কুরবানী, মানবিকতা, এনিম্যাল এথিকস এবং ওরিয়েন্টালিষ্টদের অনধিকার চর্চা
লিখেছেন লিখেছেন মু নি র মু হা ম্ম দ ০৩ অক্টোবর, ২০১৪, ০২:২৮:২৭ দুপুর
প্রতি বছর ঈদুল আযহা এলেই এনিম্যাল এথিকসের নামে কিছু বুদ্ধিদীপ্ত লেখার উৎপাদন হয়। একসময় এগুলো সরাসরি ইসলাম নামক জীবন ব্যবস্থাটিকে সরাসরি আঘাত করে লেখা হত। কিন্তু সাইকোলজিক্যাল ফ্যাক্ট হল আপনি যদি দুনিয়ার সবচেয়ে ভাল কথাটাও কাউকে আক্রমণ করে বলেন তাহলে আপনি অবশ্যই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াই পাবেন। মানুষ যখন ক্ষুব্ধ হয় তখন সে যুক্তির ধার ধারে না। An attack is usually answered by another attack. কিন্তু এই উৎপাদিত তথাকথিত “বুদ্ধিবৃত্তিক” লেখাগুলো উৎপাদনের মূল উদ্দেশ্য আপনাকে রাগিয়ে দেয়া নয় বরং আপনার বিশ্বাস ও আস্থার স্থলে ছোট ছোট সংশয় ও “কিন্তু” ঢুকিয়ে দিয়ে আপনাকে ধীরে ধীরে নাস্তিকতার দলে ভেড়ানো। এইসকল অসংখ্য ছোট ছোট কিন্তু ও সংশয় মিলে ইসলামের প্রতি একজন মুসলমানের সন্দেহ ও সংশয়ের মাত্রাটা প্রকাণ্ড হয় আর সে নিজের অজান্তেই ইমানের পরীক্ষায় হেরে যায়। সেজন্য এই ধরনের লেখাগুলোতে আক্রমণাত্মক ভাবটা এখন আর থাকে না। থাকে আর্গুমেন্টেটিভ টোন বা বিতার্কিক আবহ। এতে আশ্রয় নেয়া হয় ইসলামেরই কিছু মানবিক প্রিন্সিপ্যাল, যেগুলোকে যুক্তি হিসেবে দাড় করিয়ে দেখানো হয় স্বয়ং ইসলামেই “মানবিকতার” যে গাইড লাইন আছে তার আলোকে আমরা এনিম্যাল এথিকসের ব্যাপারে চিন্তা করতে পারি।
এ বিতার্কিক আবহ মানুষের উৎসুক মনকে একটিভ করে তোলে, সে উত্তর পেতে অস্থির হয়ে পড়ে। কিন্তু সে উত্তর পাবে কই? তার শিশু শ্রেণী থেকে মেট্রিক পর্যন্ত পড়া ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা নামক বইগুলোতে তো এ ব্যাপারে কিছুই নেই! শত শত পৃষ্ঠার এই বইগুলো থেকে সে শিখেছে কি? অবশ্যই শিখেছে কিছু, কিন্তু মুসলমান জীবনের প্রয়োজনের কাছে সেটা এতটাই অপ্রতুল যে সে না পেয়েছে ঘোড়ার ডিম না হয়েছে প্রকৃত কিছু। এভাবে একটি মহল ক্রমাগতভাবে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আমাদেরকে ইসলাম থেকে দূরে রেখে রেখে আমাদেরকে অজ্ঞ রেখে নিজেদের মত করে আমাদেরকে জ্ঞান দিতে আসে। সে জ্ঞান পেয়ে আমরা আমাদের ইমান আকিদা ও বিশ্বাসের ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে যাই। এরকম একটি মহল এদেশের শুধু নয়, প্রায় সকল মুসলিম দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদ অধিকার করে বসে আছে। ওরা শুধু পলিসি চেঞ্জ করে আর আমরা কোত্থেকে কিভাবে যে নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হই তার কোনও টেরই পাই না আমরা।
আর কদিন পরেই পবিত্র ঈদুল আযহা। এমন সময়ে পশুকুরবানী নিয়ে একটি মানবতাবাদী লেখা কেন আসে না তা নিয়ে আমি বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। এর আগে বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরে মতামত-বিশ্লেষণ বিভাগের আন্ডারে এইরকম লেখা এসেছে। তাই চোখ রেখে যাচ্ছিলাম সেখানে। কিন্তু আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই পেলাম ঢাকাট্রিবিউনে। এবার ইংরেজিতে লেখা হয়েছে । লেখাটির নাম Can slaughter be religion? “জবাই করা কি ধর্ম হতে পারে?”। ভাবখানা এমন যেন ধর্মের ব্যাপারে তারা কতো আন্তরিক। এটাকেই বলে টোন, আপনি লেখার টোনটা একটু চেঞ্জ করে দিয়ে চরম বিদ্বেষী মতামত ভদ্রভাবে প্রচার করতে পারেন। তখন সহজেই এটার নাম দিতে পারবেন “মুক্তবুদ্ধি চর্চা”। লেখাটি লিখেছেন রেইনার এবার্ট। তিনিই আবার ২০১২ সালের অক্টোবরে এই একই বিষয়বস্তু নিয়ে বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরে লিখেছেন “মুসলিম ভাইবোনদের প্রতি খোলা চিঠি”। এই লেখকের সহকারী লেখকদের একটা তালিকা হল হাসনা বেগম, টিবর আর মাচান ও শাহনূর রাব্বানী। নামগুলো কেন বললাম? কারণ মাঝে মাঝে লেজুড়বৃত্তিমুলক সিন্ডিকেট লেখার সূত্র বের করতে পাঠকের এই নামগুলো দরকার হতে পারে।
