চাঁদ দেখা, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা উদযাপনে বিভ্রান্তির অপনোদন।

লিখেছেন লিখেছেন হাবিবুর-রহমান ০১ অক্টোবর, ২০১৪, ০৫:০০:১০ বিকাল

সমগ্র বিশ্বের মুসলিম জাতী ইসলামের অন্যতম বুনিয়াদী ইবাদত মাহে রমজানের সিয়াম বা রোযা পালন শেষ করেছেন। বাংলাদেশের মুসলিম সমাজও দ্বিধা বিভক্তির মাঝে (কেউ একদিন আগে কেউ একদিন পর) পবিত্র মাহে রমজানের রোযা পালন, ঈদুল ফিতর উদযাপন শেষ করে ঈদুল আযহা উদযাপনের অপেক্ষায় আছেন।

বিগত কয়েক বৎসর থেকে বাংলাদেশের মুসলমানদের মাঝে রোযা পালন শুরু করা, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা উদযাপনের দিন নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন পত্র পত্রিকা ও টেলিভিশনের খবরে জানা যায় চাঁদপুরের শাদ্রা সহ ৪০টি গ্রাম, শরীয়তপুরের ৩০টি গ্রাম এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার কিছু লোক ইসলামী যযবা দেখাতে গিয়ে অগ্রিম রোযা অগ্রিম ঈদুল ফিতর পালন করছেন। শরীয়তের মুল লক্ষ্য ও ভাব ধারায় অনভিজ্ঞ কতিপয় নামধারী আলেম-ওলামা, পীর-বুযর্গ, মুত্তাকী পরহেজগার, আলেমে হাক্কানি আরেফে রাব্বানী খ্যাত নিজেদের মন মত শরীয়ত বর্জিত মনগড়া পদ্ধতিতে বিভিন্ন ইবাদত বন্দেগী করে নিজেদেরকে শরীয়ত বিশেষজ্ঞ এবং পরকালের নাজী এবং সফলকাম মনে করেন। প্রকৃত পক্ষে এরাই বেদয়াতী গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট, পরকালে জাহান্নামী। তাঁরা রমজানের রোযা, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা উদযাপনের দিন নিয়ে প্রতি বৎসরই চরম খামখেয়ালী ও উদাসীনতার পরিচয় দিয়ে থাকেন। ইসলামের বুনিয়াদী ইবাদত রোযা-নামাজ নিয়ে এহেন বিভ্রান্তি ও খামখেয়ালী ধর্ম প্রাণ মুসলমানদের কাম্য হতে পারে না।

শাদ্রা ও শাদ্রার অন্ধ অনুসারীরা সৌদি ভূখণ্ডে রমজানের চাঁদ উদয়ের সাথে মিল রেখে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে চাঁদ উদয়ের পূর্বে শাবান মাসের ২৯/৩০ তারিখ অগ্রিম রোযা শুরু করে, অগ্রিম সাহরী খায় এবং সৌদি গনের ৩ ঘণ্টা পূর্বে সৌদি দিনের বেলায় ইফতারও করে। এমনকি বাংলাদেশ ভূখণ্ডে শাওয়াল মাসের চন্দ্র উদয়ের পূর্বে রমজান মাসের শেষ দিন শাদ্রা ও শাদ্রার অনুসারীরা অগ্রিম ঈদুল ফিতর আদায় করে। এখন প্রশ্ন এদের ঈদুল ফিতর সহীহ হলে এবং সাওয়াব বলে গণ্য হলে যারা রোজা রাখেন তাদের রোজা রাখাটা হবে হারাম, গুনাহ বলে বিবেচিত হবে কেননা ঈদের দিনে রোজা রাখা হারাম। আর রোজা রাখা সহীহ হলে শাদ্রা ও শাদ্রার অনুসারীদের ঈদ পালন করা হবে হারাম। মোটকথা একই ভূখণ্ডে একই এলাকায় একই সময়ে কেউ রোজা পালন করবে আর কেউ ঈদ পালন করবে দুটি বিপরীতমুখী আমল কখনও ইবাদত হতে পারে না। অথচ প্রতিদিন তারা পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, জুমা ও অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান বাংলাদেশের সময়ের সাথে মিল রেখেই আদায় করে থাকেন।

যাহোক এখন প্রশ্ন দ্বিমুখী বা বিপরীত মুখী আমলের কারণে তাদের রোযা সহীহ হলে নামাজ সহীহ হবে না, আর নামাজ সহীহ হলে রোযা সহীহ হবে না। বরং দিনের বেলায় পানাহারের অপরাধে প্রত্যেকটি রোযা ভঙ্গ হবে, কাযা ও কাফফারা আদায় করাও ওয়াজিব হবে। অতএব তাদের দাবীটা গরমিলে রূপান্তর হয়ে গেল।

আমি আশা করি তারা বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বসবাস করে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে চন্দ্র উদয় অস্তের ভিত্তিতে রোযা, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা উদযাপন করবেন এবং অগ্রিম সাহরী, অগ্রিম ইফতার, অগ্রিম রোযা পালন এবং অগ্রিম ঈদুল ফিতর উদযাপন করা থেকে বিরত থেকে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের সাথে মিল টা ঠিক করে নিবেন। কেননা আল্লাহ কখনও মোনাফেকি ইবাদত কবুল করেন না। চাঁদ দেখার ব্যাপারে ভৌগলিক পার্থক্য অস্বীকার করার উপায় নেই। এ বিষয়ে বহু আলেম ওলামায়েকেরাম গনের মাঝে মত পার্থক্য রয়েছে। রাসূল সঃ বলেছেন তোমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখ এবং চাঁদ দেখে রোযা ভঙ্গ কর। এতে দেখা যায় ভৌগলিক পার্থক্যকে স্বীকার করে নিয়ে প্রত্যেক দেশে পৃথক পৃথক সময় রমজানের চাঁদ দেখে রোযা শুরু করতে হবে। শাওয়ালের চাঁদ দেখে ঈদুল ফিতরও উদযাপন করতে হবে। রমজানের চাঁদ উদয়ের পর সুবহে সাদিক থেকে শুরু করে প্রত্যেক দেশের ভূখণ্ডে সূর্যাস্ত না যাওয়া পর্যন্ত দিনের বেলায় পানাহার ও কামাচার থেকে বিরত থাকার নামই রোযা। তাকওয়ার গুণাবলী অর্জনের লক্ষ্যে পবিত্র মাহে রমজানের রোযা আল্লাহ পাক ফরজ করেছেন। আল্লাহ পাকের নির্দেশে প্রতিটি মোমেন ব্যক্তি ৬৯৬-৭২০ ঘণ্টা রমজানের একটি মাস প্রবৃত্তি কে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দিনে বেলায় হালাল পানাহার ও কামাচার কে বর্জন করে স্থায়ী ভাবে হারাম কে ত্যাগ করার মন মানসিকতার সৃষ্টি করাই হল রোজা পালনের মুল উদ্দেশ্য। এছাড়া রোজা প্রতিটি মোমেন কে জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ্‌র হুকুম কে যথাযথ ভাবে কাঁটায় কাঁটায় মানার প্রশিক্ষণ দান করেন।

পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে বুঝা যায় ইসলাম ঘড়ির দৃষ্টিতে সময় নির্বাচন ও নির্ধারণের পরিবর্তে বিশ্ব প্রকৃতির দিক চক্রাবলে যে সব নিদর্শন (চন্দ্র, সূর্য) উজ্জ্বল হয়ে উঠে উহার দৃষ্টিতে সময় নির্দিষ্ট করেছেন এবং নামাজ রোজার সময় নির্ধারণ করেছেন। অতএব চন্দ্র সূর্য উদয় অস্তের ভিত্তিতে দিন রাত বিবেচনা করা হয় চন্দ্র মাস, চন্দ্র বৎসর ও সৌর বৎসর হিসাব করা হয়। আমরা প্রতিদিন চাঁদকে একটু দেরীতে উঠতে দেখি, এর ফলে চাঁদকে ক্রমে ক্রমে বড় হতে দেখা যায়; আবার পূর্ণিমার পর ক্রমান্বয়ে ছোট হয়ে শেষ পর্যন্ত অমাবস্যা হয়ে চাঁদের একটা মাস অতিবাহিত হয়। চন্দ্র মাস গুলি সৌর মাস অপেক্ষা একটু কম হওয়ায় সৌর বৎসর হতে প্রতি বৎসরই চন্দ্র বৎসর ১১দিন কম হয়ে থাকে। যার ফলে আমরা প্রতি ৩৩ বৎসর অন্তর একবার বড়দিনে রোজা করে থাকি। যদি চন্দ্র বৎসর সৌর বৎসরের ন্যায় হত; তাহলে প্রতিটি মুসলিমকে সারাজীবনই একই সময়ে রোজা পালন করতে হত। বিজ্ঞানময় মহান আল্লাহ্‌ বিজ্ঞচিত ভাবে মুসলিম জাতীর কল্যাণে বৎসরের ছোট দিন ও বড় সব দিনগুলোতে রোজা পালনের ব্যবস্থায় মহা কৌশল অবলম্বন করেছেন। আল্লাহ পাক যদি সৌদি আরবের সাথে মিলায়ে রমজানের রোযা ফরজ করতেন; তা হলে কোথাও দিনের বেলায়, কোথাও রাতের বেলায় এবং কোথাও দিন ও রাতের কিছু অংশ মিলিয়ে রোজা রাখতে হত। রোযার সংখ্যা ২৯টি বা ৩০টি নয় বরং এক চন্দ্রমাস রোযা ফরজ করা হয়েছে। তবে কেউ বাংলাদেশে রোজা রাখা শুরু করে রমজান মাসে সৌদি আরব চলে গেলে তার একটি রোজা কমে যাবে; আবার কেউ সৌদিতে রোজা শুরু করে রমজান মাসে বাংলাদেশে আসলে তাহলে তার একটি রোজা বেড়ে যাবে। মূল কথা বসবাসরত ভূখণ্ডের সাথে চন্দ্র সূর্য উদয় অস্ত সম্পৃক্ত হওয়ায় রোজার সংখ্যা কম-বেশি হয়ে থাকে। অতএব প্রত্যেক দেশের ভূখণ্ডে চন্দ্র সূর্য উদয় অস্তের ভিত্তিতে আমাদের নামাজ রোযা অন্যান্য যাবতীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদী পালন করা কর্তব্য। কোন ক্রমেই ধর্মীয় বিষয়াদিতে অতি রঞ্জিত ও অতিরিক্ত বাড়া বাড়ি করা উচিৎ নয়। ইসলামী চিন্তাবিদদের নামে কতিপয় ব্যক্তি বর্গ একই দিনে একই সময়ে সমগ্র বিশ্বে ঈদ উদযাপনের উদ্ভট চিন্তায় লিপ্ত। এমন কি ও. আই. সি. সম্মেলনেও কেউ কেউ তাদের দাবি উত্থাপন করেছেন। আবার কেউ নিজেকে মুজাদ্দিদের দাবিও করেছে। প্রকৃত সত্য চন্দ্র সূর্য যেহেতু একই সময়ে সমগ্র বিশ্বে উদয় হয় না, একই সময়ে অস্তও যায় না। সেহেতু একই দিনে একই সময়ে সমগ্র বিশ্বে ঈদ পালন করা সম্ভব নয়, এটাই বাস্তব। একই সময়ে একই একই দিনে সমগ্র বিশ্বে ঈদ উদযাপন করাতে কোন কল্যাণ আছে বলে আমি মনে করি না।

আসুন আমরা বাংলাদেশীগন সকল প্রকার বিভ্রান্তি ও গোঁড়ামি পরিহার করে একই দিনে রোযা শুরু করি, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা উদযাপন করি। এবং একই ভূখণ্ডে একই দিনে সবাই মিলে রোজা ও ঈদ পালন করে ইসলামী ঐক্যের বন্ধন সুদৃঢ় করি; না হয় এ বিভ্রান্তি ও গোঁড়ামি একদিন মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। ধর্মীয় বিশৃঙ্খলা, অনৈক্য ও বিভ্রান্তি দূরীকরণে কুরআন, হাদিস ইজমা, কিয়াস ও বিজ্ঞান সম্মত সঠিক ফতোয়া প্রদান করা ইসলামী চিন্তাবিদ ও বিজ্ঞ আলেম সমাজের ঈমানী দায়িত্ব। ধর্মীয় বিধান পালনে নানা বিভ্রান্তি নিরসনে বাংলাদেশ ইসলামী ফাউন্ডেশনের যথাযথ ভূমিকা থাকা উচিৎ বলে আমি মনে করি। সত্য প্রকাশে চুপ থাকা ঈমান আকীদাহর পরিপন্থী বোবা শয়তানের কাজ।

আসুন আমরা কুরআন হাদিসকে বুঝতে, সত্যকে জানতে ও মানতে আল্লাহ প্রদত্ত বিবেক বুদ্ধিকে কাজে লাগাই এবং সহীহ আমলে অগ্রসর হই।

________________

মাওলানা হাবীবুর রহমান

সাবেক ঈমাম

বিষয়: বিবিধ

১১৬০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File