মেগাবাইট নয় গিগাবাইট চুরি: আমরা কি সবাই ছাগল ?
লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মাদ আতিকুর রহমান ২৬ জানুয়ারি, ২০১৫, ০৯:১১:৩৮ রাত
ব্যান্ডউইথ অপচয় হচ্ছে এটা জানতাম, কিন্তু এতোটা তা জানতাম না! এতো পুকুর নয় সাগর-মহাসাগর চুরি ! যাদের কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার নয় তাদের জন্য !
২০০৭ সাল থেকে শুনে আসছি মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ককে থ্রিজি-তে আপগেডেশনের জন্য লাইসেন্স দেওয়া হবে। দিয়েছে ঠিকই তবে থ্রিজির কতখানি স্পিড দেয়া হয়েছে তা হয়তো আমরা অনেকেই জানিনা। এখন ২০১৫ সালের জানুয়ারী মাস শেষ। সরকার এখন থ্রিজি স্পিড সাপ্লাই শুরু করেছে তবে স্পিড কার্যকারীতা টুজি পর্যায়ের যা না বললেই নয়। অথচ বিশ্বের অন্যান্যদেশ এখন থ্রিজি ছেড়ে ফোরজি নেটওয়ার্কে প্রবেশ করছে। এই না হলে আমার সোনার বাংলাদেশ!
ডিজিটাল বাংলাদেশ। সবার আকাঙ্খা। বিশেষ করে যুবসমাজ। আর যারা ইন্টারনেট জগতে বসবাস করে তাদের কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তারা এটা চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। মানুষের এই আকাঙ্খা, এই স্বপ্ন, এই চাওয়া কি অবান্তর? না কখনোই নয়। বরং সময়ের দাবি । তবে এ ঘোষনাটি যখন এসেছিলো, অনেকেই এর অন্তরালে ঘাপলা দেখতে পেয়েছিলো। বেশি সময় যায়নি এরই মধ্যে সেই থলের বিড়ালের দেখা মিলে গেছে। তাই লেখাটার শিরোনাম দিলাম “মেগাবাইট নয় গিগাবাইট চুরি”।
আজ আপনার আমার স্বপ্ন, আকাঙ্খার বুকে লাথি মেরে মুষ্টিমেয় কিছু লোক কি কাজটাই না করছে! কয়েকদিন আগে ফেসবুকে ছো্ট্ট একটি তথ্য আসার পর থেকে আমার কয়েকজন বন্ধু খুব তাগিদ দিচ্ছিল, আমি যেন এটি নিয়ে অল্প কিছু লিখি।কিন্তু লিখতে গিয়ে যা পেলাম, তা মোটামুটি ভয়ংকর।তাই শিরোনামে “আমরা কি সবাই ছাগল” ব্যবহার না করে পারলাম না। কেউ এর ভুল ব্যাখ্য করবেন না। ব্যাখ্যা আমিই করছি, লেখাটি পড়লেই বুঝতে পারবেন এ দেশের নীতি-নির্ধারকরা আমাদের ছাগল না এরচেয়ে আরও নীচের কিছু ভাবে।
আপনি কি জানেন, বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানীর সিমিউই-৪ এর কক্সবাজার সংযোগে কত জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ আছে? মাত্র ১৬৪ জিবিপিএস। আর আমি আপনিসহ সারা বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা কতটুকু ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করছি সেটা জানেন? মাত্র ২২ জিবিপিএস। তাহলে বাকিগুলো কি হয়? এই জন্যেই তো বলেছি মেগাবাইট নয় গিগাবাইট চুরি। একটু পরেই জানতে পারবেন, কি হয় এগুলো।
বাংলাদেশ ২০০৬ সালের মে মাসে ৭.৫ Gbps ব্যান্ডউইথ নিয়ে সিমিইউ-৪ সাবমেরিন ক্যাবলে প্রথমবারের মতো যুক্ত হয়। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে ১ম আপগ্রেডেশনের মাধ্যমে ২৪ Gbps এ উন্নীত হয়। ২য় আপগ্রেডটি হয় ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে, যা থেকে বাংলাদেশ ৪৫ Gbps ব্যান্ডউইথ অর্জন করে। আর তৃতীয় আপগ্রেডটি হওয়ার কথা ছিলো ২০০৯ এর ডিসেম্বরে যা থেকে বাড়তি আরও ১১০ জিবিপিএস যুক্ত হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু সে সময় নীতি নির্ধারকরা সেটা নেননি।
২০০৮ এ যখন ব্যান্ডউইথ ৪৫ জিবিপিএস, তখন সারা দেশের মানুষ আমরা ব্যবহার করতাম ১০ জিবিপিএস। এখন প্রশ্ন, তাহলে বাকি ব্যান্ডউইথ কি হতো? প্রশ্নটি জমা রাখুন, উত্তর নিজেরাই পাবেন।
ভবিষ্যতে দেশের ব্যান্ডউইথ চাহিদা সামনে রেখে বিএসসিসিএল সরকারের অনুমতিক্রমে কনসোর্টিয়ামের আপগ্রেড-৩ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে অতিরিক্ত 4 Million MIU*Km ক্যাপাসিটি আনয়নের ব্যবস্থা করেছে। গত ৩রা এপ্রিল ২০১১ তারিখে গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উক্ত Upgradation প্রকল্পের শুভ উদ্বোধন করেন। ইতিমধ্যে বিএসসিসিএল আপগ্রেড-৩ তে অংশগ্রহণ করার জন্য ৫০ কোটি টাকা নিজস্ব তহবিল হতে SEA-ME-WE-4 কনসোর্টিয়াম কে প্রদান করেছে। এর ফলে ব্যান্ডউইথ পরিমান ২০১২ সালের মে মাস নাগাদ ৪৪.৬০ Gbps হতে বৃদ্ধি পেয়ে ১৬০ Gbps এ পৌঁছাবে। কিন্তু এটি আসলে হয়ে গেছে ২০১১ এর অক্টোবর মাসে, এখানে দেখুন মন্ত্রী বলেছেন -
অথচ সরকারের তাবেদার এক পত্রিকার দাবী এ ব্যান্ডউইথ এখনও যুক্ত হয়নি তবে যুক্ত হবে আগামী জুলাই মাসের শেষের দিকে।এই দেখুন এখানে:
তবে ভয়ংকর কথা হচ্ছে এই কাজটা ২০১০ সালেই হয়ে যাওয়ার কথা ছিল যা বিটিসিএল এর ওয়েবসাইট সেসময় এক প্রেস-রিলিজে (http://www.bsccl.com.bd/index.html ) বলেছিল। তখন ঐটা স্থগিত করা হয়েছিল। কেন? যেহেতু যা ছিল তারই চারগুন ব্যান্ডউইথ অব্যবহৃত ছিলো। এত ব্যান্ডউইথ দিয়ে কি হবে, রপ্তানীর উদ্দ্যোগও প্রকাশ্য নেয়া যাচ্ছে না, এইসব অজুহাতে। আর এদিকে এই একই সাবমেরিন ক্যাবলে অন্যান্য দেশগুলো আজ ১.২৮ Tbps এ উন্নিত হয়ে গেছে।
কত বড় রাষ্ট্রীয় ক্ষতি! যেমন ধরুন, এই মুহুর্তে সারাদেশ যদি ২২ Gbps এবং তার প্রতি মেগাবিট/সেকেন্ডের দাম ৮ হাজার টাকা হয় তাহলে মোট সাড়ে ১৭ কোটি টাকার ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করছে। আর অব্যবহৃত রাখছে ১১৩ কোটি টাকারও বেশি ব্যান্ডউইথ। ব্যান্ডউইথ ব্যবহার না করা মানে অপচয় করা। কারণ ব্যান্ডউইথ সংরক্ষণ করার বস্তু না। এটি টাকা নয় যে কোনো ব্যাংকে এটি জমা করবেন। গ্রামীনের পি২ প্যাকেজ নিয়ে আপনি ব্যবহার না করলেও যেমন মাস শেষে থাকবে না, তেমনি ১৬৪ জিবিপিএস এর ২২ জিবিপিএস ব্যবহার করলেও বাকিটুকু আমরা সঞ্চয় করতে পারব না। অথচ আমাদের ইডিয়ট পলিসি মেকাররা ব্যান্ডউইথ সংরক্ষনের নীতি গ্রহন করে! আরও আছে, ঐ মুহুর্তে সারাদেশে ২২ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ ব্যবহার হচ্ছে এবং বাড়তি ব্যান্ডউইথ সরকার ২০১৩-১৪ সাল পর্যন্ত চাহিদার কথা বিবেচনা করে সংরক্ষণ ও রপ্তানী করার চিন্তা ভাবনা করছে। কত বড় ইডিয়ট চিন্তা-ভাবনা, তাই না? উত্তরে আমি বলবো, তাদেরকে যদি ইডিয়ট ভাবেন তাইলে আপনি রামবোকা। কি হচ্ছে এই বাড়তি ব্যান্ডউইথ একটু পরেই জানতে পারবেন।
সরকার যদি পুরো ব্যান্ডউইথ আমাদের জন্য ছেড়ে দিতো তাহলে বর্তমানে আমরা যে স্পিডে কাজ করি তার ৭ গুণ স্পিড পেতাম। আফসোস তা কি আর হবে? ইতিমধ্যে বিভিন্ন ব্লগে এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে। একজন ব্লগার মন্তব্য করেছেন, ২০০৭ সাল থেকে সাবমেরিন ক্যাবলে যুক্ত হয়ে, ৮০ ভাগ ব্যান্ডউইথ জোর করে অব্যবহৃত রাখার পরও ৩ বছরে দেশে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। কিন্তু বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা যেখানে বিশ্বের সর্বনিম্ন গতিতে নেটে কাজ করে। বিশ্বের সর্ব উচ্চ ব্যান্ডউইথ মূল্যের জন্য বাংলাদেশের আইএসপিগুলোকে প্রতি ইউজার ৫ কিলোবাইট হারে ব্যান্ডউইথ ডিস্ট্রিবিউশন প্লান করতে হয়। সর্বনিম্ন গতি সত্বেও বাংলাদেশে সরকার বিশ্বের সর্বোচ্চ দামে ব্যান্ডউইথ বিক্রি করে । কথা সত্য।
আজকের দিনে ১ Mbps এর নিচের গতিকে ইন্টারনেটই বলা হয় না। ব্রডব্যন্ডের সংঙ্গা ৫ এমবিপিএস করার দাবি উঠছে আজকাল। আপনি জানেন কি, বাংলাদেশের টেলি আইনে ২৫৬ kbps ও এর অধিক গতিকে ব্রডব্যন্ড বলা হয়। কতই না মজার বিষয়! ন্যাশনাল ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্কে ইন্টারনেটে অস্ট্রেলিয়ায় ২৪তম অবস্থানে রয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় ইন্টারনেটের গড় গতি ৪.৯ Mbps । আর অন্যগুলোর কথা নাইবা বললাম, বললে হয়তো আপনাদের মাথা ঘুরে যাবে কিংবা নিজেকে সত্যিই ছাগল মনে হবে।
আচ্ছা, তারপরও মোটের একটা হিসাব আপনাদেরকে দিই। দক্ষিন কোরিয়া বাংলাদেশের অর্ধেক জনগণ নিয়েও এই মুহুর্তে কত ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করছে, জানেন? ১১ টি ক্যাবলে দক্ষিণ কোরিয়া এই মুহুর্তে ২৫ টেরাবিট/সেকেন্ড বা ২৫০০০ Gbps ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করছে। আর আমরা ১৬ কোটি জনগণের বাংলাদেশ মাত্র ১৬৪ Gbps এর মধ্যে ১৪২ Gbps ফেলে দিচ্ছি !! চলুন তো, সরকার যে হিসাব দিয়েছে সে মতেই (আমাদের হিসাব বাদ) এই ফেলে দেয়া বা অব্যবহৃত ব্যান্ডউইথ এর পরিমানটার বাজার মূল্যটা একটু দেখি! সাবমেরিন ক্যাবলে গত ৩ বছরে (৩০*৬০*৬০*২৪*৩৬৫*৩) ভাগ ১০০০ = ২৮,৩৮,২৪০ টেরাবিট বা প্রায় ৩০ লক্ষ টেরাবিট কন্টেন্ট অব্যবহৃত ছিল। এখন প্রতি জিবি ১০০/- টাকা করে ধরলেও এই ক্ষতির আর্থিক পরিমান ২৮,৩৮,২৪০*১০০*১০০০ = ২৮৩,৮২,৪০,০০,০০০ টাকা বা প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। কি মাথা ঘুরে গেলো নাকি? এই হিসাবটা বের করে দেওয়ার জন্য একজন নামহীন ব্লগার ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। যে কিনা এই হিসাবটা আমাকে দিয়েছে।
আচ্ছা যাক। মূল আলোচনায় আসি। আপনার কি মনে হয়, সরকারের নীতিনির্ধারকদের মাথায় এই হাজার হাজার কোটি টাকার হিসাবটা ঢুকেনি। তারা শুধু নদীর মাঝি আর বাস ড্রাইভারের উপরই অদৃশ্য চাঁদা আদায় করতে জানে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের কিভাবে ঠকাতে হয়, তা বুঝি তারা জানেনা? এরকম ভেবে থাকলে আপনি বোকার স্বর্গে নয় বোকার নরকে বাস করছেন। বিএসসিসিএল, বিটিসিল এবং অবৈধরা অবশিষ্ট ১৪২ জিগাবিট ব্যান্ডউইথ অবৈধ ভিওআইপি কলে গোপনে ডাইভার্ট করে প্রতিদিন প্রায় ৬ কোটি মিনিট আন্তর্জাতিক কল করছে। যার দ্বারা মুষ্টিমেয় কিছু লোক আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের ঘাড়ে বসে কলা খেয়ে ছাগলের মতো আমাদের খোসা ধরিয়ে দিচ্ছে। বিটিসিএল এর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার স্বার্থে জানিয়েছে, এই কাজে সরকারের উচু পর্যায়ের বেশ কিছু লোকের হাত রযেছে।তবে সে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য না দিতে পারায় আমি কারও দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলতে চাই না। আমি সমস্ত ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের পক্ষ থেকে শুধু এতটুকু বলতে চাই, আমাদের টাকা দিয়ে কেনা এই ব্যান্ডউইথ যেন আমরা পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারি। আর সমস্ত ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের বলতে চাই, আমরা ছাগল নই যে আমাদের খোসা ধরিয়ে দিবে আর আমরা তা বসে বসে চিবোব। এই মুহূর্ত থেকে প্রতিবাদী হোন, আওয়াজ তুলুন। তবেই প্রমাণ হবে আমরা ছাগল নই!!!!
বিষয়: বিবিধ
১২৪৬ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সঠিক ধারনা না থাকায় আমরাও অনেক পিছিয়ে আছি । আল্লাহ্ পাকের দরবারে দোয়া করি খুব দ্রুত ওদের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক.....আমিন
মন্তব্য করতে লগইন করুন