পথে পথে ( ধারাবাহিক উপন্যাস) পর্ব-১
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ অয়েজুল হক ১০ নভেম্বর, ২০১৪, ০২:৪৪:০৪ দুপুর
সাদা কুকুরটা অনেক সময় ধরে মোকলেসের পিছ পিছ ঘুরছে। করওয়ান বাজার থেকে রমনা পার্ক পর্যন্ত এসেছে। রমনা পার্কে এসে বসেছে তাও প্রায় পনের মিনিট। কুকুরটা যাচ্ছেনা। সামনে বসে ঝিমাচ্ছে। লোকজন বড় বড় চোখে দেখে আবার যার যার কজে চলে যচ্ছে। আশ্চার্য হবার কিছু নেই তারপরও আশ্চার্য হচ্ছে। মোকলেস বসা তার পাশে বসা একটা সাদা কুকুর। দেশী কুত্তা।
‘ এই যে ভাই বাড়ি কোথায় আপনার?’ মোকলেসের কাছে এসে প্রশ্ন করেন এক ভদ্রলোক। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। কালোপ্যান্ট, সবুজ শার্ট আর লাল টাই পরা ভদ্রলোকের দিকে ভদ্রদৃষ্টিতেই তাকায় মোকলেস। তারপর ভদ্রভাবে উত্তর দেয়, ‘ বাড়ি নেই।’
‘ কেন বাড়ি কি হয়েছে!’
কিছু কিছু মানুষ আছে অযথা প্রশ্ন করে। অযথা কথা বলে। বকবক করে। কোন দরকার নেই, জেনে কোন লাভ নেই তারপরও জানতে চাইবে। হাজার হাজার প্রশ্ন করে কান ঝালাপালা করবে। লোকটাকে সে রকম ধাচের মনে হয়। বাচাল।
‘ উই পোকায় খেয়েছে, বন্যায় ভেসে গেছে। ’
মোকলেসের কথা শুনে লোকটা কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়; চোখে মুখে তার অসন্তুষ্ট হওয়া ভাবটা ফুটে ওঠে।
‘ বাড়ি নেই তা থাকেন কোথায়?’
‘ রাস্তায় থাকি।’ জবাব দেয় মোকলেস।
লোকটা বিকট শব্দে হাসে। হেঃ হেঃ। নিচের পাটির ঠিক মাঝখানের একটা দাত না থাকাতে হাসিটা কুৎসিত লাগে।
‘ রাস্তায় থাকেন, পথের মানুষ?’
‘ হ্যা।’
‘ তাইতো ভাবি পার্কে মানুষ প্রেমিকা নিয়ে বসে থাকে কিন্তু আপনি বসে আছেন কুকুর নিয়ে। কেন! আমার কেন’র জবাব পেতে দাড়ালাম অবশেষে উত্তর পেলাম।’
ভেবেছিল লোকটা এবার চলে যাবে। কিন্তু যায়না। মনে হয় দীর্ঘক্ষন বকবক করার জন্য তৈরী হয়। দাড়ানো থেকে বসে।
‘ কুকুরটার সাথে আপনার দারুন মিল আছে দেখছি।’
মোকলেসের কথা শুনে লোকটা ভ্রুকুচকায়। বড় বড় চোখে মোকলেসের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, ‘ তারমানে?’
‘ কুকুরটাকে আমি চিনিনা সেও আমার সাথে বসেছে আপনাকে চিনিনা আপনিও ওর মতো আমার পাশে বসেছেন।’
‘ আপনার পাশে বসতে যাব কেন?’
‘ কেন বসলেন আর কুকুরটাইবা কেন বসলো জানিনা।’
‘ আমার প্রেমিকা আসবে তার জন্য অপেক্ষা করছি।’
‘ কুকুরটাও তার প্রেমিকের জন্য অপেক্ষা করছে।’
লোকটা ভেতর ভেতর প্রচন্ড রেগে ওঠে। রাগলে মানুষ থাপ্পড় মারার জন্য এগিয়ে আসে। কষে থাপ্পড় মারে। থাপ্পড় মারার শক্তি বা সাহস না থাকলে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। এ গাধা লোকটার মাঝে কোনটারই ভাবলক্ষন দেখা যায়না। থাপ্পড় মারতে এগিয়ে আসেনা আবার চলেও যায়না। রাগে গজগজ করে। এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল বেশ কয়েক বছর আগে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ভারত- পাকিস্তাানের ম্যাচ। খেলা দেখার জন্য রাস্তায় দর্শকদের লম্বা সারি। স্টেডিয়ামে ঢোকা গেট থেকে লম্বা, সোজা-বাকা হয়ে চলে গেছে অনেক দূর। মোকলেস লাইনের শুরুতে দাড়ানো একজন ভদ্রলোককে প্রশ্ন করে, ‘ ভাইজান লাইনের শেষ কোথায়?’
লোকটা মোকলেসের দিকে তাকায়। কিছু না বলেই প্রথমে কিছু হাসি উপহার দেন তারপর সে হাসি মুখে রেখেই বলেন, ‘ যেখানে শেষ মানুষটা দাড়িয়ে আছে সেখানে লাইনের শেষ।’
‘ ও আচ্ছা।’ মোকলেস বুঝতে পারে লোকটা তাকে নিয়ে রসিকতা করছে। তার সাথেও একটু রসিকতা করা দরকার। ‘ সেই শেষ লোকটা কোথায়, কতোদূর?’
‘ আমি কিভাবে বলবো আমি এসে লাইনে দাড়িয়েছি সকাল সাতটায় এখন সাড়ে আটটা বাজে।’ লোকটা থামে। ‘ আপনি এক কাজ করুন রিক্সা ভাড়া করে লাইনের শেষ খুজতে থাকুন।’
‘ রিক্সায় যাব কেন! আমি হেটে যাব।’
‘ সেটাতো আপনাকে দেখেই বুঝেছি। ফকিরের কপালে কি পোলাও জোটে?’
কিছু না বলে মোকলেস সামনে এগিয়ে যায়। লোকটার একদম কছে গিয়ে তার ডান গালে কষে একটা থাপ্পড় মারে। থাপ্পড় মেরে এক মুহুর্ত দাড়ায় না। পেছন ফিরেও তাকায় না। মোকলেসের বেশ জানা আছে লোকটা সকাল সাতটার লাইন ভেঙ্গে মারামারি করতে বেরিয়ে আসবে না। একটা কেন দশটা থাপ্পড় দিলেও সে লাইন থেকে বের হবেনা। কিছুদূর এসে আবার ফিরে গিয়ে আর একটা থাপ্পড় মারতে ইচ্ছা করছিল। তারপরও আর যাওয়া হয় না। সেদিনকার ঘটনায় থাপ্পড় মারার পর লোকটার যে চেহারা হয়েছিল বর্তমানে পার্কের লোকটার চেহারা সেই একই রকম। পার্থক্য এটুকু লোকটা একটা জালে জড়িয়েছিল আর এ ভদ্রলোক মুক্ত। ইচ্ছা করলেই মোকলেসের দিকে ধেয়ে আসতে পারে। থাপ্পড় মারতে পারে।
‘ ভদ্রলোকের পোষাক পরলেই ভদ্রলোক হওয়া যায়না, বুঝলেন?’
‘ জ্বি, বুঝেছি। টাই গলায় না ঝুলিয়ে ফ্যানের সাথে ঝোলান। তারপর ঝুলে পড়ুন। ওসব টাইফাই আপনি পরেছেন কেন?’
‘ পরেছি আপনাকে ঝোলাব বলে।’
‘ আমার খুব ঝুলতে ইচ্ছ করছে। আপনার টাই ধরে ঝুলবো, ছোট বাচ্চাদের মতো দোল খাব।’
লোকটা এবার আর এক মুহুর্ত দেরী করেনা। ভন ভন করে হাটে। কিছুদূর গিয়ে একটা গছের নিচে দাড়ায়। হয়তো এই পার্কেই আর থাকতো না। কিন্তু যেতে পারছে না। তার প্রেমিকা আসবে। দূর থেকে আড়চোখে তাকায়। মোকলেসকে দেখে। মোকলেস তাকালেই দৃষ্টিটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। হঠাৎ মোকলেসের পেছন থেকে কেউ চোখ বন্ধ করে ধরে।
‘ বলোতো আমি কে?’ নারী কণ্ঠ।
অবাক হয় মোকলেস। ‘ জানিনা।’
‘ কি!’ চিৎকার করে ওঠে মেয়েটা। ‘ আমার কণ্ঠ শুনেও আমাকে চিনতে পারলে না! নাম না বলা পর্যন্ত আমি তোমার চোখ টিপে ধরে থাকবো।’
কি অবাক কান্ড! আজ রমনা পার্কে আসার আগে থেকেই সব অবাক কান্ড ঘটছে। মেয়েটা আঙ্গুলের চাপ বাড়ায়। আর একটু চাপ দিলেই যে কোন সময় চোখটা ফটাস করে ফেটে যেতে পারে। মোকলেস বিনয়ের সাথে বলে,‘ এ কি করছেন আপনি! আমার চোখ ফেটে যাবে তো।’
মেয়েটা আরও ক্ষেপে ওঠে। ‘ কি……! আমি এখন আপনি হয়ে গেছি? ছাড়বো না। আমি তোমার চোখ গলিয়ে দেব।’
এ মারাত্মক বিপদ থেকে বাচার একটাই মাত্র উপায়, একের পর এক নাম বলে যাওয়া। সঠিক নামটা যদি হয়ে যায় তাহলেই মুক্তি। ‘ খাদিজা, রোকেয়া, ফাহমিদা, তাকলিমা, হালিমা, রওশোনারা, আফসানা, তাহেরা, হাবিবা, শিরিনা।’ মেয়েটা হাত সরায় না। কি বিপদ! মেয়েটার নাম আধুনিক ষ্টাইলের হলে তো আরও বেশি বিপদ। নামের কোন ক্থল কিনারা নেই। ‘ ঝিংকি, পিংকি, টিংকি, প্রেমা,প্রিয়া, রিয়া,কেয়া, পুষ্পিতা, সুষ্পিতা, মুষ্পিতা, অর্পিতা, সর্পিতা, কবিতা, উপন্যাস, গল্প, আখি, পাখি, সখি নাকি?’
‘ এতো ঢং করে বলা লাগে?’ হাত সরিয়ে মেয়েটা সামনে এসে দাড়ায়। মোকলেস সবকিছু ঝাপসা ঝাপসা দেখে। দূরে বসা ভদ্রলোক মুচকি মুচকি হাসছে। সখি মেয়েটার চেহারা আস্তে আস্তে ক্লিয়ার হয়।
‘ তোমার নাম তাহলে সখি?’
‘ সরি মাফ করবেন।’
‘ মাফ করতে পারবো না, আমি এখন তোমার চোখ টিপে ধরবো।’
‘ আমি আসলে ভুল করে ফেলেছি। ও প্রতিদিন এখানেই বসে।’
‘ হায় সখি।’ দূরে বসা প্রেমিক হাক দেয়।
প্রেমিক কে দেখে সখি বড় বড় চোখে তার দিকে তাকায়। ‘ তুমি ওখানে, এতো সময় মজা দেখছিলে তাইনা!’
হেঃ হেঃ হাসে লোকটা। প্রেমিকাকে পেয়ে কিছুটা সাহস বেড়েছে।
সখি মোকলেসের দিকে তাকায়। ‘ ওর কথায় কিছু মনে করবেন না আর আমার নির্দয় আচরনের জন্য ক্ষমা চাচ্ছি।
‘ না, না ক্ষমা চাওয়ার কিছু নেই। পার্কে বসে প্রেম করুন। ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করুন।’
মেয়েটা লজ্জা পায়। চোখে মুখে কিছুটা লজ্জা নিয়ে চলে যায়। মোকলেস একা একা বসে থাকে। কুকুরটা প্রেমিক-প্রেমিকা জুটির পিছ পিছ গেছে। কেন গেছে কে জানে। তথাকথিত প্রেম ভালোবাসায় ছেয়ে গেছে দেশ। মনুষের হৃদয়ে প্রেম-ভালোবাসা উতলে পড়ছে।
বিষয়: সাহিত্য
১২৩৪ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
গল্প ভাল লেগেছে ধন্যবাদ ভাইয়া ।
অনেক ভালো লিখেন আপনি।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন