প্রথম যেদিন মর্গে

লিখেছেন লিখেছেন মো নজরুল ইসলাম ২০ অক্টোবর, ২০১৪, ১০:৪৫:৩২ সকাল

এফএম রেডিও গুলোতে ভূতের গল্প খুব জনপ্রিয়। এই ভূতের গল্পে প্রায়ই হসপিটাল বা মেডিক্যালের মর্গের প্যারানরমাল বিভিন্ন কাহিনী তুলে ধরা হয়। আমি দায়িত্ব পালন করতে সিলেট উসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে অনেক বার গিয়েছি। তবে ভূতের গল্পে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার কোনটাই তখন আমার মনে হয়নি বা আমি অন্য রকম কোন অনুভূতি বোধ করেনি। হয়তো সহকর্মীরা সাথে থাকায় এমনটা হয়েছে।

সিলেট উসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গ মেডিক্যালের ইমার্জেন্সী গেইট দিয়ে ঢুকে একদম সুজা রাস্তা দিয়ে চলে গেলে একটি এক তলা বিল্ডিং পাওয়া যাবে। এটাই মর্গ। এখানে একজন দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা বা দাড়োয়ান আছেন। যিনি উপরের নির্দেশে গেইটের তালা খোলে দেন। নতুবা সব সময় এটা তালা বদ্ধ থাকে। আবার যখন লাশ আসে- তা ফ্রিজে ঢুকিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে গেইটে তালা দেয়া হয়।

আমি যেদিন প্রথম মর্গে গিয়েছিলাম, সেদিন সারা দেশে জামায়াতের হরতাল চলছিল। সম্ভবত এটি ২০১৩ সালের ঘটনা। হরতালের দিন খুব সকালে ডিউটিতে বের হতে হতো। কারণ তখন আমি স্টাফ ফটো সাংবাদিক হিসেবে অনলাইন দৈনিক সিলেটের সকাল ডট কমে নিয়োজিত। হরতাল চলাকালে জামায়াতের মিছিল-সমাবেশ কখন, কোথায় হবে তা বলা মুশকিল। তারা ফজরের নামাজের পরেও মিছিল দিয়ে দিতে পারে। ভাগ্য যদি ভালো থাকে তাহলে সামনে পেয়ে যেতে পারি।

সকাল ৭টায় জিন্দাবাজার এলাকায় ঘুরাগুরি করে বন্দরবাজারের দিকে রওনা হলাম। সকাল ৮টায় কোর্ট পয়েন্টে আমরা ক’জন ভ্যান গাড়ি দিয়ে বিক্রি করা চা ওয়ালার কাছ থেকে চা খেয়ে দাড়িঁয়ে আছি। রাস্তা-ঘাট একদম নিরব। দু’একটা রিক্সা চলছিল। দোকান-পাট সব বন্ধ। মানুষ একদম নেই বললেই চলে। আরেকজন ভাইয়ের মোবাইলে ফোন করে কে যেনো বলছে- বিশ্বনাথে শিবিরের মিছিলে পুলিশ গুলিতে একজন নিহত। তখন প্রায় ৯টা বেজে গেছে। বিশ্বনাথের ঘটনা হওয়ায় আমাদের প্রতিনিধিই এসব কাবার করেন। উনার আলাপ শেষ হতে না হতেই আমার মোবাইল বেজে উঠলো। অফিস থেকে বস ফোন দিয়েছেন। রিসিভকরে সালাম দিতেই জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখন কোন জায়গায়? বললা- কোর্ট পয়েন্টে। উনি বললেন, তারাতারী উসমানীতে যাও- একটা লাশ আসতেছে বিশ্বনাথ থেকে, ওটার ছবি, নাম-ঠিকানা, ডাটা নিয়ে অফিসে আসো।

হরতালের দিন- রিক্সা নেই। একটা রিক্সা বেশী ভাড়াঁ দিয়ে আরেকজন ভাইকে নিয়ে গেলাম মেডিক্যাল। গিয়ে দেখি অন্যান্য টিভি চ্যানেলের লোকও সেখানে উপস্থিত। যাদের কোর্ট পয়েন্টে দেখে ছিলাম, তারা মোটর সাইকেল থাকায় আমাদের আগে চলে গেছেন। লাশের সব কাজ শেষে মর্গে রাখা হয়েছে। মর্গ কোন দিকে জানতাম না। আর জানবই বা কি করে। কখনো যাওয়ারই প্রয়োজন পরেনি। আমি প্রথমে মনে করে ছিলাম মর্গ মেডিক্যালের প্রধান বিল্ডিংয়ের কোন এক রুমে হবে। কিন্তু না। ওটা বাইরে। ইমার্জেন্সী গেইট দিয়ে ঢুকে প্রধান বিল্ডিং পার করে একটু দূরে মর্গ। এর আশ-পাশে রাখা হয় অ্যাম্বুলেন্স।

অনেকক্ষন দাড়ানোর পর এক বড় ভাইয়ের পিড়াপিড়িতে দায়িত্বরত কর্মকর্তা মর্গের গেইট খোলে দিলেন। গেইটের ভিতর ঢুকেই সামনের বারান্দায় বাম পাশে একটি বসার ব্রেঞ্চ রাখাছিল। ডান পাশের বড় দরজা দিয়ে ঢুকেই ফ্রিজ রোম। মানে এই রোমের মধ্যেই লাশ রাখা হয়। আর এই পুরো বিল্ডিংটাকেই বলা হয় মর্গ। রোমটা কিছুটা অন্ধকারের মতো। ৬০ পাওয়ারী একটা লাইট জ্বালানো হলো। তবুও কিছুটা অন্ধকার। দায়িত্বরত কর্মকর্তা আগেই বলে রেখে ছিলেন ক্যামেরা রেডি রাখতে। কারণ উর্দ্ধতন কর্মকর্তা কেউ আসলে উনার প্রবলেম হবে। তাই আমরাও রেডি। ফ্রিজের মাঝের একটা ড্রয়ার খোলে দেয়া হলো। ভেবেছিলাম রক্তাক্ত একটা লাশের মুখ দেখতে যাচ্ছি। কারণ আগেই জেনে ছিলাম যে মাথায় গুলি লাগায় লোকটি তাৎক্ষনিক মাঠিতে লুঠিয়ে পড়ে এবং মৃত্যু বরণ করে। ড্রয়ার খুলতেই টিভি সাংবাদিক ক্যামেরাম্যানরা বললেন, স্টিল ক্যামেরার সবাই আগে ছবি নিয়ে নাও পরে আমরা নিব। টিভি ক্যামেরাম্যানদের ফুটেজ নিতে একটু সময় বেশি প্রয়োজন হয় আর বিরতিহীনভাবে কোন বাধাঁ ছাড়াই নিতে হয়। তাই সবাই হুমড়ী খেয়ে ছবি তোলতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম।

লাশের বামপাশে মাথায় গুলি লেগেছে। রক্ত কিছুটা ঢেকে দেয়া সাদা কাপড়ে লেগেছে। হয়তো ছোট করে মাথার চুল কেঁেট দেয়া হয়েছে। মাথার বামপাশের অংশটা আগুনে পুড়ে গেলে চামড়া যেমন দেখায় ঠিক তেমনি দেখা যাচ্ছে। রক্ত বন্ধ রকার জন্য সেলাই দেয়া হয়েছে। জীবিত মানুষের সেলাই দেয়ার দৃশ্য দেখা হলেও এটাই প্রথম অদ্ভুত ধরনের সেলাই। সুই-সুতা ব্যবহার করতে হয়নি। সম্ভবত কোন গরম মেশিন যাতিয় যন্ত্র দিয়ে সেলাই দেয়া হয়েছে। একদম রক্ত বের হচ্ছে না। চোখের নিচে কালো দাগ।

সবার সাথে গাঁধাগাধি করে কয়েকটা ছবি নিয়ে কিছুটা সরে গেলাম। রোমে কয়টা এরকম ফ্রিজ আছে গুনে দেখিনী। বাকী ড্রয়ার গুলোতে লাশ আছে কিনা জানতে ইচ্ছে হলো। হয়তো বা আছে। জামেলার মধ্যে কাউকে জিজ্ঞেস করার মতো সুযোগ পেলাম না। সবার ছবি তোলা হতে না হতেই ফ্রিজের ড্রয়ার লাগিয়ে দেয়া হলো। রোমটা একটু ঘুরে দেখে বাইরে বারান্ধায় চলে আসলাম।

স্বজন বলতে একমাত্র লাশের চাচা এসেছেন। উনি খবর পেয়ে সুজা সিলেট চলে আসেন। লাশ দেখার সুযোগ হয়নি। আমাদের সাথে উনিও লাশ দেখলেন। চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করতে কে যেনো উনাকে বাইরে নিয়ে গেছেন। বাইরে বের হয়ে দেখলাম, চাচা কাঁদতেছেন। কে একজন উনাকে শান্তনা দিচ্ছে। সবাই অপেক্ষায় আছে, কবে উনি একটু শান্ত হবেন আর তথ্য সংগ্রহকরে বিদায় হবে। একটু স্থির হতেই উনাকে প্রশ্ন করা হলো, ভাতিজার নাম, ঠিকানা, বয়স ইত্যাদি। আমাকে কোন প্রশ্ন করতে হলো না। সবাই যখন করতেছিল তখন নোট করে নিয়েছিলাম।

অনলাইন পোর্টাল আর টিভি সাংবাদিকতার মধ্যে হয়তো কোন পার্থক্য নেই। ডু ইট নাও সিস্টেমের। কার আগে কে ইনফরমেশন কন্ট্রোল রুমে জানাবে। আর কন্ট্রোল রুমের লোকজনও অধিক আগ্রহে বসে থাকেন, ইনফরমেশন জানাতে এতো দেরী হচ্ছে কেনো। আমার বেলাও তার ব্যত্তয় ঘটলো না। অফিস থেকে ফোন আসতে লাগলো। ফোনে কিছুটা বলে দিলাম। বস বললেন, তাড়াতারি অফিসে চলে আসো। কারণ, ডাটা দিলেও ছবিতো দেয়া সম্ভব না।

মর্গ থেকে বের হয়ে একটা রিক্সা নিয়ে অফিসের দিকে ছুটে চলা। তখন আমাদের অফিস ছিল জিন্দাবাজার ওয়েস্ট ওয়ার্ল্ড মার্কেটে। রিক্সায় বসে ডাটাগুলো মনেমনে সাজাতে লাগলাম। অফিসে পৌছে ছবি দিলাম। বস নিউজ রেডি করে রেখেছিলেন। শুধু ছবিটা লাগিয়ে দিলাম।

কাজ শেষে আবার মাঠে চলে যাওয়ার নির্দেশ। কখন, কোথায় কি হয় কে জানে। তাই মাঠে চলে গেলাম। দিনটি অন্যান্য কাজের জামেলায় চলে গেলো। সচরাচর মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে যখন কারো বাসায় যাই তখন অন্য রকম একটা ফিলিংস জন্মায়। দায়িত্বরত অবস্থায়ও জন্মায় তবে তা সাময়িক। কাজের চাপে কিছুক্ষণ পর আর তা মনে থাকেনা। মাঝে মাঝে যখন মর্গের প্যারানরমাল কাহিনী শুনী তখন অবাক হই। আমিও তো এরকম একটা মর্গে গিয়েছিলাম। সত্যিই চিন্তা করলে মনে- হয় মর্গ আরেকটা জগৎ। আর সেখানের পরিবেশটাও অন্যরকম। মর্গ........

বিষয়: বিবিধ

১৩৯৫ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

276275
২০ অক্টোবর ২০১৪ দুপুর ১২:১১
নিরবে লিখেছেন : দম বন্ধ হয়ে গেছিলো প্রায়... Whew! Whew! Whew! Whew! Whew! Whew!


ভালো লাগলো ধন্যবাদ I Don't Want To See I Don't Want To See I Don't Want To See I Don't Want To See
২১ অক্টোবর ২০১৪ রাত ১১:৫১
220912
মো নজরুল ইসলাম লিখেছেন : দম বন্ধ হবার মতো লিখা আসছে... মর্গ সম্পর্কে।
আপনাকে স্বাগতম, ভালো থাকবেন।
276383
২০ অক্টোবর ২০১৪ বিকাল ০৪:৫৫
নূর আল আমিন লিখেছেন : অসাধারণ একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন ধন্যবাদ
২১ অক্টোবর ২০১৪ রাত ১১:৫২
220913
মো নজরুল ইসলাম লিখেছেন : আপনাকে স্বাগতম। অভিজ্ঞতার কথা লিখে আমি আনন্দিত
276507
২০ অক্টোবর ২০১৪ রাত ১০:৪৩
সায়েম আহমেদ লিখেছেন : বাপরে...
২১ অক্টোবর ২০১৪ রাত ১১:৫৩
220914
মো নজরুল ইসলাম লিখেছেন : ভয়ের কিছু নাই তো, ভয় পেলেন নাকি?

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File