নিরির বৈশাখ

লিখেছেন লিখেছেন মোঃ অয়েজুল হক ১৬ এপ্রিল, ২০১৫, ০৩:৫১:৩৩ দুপুর

আবার আকাশে কালো মেঘ জমা হয়েছে। কাল এমন ছিলনা। বেশ চমৎকার রোদ্রজ্জল দিন ছিল। গরমে বার বার গা থেকে দু’হাত দিয়ে ঘাম ঝাড়তে ঝাড়তে মনে হচ্ছিল পা দুটোকেও যদি এ কাজে ব্যবহার করা যেত মন্দ হতো না। তারপরও কাল চমৎকার দিন ছিল একথা মনে হচ্ছে এখন। মনে হবার যথেষ্ট কারনও আছে। পহেলা বৈশাখ নিয়ে বহু প্রগ্রাম করা। সকাল বেলা উঠেই প্রথমে পান্তা ইলিশ দিয়ে ভাত খাবে। আয়োজন টা বাড়িতে নয়। ইলিশ মাছের যে দাম, বাবাকে বললেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবেন। এমনিতেই অভাবের সংসার। কথায় আছে মড়ার উপর খড়ার ঘা। বাবা যদিও বহুদিন বেত্রাঘাত করেন না তারপরও পহেলা বৈশাখে ইলিশ মাছ আনতে বললে বহুদিন পর সে অনাকাঙ্খিত ঘটনাটাও ঘটে যাবার সমূহ সম্ভাবনা আছে। কি দরকার শুধু শুধু ঝামেলা করার। বাবা বাবার মতোই থাক। অবশ্য গত ছ’মাসে বিভিন্ন কৌশলে বাবার কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কাজটা বাকি রাখেনি নিরি। প্রাইভেট, কোচিং বিভিন্ন অজুহাতে টাকা নিয়েছে। সর্বশেষ গিয়েছিল ছোট বোনের বাড়ি। বোনটার বিয়ের পর খুব একটা যায়নি । শত অনুরোধ করেও যে নিরি কে বোনটা বাড়িতে আনতে পারেনি সে কিনা বিনা নোটিশে হাজির। নিরিকে দেখেই চোখ বড় বড় করে হাস্যজ্জল মুখে বলে, ভাইয়া তুমি?

‘হ্যা। ’

‘ তোমাকে তো খবর দিলেও আসনা। খুব অবাক হলাম।’

‘ এমনি তো আসিনি ।’

‘জানি।’

‘আমার কিছু টাকা লাগবে।’

‘কতো টাকা।’

‘হাজার পাচেঁক হলেই হবে।’

‘এতো টাকা দিয়ে তুমি কি করবে, ছাত্র মানুষ!’ নিরির দু’বছরের ছোট বোন মিলার চোখে কিছুটা বিস্ময়। দেশের অবস্থা ভাল না। যুব সমাজ নানা ধরনের অপরাধ কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ছে। ধনী-গরিব ভেদাভেদ নেই। একে একে বড় হচ্ছে অসভ্য, নোংরা মানুষের মিছিল।

‘কিরে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছিস যে? না দিলে বলে দে চলে যাই।’ কথা বলে নিরি।

‘ভাইয়া তুমি এরকম হয়ে গেছ কেন?’

‘ কি রকম! খচ্চর টাইপের?’

‘হ্যা।’

‘তাহলে চিড়িয়াখানায় ফোন দে।’

‘ কেন?’

‘ নতুন একটা খচ্চর পেয়ে তারা খুশি হবে। মানুষ খচ্চর দেখেছে কেউ! সবাই দেখবে আর অবাক হবে।’

মিলা খিল খিল করে হেসে ওঠে। ছোট বেলা থেকেই এ বোনটার হাসি নিরির ভাল লাগে। পিঠাপিঠি ভাই-বোন, অনেকটা বন্ধুর মতো করে বড় হয়েছে। মাঝখানে মিলার বিয়ে হয়ে গেল। চেহারা ভাল হওয়ার সুবাদে ডাক্তার ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে মিলার। পরিবারটাও ভাল, সমাজ যাকে বলে অভিযাত পরিবার। ‘ হাসিছিস কেন? টাকা দে, চলে যাই।’

‘চলে যাবে?’

‘ হ্যা।’

‘এতদিন পর এসে একদিনও থাকবে না, এতটা পর হয়ে গেলে ভাইয়া?’

‘আমার জরুরী কাজ আছে মিলা।’

মিলা ভেতরে চলে যায়। মিনিট পাঁচেক পর এক হাজার টাকার পাঁচটা কড়কড়ে নোট গুনে দেয়। টাকা হাতে নিয়ে নিরি উঠে দাঁড়ায়। ‘ যাই মিলা। পরে আবার আসবো।’

‘ কি জন্য, টাকা নিতে?’

‘ হ্যা।’

‘ আচ্ছা, তবে আমাকে একটু আগে ভাগে জানিয়ে রেখ, সবসময় তো আর কাছে টাকা থাকেনা।’

‘ আগে ভাগে জাননো হয়তো সম্ভব হবেনা। যা পারিস তাই দিস।’

‘ আচ্ছা।’

নিরি চলে আসে। মিলা হয়তো বেশ কিছুক্ষন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু ভাবে। কিছু কষ্ট তাকে ছুঁয়ে যায়। মেয়েরা সব ছেড়ে স্বামীর সংসারে আসে, অতিআপন সব মানুষ গুলোকে ছেড়ে স্বামী মানুষটাকে নিয়ে স্বপ্ন সাঁজায়। শত স্বপ্নের ভীড়েও হারিয়ে যায় না এক সাথে বেড়ে ওঠা আপন গুলো। মাঝে মাঝে মনের ভেতর কামড় দেয়। খুঁজে ফেরে আপন মুখ গুলো। খুঁজে বেড়াক, যার যা ইচ্ছা তা খুঁজুক। নিরির ভাবতে ভাল লাগেনা। ওর মাথায় আপতত একটাই চিন্তা তাপসী । বৈশাখী অনুষ্ঠানটা জমজমাট হোক। তাপসীকে চেনা মাস ছয়েক আগে। প্রথম পরিচয় পর্বটা মোটেও সুখকর ছিল না। শীতের দুপুরে মিষ্টি রোদ মাড়িয়ে বড় রাস্তা ধরে আপন মনে হেঁটে যাওয়া যুবক। মাথা ভরা চিন্তা,বুদ্ধি। বেশি চিন্তা বুদ্ধিটাও নিরির জন্য আরেক দুশ্চিন্তার কারন। কলেজ লাইফে অতিবুদ্ধির কারনে স্যারদের বহু বেত্রাঘাত হজম করতে হয়েছে। বেত্রাঘাতে নিরির একার কষ্ট এমনও নয়, যিনি বেত্রাঘাত করেন তাকেও পরিশ্রম করতে হয়। বেত উচু করতে হাত উচু, এরপর যথেষ্ট পরিমান শক্তি সঞ্চয় করে তারপর না হয় একটা বাড়ি। নিরিকে মারতে মারতে একবার ইংরাজী স্যার হাফিয়ে ওঠেন। হাস ফাস করে দম নেন। তড়িঘড়ি নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে লাল চোখে নিরিকে দেখে। মানুষটা পরিশ্রান্ত, যথেষ্ট ক্লান্ত। তার চোখ মুখ সে কথা বলে দেয়। নিরি হাসি আটকাতে পারে না। স্যার মানুষটা আবার ধেয়ে আসেন, ‘ এই বেয়াদব হাসছিস কেন?’

‘ স্যার আপনি ক্লান্ত, রেষ্ট নেওয়া দরকার।’

‘ চুপকর একটা কথাও বলবি না।’

‘ জ্বি স্যার। একটা কথাও বলবো না।’ নিরি চুপ করে গেলেও স্যার মানুষটা চুপ করেন না। নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে দম টেনে টেনে বলেন, ‘ এমন বদমাশ আমার জীবনে দেখিনি। স্যারকে কুক দেয়, ইট মারে।’ নিরির চোখে ভেসে ওঠে একটা সুন্দর প্রভাত । শুক্রবার। সকাল ১০ টার মতো বাজে। পড়ার নাম করে বন্ধু লিটনদের বাড়িতে রাত কাটানো বেশ আগের অভ্যাস। দু’জনের পিতার সাথে বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক থাকাতে বিষয়টা সহজ হয় নিরির জন্য। মাঝে মাঝেই এক সাথে থাকে দু’বন্ধু। একসাথে খায়, ঘুমায়। পড়াটা পড়ার যায়গাতেই থাকে। সেদিন রাতে শতাধিক ভাঙ্গা ইটের আধলা নিয়ে ছাদে যায়।। লিটন রিতাকে ভালোবাসে। রিতা মেয়েটা ওকে পাত্তাই দেয় না। একটা উপযুক্ত প্রতিশোধ নেয়া দরকার। প্রতিশোধের চিন্তা থেকেই ইটের আধলা নিয়ে ছাদে যাওয়া। তিন চারটে বাড়ির পরই রিতাদের টিনের ঘর। শেষ রাত পর্যন্ত চলে ভৌতিক আক্রমন। একের পর এক গুড়–ম গুড়–ম করে ইটের আধলা পড়তে থাকে রিতাদের টিনের চালে। সিনেমার নয়করা নায়িকাকে পাবার জন্য কত্তো কিছু করে, আর এ তো সামান্য ইটের আধলা ফেলা। প্রথম শব্দেই হয়তো ঘুমন্ত সব গুলো মানুষের ঘুম ভেঙ্গে গেছে। তারপর এক ঝাক ভয় সবার বুকে দানা বেধে ভীত সন্ত্রস্থ করেছে সবাইকে। রিতারা কষ্ট পাক। ভালোবাসার এ যুগে কেন ভালোবাসবে না মেয়েটা! গরম কাল বলে চারতলার ছাদের উপরই ঘুমানোর সিদ্ধান্ত হয়। সকালের সূর্যটা একটু ঝাঝালো হয়ে যখন ওদের চোখে পড়ে তখন ঘুম ভাঙ্গে। চোখ কচলাতে কচলাতে ছাদের কার্নিশে গিয়ে দাড়াতেই প্রথম দেখা যায় ওদের ইংরেজী স্যার বাজারের ব্যাগ হতে করে যাচ্ছেন। হেলে দুলে হাটছেন। কয়েকটা ইটের আধলা তখনও অবশিষ্ট, এগুলোকে কাজে লাগানো দরকার। ‘ স্যারের সামনে একটা ইটের আধলা ফেললে কেমন হয়?’ প্রশ্ন করে নিরি।

‘ ওহ্ , গুড আইডিয়া। দোস্ত আমরা নতুন নতুন কিছু করছি।’

চারতলার ছাদ থেকে একটা ইটের আধলা স্যারের একটু সামনে নিক্ষেপ করে। আধলাটা আবার স্যারের মাথায় না পড়ে সেটা দেখার জন্য সামান্য অপেক্ষা। মাথায় না পড়ে সামনেই পড়ে। স্যার মানুষটা লাফিয়ে ওঠেন। সাথে সাথে উপরের দিকে তাকান। নিরি মুখ লুকাবার আগে ছোট বেলা পলাপলি খেলার সেই কুক শব্দটা বেশ জোরের সাথে বলে। কুক কুক। হাসতে হাসতে দু’বন্ধু লুটিয়ে পড়ে ছাদের উপর।

ধক করে একটা কিছুর সাথে ঘা লাগে নিরির। একটা মেয়ে ছিটকে পড়ে। দেখতে যতটুকু সময়, মুহুর্তেই মেয়েটা উঠে এসে চটাস করে একটা থাপ্পড় লাগায় নিরির গালে। চমকে ওঠে নিরি। কিরে! একটা মেয়ে মানুষ ওকে থাপ্পড় মারে!! কি অদ্ভূদ ব্যপার? নিরিও প্রতিউত্তর দিতে দেরি করেনা। কষে একটা থাপ্পড়। নিরির থপ্পড়টা হজম করতে পারেনা মেয়েটা। হুড়মুড় করে আবার পড়ে যায় রাস্তায়। দুপুরের ফাঁকা রাস্তা। এদিকে ওদিক তেমন কোন মানুষজন নেই। এবার আর মেয়েটা উঠছে না। ভয় করে নিরির। পালালে পালাতে পারে, আবার বিবেক বাধা দেয়। অনেকদিন পর উপলদ্ধি করে তারও বিবেক নামের একটা জিনিস আছে। কোথায়? কে জানে। মেয়েটাকে টেনে টুনে গাছের ছায়ায় নিয়ে যায় নিরি। কিছুক্ষন বাদেই হুশ ফেরে মেয়েটার। ‘ আপনি?’

‘ হ্যা।’

‘ আপনার এতোবড় সাহস আমার গালে থাপ্পড় দিলেন?’

‘ এটা সাহসের কিছু না।’

‘ চোখ কি বাড়িতে রেখে রাস্তা দিয়ে হাটেন?’

‘ না। চোখ সাথেই ছিল, আপনারটা কোথায় ছিল!’

‘ আমি চিন্তা মগ্ন ছিলাম, খেয়াল করিনি।’

‘ আমি ও তাই। আমার অনেক বুদ্ধি। বুদ্ধির সাথে খেলা করছিলাম।’

‘ ব্যাস, শোধবাদ।’

সেই থেকে তাপসীর সাথে পরিচয়। তারপর সেই তাপসী মেয়েটাই হয়েছে ওর জীবনের সবচেয়ে আপন মানুষ। কাঙ্খিত মানুষ।

মেঘ জমেছে তাতে কি! বৈশাখ ব্যর্থ হবে? এতো দিনের প্লান প্রোগাম। তাপসীকে ফোন করে। ‘হ্যালো তাপসী’

ওপাশ থেকে তাপসীর কন্ঠ ভেসে আসে, ‘ জ্বি’

‘ বৈশাখী শুভেচ্ছা। কি করো?’

‘ এই তো ঘুম ভাঙ্গলো। অনেক রাত পর্যন্ত সিরিয়াল দেখলাম, ঘুমোতে দেরি হলো।’

‘গুড। পান্তা ইলিশ খেতে হবেনা?’

‘ হ্যাঁ, সারা বছর তো চাইনিজ খেয়ে কাটালে চলবে না। আমাদের ঐতিহ্য আছে সেটাও মনে রাখতে হবে।’

‘ কখন আসছো?’

‘ এই তো, তুমি রেডি হয়ে বের হও। আমিও বেরোচ্ছি।’

নিরি বের হবার সময় বাবার সাথে দেখা। ‘ কোথায় যাস?’

‘ একটু জরুরী কাজ আছে’

‘ আকাশে মেঘ, সে খেয়াল আছে?’

‘ জ্বি। আছে।’

সামনে হাঁটতে শুরু করে নিরি। পেছনে বাবা। সামনে পহেলা বৈশাখ। মাসব্যপি বৈশাখী মেলা। হাসান টাওয়ারের সামনে তাপসীর সাথে দেখা। ভ্রু’কুচকে কথা বলে তাপসী, ‘ একটু দেরী হয়ে গেল না?’

‘ হ্যা। চল পান্তা ইলিশ খেতে হবে।’

‘ এখন কি আর পান্তা ইলিশ পাওয়া যাবে! দেখেছো কতো বাঁজে?’

নিরি হাত ঘড়ির দিকে তাকায় বেলা ১১ টা। আকাশে মেঘ বলে ঠিক বোঝা যায়না সময়টা এতোখানি গড়িয়েছে। তাপসীর কথাই সত্য হয়। কোথাও পান্তা ইলিশ পাওয়া যায় না। হাজার হাজার দোকন বসেছিল পান্তা ইলিশের। অধিকাংশ দোকানই সারা বছরের জন্য নয়। মাত্র একদিনের জন্য। বৈশাখী বাঙ্গালীদের পান্তা-ইলিশ খাওয়ানোটাই তাদের উদ্দেশ্য। বুক ভরা কষ্ট নিয়ে দু’জন মানুষ ঘোরাফেরা করে। বিকালের দিকে তাপসী চলে যায়। নিরি তাপসীকে মনে করিয়ে দেয়,‘ রাতে কিন্তু মেলা আছে। মাস ব্যপি বৈশাখী মেলা। প্রথম দিনটা মিস করা যাবে না।’

‘ঐ যে প্লান করা ছিল ভুলে গেছ?’

নিরি ভোলেনি। বুদ্ধিটা বের করেছিল তাপসী। উভয় পরিবারের মানুষগুলো সেকেলে। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। চৈত্র বৈশাখ যাই হোক কোন ভাবেই তাপসীকে বাইরে থাকতে দেবেনা ওর বাবা-মা।

‘ একটা উপায় আছে।’ কথা বলে তাপসী।

‘ কি!’

‘ নিতুদের বাড়িতে থকব বলে রাতে বের হতে পারি। নিতু ভাল ছাত্রী, আমার বান্ধবী। তাকে বাড়ির সবাই খুব বিশ্বাস করে। বলবো রাতে ওদের বাড়িতে অনুষ্ঠান।’

‘রাতে যদি ফোন করে!’

‘ নিতুর কাছে বলে ওর কিছু কথা রেকর্ড করে বাজিয়ে দিলেই তো হয়।’

‘ গুড আইডিয়া।’ হাস্যজ্জ্বল নিরি।

সন্ধা নামতেই জমজমাট হয়ে ওঠে মেলা প্রাঙ্গন। চারিদিকে মানুষ। ধুম ধাড়াক্কা বেজে চলছে হিন্দি গান। কোথাও কোথাও ইংলিশ গানও চলছে। ইংলিশ গানের কিছু বুঝে আসেনা নিরির। শুধু চিৎকার আর মিউজিক শুনে যুবকের উচ্ছাসে মেতে ওঠা। কারন কি! কতো কিছুরই তো কারন জানা নেই আমাদের। সব কিছুর কারন জানতে চাওয়াটাও ভাল নয়।

মেয়ে গুলো সেজেছে বৈশাখী সাঁজে। কারও হলুদ শাড়িতে ফুল , ফুলের ভেতর লেখা এসো হে বৈশাখ। কারও লাল , কারও। নিরি মাথায় একটা ফিতা বেধেছে। ফিতায় বেশ মোটা আচড়ে লেখা- এসো হে বৈশাখ। নিরি বেশ জানে বৈশাখ কে না ডাকলেও সে তার সময় মতো ঠিকই আসবে। ডাকার মানে কি! দেশ প্রেম। আমরা বাঙ্গালী। বাংলা ভাষা ও সাংষ্কৃতি আমাদের আবহমান কালের ঐতিহ্য। তাইতো এ উৎসব, ডাকা।

তাপসী বিকালে বিদায় নিয়ে গেছে সন্ধ্যার পর থেকেই মেয়েটাকে অনুভব করছে বুকের ভেতর। সবাই কি সুন্দর জোড়া-জোড়া! রাত ন’টায়ও যখন তাপসীর খবর নেই তখন মেজাজ খারাপ হয় নিরির। ফোন করে। ‘তাপসী আসবে না?’

‘হ্যা .. …………………..’ নেকি সুরে গলে পড়ে মেয়েটা।

‘ কোন সমস্যা?’

‘ না, সিরিয়াল টা শেষ করে আসছি।’

‘ কিসের সিরিয়াল!’ নিরির মেজাজ গরম হলেও কথায় প্রকাশ করে না।

‘ কেন হিন্দি সিরিয়াল। ওফ্ জানো কি সুইট। আচ্ছা রাখি পরে কথা হবে।’

টেলিভিশনের কিছু আবহ শব্দ আর তাপসীর রাখি পরে কথা হবে একসাথে বেজে ওঠে তারপরই লাইনটা কেটে যায়। খারাপ মেজাজ নিয়ে মেলার ভেতর একা একা বসে থাকে নিরি। জুয়ার আসর বসেছে। আসর থেকে হাক ডাক শোনা যায়। বিভিন্ন কৌশলে মানুষকে ডাকছে। আসুন ল্যাইগা যাবে, ভাগ্যে থাকলে ঠেকায় কে! নিরির ভাবনায় আপাতত তাপসী। না, শুধু এক তাপসী নয়- কোটি কোটি তাপসী। হিন্দি সিরিয়াল আর ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে বিষাক্ত হয়ে গেছে আমাদের গোটা সমাজ। এই যে বৈশাখী মেলা হিন্দি গান হবে কেন! তাপসী নামের কোটি কোটি মানুষ গুলোই বা হিন্দী সিরিয়ালের এত ভক্ত হবে কেন! দেশ ও ভাষার জন্য যুদ্ধ করে যারা প্রান বিসর্যন দিল তাদের প্রতিদান বোধহয় এমনই!

রাত সাড়ে দশটার দিকে তাপসী আসে। ‘ কি তোমার সিরিয়াল শেষ হলো?’

‘ হ্যা। জানো………. ’ তাপসী কে থামিয়ে দেয় নিরি। ‘ থাক আর বলতে হবে না।’

‘ তুমি খুব রাগ করেছো?’

‘ না।’

‘ সরি।’ তাপসীর কথায় যেন সব ভুলে যায় নিরি।

মেলায় ঘুরতে ঘুরতে সময় যায়। ওরা গিয়ে বসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চের সামনে। নাচ-গান হচ্ছে। একমাস ধরে হবে। যুবক-যুবতী হাত ধরে গানের তালে তালে নাচছে। হঠাৎ করেই তাপসীর মোবাইলটা বেঁজে ওঠে। ওর বাড়ি থেকে ফোন করা হয়েছে। নিরি রেকডিং বাঁজিয়ে দেবার জন্য নিজের ফোনটা রেডি করে।

‘ হ্যা, আম্মু।’ কথা বলে তাপসী

‘ তুই কোথায়?’

‘ এই তো মিতুর সাথে গল্প করছি।’

‘ এত মানুষের চিৎকার গান বাজনার শব্দ কেন?’

‘ওদের বাড়ি অনুষ্ঠান বলছিলাম না।’

কই নিতুর কাছে দে। নিতুর গলাটা চেনা তাপসীর আম্মুর। রেকডিং বাজতে শুরু করে। ‘ আন্টি কেমন আছেন?’

‘ ভাল আছি, তোমার আংকেল কথা বলবে।’

‘হ্যালো।’ কথা বলেন তাপসীর আব্বু।

‘ জ্বি আন্টি, তাপসী আমার কাছেই আছে।’

‘ নিতু আমি তোমার আংকেল।’

‘ না না আপনি কোন দুঃশ্চিন্তা করবেন না।’

‘ মানে!’

‘ এই তো একটু পর ঘুমাবো।’

‘ আমি তোমার আংকেল। কি সব বলছো!’

‘ জ্বি আন্টি।’

নিরির হাসি চাপাতে কষ্ট হয়। কি সব হচ্ছে। রেকডিং কি বোঝে আংকেল, আন্টি!

ভদ্রলোকের মেজাজ খারাপ হয়। ‘ তাপসী কোথায়?’

‘ জ্বি আন্টি, দোয়া করবেন।’

‘ নিতু আমি তোমার আংকেল, তাপসী কোথায়?’

‘অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়–ন। আন্টি রাখি তাহলে।’

নিরি খিল খিল করে হেসে ওঠে। তাপসীর মুখটা ভীত-সন্ত্রস্থ। নিরি হাসি থামিয়ে সান্ত¦না দেয় ‘ ভয় পেয় না, আমি আছি না।’

‘তুমি আছো তো কি হবে!’

‘ আমার মাথায় যে বুদ্ধি তা তো জানই। ঠিকই একটা সমাধান বের করে ফেলবো।’ মুখের কথা শেষ হতে না হতেই প্রচন্ড ঝড়ো বাতাস শুরু হয়। মুহুর্তের মধ্যেই হুড়ো হুড়ি দৌড়া-দৌড়ি। বাতাসের প্রথম ঝাপটা আর সাথে সাথে প্যান্ডেলের কয়েকটা বাশ খুটি হুড়মুড় করে এসে পড়ে নিরির গায়ের উপর। তাপসী নিরির কাছেই ছিল। দৌড়ে পালাতে যায়। চাপা পড়ে নিরি কাতর কন্ঠে ডাকে, তাপসী। তাপসী। ডাক শুনে মেয়েটা নিরির কাছে আসে। বেশ কয়েকটা বাশ কাপড় দড়ি নিরির প্রায় সবটা ঢেকে ফেলেছে। একটা আঘাতে শরীরের কোথায় যেন ক্ষত হয়েছে। লাল রক্তে ভিজে উঠছে সাদা কপড়। সাথে সাথেই বাতাসের আরেকটা দমকা। কড় কড় করে ওঠে বাশ খুটি। তাপসী দৌড় দেবার আগে শুধু বলে, নিরি আরও অনেক বাশ খুটি আছে। তাপসী চলে যায়। একা একা পড়ে থাকে নিরি। শরীরের সব শক্তি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে! কোথায় হারালো? বিদ্যূৎ চলে যায়। আবার বাতাসের ঝাপটা। কয়েকটা মানুষের চিৎকার। কিছু মানুষের পায়ে পিষ্ট হয় চাপা পড়া নিরি। তাপসীর কথা আর মনে পড়েনা ।

বিষয়: সাহিত্য

১৬৪৬ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

315371
১৭ এপ্রিল ২০১৫ রাত ১২:৫১
নুর আয়শা আব্দুর রহিম লিখেছেন : কঠিন গল্প! MusicHappy] Day Dreaming Big Hug Cheer Thumbs Up ^Happy^MusicHappy] Day Dreaming Big Hug Cheer Thumbs Up ^Happy^MusicHappy] Day Dreaming Big Hug Cheer Thumbs Up ^Happy^MusicHappy] Day Dreaming Big Hug Cheer Thumbs Up ^Happy
316262
২২ এপ্রিল ২০১৫ দুপুর ০১:০১
মোঃ অয়েজুল হক লিখেছেন : ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File