পায়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো বৃষ্টিভেজা ঘাসের উপরে। মাটির শীতলতা যেন তার শরীরের প্রতিটি শিরায় উপশিরায় পৌঁছে যাচ্ছে। যেন আপাদমস্তক এক প্রশান্তি নেমে এসেছে। তার মন থেকে অজান্তেই ঠোঁট ফেটে বেড়িয়ে এলো- সুবহানআল্লাহ ! কত সুন্দর তোমার সৃষ্টির পরশ ! কত শ্বাশ্বত তোমার রাসুলের সুন্নাহ!
বিষয়: বিবিধ
১৯০৮ বার পঠিত, ২৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জাজাক-আল্লাহ খায়ের।
আমার বেশ ভাল লেগেছে - আমি পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম অনেক অনেক বছর বুঝিবা খালি পায়ে মাটিতে হাটিনি। তারপর মনে এলো বছর দুয়েক আগে এক বিকালে ফুটবল খেলতে গিয়ে মিনিট ১৫ খালি পায়ে ছিলাম আর সারা পায়ের তলা ঘাসের কষ লেগে প্রায় বাদামী হয়ে গিয়েছিল।
আগামী কাল ই আপনার লিখাটি আমার ছেলেমেয়ের সাথে শেয়ার করবো। আশা করি আমরা চারজন কখনো কখনো খালি পায়ে হাঁটবো। ইনশাল্লাহ্।
ধন্যবাদ।
অসাধারণ নান্দিকতায় একান্ত প্রয়োজনীয় সহজেই পালনীয় একটি বিষয় কে উপস্হাপন করায় অনেক অনেক ধন্যবাদ ও জাযাকাল্লাহু খাইরান জানাচ্ছি-শ্রদ্ধেয় এস এম আবু নাছের!
রাসুলে আরাবী সাঃ এর প্রতিটা সুন্নাহ পালনের তাওফিক আল্লাহ আমাদের দান করুন, আমিন।
ধন্যবাদ
খুব সু্ন্দর করে লিখেছেন।
খালি পায়ে খেলা আমাদের ছোট বেলায় স্বাভাবিক ছিল। এখন নোংরা কথা বলে বেশিরভাগ বাবা মা ই সন্তানদের খালি পায়ে হাটতে দেননা।
তবে অনেকদিন ওভাবে হয় না অবশ্য...
মন্তব্য করতে লগইন করুন