আমাদের কলোনিয়াল মানসিকতার একটা সুযোগ এরা পাচ্ছে। শত শত বছর ইংরেজদের দোররার তলে শাসিত হওয়ার পরে আমাদের মন ও মানসিকতায় এটা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে পশ্চিমদেশ থেকে যাদের পড়াশোনা তারা খুবই গুনগত মান সম্পন্ন। তাদের বুদ্ধি, তাদের মতামত এবং তাদের জুতোর রশি থেকে মাথার চুল পর্যন্ত এতটাই গুনগত মান সম্পন্ন যে ওগুলো ধুয়ে পানি খেলেও আমাদের অনেক উন্নতি হবে। এই হল আমাদের কলোনিয়াল মেন্টালিটি, যাকিছু ওয়েস্টার্ন থেকে আসে তা কিছুই শিরোধার্য। এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে চাকরি-বাকরি সব ক্ষেত্রেই যারা ওয়েস্ট থেকে ডিগ্রী নিয়ে আসেন তাদের বাজার কাটতি থাকে আকাশ চুম্বী। এই লেখকও আমাদের কলোনিয়াল মানসিকতার কাছে ওয়েস্টার্ন ব্র্যান্ড বেচে খাচ্ছেন। তার লেখার নীচেই লেখা থাকে... Rice Universityর ছাত্র, এবং Associate Fellow at the Oxford Centre for Animal Ethics”
যাইহোক, আমি পাঠকদেরকে প্রকৃতির ফুড সাইকেলটা নিয়ে অতি অল্প সময়ের জন্য চিন্তা করতে বলবো। আপনি যদি ফুড সাইকেলের দিকে তাকান তাহলে দেখবেন যে প্রায় সকল প্রাণীই কোনও না কোনও প্রাণীর খাদ্য। আমরা যেরকম গরু ছাগলের গোস্ত খাই তেমনি অন্য প্রায় সকল প্রাণীরাই কোনও না কোনও প্রাণীকে নিজেদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। মূলত এটাই আল্লাহ কর্তৃক বেধে দেয়া প্রকৃতির নিয়ম। সেজন্যই আপনি একটি প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটালে অন্য অনেক প্রাণীও ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হবে যারা ঐ প্রাণীকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। অতএব এই দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলমানরা যে গরুছাগল জবাই করে খাচ্ছে তা নিয়ে মোরাল বা এথিকাল প্রশ্ন তোলার কোনও গ্রাউন্ড নেই। চিন্তার ক্ষেত্রে অলস মানুষের বিশ্বাস ও আস্থার উপর আক্রমণই হচ্ছে এনিম্যাল এথিকসের নামে এসকল উদ্ভট কথা ছড়ানোর মুল উদ্দেশ্য।
প্রাণী বিলুপ্তির বিষয়ে কিছু কথা না বললেই নয়, এখানে ইসলামের একটা মহিমান্বিত পদক্ষেপ আছে যার সম্বন্ধে আমাদের খুব কম লোকেরই ধারণা আছে। শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে যেসকল পশু মাংসাশী নয় অর্থাৎ অন্য পশুর গোস্ত খায় না কিংবা হিংস্র নয় এমন প্রাণীই শুধু মানুষ আল্লাহর নামে জবাই করে খেতে পারবে। প্রাণীদের মধ্যে ঘোড়া এমনই একটি প্রাণী অথচ এই প্রাণীটি খেতে রাসুল (স) নিষেধ করেছিলেন কারণ ঘোড়ার প্রজনন হার উট, গরু, ছাগল ও ভেড়ার তুলনায় অনেক বেশি অপ্রতুল। এখন যদি মানুষ ঘোড়াও খেতে শুরু করে তাহলে একদিন এই প্রাণীটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সুতরাং এটাকে আপনি ইসলামি এনিম্যাল এথিকসের একটা নীতি হিসেবে ধরে সামনে আগাতে পারেন। তার মানে হল ইসলাম এনিম্যাল এথিকসের ব্যাপারে অচেতন নয় বরং খুব ভালোভাবেই সচেতন।
এছাড়া রেইন এবার্ট কিছু কিছু ব্যাপার তুলে ধরেছেন যার সাথে আমি নিজেও একমত যেমন কোরবানির পশুকে যানবাহনে করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেয়ার সময় অমানবিক আচরণ না করা। জবাই করার সময় টর্চার না করা। আসলে এগুলোই মূলত ইসলামের নির্দেশিত পথ। কিন্তু এই লোকটি ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে ইসলাম জানে কোথায় ইমোশনের লাগাম টানতে হবে আর রেইন এবার্ট জানেননা কোথায় ইমোশনের লাগাম টেনে বাস্তবিক চিন্তা করতে হবে। বরং তিনি জানেন কিভাবে মানুষের মানবিক আবেগকে পুঁজি করে তিলকে তাল বানাতে হবে। এটা নিঃসন্দেহে দুরভিসন্ধিমুলক বুদ্ধি-চর্চা। সন্দেহ বাদী ও নাস্তিকদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা অন্য অনেক জায়গার মতো এই জায়গাটিতে এসেই দুর্ণিতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে সব সময়। এভাবে আরও অনেক যুক্তি দেয়া যায় কিন্তু ছোট্ট কলেবরের কারণে সেটা করা যাচ্ছে না।
উপরের যুক্তিগুলো স্রেফ যুক্তির কথা। এখন যেটা বলবো সেটা হল ইমান বা বিশ্বাসের কথা। এটা এমন একটা গ্রাউন্ড যেখানে রেইন এবার্টদের যুক্তির কোনও মূল্য নেই। কারণ একটাই, তারা বিশ্বাসী নন আর আমরা বিশ্বাসী। নাস্তিকরা কিংবা ওরিয়েন্টালিষ্টরা নামাজ, হজ্জ্ব ও রোজা এমন ইবাদাত গুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারেন। সেক্ষেত্রে আমাদের চেষ্টা থাকে তাদের প্রশ্নের যুক্তিপূর্ণ জবাব দেয়া। এই চেষ্টাটাই আমি উপরে করেছি। কিন্তু আমরা কিভাবে নামাজ পড়বো, কিভাবে হজ্জ পালন করবো অথবা কিভাবে রোজা রাখবো এমন কথা ইনারা বলার অধিকার তারা রাখেন না। এটা যিনি বলবেন তিনি একমাত্র আল্লাহ ও তার রাসুল (স)। তা না হলে আমাদের বিশ্বাস বা ইমানের যৌক্তিক কোনও মূল্যই থাকে না। অতি বুদ্ধিসম্পন্ন রেইন এবার্ট এই অনধিকার চর্চাটাই করেছেন। তিনি পবিত্র ঈদুল আযহা কে কিভাবে সেলিব্রেট করা যায় সে পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি আমাদেরকে ভেজিটেরিয়ান ওয়েতে সেলিব্রেট করার পরামর্শ দিয়েছেন। ঈদুল আযহা আমাদের ধর্মীয় ইবাদাত। এটা কিভাবে আমরা পালন করবো তা একমাত্র আল্লাহ ও তার রাসুল (স) বলবেন। এবং সে নির্দেশনা আমরা পেয়েছিও।
মুসলমানদের জন্য কথা হল, যারা আল্লাহতে বিশ্বাস করেন তাদের জন্য একমাত্র ধর্তব্য হল আল্লাহ ও তার রাসুল (স) কি বলেছেন সেটা। সেক্ষেত্রে মানুষের ইমোশোনালি বায়াসড মানবিকতার থিওরি যতই আকর্ষণীয় হোকনা কেন তাতে আমাদের কিছুই করার নেই। কারণ আমরাতো সেই বিশ্বাসী যারা আল্লাহর রাহে নিজেদের জীবন এমনকি নিজের সন্তানদের জীবনকেও বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত। অতএব এরকম ইমানের কাছে অতিরঞ্জিত মানবিকতা, ইমোশনালি বায়াসড এনিম্যাল এথিকসের দোহাই অসাড় হয়ে পড়ে। আমরা যে পশুগুলো আল্লাহর রাহে কুরবানি করছি সেগুলো মহান আল্লাহরই সৃষ্টি। যেটি অতি ইসলাম বান্ধব হওয়ার ধান্দাবাজি করতে গিয়ে রেইন এবার্ট নিজেই স্বীকার করেছেন। অতএব যিনি আমাদের ও এই পশুগুলির সৃষ্টি কর্তা তিনিই যদি আমাদের আদেশ করেন তার নামে কিছু পশুকে কুরবানি করে দিতে তাহলে সেখানে রেইন এবার্টদের সমস্যাটা কোথায়? মালিক কি তার তৈরি জিনিসকে তার ইচ্ছে মতো পাওয়ার অধিকারী নন? যদি তাই হয় তাহলে এনিম্যাল এথিকসের নামে স্রষ্টার আদেশ অমান্য করার পরামর্শ দিয়ে রেইন এবার্ট কি মূলত মুসলমানদেরকে তাদের ইমান বিসর্জন দিতে আহবান করছেন না?
https://www.facebook.com/permalink.php?story_fbid=332577816912358&id=100004804274713
বিষয়: বিবিধ
১০৯১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন