বনলতা এখনও কি নবীন নগরে?
লিখেছেন লিখেছেন সাইফুল সাইমুম০১ ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৩:০৬:০১ দুপুর
সে দিন বনলতার সাথে দেখা হয়েছিল কিন্তু কথা তো হয়নি। ভাবে বুঝিয়াছিলাম সে কিছু বলিতে চাহিয়া ছিল। রজনী তখন ও পুরোটা নিভিয়া যায়নি । অরূপ আমারে ডাকিতে ছিল । আমি তার ডাক শুনিতে পারিয়া বলিলাম আসিতেছি । একটু অপেক্ষা করিতে । বনলতা হাটিতে লাগিল। মাটি গুলো গুমুরের শব্দ নিয়ে আমার হৃদয় পটে নুপুর হইয়া তখন বাজিতে ছিল। আর দেরি না করিয়া তার পথ আগলাইয়া সমুখে নিজেকে দাড় করায় লাম। সে কাঁদিয়া উঠিতে আমি সরিয়া গেলাম। তাহা দেখিয়া সে যেতে যেতে নিরব চাহনি দিয়া বার বার আমাকে দেখিতে ছিল। আমি আর দাড়াইতে পারিলাম না। অরূপের কাছে ছুটিয়া গেলাম। অরূপ আমাকে যে কথাটি বলিতে চাইতেছে তাহার জন্য আমার দেহের ও মনের অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করিতে লাগিল। আমি আর ধের্য্য ধরিতে পারিব না বলে বলিলাম তুই আমায় কি কহিতে ডাকিলে, না কহিলে আমি আর কখনো
শুনিব না। অরূপ বলিল তাহাই কর দাদা। ঐ কথা না শুনিলে যে তোমার মঙ্গল হয়। অরূপের হাত খানা নিজের হাতে তুলিয়া
মদন করিতে করিতে বলিলাম বাপুধন বলিয়া পেল। মঙ্গল অমঙ্গল যা হবার তা তো হয়ে বসিয়া আছে আর কি নতুন করিয়া
হবে গো। অরূপ বলিল দাদা আমি যে তোমাকে কি ভাবে বলিব তাহা ভাবিয়া আমি কুল কিনারা খুজে পাইতে ছিনা।
তবু ও যে আমাকে তোমায় বলিতে হইবে। মনটা উৎপুলল হয়ে উঠিতে ভিতর বাড়ী হইতে কে যেন ডাকিয়া কহিল
অরূপের বাবা হঠাৎ মাথা ঘুরিয়া মাটিতে পড়িয়া গেল। তাহার জন্য ডাক্তার ডাকিতে হইবে। অরূপ ক্ষণিকের জন্য সব
ভুলিয়া গেল। তার বাবাকে দেখিতে দৌড়াইয়া অন্দর মহলে দিকে আসিল। নিরূপায় হইয়া আমাকে ডাক্তার ডাকিতে বাজার যাইতে হইল। ডাক্তারকে যথা সময় পেতে একটু দেরী হইয়া গেল। তাই একটু অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। মনকে মানাতে পারলাম। মন বারে বারে মনের অগোচরে বনলতাকেই খুজিতে লাগিল। কেন বা আজ এমনই হইতেছে বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিনা। শরৎ বাবু আসিয়া আমার সাথে দাড়াইল। নিজে থেকে বলিয়া উঠিল ডাক্তার বাবু কি এখনো আসে না। উনার বয়স হয়েছে।
চোখে যাপসা দেখে। বুঝিতে পারিয়া কহিলাম না এখনো আসে নাই। আমি তাহার জন্য বসিয়া আছি। শরৎ বাবু আমায় বলিল তোমার আবার কি হইয়াছে। আমি বলিলাম আমার কিছু হয় নাই। তবে অরূপের বাবা হঠাৎ মাথা ঘুরিয়া মাটিতে পড়িয়া গেল। ডাক্তার বাবু আসিয়া ব্যস্ততার সঙ্গে ব্যগটি টেবিলের উপর রাখিয়া রুমাল দিয়ে ঘাম মুছিতে মুছিতে কহিল এত ব্যস্ত এই বয়সে শরীরে যে আর কাটেনা। শরৎ বাবুকে দেখে তিনি প্রতিদিনকার নিয়মে কয়েকটা টেবলেট দিয়ে বলিলেন আর কত । এবার একটু ক্ষান্ত দিলেও পার। যাওয়ার যে আর বেশী সময় নেই। আমায় বলিল চল কি আর করা পেট চালাতে যে মানুষের সেবা করিতে করিতে একদিন নিজেই চলিয়া যাব ঐ অচিন জীবনের কাছে। ডাক্তার বাবুর কথা গুলো বলিতে বলিতে যখন বাড়ী এসে পৌঁছলেন তখন আর অরূপের বাবা এই জীবন ছাড়িয়া পর জনমে চলিয়া গেলেন। কান্নার সোরগোলে আজ বাড়ীটা শশ্মান হইয়া যাইতেছে। ডাক্তার বাবু যেতে চাইল। তবুও গেল না। আগাইয়া আসিয়া অর্রূপের বাবার নিকটে আসিলেন অনেকের ভীড় ঠেলিয়া। হাতের রগখানা ধরিয়া দেখিলেন রক্ত চলাচল বন্ধ হইয়া গিয়াছে। তিনি ও দু'ফোঁটা চোখের জল দিয়ে চলিয়া গেলেন। অপত্যাশিত এই মানুষটি চলিয়া যাবে কেউ কখন ও ভাবিতে পারিল না। আমি নির্বাক
হয়ে অরূপের দিকে তাকাতে গিয়ে চোখের জল আর আটকাইতে পারিলাম না। অরূপ আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করিয়া
কাঁদিতে লাগিল। বলিলাম এখন কাঁদার সময় কাঁদব তার সাথে উনার গোছল কাফন দাফন ব্যবস্থা করিতে যে হয়। যতই তাড়াতাড়ি করা যায় ততই যে মৃত ব্যক্তির মঙ্গল হয়। লোকজনের ভিতর থেকে কেহ একজন বলিয়া উঠিল হ্যাঁ তাই কর। মরিলে এমনই করিতে হয়, যাকে এতদিন আপন বলে কাছে টানিয়া লইতে আজ মরিতে মরিতে তাহারে যে দুরে ঠেলিয়া দিতে হয়। না হইলে যে অমঙ্গল হয়। অনেকের এই কথা শুনে খারাপ লাগিল। অনেকে খুজিতেছিল ইহা কে বা বলিতেছিল। কিছু জবাব দেবে ভাবিয়া কেহই আবার কিছুই বলিল না। সন্ধ্যা রাতের কাছাকাছি সময় আমরা আত্মীয় স্বজন যাহাদেরকে উপস্থিত করিতে পারিয়াছিলাম সকলকে নিয়া তাহাকে সাড়ে তিন হাত মাটির কোমল বিছানায় শুয়ে দিয়ে তাহার মাগফিরাতের জন্য গ্রামের মৌলভীর সাথে দোয়া করিলাম। সবায় মাটি দিয়ে চলিতে লাগিল। অরূপ কিছুতে বাবাকে ছেড়ে যেতে চাহিল না।
তার বাবা আর কোন দিন তার সাথে কথা বলিবেনা। তাকে বকাঝকা করিবেনা। সে তা বুঝতে পারিয়াছে কিন্তু নিজের মনকে বুঝ মানাইতে পারিল না। অরুপ ও তার ছোট ুদটি বোনকে এতিম করিয়া তার বাবা চলিয়া গেলেন।
সবায় পেছন দিকে তাকিয়ে আমায় বলিতে লাগিল আমি যেন অরূপকে নিয়ে আসি। আমি বলিলাম আসিতেছে। তখন পুরো সন্ধ্যায় ডেকে নিল রাতের পৃথিবীকে। কোথাও আর কাহারে দেখা গেল না। আমি নিজেই বক বক করিতে লাগিলাম শোকাকুল অরুপের সঙ্গে। অরুপ আমায় বলিল কি হইল দাদা। তুমি আমায় রোধন না করিতে বলিতেছ। তোমার ও যে রোধন ভাঙিয়া পড়িতেছে। তার সাথে মাটিতে লুটিয়া বসিয়া পড়িলা। কবরের পাশে বসিয়া দেখিতে ছিলাম মায়ার এই পৃথিবী ছাড়িয়া ছোট এই চার দেয়ালের বন্দী ঘরে আমাদের যারা জীবত বলিয়া প্রাণের বেকুলতা জড়িয়া রহিয়াছি সবাকে আসিতে হবে। অপরুপের বাবা বাচিঁয়া গিয়াছে। তাহারে যে আর নতুন করিয়া আসিতে হবে না। অরূপ আমাকে নাড়িয়া বলিল কি ভাবিতেছ। আমি হালকা কাঁপিয়া উঠিতে
সে ভয় পাইয়া উঠিল। আমিও ভয় পাইয়ে গেলাম। উভয়ে অন্যন্য চোখ-চোখি তাকাতে গিয়ে দু’জনেই কাঁপিতে লাগিলাম।
কে যেন আমাদের উপর ছায়া ফেলিতেছে। শোকাকুল হৃদয়ে শোক লুকিয়ে গিয়ে কি যেন আবহমান স্রোতে বাসিয়া নিতে চাইতেছে, চিৎকারের জন্য অপেক্ষা না করিতেই বশির চাচা হাতের হারিকেনের আলো পাইয়া সব কিছু পুর্বেকারের মত হইয়া উঠিল। আর কারো দাড়াইতে ইচ্ছা করিল না। বশির চাচা ও ডেকে নিল দু’জনকেই। যেতে যেতে সেই চির বাণীগুলো শুনাইতে লাগিল। আমার বাবাও গত হইয়া গিয়েছেন। তা বলে কি আমি কবরের পাশে বসিয়া জীবন কাটিয়া দিয়াছ। দেখ আমি কত স্বাভাবিক। সবাইকে একদিন যেতে হবে। তাই বলে কারো কাজ থেমে থাকবে না। আসবে যাইবে তাইতো এই ভবের অপর নাম হচ্ছে রঙ্গশালা। বাড়ীর উঠানে সেকেলের একটি বড় হামলাইট জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। তবুও যেন এত আলোর ভিতর সব কিছু আধাঁর আধাঁর লাগছিল। মানুষ মরিয়া গেলে কয়েকদিন এমনই লাগে। কারো ভয় লাগছে। অরুপের বোন রূপা রুম্পা কাঁদছে । তার মা তাদের কে আগলিয়ে রাখে রূপার ক্লাস ফাইভের ছাত্রি। আর রূম্পা থ্রীতে পড়ে। অরূপ এই বছর হাইস্কুল শেষ করিতে পরিক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। লেখাপড়ায় ব্যস্ত দেখিয়ে বাড়ীর অন্য সকল কাজকে ফাঁকি দিত বলে বাবার বকাঝকা শুনতে হত।
তার বাবা একটি সরকারী অফিসে চাকরী করত, প্রথম জীবনে অনেক টাকা জমি জমা রেখেছে , যতদিন আধুনিকতার ছোঁয়া লাগল তার সেই কাজ ঘুটিয়ে যেতে বসল। অন্য সহকারীর সাথে পাললা দিতে না পারায় গত বছর তার চাকরি খোয়াইল। বাড়ীতে আসিয়া গিরিস্থের দিকে মনোযোগ দিবে বলিয়া স্থির করিল। কিন্তু বিভিন্ন উপদান দেশের অকাল পড়ায় সে দিকে আগাল না। অবশেষে স্থির করিয়া লইল নিজ গ্রামের বাজারে একটি হার্ডওয়্যার দোকান দেবে।
দোকানের অনেক কিছু আগাইতে লাগিল। হঠাৎ কিছুদিন ধরে মাথা ঘুরিত। কাউকে সে বলিত না। অরূপের মা
রাবেয়া স্বামীর ইহা দেখিয়া ভয় পাইয়াছিল। সে বলিয়াছিল যে, শহরের কোন ভাল ডাক্তার দেখিয়ে যেন চিকিৎসা করিয়া লয়। কিন্তু তাহার কথা সেই শুনিল না। রাবেয়াও আর কাউকে সে কথা জানাইল না। কিন্তু তাহার মনে সে সংশয় বার বার জাগিয়া উঠিতে লাগিল। ব্যথার সে রাত্রিতে আর না ঘুমিয়ে অরূপের সাথে জাগিয়া থাকিলাম। অরূপের মায়ের বার বার অনুরোধ কে পায়ে দলিয়া অরূপ আর পড়া আগাইল না। অরূপ তার বাবার আশা পুরুণে নবীন নগরে দোকান খুলিয়া বসিয়া গেল। অরুপের সে কথাটা আর কোন দিন জানিতে পারিলাম না। কারণ আমাকে তার কিছুদিন পরই তাহাদেরকে ছাড়িয়া শহরে আসিতে হইল। এখনও বনলতার কথা মনে পড়ে। বার বার ভাবি সেদিন বনলতা কেনই বা কাঁদিয়া ছিল আর অরূপই বা কি কহিতে ছিল। মাঝে মাঝে রূপা রুম্পার কথা মনে পড়ে। মনে হয় অনেক বড় হইয়া গিয়াছে। হয়ত ভাল কোন পাত্র দেখিয়া অরূপ তাহাদেরকে বিবাহ দিয়া নিজেও সংসারী হইয়াছে। যোগাযোগের যে তাদের কাছে আমার আর কোন ঠিকানা রহিল না। বনলতার বিবাহ হইল কি হইল না। তাহা জানিতে মনে এক উৎসক রঙ খেলা করিতে লাগিল। যাহাকে কাছে পাইয়া ও জড়িয়ে ধরিয়া বলিলাম না এমন কেন মনে হইল। আজ তাহারে না দেখিয়াও বার বার স্মরণের কোমর ভাঙিয়া রাখি বাঁধিতেছে। সে আকাশটারে ধরিতে যাইতেছি পিঠে একটা বোঝা বহিয়া আমার সে কোলাহল জীবনের নবীন নগরে।
বিষয়: বিবিধ
১২৩৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন