দ্য রুলস অব ওয়ার্ক : ব্যক্তিগত সাফল্যের চাবিকাঠি- পর্ব ১

লিখেছেন লিখেছেন উম্মত মোহাম্মদ ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৯:০৮:১১ রাত

কর্মজীবনে সাফল্যের জন্য রিচার্ড টেম্পলারের লেখা ‘দ্য রুলস অব ওয়ার্ক’ নামের বেস্টসেলার বইটি পাঠকদের জন্য অনুবাদ করে প্রকাশ করার হল বাংলা ভাষায়। এই বইটি জীবনে চলার পথে প্রয়োজনীয় কিছু নিয়মের সংকলন, যা বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক পঠিত বইয়ের একটি। সারা বিশ্বে প্রায় ২ মিলিয়ন মানুষ এর অনেকগুলো সিরিজ ক্রয় করেছেন এবং বইটি প্রায় ২২ টি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। আজ প্রকাশিত হলো প্রথম পর্ব।

লেখকের কথা: দ্য রুলস অব ওয়ার্ক বইটি লেখার কাজ আমি অনেক বছর আগেই শুরু করেছিলাম যখন আমি একটি কোম্পানির অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ছিলাম। প্রমোশন পেয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার থেকে ম্যানেজার হওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলাম আমি এবং রব। কাগজেকলমে আমি বেশি অভিজ্ঞ, পারদর্শিতা বেশি এমনকি আমার অফিসের বেশিরভাগ স্টাফই তাদের ম্যানেজার হিসেবে আমাকেই চাইত। সত্যি কথা বলতে কি, রব সে তুলনায় কোনো কাজেরই না।

আমি একদিন অফিসের বাইরে আমাদের কোম্পানির একজন কনসালট্যান্টের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম যে ম্যানেজার হওয়ার চান্স আমার কতটুকু? তিনি বললেন, “ক্ষীণ”। আমি হতভম্ব হয়ে পড়লাম। আমার কাজের অভিজ্ঞতা, পারদর্শিতা এবং চরম কর্মক্ষমতার কথা তাঁকে বুঝিয়ে বললাম। তিনি আমাকে বললেন, ‘সব ঠিক কিন্তু তোমার হাঁটা একজন ম্যানেজারের মতো না।” হতাশ হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আর রবের হাঁটা?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ, ওটাই ওর শক্তিশালী জায়গা”। বলাই বাহুল্য যে তিনি সঠিক ছিলেন আর রব প্রমোশন পেয়ে গেল। আমাকে কাজ করতে হলো এক উজবুকের নীচে যেই উজবুক ঠিকঠাক হাঁটতে পারে। আমি ওর হাঁটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতাম।

কনসালট্যান্ট ঠিকই বলেছিলেন, ওর হাঁটা ম্যানেজারের হাঁটা। এরপর থেকে আমি একধরনের গবেষণা শুরু করে দিই। সব কর্মচারী-কর্মকর্তাকে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করি। একজন স্টাফ কীভাবে কাজ করে, একজন অ্যাডমিন অফিসার কীভাবে কাজ করে, একজন নিরাপত্তাকর্মী কীভাবে কাজ করে এবং সর্বোপরি একজন ম্যানেজার কীভাবে কাজ করেন। আমি গোপনে সেই হাঁটা অভ্যাস করতে থাকি।

যেহেতু হাঁটা দেখার জন্য আমাকে অনেক সময় দিতে হতো তখন আমি এটাও খেয়াল করি যে একজন ম্যানেজারের পোশাক, আচরণ, কথা বলার স্টাইলও একেবারেই ভিন্ন থাকে। আমি কাজে ভাল বা অভিজ্ঞ এটা যথেষ্ট নয়। দেখে মনে হতে হবে যে আমি যে কারো চাইতে ভাল। আমি ধীরে ধীরে লক্ষ্য করলাম যে কোন সংবাদপত্র পড়ছি, কোন কলমটা ব্যবহার করছি, কীভাবে সহকর্মীদের সাথে কথা বলছি, মিটিং-এ কী বলছি- সব মাপা হচ্ছে, মূল্যায়ন করা হচ্ছে এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। কাজটা ভাল জানাই জরুরী নয়, জরুরী হলো যেমন চাওয়া হচ্ছে নিজেকে তেমন টাইপ করে তোলা। সেই টাইপ বানানোর প্রয়াস থেকেই আমি দ্য রুলস অব ওয়ার্ক বইটি লিখেছি। ‘দ্য রুলস অব ওয়ার্ক’ বইটি মূলত যেকোনো কাজ করার সঠিক পদ্ধতি শেখানোর কৌশলস্বরূপ।

আমি খেয়াল করে দেখলাম যে ম্যানেজারদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যারা পরবর্তী ধাপ অর্থাৎ জেনারেল ম্যানেজারের হাঁটা অনুশীলন করেন। আমি যখন বিভিন্ন শাখায় ঘোরাঘুরি করলাম তখন দেখলাম যে জেনারেল ম্যানেজারদের মধ্যেও কেউ কেউ পরবর্তী ধাপ রিজিওনাল ডিরেক্টরের পদের মতো হাঁটা, স্টাইল, ভাবমূর্তি ইত্যাদি অনুশীলন করা শুরু করে দিয়েছেন।

আমিও ম্যানেজারের হাঁটা অনুশীলন শেষ করে জেনারেল ম্যানেজারের হাঁটা অনুশীলন করা শুরু করলাম। ৩ মাস পরে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার থেকে একলাফে আমার প্রমোশন হলো জেনারেল ম্যানেজার পদে এবং আমি ওই উজবুকটার বস হয়ে গেলাম।

বইটিতে মোট ১০টি অধ্যায় রয়েছে এবং প্রতিটি অধ্যায়ের ১০টি করে ভাগ রয়েছে। এই ভাগগুলোসহ সবগুলো অধ্যায় ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হল।

১. যেমন কথা তেমন কাজ: এটি একটি ভিত্তিস্বরূপ নিয়ম যেটি অন্য সব নিয়মগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে- আপনার কাজটিকে ভালোভাবে সম্পন্ন করতে চাইলে কাজটিকে আগে ভালোভাবে জানুন, এরপরে কাজটি ভালোভাবে করুন এবং অন্যান্যদের তুলনায় যেন আপনিই ভালভাবে করেন। এতই সহজ। এটির গোপন ব্যাপারটি হলো আপনাকে নিশ্চিত হতে হবে যেন কেউ না জানে যে এত ভাল করার জন্য আপনি কতটা পরিশ্রম করছেন। আপনি গোপনে প্রস্তুতি নিন, এমনকি কাউকে জানতে দিবেন না যে এই বই আপনি পড়ছেন। আপনি নিজেকে শান্ত ও দক্ষভাবে উপস্থাপন করুন, আপনি যে সবার চাইতে ভাল এবং আপনার সবকিছু যে সুনিয়ন্ত্রিত তা ফুটিয়ে তুলুন। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিনের কাজকর্ম সহজভাবে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে করুন। আপনাকে টলানো বা থামানো অসম্ভব। মূল কথা হলো, আপনাকে আপনার কাজটা খুব ভালভাবে জানতে হবে।

১.১. আপনার কাজটি যেন নজরে পড়ে আপনি এত ব্যস্ত যে আলাদা করে নিজের কাজটিকে তুলে ধরা বা গুরুত্ব দেয়া হয়ে ওঠে না। কিন্তু এটা জরুরী। এতে আপনার কাজ অন্যদের তুলনায় পরিলক্ষিত হবে এবং আপনার প্রমোশন পাওয়ার পথ সুগম হবে।

প্রতিদিনের কাজের রুটিন থেকে বেরিয়ে আসুন। অফিসে সবাইকে যদি অনেকগুলো হিসাব করতে হয় তাহলে বেশি বেশি হিসাব করলেই আপনি উন্নতি করতে পারবেন না। বরং যদি আপনি বসের কাছে একটি রিপোর্ট দেন যে কী করলে আরো বেশি হিসাব বানানো যাবে তাহলে আপনি তাঁর নজরে পড়বেন। কিন্তু তা প্রতিদিন করবেন না, মাঝে মাঝে। তাহলে আপনার উদ্যোগ প্রশংসিত হবে। খেয়াল রাখবেন যে আপনার দেয়া সাজেশন যেন সত্যিই কাজের হয়। আপনার নাম যেন অবশ্যই স্পষ্ট করে সেখানে লেখা থাকে। খেয়াল রাখুন যে আপনার রিপোর্টটি যেন আপনার বসের পাশাপাশি তার বসও দেখেন। রিপোর্ট না হয়ে তা কোম্পানির নিউজলেটারের জন্য একটা প্রবন্ধও হতে পারে।

কাজে খুব দক্ষ হতে হবে আপনাকে। এর জন্য কাজ ছাড়া অন্য সবকিছু ভুলে যান। অফিসে কাজের নামে প্রচুর পরিমাণে রাজনীতি, পরচর্চা, গুটি চালাচালি, সময় নষ্ট করা এবং সামাজিকতা হয়। আপনি যদি আপনার কাজে মনোযোগ নিবদ্ধ রাখেন তাহলে এমনিতেই সহকর্মীদের তুলনায় অনেকটা এগিয়ে থাকবেন। ‘রুলস অব দ্য ওয়ার্ক’-এর প্লেয়ারকে থাকতে হবে নিবেদিতপ্রাণ।

১.২. কখনও বসে থাকবেন না অনেকেই আছেন যারা সারাদিন অফিসে বসে বাড়ি যাওয়ার সময়ের অপেক্ষা করেন। তাদের একটাই লক্ষ্য থাকে, কখন তারা বাড়ি যাবেন। এটি করা যাবে না। আপনার লক্ষ্য কিন্তু শুধু কাজ করা না। আপনার লক্ষ্য প্রমোশন। আরো অর্থ, সাফল্য, ওপরে ওঠা, যোগাযোগ গড়ে তোলা, নিজের অবস্থান তৈরি করা ইত্যাদি। কাজ ভাল করতেই হবে কিন্তু সবসময় চোখ রাখতে হবে পরবর্তী ধাপের দিকে। অন্যরা ফাঁকি দেয়ার সুযোগ খুঁজুক, আপনি একটি কাজ শেষ করে আরেকটির পরিকল্পনা করুন।

একজন আদর্শ ‘রুলস’ প্লেয়ার লাঞ্চের আগে কাজ সেরে ফেলেন যাতে করে দুপুরের পর তাঁরা প্রমোশনের লক্ষ্যে কিছু স্টাডি করতে পারেন- যেমন সহকর্মীদের মধ্যে যারা প্রতিদ্বন্দ্বী আছেন তাদের ক্ষমতা যাচাই করা, কিছু রিপোর্ট লেখা যাতে নিজের নাম নজরে আসে, সবার কাজের প্রক্রিয়া কীভাবে উন্নত করা যায় তা নিয়ে গবেষণা করা, কোম্পানির নিয়মকানুন ও ইতিহাস সম্পর্কে সবার জ্ঞান বাড়ানোর চেষ্টা করা ইত্যাদি। লাঞ্চের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারলে সারাদিনের কাজের ফাঁকে ফাঁকেই এই স্টাডিগুলো করে ফেলতে হবে। শুধু চাকরি করলেই হবে না; আপনাকে প্রস্তুতি, গবেষণা, বিশ্লেষণ এবং শেখার মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা এর আগে ম্যানেজারের হাঁটার কথা বলেছি। যার হাঁটাচলা, আচার-আচরণ অনুশীলন করা দরকার বলে মনে করেন করুন। মনে রাখবেন, চলতে না থাকলে শেকড় গজিয়ে যাবে। কখনো থেমে থাকবেন না, চলমান থাকুন।

১.৩. সতর্কতার সাথে সেবা দিন অনেকেই ভাবেন যে সবকিছুতে ‘হ্যাঁ’ ‘হ্যাঁ’ করলেই বুঝি নজরে পড়া যাবে, প্রশংসিত হওয়া যাবে আর প্রমোশনের পথ সহজ হবে। কিন্তু এটা সত্যি নয়। এতে করে চতুর ম্যানেজার এদেরকে ব্যবহার করেন আর এরা অতিরিক্ত খাটুনিতে কাহিল হয়ে পড়েন, অবমূল্যায়িত হন এবং ব্যবহৃত হন। কাজেই হ্যাঁ বলার আগে কিছু বিষয় ভাববেন- এই ব্যক্তি কেন সাহায্য চাইছেন? আমার পরিকল্পনায় এটি কতটুকু সাহায্য করবে? আমি কাজটি করলে ম্যানেজমেন্টের নজরে আমি কেমন হবো আর না করলে কী হবে? আমাকে দিয়ে কি এমন কোনো নোংরা কাজ করানো হচ্ছে যেটা অন্য কেউ করতে চায় না? নাকি এই ব্যক্তিটি সত্যিই কাজের ভারে বিপর্যস্ত এবং আমার সাহায্য তাঁর দরকার?

এমনও হতে পারে যে একটি নোংরা কাজ যা কেউ করতে চায় না তা করে আপনি ম্যানেজমেন্টের সুনজরে পড়তে পারেন। তাঁরা ভাববেন যে আপনি চ্যালেঞ্জ নিতে সক্ষম, কোম্পানির জন্য প্রয়োজনীয় এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে কাজের জন্য প্রস্তুত। আবার আপনি যদি কেবল ফাইলের কাজই করেন তাঁরা ভাবতে পারেন যে আপনি একজন সাধারণ কেরানী। অথবা কাউকে বিপদে সাহায্য করলে আপনার গুডউইল বাড়তে পারে। কাজেই কিছু করার আগে ভালভাবে ভাবুন। না বুঝে হাত তুলে বাঁদর সাজার কোনো মানে হয় না।

এমনও হতে পারে যে অন্যরা সবাই মিলে কোনো কাজে পিছিয়ে গেলেন আর আপনি বাধ্য হলেন সাহায্য করতে। প্রথমবার এমন পরিস্থিতিতে পড়লে অবশ্যই করবেন। কিন্তু মনে রাখবেন যে ‘রুলস’ প্লেয়ারের সাথে কক্ষনো এরকম দুইবার হবে না। এরপর চোখ-কান খোলা রাখবেন আর এমন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হলে অন্য সবার সাথে আপনিও পিছিয়ে যাবেন।

১.৪. এমন একটি কাজের জায়গা বাছুন যা কেউ খেয়াল করেনি আমার একজন কলিগ ছিলেন যিনি সব কাস্টমারদের নাড়ী-নক্ষত্র জানতেন। কার বাচ্চার কবে জন্মদিন, কে কোথায় ছুটি কাটালো, কে কী পছন্দ করে ইত্যাদি ছিল তাঁর নখদর্পণে। এটি কিন্তু তাঁর কাজের অংশ ছিল না। অন্যদেরও কোনো কাস্টমারের ব্যাপারে জানতে হলে তাঁর শরণাপন্ন হতে হতো। এই দক্ষতা অর্জন করতে গিয়ে তাকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে। ব্যাপারটি অচিরেই রিজিওনাল ডিরেক্টরের নজরে আসে এবং তাঁর পদোন্নতি হয়।

এমন একটি জায়গা বাছুন যা কেউ এর আগে খেয়াল করেনি। সেটা হতে পারে রিপোর্ট লেখা, এমন কিছু জানা যা অন্যরা জানে না, বাজেট বানানোতে পারদর্শিতা ইত্যাদি। নিজেকে অপরিহার্য হিসেবে গড়ে তুলুন। নিজের জন্য এমন একটি জায়গা বানাতে গেলে আপনাকে যখন-তখন অফিসের বাইরে যাতে হবে, কাউকে কিছু ব্যাখ্যা না করেই ছুটোছুটি করতে হবে। এতে আপনাকে দলের থেকে আলাদাভাবে দেখা যাবে, স্বাধীনতা পাবেন এবং উন্নত গুণাগুণসম্পন্ন হয়ে উঠবেন। আগে অবশ্যই নিজের কাজ করে নেবেন।

আপনার কাজ শুধু আপনার বসের নজরেই পড়বে না, অন্যদের এবং তাদের বসদের চোখেও পড়বে। বসদের মিটিং-এ যখন অন্য কোনো বস আপনার বসকে বলবেন আপনার কথা তখন আপনাকে প্রমোশন না দেয়া কঠিন হবে। বসদের গ্রুপে নিজের অবস্থান ধরে রাখার জন্যই তিনি তা করবেন।

১.৫. কম প্রতিশ্রুতি, বেশি কাজ ধরুন একটি কাজ করতে আপনার বুধবার পর্যন্ত সময় লাগবে কিন্তু আপনি সময়টি বাড়িয়ে শুক্রবার পর্যন্ত বলুন। আবার ধরুন যে কাজ করতে আপনার ১ সপ্তাহ লাগবে তার জন্য সময় নিন ২ সপ্তাহ। যদি মনে হয় যে আরো ২ জন লোক লাগবে তাহলে বলুন ৩ জন লাগবে। এর মানে এই নয় যে আপনি অসৎ কাজ করছেন বা এতে আপনার ব্যক্তিত্ব নষ্ট হচ্ছে। বরং এটি আপনার দূরদর্শিতার উদাহরণ যা আপনার কাজে সহায়তা করবে। আপনি বেশি সময় চেয়েছেন বলে যে আস্তে ধীরে কাজ সারবেন তা কিন্তু নয়! বরং সময়ের আগে কাজ বুঝিয়ে দিন, বাজেটের মধ্যে রাখুন এবং মান নিশ্চিত করুন।

বেশি কাজ বলতে বোঝাচ্ছি যে আপনাকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যে পরিমাণ কাজ দেয়া হয়েছে, সেটি করে তার সাথে আরো কিছু সম্পর্কিত কাজ গুছিয়ে ফেলুন। ধরা যাক একটা কোম্পানি ব্রোশিওর ছাপানোর কাজ দেয়া হয়েছে। আপনি পুরো কাজটির একটি রঙিন গেটআপ তৈরি করে ফেলুন, প্রুফ রিডিং সেরে ফেলুন এবং ছবি, প্রিন্টিং-এর খরচ- সব উপস্থাপন করুন মিটিং-এ। তবে সবসময় এমনটি করবেন না। মাঝে মাঝে তাক লাগিয়ে দিন বসকে।

কখনো কখনো কোনো সফটওয়্যার বা টেকনিক জেনেও না জানার ভান করুন। পরে পুরো কাজটা করে দেখালে সবাই চমকে যাবে এবং আপনার সুনাম হবে। আগেভাগেই যদি বলে দেন যে এই কাজ আপনি পারেন তাহলে কোনো চমক থাকবে না।

‘রুলস’ প্লেয়ার হিসেবে আপনি কখনোই দেরীতে কাজ জমা দেবেন না বা কম দেবেন না। অল্পসময়ে কাজ জমা দেয়ার লোভে অনেকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলেন কিন্তু পরে ব্যর্থ হন। তখন অন্যের চোখে ছোট হতে হয়। তাদেরকে প্রথমে অতিউদ্যমী আর শেষে অযোগ্য মনে হয়।

১.৬. এমন কিছু জানুন যা অন্যরা জানেন না স্টিভ নামে একজনের সাথে আমার পরিচয় ছিল যে ফ্রেঞ্চ ভাষা জানত। সে প্রথম প্রথম আমাদের মতোই অল্পসল্প জানতো। কিন্তু পরে সে সন্ধ্যায় ফ্রেঞ্চ ভাষার ক্লাস করত, ফ্রেঞ্চ মুভি দেখত, ফ্রেঞ্চ রেকর্ড শুনত এবং ফ্রেঞ্চ উপন্যাস পড়ত। এতে করে সে কিছুদিনের মধ্যেই ফ্রেঞ্চ ভাষায় অনর্গল কথা বলতে শিখে গেল। আমরা তার এই বিষয়টিকে ততটা গুরুত্ব দিইনি। সে অনুমান করেছিল যে আমাদের প্রতিষ্ঠান ইউরোপে যাবে এবং আদপেই তার ফ্রেঞ্চ জানা থাকাটা একটা অনন্য সম্পদ হিসেবে গণ্য হলো।

আপনার কীসে মেধা আছে খুঁজে বের করুন। কেউ কম্পিউটারের আগাগোড়া জানে, কেউ প্রিন্টিং-এ ওস্তাদ। আপনি কি বাজেট ভালো বোঝেন না সফটওয়্যার? টিম চালাতে পটু না স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ভাল বোঝেন? যেটাতেই ভাল হোন না কেন খেয়াল রাখবেন তা যেন কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং আকর্ষণীয় হয়। এভাবে অন্যরা প্রয়োজনে আপনার কাছে আসবে এবং আপনি কর্মচারীর চাইতে কনসালট্যান্ট হিসেবে গুরুত্ব পাবেন।

১.৭. শতকরা ১০০ ভাগ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোন ‘রুলস’ প্লেয়ার হিসেবে আপনাকে আপনার সহকর্মীদের চেয়ে অনেক বেশি খাটতে হবে। লক্ষ্য থেকে এক সেকেন্ডের জন্যও সরা যাবে না। পাকা অপরাধীরা যেমন সদা সতর্ক থাকে তেমনি আপনাকে নিজের সব কথা, পদক্ষেপ ও আচরণ খেয়াল করতে হবে। যদি এর মধ্যে একটি নিয়মও কঠিন লাগে তাহলে ছেড়ে দিন। নিবেদিতপ্রাণ ‘রুলস’ প্লেয়ার দরকার। এজন্য আপনাকে শপথ নিতে হবে। কাজের প্রতি সজাগ, উৎসর্গীকৃত, নিবেদিতপ্রাণ, জাগরুক, আগ্রহী, প্রস্তুত ও সতর্ক হতে হবে।

আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া গেমগুলোতে আপনি নিজেকে না জড়িয়েও উপভোগ করতে পারবেন। পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলে দেখবেন আপনাকে খুব বেশি কিছু করতে হচ্ছে না। এক টোকাতেই মানুষকে দিকনির্দেশনা দিয়ে দিতে পারবেন। খুব বেশি হাঁকডাক করতে হবে না। কিন্তু সম্পূর্ণরূপে মনোনিবেশ না করলে কিন্তু বোকায় পরিণত হবেন।

১.৮. নিজের কাজকে উপভোগ করুন আপনি যদি আপনার কাজকে উপভোগই না করেন তাহলে আর কী লাভ? আপনি যদি আপনার কাজের মাঝে আনন্দই খুঁজে না পান তাহলে বরং আপনি কাজ ছাড়াই থাকুন। অনেকে আছেন যারা স্বীকার করতে ভয় পান যে তাঁরা নিজেদের কাজ করতে উপভোগ করেন, পাছে লোকে কাজপাগল বা দুঃখী ভাবে! অনেকেই ঘ্যানঘ্যান করে অভিযোগ করতে থাকেন কাজ নিয়ে, তাদের ধারণা এটা খুব ভাল ব্যাপার। কিন্তু ‘রুলস’ প্লেয়াররা নিজের কাজকে ভালবাসেন। কাজ করাটাই মজা- এই ভাবনাটা গেঁথে দিন নিজের মধ্যে।

কর্মক্ষেত্রে ভাল সময় কাটানো আর অনুধাবন করা যে কাজ ভাল- দুটো সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। কাজ ভাল লাগার অর্থ হলো- আপনি যা করেন তা নিয়ে গর্বিত, চ্যালেঞ্জ উপভোগ করেন এবং প্রতিদিন আগ্রহ ও আশাবাদ নিয়ে এগিয়ে যান। আর ভাল সময় কাটানো মানে আপনার অর্জন খুব বেশি না, আড্ডা দেন, সহকর্মীদের সাথে পরচর্চা করেন আর ঝিমান। এই আনন্দ ক্ষণস্থায়ী।

কাজ ভাল লাগার অর্থ হলো আপনি আলোচনা, প্রতিদিনের চ্যালেঞ্জ, চাপ, ব্যর্থতা, বিরক্তি, অনিশ্চিত ভবিষ্যত, নতুন কিছু শেখা ইত্যাদি উপভোগ করেন। রিটায়ার করার এক বছরের মধ্যে বিরাটসংখ্যক লোক মারা যান, তাহলে বুঝতেই পারছেন যে এই কাজ অস্তিত্বের জন্য কতটা জরুরী।

১.৯. সঠিক আচরণ গড়ে তুলুন অনেকেই একধরনের ‘আমরা এবং তারা’ মনোভাব ধারণ করে থাকেন। তারা ‘কর্মচারী’দের পক্ষে গলা ফাটান আর ‘ম্যানেজমেন্ট’-এর দোষ দেন। আপনি সঠিক আচরণ ধারণ করবেন। কখনোই ‘আমরা’ হিসেবে ভাববেন না। এখন আপনার অবস্থান যাই হোক না কেন, ভবিষ্যতে আপনি এই ডিপার্টমেন্টের হেড হবেন। ভবিষ্যত চেয়ারম্যান এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টরের বীজ অঙ্কুরিত আছে আপনার মধ্যে। সবাইকে ‘তারা’ হিসেবে দেখুন। প্রকাশ্যে সহকর্মীদের সাথে এক কাতারে দাঁড়াতে হলেও মনে মনে তাদেরকে ‘তারা’ হিসেবে ভাবুন। এটি কক্ষনো ভুলবেন না। বড়জোর তাদের অভিযোগ শুনে হু হাঁ করুন কিন্তু আপনিও ঘ্যানঘ্যান জুড়ে দেবেন না। যৌক্তিকভাবে মনে মনে চিন্তা করুন।

সঠিক আচরণটি হলো- প্রথমে আপনি ম্যানেজমেন্টের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বোঝার চেষ্টা করুন তারপর ‘রুলস’ প্লেয়ার হিসেবে নিজের কথা ভাবুন। অবস্থা যত ভাল হোক বা চরমই হোক দিনের পর দিন আপনাকে আপনার সবচেয়ে ভালটাই দিতে হবে। নিজের কাজের মান বাড়ান এবং সেটি অক্ষুণ্ণ রাখুন। বিরক্ত, ক্লান্ত, অতিষ্ঠ হয়ে গেলেও হাল ছাড়া যাবে না। মাথা উঁচু রেখে, ঘ্যানঘ্যান না করে, ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে ভাল কিছুর আশায় সর্বদা এগিয়ে যাওয়াই সঠিক আচরণ। আপনার ক্ষমতা আছে কিন্তু তা ব্যবহার করতে হবে দয়া, মানবিকতা, নিয়ন্ত্রণ এবং বিবেচনার সাথে। কাউকে খাটো করা যাবে না। কিন্তু কেউ যদি অলস বা বাজে হয় সেটার সুযোগ আপনি নিতেই পারেন। কিন্তু কেউ যেন আপনাকে দোষ দিতে না পারে।

১.১০. আপনি কতটা পরিশ্রম করছেন তা কাউকে জানাবেন না এক্ষেত্রে রিচার্ড ব্র্যানসনকে খেয়াল করুন। তিনি এমন একজন মানুষ যাকে সবসময় খেলতে, মজা করতে বা ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়, কখনই ডেস্কে বসে কাজ করতে দেখা যায় না। কিন্তু তারপরও তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী। কখনোই ব্যবসায়িক বিফলতা তার জীবনে আসেনি। কিন্তু দিনের একটা সময়ে নিশ্চয়ই তাঁকে কাজ করতে হয়। আমরা দেখতে পাই না।

এই ধরনের ইমেজ তৈরি করতে হবে ‘রুলস’ প্লেয়ারকে- সহজ, সাবলীল, আনন্দিত, সুনিয়ন্ত্রিত এবং ঠান্ডা। কখনো দৌড়াদৌড়ি, হুড়োহুড়ি করা যাবে না, আতঙ্কিত হওয়া যাবে না, তাড়াহুড়া করা যাবে না। রাত জেগে কাজ করলেও স্বীকার করা যাবে না। ছুটির দিনে কাজ করলেও তাই। কখনো ঘ্যানঘ্যান কর যাবে না যে কত ঘণ্টা কাজ করছেন বা কত কষ্ট করছেন। বাইরের মানুষ যেন ভাবে যে আপনি অনায়াসেই সব করেন। এজন্য আপনাকে অবশ্যই নিজের কাজে খুব ভাল হতে হবে। আর যদি এখনো ততটা ভাল না হয়ে থাকেন তাহলে শিখুন, পড়ুন, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান বাড়ান। কাজের আদ্যোপান্ত না জানা পর্যন্ত প্রশ্ন করুন, বারবার আওড়ান, খাটুন ও ডুবে যান প্রস্তুতিতে।

এর জন্য আপনার যা যা করা উচিত :

-কাজের শেষ তারিখের পর আবার সময় চাইবেন না

-কারও সাহায্য চাইবেন না

-উপদেশ, নির্দেশনা, তথ্য, মতামত ইত্যাদি চাইতে পারেন

-কতটা কাজ আপনাকে করতে হবে এ নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করবেন না

-দৃঢ়প্রত্যয়ী হোন যাতে অতিরিক্ত কাজের বোঝায় বিপর্যস্ত হতে না হয়

-সবসময় নিজের কাজগুলোকে সহজ উপায়ে করার চেষ্টা করুন এবং দ্রুততার সাথে

বিষয়: বিবিধ

১৪৫১ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

298434
০১ জানুয়ারি ২০১৫ রাত ১২:১৯
প্রবাসী মজুমদার লিখেছেন : ধন্যবাদ খুব দারুণ ও কর্মজীবনে খুবই প্রয়োজন এমন একটি বইকে ভাষান্তরিত করে তুলে ধরার জন্য। নিজেও জীবনে অনেক চাকুরী করেছি। কিন্তু আজ যেন এ বই থেকে নতুন নয় শুধু প্রয়োজনীয় অনেক কিছু শিখলাম। নিয়মিত লিখবেন প্রত্যাশায় থাকলাম।
০১ জানুয়ারি ২০১৫ দুপুর ০৩:৪৬
241732
উম্মত মোহাম্মদ লিখেছেন : মজুমদার ভাই ধন্যবাদ আপনাকে, আমি মনে করি কর্মজীবি সবাই এই বইটি পড়া খুবই প্রয়োজন। জীবন চলার পথে কর্মজীবনের অনেক কিছু শেখার আছে এই বইতে। অন্যদেরকে ও উতসাহিত করবেন।
০২ জানুয়ারি ২০১৫ রাত ০৪:৫৪
241819
প্রবাসী মজুমদার লিখেছেন : বইটি আমি কপি করে রেখে দিয়েছি। দারুণ বই। সাথে রাখার মত।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File