সংবাদ মাধ্যমঃ প্রেক্ষিত ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি # মুহাম্মদ আবদুল কাদের #
লিখেছেন লিখেছেন নিঝুম অরন্ন ০৯ নভেম্বর, ২০১৪, ০৪:১৪:৪১ বিকাল
সংবাদ মাধ্যমঃ প্রেক্ষিত ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি
আমরা সবাই অবগত যে সংবাদ মাধ্যম গুলোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল রাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় বা স্থানে দৈনন্দিক যা সংঘটিত হয় তা বস্তুনিষ্ঠ ভাবে জাতির কাছে সংবাদ তুলে ধরা। যার মাধ্যমে সকল নাগরিককে সচেতন করে মানবতার কল্যাণ সহ একটি দেশকে সুখী-সমৃদ্ধশালী, শান্তি প্রিয় আবাস ভূমি ও উন্নত জাতি গঠনে ভূমিকা পালন, বিভেদ নয় ঐক্য বদ্ধ প্রচেষ্টা পালন,অপসংস্কৃতি নয় সুস্থ্য সংস্কৃতি চর্চা, পাশ্চাত্য আধিপত্য প্রতিষ্ঠা নয় নিজস্বতা, সাম্য প্রতিষ্ঠা, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অনুকরণীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্ঠা, নিজের স্বার্থ প্রতিষ্ঠা নয় দেশের দেশের মানুষের স্বার্থের জন্য কাজ ইত্যাদি। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হল বর্তমান যুগে সংবাদ মাধ্যম গুলো অধিকাংশ সময় উপরোক্ত বিষয়গুলো উপেক্ষা করে সত্য ও কল্যাণকর সংবাদ পরিবেশন করার পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বসতি হয়ে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষকে উসকে দিয়ে বিভেদের দেয়াল সৃষ্টি করে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের মানচিত্রকে বারবার হুমকির সমুখিন করছে। প্রিয় পাঠকগণ আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস হলো তাদের জন্য যারা সত্যিকার দেশপ্রেমিক, যারা উত্তরত্তর দেশের মান মর্যাদা বৃদ্ধি করতে ইচ্ছুক, ইসলাম প্রিয় এবং দুনিয়ায় শান্তি ও আখেরাতে শান্তি প্রাপ্ত হতে আগ্রহী সে সকল মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও সংবাদ কর্মী তাদের জন্য।
ইসলামী সংবাদ মাধ্যম একটি বিশেষায়িত সংবাদ মাধ্যম। যার উৎসমূল অনন্য বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। এর মূলভিত্তি প্রধান দু’টি বিষয়ের দিকে নিবদ্ধ। আর তা হল, কুরআনুল কারীম ও রাসূলের সুন্নাহ্। সংবাদ মাধ্যম মানুষের এক ধরনের প্রচেষ্টা ও তৎপরতা, যা যোগাযোগের সকল মাধ্যমকে অন্তর্ভুক্ত করে। সুনির্দিষ্ট নীতিমালার উপর ভিত্তি করে এটি পরিচালিত হয়। যেসব মৌলিক নীতিমালার উপর ভিত্তি করে ইসলামী সংবাদ মাধ্যম পরিচালিত হবে, তা-ই ইসলামী মিডিয়ার বা সংবাদ মাধ্যমের ভিত্তি। নিম্নে এ বিষয়ে মূলত তিনটি জিনিস আলোচনা করব প্রথমত ইসলামের দৃষ্টিতে সংবাদ মাধ্যমের উৎস, দ্বিতীয়ত মূলনীতি, তৃতীয়ত এর ভিত্তি । যা বিস্তারিত আলোকপাত করা হল:
ক. সংবাদ মাধ্যম এর উৎসমূহ
প্রত্যেক সংবাদ মাধ্যমের উৎসমূল রয়েছে যার দ্বারা পরিচালিত হয়। ইসলামী সংবাদ মাধ্যমও অনুরূপ উৎসের অধিকারী। এর উৎসসমূহ ইসলামের উৎসের মত। আর এটি একটি বিশেষায়িত সংবাদ মাধ্যম। নিম্নে এর উৎসসমূহ বিস্তারিত আলোকপাত করা হল:
প্রথমত: কুরআনুল কারীম
মহাগ্রন্থ আল্-কুরআন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির হেদায়েতের জন্য প্রেরিত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। এর অলৌকিকত্ব অত্যন্ত ব্যাপক, ভাষা উচ্চারণ, বর্ণনা ভঙ্গিমা, অর্থ প্রভৃতি ক্ষেত্রে এটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। যেহেতু এটি মানবজাতির হেদায়াতের নিমিত্তে নাযিলকৃত, সেহেতু এতে দুনিয়া ও আখেরাতের সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন-
‘‘এ কিতাবে আমরা কোন কিছুই বাদ দেইনি।’’ সূরা আল আন ’আম- ৩৮
অতএব, আল-কুরআন রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে প্রেরিত রিসালাত যা মানবজাতির পূর্ণ হিদায়াতের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। ফলে এটি সংবাদ মাধ্যম বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ও প্রভাবিত একটি গ্রন্থ। যাতে মানুষের মাঝে প্রভাব সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন মাধ্যম ও পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। আর মুসলিমগণ মানুষের পরস্পরের মাঝে যে কোনো সংবাদ বা ইসলামী দা‘ওয়াতী মেসেজ পৌঁছে দিতে কুরআন থেকেই উপর্যুক্ত পদ্ধতি ও মাধ্যম অন্বেষণ করে। কুরআনুল কারীম বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষের অন্তরের গভীরে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে। ইসলামী সংবাদ মাধ্যমও মানব অন্তরের গভীরে যেতে চায় তার স্বাতন্ত্রতা বজায় রেখে। সুতরাং এর মূলভিত্তি প্রধান দু’টি বিষয়ের দিকে নিবদ্ধ। আর তা হল, কুরআনুল কারীম ও রাসূলের সুন্নাহ্। বিদায় হজ্জের ভাষণে এ দু’টি বিষয়কে আঁকড়ে ধরার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকলকে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি তৎকালীন অন্যতম গণমাধ্যম বক্তৃতার মাধ্যমে লাখ জনতার উপস্থিত শ্রোতামন্ডলী ও অনুপস্থিত সকল মুসলিমকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন -
‘‘আমি তোমাদের কাছে দু’টি বিষয় রেখে যাচ্ছি, তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না যতক্ষণ সেগুলো আঁকড়ে ধরে রাখ- আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাত ।’’ মুওয়াত্তা ইমাম মালিক, হাদীস নং ১৮৭৪
সংবাদ মাধ্যমও অবশ্য কর্তব্য হলো উপর্যুক্ত দু’টি বিষয়কে আবশ্যক করে নেয়া, চাই তা তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে হোক অথবা বাস্তবিক অনুশীলনের ক্ষেত্রে হোক। মহান আল্লাহ বলেন,
আর আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল কোনো বিষয়ের ফয়সালা দিলে কোনো মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর জন্য সে বিষয়ে তাদের কোনো (ভিন্ন সিদ্ধান্তের) ইখতিয়ার সংগত নয়। আর যে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করল সে স্পষ্টভাবে পথভ্রষ্ট হবে। সূরা আহযাব : ৩৬
কুরআনের তেলাওয়াত ইবাদাত এবং গবেষণামূলক অধ্যয়ন মানুষকে আল্লাহর নৈকট্যশীল করে। যারা তা অস্বীকার করে তারা কাফির হিসেবে সাব্যস্ত হবে। এটি ইসলামী শরীয়তের যে কোনো দলীল-প্রমাণাদির ক্ষেত্রে প্রথম উৎস। আর এটি প্রধান সংবিধান ও প্রধান উৎস হিসেবে স্বীকৃত।
উপরে বর্ণিত কুরআনের সংজ্ঞা আরো স্পষ্ট করে দেয় যে, কুরআনের শব্দ ও অর্থ উভয়টি আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। আর রাসূলের দায়িত্ব হলো শুধু তা পৌঁছে দেওয়া।
কুরআনুল কারীম আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘নিশ্চয় আমরা কুরআনকে আরবী ভাষায় অবতীর্ণ করেছি।’’ সূরা আয্-যুখরুফ : ৩
অর্থাৎ কুরআনের অনুবাদ কুরআন নয়, আর তা দিয়ে কোনো হুকুমও সাব্যস্ত হবে না। সালাত শুদ্ধ হবে না। ইসলামী শরীয়তের এটি উৎসও হবে না। এছাড়াও কুরআনের মত ধারাবাহিক বর্ণনায় নাযিলকৃত অকাট্য বিশ্বাসসহ অবতীর্ণ কোনো কিছু এর সমান হতে পারে না । অতএব, এ অর্থে এটি সকল গবেষক, ফকীহ ও মুজতাহিদের নিকট প্রধান উৎস। পবিত্র কুরআনের বর্ণিত যাবতীয় বিধি-বিধান, শিক্ষা, শিষ্টাচার, আখলাক সংবাদ মাধ্যমের প্রধান উৎস। প্রত্যেক মিডিয়া ব্যক্তিত্ব অথবা সংবাদ সংস্থার উচিত হলো কুরআনুল কারীমের উপরোক্ত বিষয়াদির সাথে একাত্মতা পোষণ করা। ফলে সংবাদ মাধ্যমের বার্তা স্থির; যা পরিবর্তনীয় নয়। কিন্তু ইসলামী মিডিয়ার উৎস কুরআন যা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। অতএব, মুসলিম সংবাদ মাধ্যম কর্মীর দায়িত্ব হলো- কোনো পরিবর্তন-পরিবর্ধন ব্যতিরেকে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে প্রচার চালানো।
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রচার কাজ ও ইসলামী মিডিয়া বা সংবাদ মাধ্যম একই সূত্রে গাঁথা। যদিও সময় ও পারিপার্শ্বিকতার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছিল। তথাপিও নূহ ‘আল্ইাহিস সালাম, লূত ‘আল্ইাহিস সালাম, ইব্রাহীম ‘আল্ইাহিস সালাম, শু‘আইব ‘আল্ইাহিস সালাম, হুদ ‘আল্ইাহিস সালাম ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-সহ নবী-রাসূলগণ মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদাতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
কুরআনুল কারীমে দা‘ওয়াহ সংক্রান্ত বা প্রচার-প্রোপাগান্ডা সংক্রান্ত, যোগাযোগ সংক্রান্ত অসংখ্য আয়াতের অবতারণা হয়েছে। এসব আয়াতে বর্ণিত পদ্ধতি ও বাচনভঙ্গি কুরআনের ভাষায় মিডিয়ার মডেল হিসেবে উপস্থাপিত হওয়াকে আরো সুদৃঢ় করেছে। ফলে কুরআন অধ্যয়ন ও তার যথার্থ অনুধাবন সংবাদ মাধ্যমের অন্যতম প্রধান কাজ। কুরআনুল কারীম মানুষের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। নিম্নে সেসব পদ্ধতির বর্ণনা উপস্থাপিত হল।
এক. কিসসা
পবিত্র কুরআনের এক গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনাধারা হলো কিসসা কাহিনী। মানব জীবনের বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়ে এসব কিসসা বর্ণিত হয়েছে। ইউসূফ ‘আল্ইাহিস সালাম এর জীবন কাহিনীকে সর্বোত্তম কিসসা হিসেবে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এগুলোর উদ্দেশ্য হলো মানুষকে শিক্ষা দেয়া। ফলে মানুষের মাঝে কুরআনের নির্দেশনা পৌঁছে দিতে এটি অন্যতম একটি পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃত রয়েছে। এসব বর্ণনা ও কাহিনী সত্য। কুরআনের এসব কিসসা কাহিনী মিডিয়ার উদ্দেশ্যকে বিভিন্নভাবে সুস্পষ্ট করে তোলে। যেমন:
ক. সংবাদ : এক্ষেত্রে আদম ‘আল্ইাহিস সালাম এর জীবনী ও এ ধরাধামে তার সন্তানদের কাহিনীও বর্ণিত হয়েছে। এ ছাড়াও মূসা ‘আল্ইাহিস সালাম, হারূন ‘আল্ইাহিস সালাম ও তাদের বিরুদ্ধাচরণকারী ফিরআউনের ঘটনাবলীসহ অনেক ঘটনা বিবৃত হয়েছে।
খ. প্রশিক্ষণ : কুরআন কিসসা কাহিনী বর্ণনাকে তারবিয়া বা প্রশিক্ষণের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করেছে। কিভাবে মানুষ তাদের জীবন অতিবাহিত করবে এবং কিসে তাদের মুক্তি ও কিসে তাদের সফলতা রয়েছে তা উপস্থাপন করা হয় কিসসার মধ্যে। এক্ষেত্রে ইউসূফ ‘আল্ইাহিস সালাম এর কাহিনী ও মিশরের রাজার স্ত্রী জোলায়খার ঘটনা অন্যতম।
গ. দৃঢ়ীকরণ : কুরআনের কাহিনীর অন্যতম টার্গেট হলো মু’মিনের অন্তরকে দৃঢ় করা এবং কষ্ট ও দুঃখের কারণে মানব মনে যেসব দুশ্চিন্তা, দুঃখ, বেদনা, কষ্ট, সৃষ্টি হয় তা হতে বিরত রাখা। কুরআনুল কারীমে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অন্তরকে সুদৃঢ় করার জন্য অনেক কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। যেগুলোর মাধ্যমে ইসলামী দা‘ওয়াহর পথে যুদ্ধ-বিগ্রহ অশান্তি ও তার সাহাবীদের কষ্ট দেখে বিচলিত না হয়ে দ্বীনের উপর অটল অবিচল থাকতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।
ঘ. শিক্ষা : কুরআনে বর্ণিত অধিকাংশ কিসসা-কাহিনী মানুষকে তাদের দ্বীনের মূল ভিত্তি ও শিষ্টাচার সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। কিরূপে মানুষ তাদের সন্তানদের সাথে আচরণ করবে, কিভাবে অপরাধীর প্রতিশোধ নিবে এবং মুহসিন বা সৎ মানুষ হওয়া যাবে এসব শিক্ষা দেয়। এক্ষেত্রে হাবিল কাবিলের কাহিনী ও শু‘আইব এর কন্যাদ্বয়ের সাথে মূসা ‘আল্ইাহিস সালাম এর আচরণ উল্লেখযোগ্য। তাছাড়াও ইসলামী দা‘ওয়াত ও আখলাকের মূলনীতি এবং পবিত্র জীবনের ভিত্তি সম্পর্কেও কিসসা ও কাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
দুই. সংলাপ
কুরআনের অনেক স্থানে সংলাপের পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে যা সংবাদ মাধ্যমের অন্যতম কাজ। এর নীতিমালা আমরা ইবরাহিম ‘আল্ইাহিস সালাম ও তাঁর রবের মধ্যকার সংলাপের মধ্যে দেখতে পাই। যেমন আল্লাহ বলেন-
‘‘আর যখন ইব্রাহীম বলল, ‘হে আমার রব! কিভাবে আপনি মৃতকে জীবিত করেন আমাকে দেখান’, তিনি বললেন, ‘তবে কি আপনি ঈমান আনেন নি?’ তিনি বললেন, ‘অবশ্যই হাঁ, কিন্তু আমার মন যাতে প্রশান্ত হয়!’ আল্লাহ্ বললেন, ‘তবে চারটি পাখি নিন এবং তাদেরকে আপনার বশীভূত করুন। তারপর সেগুলোর টুকরো অংশ এক এক পাহাড়ে স্থাপন করুন। তারপর সেগুলোকে ডাকুন, সেগুলো আপনার নিকট দৌড়ে আসবে। আর জেনে রাখুন, নিশ্চয় আল্লাহ্ প্রবল পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। সূরা আল্-বাকারাহ : ২৬০।
অনুরূপ ভাবে মূসা ‘আল্ইাহিস সালাম ও ফির‘আউনের মধ্যকার সংলাপ কুরআনে এসেছে।
ফির‘আউন বলল, ‘সৃষ্টিকুলের রব আবার কী? মূসা বললেন, ‘তিনি আসমানসমূহ ও যমীন এবং তাদের মধ্যবর্তী সব কিছুর রব, যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাসী হও। ফির‘আউন তার আশেপাশের লোকদের লক্ষ্য করে বলল, ‘তোমরা কি ভাল করে শুনছ না?’ মূসা বললেন, ‘তিনি তোমাদের রব এবং তোমাদের পূর্বপুরুষদেরও রব।’ ফির‘আউন বলল, ‘তোমাদের প্রতি প্রেরিত তোমাদের রাসূল তো অবশ্যই পাগল।’ মূসা বললেন, ‘তিনি পূর্ব ও পশ্চিমের এবং তাদের মধ্যবর্তী সব কিছুর রব; যদি তোমরা বুঝে থাক!’ ফির‘আউন বলল, ‘তুমি যদি আমার পরিবর্তে অন্যকে ইলাহরূপে গ্রহণ কর আমি তোমাকে অবশ্যই কারারুদ্ধ করব’। সূরা শুআরা ২৩-২৯।
এছাড়াও পবিত্র কুরআনে মিডিয়ার পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। মানব জীবনের বিভিন্ন অংশে এটি ব্যাপৃত। যেমন: আকীদা সংক্রান্ত,ইবাদাত ও মু‘আমালাত, চরিত্র, জিহাদ, শাস্তির বিধান, পারিবারিক ব্যবস্থা, অদৃশ্য ও পূর্ববর্তী উম্মতদের অবস্থা ,জীবনের বিভিন্ন দিক ।
দ্বিতীয়ত:সুন্নাহ
ইসলামী শরী‘আতের দ্বিতীয় উৎস হলো সুন্নাহ। আর তা হলো: রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা, কাজ ও সমর্থনের সমষ্টি। এটি তিন ভাগে বিভক্ত।
ক. সুন্নাতে মুয়াক্কিদাহ: যা পবিত্র কুরআনে বিধৃত হয়েছে। আর রাসূলের সুন্নাতে সেটাকে তাকিদ দেওয়া হয়েছে।
খ. সুন্নাতে মুবাইয়্যেনাহ: যার কিছু অংশ কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। আবার কিছু অংশ নির্দিষ্ট করা হয়েছে এবং কিয়দাংশ মুতলাক। হাদীসে সেটাকে বিস্তারিত বর্ণনা করেছে। কিংবা সেটার শর্তহীনতাকে শর্তযুক্ত করেছে। অথবা সেটার সাধারণ নির্দেশকে বিশেষায়িত করেছে।
গ. সুন্নাহ মুশাররি‘আহ: এমন সব বিধান যা শুধু হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে। এ ব্যাপারে কুরআন নিরব। কিন্তু এতে কুরআনের সাথে কোনো বৈপরিত্য দেখা যায় না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দা‘ওয়াতী মিশনের সাথে সংশ্লিষ্ট হল সুন্নাত। প্রত্যেক রাসূলের আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়বদ্ধতা রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন-
“আর অবশ্যই আমরা তাদের জন্য বাণীকে বিস্তারিত বর্ণনা করেছি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।” সূরা আল্-কাসাস : ৫১
ফলে রাসূলগণ আল্লাহর পক্ষ থেকে, বান্দা ও আল্লাহর মাঝে দূত ছিলেন। মানুষের জন্য যা কল্যাণকর তার নির্দেশনা দান ও হেদায়াতের আলোকবর্তিকা দেখানো নবী-রাসূলের একমাত্র কাজ। আর এটি ইসলামী মিডিয়া বা সংবাদ মাধ্যমেরও অন্যতম কাজ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
রাসূলগণের এতদসংক্রান্ত কার্যাবলীকে আমরা দু’ভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথমতঃ আল্লাহর বাণীর প্রচার করা ,দ্বিতীয়তঃ আল্লাহর বাণী বর্ণনা করা ।
উপযুক্ত প্রথমটি দ্বিতীয়টির সাথে সম্পৃক্ত। রাসূল ও মানুষের মাঝে যে যোগাযোগ রয়েছে, সেটি যার মাধ্যমে প্রভাবিত হয় তা শুধু প্রচার দ্বারাই সম্ভব নয়। বরং একে আরো সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করা অত্যন্ত জরুরী।
দীনের আলোচ্য বিষয় মানব জাতি। আর যোগাযোগ হল দীনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহী প্রাপ্ত হয়ে দীনের এ মহান কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। তিনি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি করতঃ তাদের হেদায়াত অন্বেষণ করতেন। মক্কার মুশরিকরা রাসূলের চাচা আবু তালিবের মাধ্যমে তাঁকে এ কাজ হতে বাধা দিলেও তিনি দা‘ওয়াতের এ মিশন থেকে বিরত হন নি।
ইসলামী মিডিয়ার ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন এক অনুপম আদর্শ। তিনি ব্যক্তি যোগাযোগের মাধ্যমে অসংখ্য মুশরিককে ঈমানের ছায়াতলে নিয়ে এসেছিলেন। নবুওয়ত লাভের পর ইসলাম প্রচারে সকল উপকরণ কার্যত করার মাধ্যমে তিনি দীনের প্রচারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। বিভিন্ন সীরাত গ্রন্থ ও সুন্নাত কোষ অধ্যয়নের মাধ্যমে তার এমন চারিত্রিক গুণাবলী ফুটে উঠে, যা মূলতঃ ইসলামী দা‘ওয়াহ প্রচারকারী বা মিডিয়া ব্যক্তিত্বের প্রতিচ্ছবি।
‘‘তিনি নম্র প্রকৃতির ছিলেন, উত্তম কথা বলতেন, বাজে কথা পরিহার করতেন। প্রত্যেক মানুষকে তাদের জ্ঞান অনুযায়ী সম্বোধন করতেন। তিনি পরিচিত সকল গোত্রের সাথে আলাপচারিতা করতেন। তিনি কঠোর ছিলেন না, মন্দের জবাবে ভাল ব্যবহার করতেন, অধিক দানশীল ছিলেন, ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে মানুষকে দেখতেন। আল্লাহকে সর্বাধিক ভালবাসতেন। সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে কাজ করতেন। বিধবা ও মিসকীনদের প্রয়োজন মেটাতে এগিয়ে আসতেন, কষ্ট সহিষ্ণু ছিলেন, বিপদে- আপদে মানুষের পাশে এসে দাড়াতেন। গরীব ও অভাবীদের সাথে নিয়ে পানাহার করতেন, বাজার থেকে নিজ হাতে দ্রব্যসামগ্রী বহন করে আনতেন।’’
উপযুক্ত আলোচনার মাধ্যমে একজন মিডিয়া বা সংবাদ কর্মীর সৃষ্টিগত, চারিত্রিক, ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিভিন্ন গুণাবলী নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
ক. সৃষ্টিগত গুণ ঃ যেমন নম্র কথা, উত্তম শব্দ। গণ মাধ্যমের ক্ষেত্রে এ দু’টো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন দৃশ্যমান ও শ্রুত গণমাধ্যমসমূহ।
খ. চারিত্রিক গুণ ঃ কাউকে বর্জন না করা, বাজে কথা না বলা, সহজ ও বোধগম্য শব্দ চয়ন করা এবং কঠোরতা পরিহার করা।
গ. ব্যক্তিত্ব ঃ মন্দের বিপরীতে খারাপ কথা ও মন্দ পরিহার করা, দয়া পরবশ থাকা, বঞ্চিতকে দান করা, জালিমকে ক্ষমা করে দেওয়া, আর আল্লাহকে ভয় করা। এগুলো মুসলিম ব্যক্তিকে উত্তম সংবাদ দানে এবং সংঘাত এড়িয়ে থাকতে সাহায্য করে।
ঘ. বাস্তবিক গুণাবলী ঃ মুসলিমের উপর অত্যাবশ্যক হল রাসূল সালাøল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর গুণাবলী অর্জন করা, বিশেষতঃ মিডিয়ার ক্ষেত্রে। সর্বসাধারণ সম্পর্কে জানা, তারপর প্রত্যেকের জ্ঞান অনুযায়ী সম্বোধন করা। বর্তমান যুগের মনস্তাত্ত্বিকদের নিকট এ পদ্ধতি সাধারণের উপর প্রভাব ফেলতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে এ পদ্ধতি অনুসরণ করে আমাদের দেখিয়ে গেছেন।
ইসলামী দা‘ওয়াহ ও মিডিয়ার ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন তা নিম্নরূপ:
এক. বক্তৃতা
খুতবা বা ভাষণ মিডিয়ার অন্যতম মাধ্যম। বক্তৃতার মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদানের পাশাপাশি প্রভাব সৃষ্টি করাও সম্ভব হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন অনেক বড় খতীব। যুগে যুগে তাঁর খুতবার প্রভাবে মানব সমাজে যথেষ্ট পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে দীনের দা‘ওয়াত দিতে খুতবাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। রাসূলের জুমআর খুতবা, বিদায় হজ্বের ভাষণ সর্বস্তরের মানুষের জন্য এক নির্দেশনা।
দুই. পত্র প্রেরণ
পত্র প্রেরণের মাধ্যমে যোগাযোগ প্রক্রিয়া সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দা‘ওয়াতের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে পত্র প্রেরণ করেছেন। তিনি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের কাছে ইসলামের দা‘ওয়াত দিয়ে পত্র প্রেরণ করতেন। তন্মধ্যে রোমের বাদশাহ হিরাক্লিয়াস ও পারস্যের বাদশাহ কায়সারের কাছে প্রেরিত পত্র উল্লেখযোগ্য। হিরাক্লিয়াসকে লক্ষ্য করে তিনি বলেন,
পরম করুণাময় আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ হতে রোমের সম্রাট হিরাক্লিয়াসের প্রতি। সৎ পথ প্রাপ্তের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। তৎপর, নিশ্চয়ই আমি তোমাকে ইসলামের দিকে আহ্বান করছি। ইসলাম গ্রহণ কর, নিরাপত্তা পাবে। আল্লাহ তোমাকে দ্বিগুণ প্রতিদান দিবেন। আর যদি মুখ ফিরিয়ে নাও; তবে নিশ্চয় অধীনস্থদের অপরাধও তোমার উপর বর্তাবে। আর (আল্লাহ বলেন) ‘আপনি বলুন, হে আহলে কিতাবগণ! এস সে কথায়, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই; যেন আমরা একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া কারো ইবাদাত না করি, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক না করি এবং আমাদের কেউ আল্লাহ্ ছাড়া একে অন্যকে রব হিসেবে গ্রহণ না করি।’ তারপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে তোমরা বল, তোমরা সাক্ষী থাক যে, নিশ্চয় আমরা মুসলিম’। সহীহ বুখারী
তিন. সংলাপ
সংলাপ যোগাযোগ প্রক্রিয়া হিসেবে খুব প্রাচীন। আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে কথা বলার ক্ষমতা দিয়েছেন; যা সংলাপের একমাত্র উপাদান। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুশরিক, ইয়াহূদী, নাসারা সকলের সাথে সংলাপ করেছেন। তারা তাঁকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করতেন এবং তিনি তাদের সেসব প্রশ্নের জবাব দিতেন। ইসলামী মিডিয়ায় সংলাপকে একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে ইসলামী সভ্যতার প্রচার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব। ফলে অনেক আলিম, শিক্ষাবিদ, পন্ডিত, আহলে কিতাবদের সাথে সংলাপের আয়োজন করেছেন। সকল নবী রাসূলের প্রাথমিক উপাদান ছিল সংলাপ। তাঁরা অমুসলিমদের সাথে ডায়ালগ আদান-প্রদান করেই তাদেরকে ইসলামের আদর্শে অনুপ্রাণিত করেছেন।
চলবে..........
বিষয়: বিবিধ
১৮৩১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন